#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৩৫তম_পর্ব
তখন ই সেখানে দিগন্ত উপস্থিত হলো। অনলকে দেখতেই সে বললো,
“ধারা, হেড স্যারের রুমে”
দিগন্তের কথাটা শুনতেই অনলের বুঝতে বাকি রইলো না কাহিনী। সে যা সন্দেহ করছিলো সেটাই হয়েছে। ধারা তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক নিয়ে ঠিক লড়াই করতে চলে গেছে। মেয়েটা এতো বোকা কেনো! কেনো বুঝতে চায় না সবকিছুর একটা পদ্ধতি রয়েছে। র’ণ’চ’ন্ডী হওয়া সর্বদা মানায় না। এতো সময় তো সন্দেহের তোর অনলের উপর ছিলো এখন ধারার উপরও সেটা বর্তাবে। অনল আর দাঁড়ালো না। সে সোজা চলে গেলো ডিপার্টমেন্ট হেড আনসারী সাহেবের কেবিনের কাছে। অনলের ছুটে যাওয়া মাহির মনে সন্দেহ তৈরি করলো সে দিগন্তকে জিজ্ঞেস করলো,
“কাহিনী কি?”
“সকালবেলা ধারা আমাকে ফোন করেছিলো। আমি তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। ফোন ধরতেই ধারা ঠান্ডা গলায় ভার্সিটিতে আসার কথার বললো। আমিও দেরি না করে চলে এলাম। ভার্সিটিতে আসার পর ও আমাকে বললো সে আনসারী স্যারের রুমে যাবে। সে তার সাথে অনল স্যারের ব্যাপারে কথা বলবে। এবং আমাকেও সাক্ষী দিতে হবে সেদিন করিডোরে যা হয়ে তা আমি রাগের বশে বলেছি। তার কোনো সত্যতা নেই। মাধবীর (গত পর্বে আমি মাধবীর নামের বদলে মালতী লিখেছিলাম) হয়তো বুঝতে ভুল হয়েছে। অনল স্যার কোনো পার্শিয়ালিটি করে নি”
“তুই কি স্যারকে স্বীকারোক্তি দিয়েছিস?”
মাহি অবাক কন্ঠে প্রশ্নটি করলো৷ দিগন্ত একটু থেমে বললো,
“হ্যা, আর উপায় কি! ভুল তো আমার হয়েছে। আমার জন্য একটা নির্দোষ মানুষ তো ভুগতে পারে না। কিন্তু স্যার বিশ্বাস কতোটুকু করেছে জানি না। আমাকে সে ক্লাসে যেতে বললো৷ ধারা এখনো স্যারের সাথেই কথা বলছে”
দিগন্তের কথাটি শুনে মাহি তার কাঁধে চা’প’ড় মেরে বললো,
“আমার তোর উপর গর্ব হচ্ছে। প্রাউড অফ ইউ দোস্ত। এটাই না আমাদের দিগন্ত”
মাহির কথাটা শুনতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো দিগন্ত। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। অগোছালো হৃদয়টা হুট করে প্রচন্ড জোরে স্পন্দিত হচ্ছে। এক অজানা ভালোলাগা অনুভূত হচ্ছে। তাড়াতাড়ি মাহির হাত সরিয়ে বললো,
“লজ্জা লাগে না, ছেলেদের গায়ে হাত দিস। অ’স’ভ্য মহিলা”
বলেই হনহন করে হাটা দিলো সে। মাহি বেকুবের মতো চেয়ে রইলো তার দিকে। ভুল টা কি হলো! দিগন্ত একটা চা’প’ড়ে এতো ক্ষেপে গেলো কেনো!
********
হেড অফ ডিপার্টমেন্ট “ম্যাথেমেটিক্স”, আব্দুল আনসারীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে ধারা। তার হাত পা এখনো ঈষৎ কাঁপছে। আনসারী সাহেব চোখের চশমাটা মুছে পড়লেন। তারপর অফিস ক্লার্ক হাফিজকে ডাকলেন। রাশভারি কন্ঠে বললেন,
“এক কাপ চা দাও”
হাফিজ ও সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো। চাও চলে এলো মিনিট দশেকের মাঝে। আনসারী সাহেব আয়েশ করে চুমুক দিলেন৷ তারপর তীর্যক নজরে তাকালো ধারার দিকে। ধারা এখনো ভীত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শুকনো ঢোক গিললো সে। এতো সময় সে এবং দিগন্ত ই স্যারের সাথে কথা বলেছে। সে কি বুঝলেন সেটা তিনি প্রকাশ করেন নি। উপরন্তু শুধু তীর্যক নজরেই দেখে গেছে ধারার দিকে। তারপর সে শান্ত কন্ঠে বললেন,
“দিগন্ত তুমি ক্লাসে যাও। আর ধারা তুমি এখানে থাকো”
তারপর থেকেই তিনি ধারাকে দাঁড় করিয়েই রেখেছেন। যত সময় যাচ্ছে ধারার ভয় গাঢ় হচ্ছে। হিতে বিপরীত হবার ভয়। ভালো করতে যেয়ে যদি অনল আরোও বাজে ভাবে এই চোরাবালিতে আটকে যায় নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না ধারা। এর মাঝেই আনসারী সাহেবের গম্ভীর কন্ঠ কানে এলো,
“দেখো ধারা, তুমি যা বলছো আমি বুঝেছি। তোমার ধারণা তোমার ক্লাসমেটের একটা ভুল ধারণা হয়েছে। বুঝলাম। কিন্তু তোমার বা ওই ছেলেটা দিগন্ত, তার স্বীকারোক্তিতে খুব একটা যায় আসবে না। তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিক। ডিসিশন আমরা তখন নিবো। তবে তোমাদের দুজনের স্বীকারোক্তিতে কিছুই প্রমাণ হয় না। চোর যদি এসে বলে সে চুরি করে নি তাহলে সত্য বদলায় না। আর আমি এখানে ছাত্রছাত্রীদের ইনভলভ করতে চাচ্ছি না, আমাদের বিষয় আমরা দেখে নিবো”
অবশেষে চা খাওয়া শেষ করে আনসারী সাহেব মুখ খুললেন। তার কথা শোনার পর পর ই ধারা প্রতিবাদ করে উঠলো,
“স্যার, মাধবীর কাছেও কিন্তু প্রমাণ ছিলো না। সেও দিগন্তের কথাটা শুনেই আপনাকে কমপ্লেইন করেছে”
“সেজন্য ই তো আমরা তদন্ত করছি। প্রমাণ হলে অনলের শাস্তি হবে না। এখানে আমার কিছুই করার নেই। সব কিছুর একটা সিস্টেম আছে৷ তুমি বরং যাও”
বলেই আনসারী সাহেব তার যাবতীয় কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার আজকে ফোর্থ ইয়ারের ক্লাস নিতে হবে। হাতে অনেক কাজ। মিটিং ও আছে দুপুরের পর। ধারার মুখে আষাঢ়ের মেঘ মেদুর জমলো। নিয়ম কাননের বাহানা দিয়ে স্যার তার কথা উপেক্ষা করে যাচ্ছে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো সে। কিন্তু হার মানবে না সে। শান্ত কন্ঠে বললো,
“স্যার, আপনাদের সন্দেহ তো আমার রেজাল্ট নিয়ে। আমার মতো খারাপ ছাত্রী কি করে ভালো করে। তাহলে আমি যদি দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেই তবেও কি আপনাদের একই সন্দেহ থাকবে?”
এবার চোখ তুলে চাইলেন আনসারী সাহেব। তার চোখ চকচক করছে। তার মাথায় দ্বিতীয় বার পরীক্ষা নেবার চিন্তা ছিলো। তদন্ত যাই হোক সে আবারো পরীক্ষা নিতেন। এই রেজাল্ট বাতিল করে দিতেন। তবে ধারা নিজেই জালে পা দিয়েছে। সন্দেহ ধারাকে নিয়ে। তাহলে পুরো ক্লাসের পরীক্ষা নিয়ে কি হবে! ধারার পরীক্ষা নিলেই তো সব স্পষ্ট হয়ে যাবে। আনসারী সাহেব হাসলেন, দুর্বোধ্য হাসি। তারপর বললেন,
“বুঝে বলছো?”
“জ্বী স্যার”
“যদি তুমি একই গ্রেড না পাও তবে কিন্তু তোমাকে রাস্টিকেট করার অধিকার প্রশাসন রাখে। সাথে অনলকে সাসপেন্ড। ভেবে দেখো”
ধারা শুকনো ঢোক গিললো। তার বুক কাঁপছে। কিন্তু অনলের জন্য এতোটুকু তার করতেই হবে। গাল ফুলিয়ে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। তারপর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো,
“জ্বী স্যার, আমি রাজি”
আনসারী সাহেবের হাসি প্রশস্ত হলো। তিনি বললেন,
“ক্লাসে যাও। তদন্ত শেষ হলেই তোমাদের জানানো হবে। আমার একার হাতে তো কিছু নেই”
আনসারী সাহেবের মুখ দেখে ধারার মনে হয়েছিলো তিনি ধারার প্রস্তাবে রাজী। কিন্তু তার শেষ উক্তি ধারাকে আবার হতাশ করলো। ক্ষণিকের জন্য উৎফুল্ল মুখশ্রী পুনরায় হতাশায় ডুবলো। ধারা নতমস্তক বেরিয়ে এলো আনসারী স্যারের কেবিন থেকে। কেবিন থেকে বের হতেই ধারার দেখা মিললো অনলের সাথে। সে কিছু বলার পূর্বেই অনল খপ করে তার হাত চেপে ধরলো। টেনে নিলে চললো ধারাকে। তার মুখশ্রী কঠিন হয়ে আছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। ধারা বারবার বলছে,
“আমাকে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছো?”
কিন্তু তার কথাটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গেলো অনল। তার সারা শরীর ঈষৎ কাঁপছে। চোয়াল জোড়া শক্ত হয়ে আছে।
মিনিট দশেক বাদে ডিপার্মেন্টাল বিল্ডিং এর একটা ফাঁকা স্থানে এসে দাঁড়ালো অনল। হাতখানা ছেড়ে দিলো সে ধারার। ফর্সা হাত রক্তিম হয়ে গেছে রুক্ষ্ম হাতের পেষ্টনে। অসম্ভব রাগ হলো ধারার। সে তীব্র স্বরে বললো,
“কি হয়েছে তোমার? উ’ম্মা’দের মতো টেনে আনলে কেনো?”
“স্যারের রুমে কেনো গিয়েছিলি?”
প্রচন্ড শীতল কন্ঠে কথাটা শুধালো অনল। তার চোখ জোড়া রক্তিম হয়ে আছে তবে দৃষ্টি বরফ শীতল। ধারা তার চোখের দিকে তাকাতেই কেঁপে উঠলো। আমতা আমতা করে বললো,
“কথা বলতে গিয়েছিলাম”
“সব জায়গায় তোর নাকটা ডুকাতেই হবে? পাকনামি না করলে হয় না? আচ্ছা! একবার আমাকে জিজ্ঞেস করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো? একা একা কেনো গেলি?”
অনলের প্রশ্নের বর্ষণে খিল হারিয়ে ফেললো ধারার। অগোছালো ভাবে বললো,
“আমার দ্বারা চুপ করে থাকাটা সম্ভব হলো না। ঘটনাটা তো আমাকে কেন্দ্রিক। তাই আমি স্যারকে বোঝাতে গিয়েছিলাম”
“বুঝেছে সে?”
ধারা মাথা নামিয়ে নিলো। তারপর নাড়িয়ে নেতিবাচক উত্তর দিলো। অসহায় কন্ঠে বলল,
“আমি তাকে দ্বিতীয়বার পরীক্ষার কথাটাও বলেছি। তবুও শুনে নি”
ধারার কথাটা শুনেই ক্রোধে ফেটে পড়লো অনল। তীব্র স্বরে বললো,
“তোর মাথা ঠিক আছে? দ্বিতীয় বার পরীক্ষা দিবি। তোর কি নিজেকে গণিতের বিদ্যাসাগর মনে হয়।সেই তো টেনেটুনে পাশ করিস। এ পেয়েছিস বলে মনে করছিস তুই বিদ্বান হয়ে গেছিস। এক লাইন লিখেই তো ইকুয়েশন ভুলে যাস। তোর মনে হয় তারা প্রশ্ন সোজা করবে। যদি সেম গ্রেড না উঠে তোকে রাস্টিকেট করবে! ওরা তো বসেই আছে প্রমাণ করার জন্য। কে বলেছিলো পাকনামি করতে তোকে?”
অনলের ক্রোধানলের মুখোমুখি এই প্রথম ধারা হয়েছে। ফ্যালফ্যালিয়ে সে তাকিয়ে রইলো অনলের দিকে। উত্তর দিতে ইচ্ছে হলো, “আমি তো তোমার জন্য করেছি” কিন্তু উত্তরটা মুখ থেকে বের হলো না। শুধু চোখ থেকে বেয়ে পড়লো এক বিন্দু অশ্রু। না চাইতেও তার চোখে ভিড় হলো অশ্রুর। অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“আমি পারবো, দেখো”
অনল সাথে সাথে দেয়ালে সজোরে আঘাত করলো। অনলের এমন আচারণে কেঁপে উঠলো ধারা। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো অনল। তার শরীর কাঁপছে। আঘাত করায় হাতটা রক্তিম হয়ে উঠেছে। বা হাত দিয়ে কপালের চামড়া টেনে ধরলো অনল। এরপর ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
“ধারা, সবখানে একটা নিয়ম থাকে। মনমতো করলেই হয় না। তোর কি মনে হয় আনসারী স্যার তোর কথা বিশ্বাস করেছে? না তিনি সুযোগ খুঁজছিলেন। আর তুই সেই সুযোগ দিয়ে দিলি। আমাকে সাসপেন্ড করলেও তারা চাকরি থেকে তো বাদ দিতেন না। আমি তো বলেছিলাম আমি সামলে নিবো। একটু বিশ্বাস রাখতে পারলি না?”
“কিন্তু, আমি তো”
“আমি তোর সাহায্য চেয়েছি কি? চাই নি। তাহলে?”
এবার মুখ ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো অনল। তারপর বললো,
“অনেক সাহায্য করেছি। এবার ক্লাসে যা। আমার টা আমাকে বুঝতে দে।”
বলেই হনহন করে হেটে চলে গেলো অনল। ধারা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। অনলের যাবার পানে টলমলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ধারা মাথা তুলে থাকালো নীলাম্বরের দিকে। আকাশেও যেনো বিষন্নতা ছেয়ে আছে। বিষাদমাখা স্বরে বললো,
“আমি সত্যি পারতাম। আমার জন্য নয়, তোমার জন্য আমি ঠিক পারতাম”
********
ক্লাস শেষ হয়েছে। বিকেলে ল্যাব থাকায় ক্যাফেটেরিয়াতে খেতে এসেছে বন্ধুমহল। ধারার মেঘ মেদুর মুখখানা দেখে বন্ধুরা বার বার জিজ্ঞেস করলো কিন্তু ধারা উত্তর দিলো না। রফিক মামা বন্ধুমহলকে দেখেই বললেন,
“কি গো সিনিয়র ভাই বোনেরা, কি হাল? দেখাই তো মিলে না। সিনিয়র হইয়ে কি হাওয়া হয়ে গেলে। এই রফিক মামারে ভুলে গেলা?”
“ভুলি নি বলেই তো আসা। দাও তো পাঁচটা গরম ভাত। আর তরকারি কি আছে?”
“আছে অনেক কিছুই আইসে দেখো”
রফিক মামার কথায় মাহি উঠলো। ধারাকে ঠেললো, কিন্তু সে উঠতে চাইলো না। সকালের ঘটনাটা এখনো চোখে ভাসছে। তখন হুট করে মাহি বলে উঠলো,
“এই ধারা, অনল ভাই এর সাথে ক্যাফের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ওই মেয়েটা কে?”
মাহির কথায় ধারার নজর গেলো ক্যাফেটেরিয়ার বাহিরে। তাদের ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেশ দূরে একটা গাছের পাশে অনলের সাথে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। মেয়েটি আর কেউ নয় অনন্যা। ক্যাফেটেরিয়া থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাদের। না চাইতেই অনলের সাথে অনন্যার দাঁড়িয়ে থাকাটা দৃষ্টিকটু ঠেকলো। অকল্পনীয় কিছু চিন্তা মস্তিষ্ক ছেয়ে গেলো ধারার। বুকে অজানা ভয় হানা দিলো। ধারা উঠে দাঁড়ালো। গটগট করে হেটে সেদিকে রওনা দিলো। মাহিও তার পিছু নিলো। অনল এবং অনন্যা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার থেকে কিছুটা দূরে একটা ঝোঁপের পিছনে আশ্রয় নিলো ধারা। সে লুকিয়ে তাদের কথা শুনবে। যদিও এই স্বভাব টি অতি কুৎসিত। কিন্তু তার মনে জন্মানো সন্দেহ এর চেয়েও কুৎসিত। সে যদি এখন সামনে যেয়ে দাঁড়ায় তারা কথা বলবে না। কিন্তু সেটা হওয়া যাবে না। আর সকালের ঘটনার পর অনলের সামনে যাওয়া মানে ক্ষুধার্ত বা’ঘে’র সামনে পড়া। তাই সে লুকিয়েই কথাটা শুনবে। মাহি এসে দেখলো ধারা ঝোঁপের পেছনে লুকিয়ে আছে। মাহিও হাতু গেড়ে তার পাশে বসে ফিসফিসিয়ে বললো,
“এখানে কি করিস?”
“নিজের বরের উপর নজরদারি। টু শব্দ করবি না। শুনতে দে”
মাহি আর কথা বাড়ালো না। তখনই অনলের শীতল কন্ঠে শোনা গেলো,
“আমি তো একবার মানা করেছি অনন্যা তাহলে কেনো বারবার আমাকে অফার দিচ্ছো?”
“আমি তোর ভালো চাই অনল। রাইট নাউ তোর যা অবস্থা, তোর কি মনে হয় এ ছাড়া কোনো অপশন আছে? ওরা তোকে সাসপেন্ড করবে। ফলে তোর ক্যারিয়ার নষ্ট হবে। অস্ট্রেলিয়ায় অনেক সুযোগ তোর। তোর জিআরই স্কোর ভালো, আর এই প্রজেক্টে কাজ করলে তোর ভিসার কোনো প্রবলেম হবে না। তুই হাইয়ার স্টাডি করতে পারবি। আমার সুপারভাইজার তোকে মাথায় করে রাখবে৷ আর সত্যি বলতে, এই প্রজেক্টটা তো তোর স্বপ্ন ছিলো”
অনন্যার কথা শুনেই তীর্যক দৃষ্টিতে তাকায় অনল। সাথে সাথেই ভেসে উঠলো ভার্সিটি জীবনের কথা। ভেসে উঠলো ইন্ট্রা ভার্সিটি প্রোগ্রামটির কথা। সেই কম্পিটিশনে একটি প্রজেক্ট নিয়ে অনল, অনন্যা এবং তাদের বাকি দুজন টিমমেট কাজ করছিলো। কম্পিটিশনে তাদের চারজনের কষ্টের ফল ছিলো এই প্রজেক্ট। সব চেয়ে বেশি আশা ছিলো অনলের প্রজেক্টটি নিয়ে। কিন্তু সব কিছু মূহুর্তেই তছনছ হয়ে গেলো। অনন্যা সবার অগোচরে সেই প্রজেক্টটি সাবমিট করলো অস্ট্রেলিয়ার একটি বড় ইউনিভার্সিটির টিচারের কাছে। ফলে খুব সহজেই তার স্কোলারশিপ হয়ে যায়। অনল যখন ব্যাপারটা জানতে পারে তখন সে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলো অনন্যাকে। অনন্যা হেসে বলেছিলো,
“আমি তোকে ইউজ করি নি অনল, তোরা আমাকে সাহায্য করেছিস”
ঘটনাটি স্মরণ হতেই অসীম বিরক্তি এবং ঘৃণা মুখে ফুটে উঠে অনলের। সে কাঠ কাঠ গলায় বলে,
“আমার ফিউচার নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না অনন্যা। তুমি বরং তোমার ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবো। আমারটা আমি বুঝে নিবো। আসলে কি বলতো! তোমার মতো স্বার্থপর মানুষ অন্য কারোর কথা ভাবতেই পারে না। এর মাঝেও কোনো স্বার্থ আছে তোমার। আমার তো মনে হয় তুমি নিজের জন্যই আমাকে অফার দিচ্ছো। হয়তো সেই প্রজেক্টে কোথাও আটকেছো। ফলে আমাকে তোমার প্রয়োজন হচ্ছে। যাক গে! আমি আবারো বলবো, আমাকে নিয়ে এতো ভাবতে হবে না। আমি এখানে আমার জীবনে সুখী আছি”
অনলের কথাটা শেষ হতেই হিনহিনে কন্ঠে অনন্যা বলে উঠলো,
“আমাকে সবসময় স্বার্থপর মনে হয় তোর! সবসময় আমাকেই দোষী করে এসেছিস। আচ্ছা তোর বউ স্বার্থপর নয়। তোকে বিপদে ঝুলিয়ে ঠিক ই তো গা ঢাকা দিয়ে আছে! কি করেছে তোর অপবাদকে মিটাতে?”…………..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৩৬তম_পর্ব
অনলের কথাটা শেষ হতেই হিনহিনে কন্ঠে অনন্যা বলে উঠলো,
“আমাকে সবসময় স্বার্থপর মনে হয় তোর! সবসময় আমাকেই দোষী করে এসেছিস। আচ্ছা তোর বউ স্বার্থপর নয়। তোকে বিপদে ঝুলিয়ে ঠিক ই তো গা ঢাকা দিয়ে আছে! কি করেছে তোর অপবাদ সরাতে?”
কথাটা কর্ণপাত হতেই চোখ মুখ খিঁচে উঠলো অনলের। তীর্যক, বরফ শীতল দৃষ্টিতে তাকালো সে অনন্যার দিকে। শান্ত কন্ঠে বললো,
“আমার বউ কি করেছে না করেছে সেই কৈফিয়ত আমি তোমাকে দিবো না অনন্যা। নিজের দায়রাতে থাকো। সীমা লঙ্ঘন করো না। আমি শান্ত আছি, শান্ত থাকতে দাও”
অনলের এমন আচারণে চমকালো অনন্যা। অনলের শীতল তীর্যক দৃষ্টি এবং মুখের কাঠিন্য নজরে আসতেই ঈষৎ ঘাবড়ে গেলো সে। তবুও কাঁপা স্বরে বললো,
“আমি সীমাতেই আছি অনল, তুই ই নিজের চোখে ভালোবাসার কাপড় বেঁধে অন্ধ হয়ে আছিস! আমি শুধু তোকে বাস্তবতা দেখাচ্ছি”
“আমি কোনো ছোট বাচ্চা নই যে বাস্তব আর কল্পনার পার্থক্য বুঝে না। কিন্তু আমার মনে হয় তুমি তোমার নিজস্ব জাগতিক দুনিয়া থেকে বের হতে পারছো না। তাই তো সবাইকে নিজের মতো মনে করছো। আমার ধারাটা বয়সে আমার থেকে অনেক ছোটো। ফলে আমি বা আমার পরিবার কখনোই ওর উপর আঁচ আসতে দেই নি। সাধ্য অনুযায়ী রাজকুমারীর মতো তাকে রাখা হয়েছে, ফলস্বরুপ এখনো পৃথিবীর রুক্ষ্ণ, নিষ্ঠুরতার সম্পর্ক তার ধারণা স্বল্প। এই জটিল ব্যাপারে জড়ালে তার ভবিষ্যতের উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। তবুও মেয়েটি শুধু আমার চাকরি রক্ষার্থে দ্বিতীয়বার পরীক্ষার আর্জি দিতেও পিছ পা হয় নি। সে জানে যদি তার রেজাল্ট আগের থেকে একটু খারাপ হয় প্রশাসন তাকে বহিষ্কার করতে পারে। তবুও মেয়েটি ভয় করে নি। আমার জন্য এই বিপদে ঝাপিয়ে পড়েছে। সুতরাং তোমার চোখ দিয়ে আমার ধারার প্রয়োজনীয়তাবোধ করছি না আমি। নিজের সীমার মাঝে থাকো অনন্যা। আমার বন্ধু হবার অধিকার তুমি হারিয়েছো। সুতরাং আমাকে উত্যোক্ত করা বন্ধ করো”
অনলের শান্ত ভঙ্গিতে কথাগুলো অপমানের ধারালো ছুরির মতো বিঁধলো অনন্যার হৃদয়ের। চরম অপমান এবং ক্রোধে বিধ্বস্ত হয়ে পড়লো সে। শুভ্র মুখখানা হয়ে উঠলো নিমেষেই রক্তিম। নিজের আত্মসম্মানের খাতিরে আর দাঁড়ালো না সে। হনহন করে ছুটলো সে। অনল তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো। চরম বিরক্তি হচ্ছে তার। মেয়ে না হলে হয়তো মে’রে’ই বসতো। ধারার নামে অহেতুক কথা কখনোই সহ্য হয় না তার। দুপকেটে হাত দিয়ে ঝোপটির কাছে আসলো সে। তারপর গলা খাকারি দিয়ে বললো,
“লুকিয়ে কারোর কথা শোনাটা মোটেই ঠিক নয়। এটা একটা বদগুন”
কথাটি কর্ণপাত হতেই মাথা তুলে তাকালো ধারা এবং মাহি। চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লো তারা। এর চেয়েও অবাককর বিষয় অনল টের পেলো কি করে! সে কি প্রথম থেকেই জানতো। সময় নষ্ট না করে উঠে দাঁড়ালো তারা দুজন। কোনো কথা না বলেই উল্টো দিকে হাটা দিলো তারা। ধারা কথা বলবে না অনলের সাথে। প্রচন্ড অভিমান হয়েছে তার। যদিও যখন অনন্যাকে মুখের উপর সঠিক জবাব দিচ্ছিলো তখন মনে এক অকল্পনীয় শান্তি লাগছিলো। হৃদয় পুলকিত হয়ে উঠছিলো এই ভেবে অনল তাকে ভুল বুঝে নি। কিন্তু সেই পুলক টিকসই হলো না। মূহুর্তেই সকালের কথাগুলো ভেবে তেতো হয়ে উঠলো হৃদয়। যদি এতোই ভালোবাসে তবে একটু বিশ্বাস রাখলে কি এমন ক্ষতি হতো! অনলও ধারাকে আটকালো না। ঠোঁটের কোনে এক অমলিন হাসি ফুটিয়ে চেয়ে রইলো ধারার যাবার পানে। মেয়েটি সত্যি ছেলেমানুষ।
ল্যাব স্যাশনাল শেষ হবার পরও বন্ধুমহল প্রস্থান করলো না। তারা দাঁড়িয়ে রইলো ডিপার্টমেন্টের বাহিরে। প্রতীক্ষা মাধবীর। মেয়েটির সাথে আজ মুখোমুখি বোঝাপড়া হবে। ধারার মুখ কঠিন হয়ে আছে। মাধবীর সাথে একটা এস্পার ওস্পার করেই ছাড়বে সে। মাহি তাকে ঠান্ডা করার জন্য বললো,
“মাথা গরম করবি না। শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করবি। তাও শান্তভাবে, উগ্র হলেই আমাদের গুটি বের হয়ে যাবে। সেটা করা যাবে না”
“এক কথা এই নিয়ে গুনে গুনে ছ বার বলেছিস, এবার থাম”
“হ্যা, কারণ তুমি যে রণচন্ডীরুপ ধারণ করো আমার ভয় হয়, কখন না মাধবীর মাথা ফাটিয়ে দিস। তাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। একটা ভুল আর আমাদের পাঁচজনের লাইফ শেষ। আমরা সবাই সিড়ির ওখানে আছি। দিগন্ত তোদের কথোপকথন রেকর্ড ও করবে। ও তোকে উস্কালেও তুই শান্ত থাকবি”
“হ্যা, হ্যা, বুঝেছিস। এবার একটু থাম আম্মা”
মাহি আর কথা বাড়ালো না। তারা প্রমাণ জড়ো করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাধবীর এই কমপ্লেইনের পেছনের আসল উদ্দ্যেশ্যটা বের করাই তার উদ্দেশ্য। এই বুদ্ধিটা অবশ্য দিগন্তের মাথা থেকে বের হয়েছে। সে ল্যাবের মাঝে সকলকে জড়ো করে। তারপর নিজের বুদ্ধিটা বর্ণনা করে। ধারা মাধবীকে প্রশ্ন করবে, বারংবার তাকে উছকে দিবে। সিড়ির নিচে থাকবে বন্ধুমহল। মাধবী একটা পর্যায়ে তার কমপ্লেইনের কারণটা মুখ ফসকে বলবেই। সেটার ভিডিও করবে দিগন্ত। তারপর সেটা দিয়েই মাধবীকে তুর্কিনাচন নাচানো যাবে৷ দিগন্তের মাথা থেকে এমন একটা বুদ্ধি শুনেই তো অবাক বন্ধুমহল। নীরব অবাক কন্ঠে বললো,
“ভাই বলে দে, কোথা থেকে ছাপিয়েছিস! তোর মাথায় এই বুদ্ধি অসম্ভব”
“কেনো? আমি কি গা’ধা নাকি গ’রু? আমার মাথায় কি কি বুদ্ধি আছে তোরা কল্পনা করতে পারবি না। আমি হলাম এ যুগের শার্লক”
দিগন্তের কথায় সকলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করে। যার অর্থ “ঢপ কম মার”। ফলে সে গাইগুই করে স্বীকার করলো,
“একটা মুভি থেকে ছাপানো”
“এবার লাইনে আসো”
নীরবের কথায় ধারাও হেসে দিলো। এই সবের মধ্যে তাদের বন্ধুত্বের শীতলতাও খানিকটা হলেও কমে গেলো। বন্ধুমহল তাদের আগের বেশে চলে এসেছে— “সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে”।
অপেক্ষার সময় বাড়ছে। অবশেষে মাধবী বের হলো তার কাজ শেষ করে। বন্ধুমহল মোবাইল নিয়ে প্রস্তুত। মাধবী ধারার মুখোমুখি হলো। ধারাকে দেখতেই খানিকটা চমকালো সে। ধারার কঠিন মুখ এবং রক্তিম চোখে যে কেউ ভয় পাবে। মাধবী পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই ধারা বাধ সাধলো। শান্ত গলায় বললো,
“মাধবী, আমার তোমার সাথে কথা আছে”
“আমার নেই, আমার কাজ কাছে। আমাকে যেতে দাও”
“প্রশ্নের উত্তর না পেলে তো যেতে দিবো না”
“আজব তো! এটা কি মামদোবাজি?”
খানিকটা ভীত কন্ঠেই মাধবী বললো। ধারা অবাক হলো। মাধবীর মতো মেয়ে এতোটা ভয় পাচ্ছে কেনো! ধারা তার গলা নরম করলো। খানিকটা ধরা গলায় বললো,
“তোমার সাথে তো শত্রুতা আমার মাধবী, অনলস্যারের সাথে এমনটা করলে কেন? আজ বিনা অপরাধে সে ভুগছে!”
“বিনা অপরাধ! তোমার মতো মেয়ে এতো ভালো নম্বর পায় আর আমি সারাদিন পড়েও সেই একই নম্বর পাই তাহলে বিনা অপরাধ কিভাবে? তুমি নিজেই চিন্তা করো তুমি কি এতো ভালো রেজাল্ট করার যোগ্য। কি জানো তুমি! কখনো পাঁচ ছ খানা টিউশনি করিয়েছো শুধু সেমিষ্টার ফি দেবার জন্য? তোমাদের মতো মেয়েরা বুঝবে না। কত কষ্ট করে আমরা আমাদের ভবিষ্যত গড়ি। এই বৃষ্টি রোদ উপেক্ষা করে টাকা কামাই করি। কারণ তোমাদের মতো কেউ মুখে তুলে দেবার মতো নেই। দেখো ধারা, আমি কি কেনো করেছি সেটার কৈফিয়ত তোমাকে দিবো না। আমার মনে হয়েছে পার্শিয়ালিটি হয়েছে আমি কমপ্লেইন করেছি। ব্যাস। যেতে দাও এবার”
বলেই হনহন করে হেটে চলে গেলো মাধবী। ধারা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। ধারার মনে হলো মাধবী তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। সে কিছু একটা লুকাচ্ছে। সে ধারার চোখে চোখ রাখতেই ভয় পাচ্ছিলো। বন্ধুমহল সিড়ির নিচ থেকে বেড়িয়ে এলো। হতাশ কন্ঠে দিগন্ত বললো,
“কি চালাক! কি সুন্দর করে সাজানো উত্তর দিলো। আমি ভেবেছিলাম ও ধারার প্রতি হিংসে প্রকাশ করবে। কিন্তু না! সে পাশ কাটিয়ে কথাটা বললো।”
“আমার মনে হয় ও কিছু একটা লুকাচ্ছে”
চিন্তিত ধারা কথাটা বললো। নীরব ও সায় দিলো। নীরব অবাক কন্ঠে বলল,
“এই এক বছর কখনো শুনলাম না মাধবীর টিউশন করা লাগে। ওর কোনো অর্থনৈতিক ঝামেলা আছে। ধারার সাথে কথা বললেই সে সর্বদা একটা দাম্ভিকতা প্রকাশ করতো। হিংসাত্মক তার পরিকল্পনা। আজ হুট করে এই টোনে কথা বললো কেনো? ও কি কোনো ঝামেলাতে আছে?”
“খোঁজ নিতে হবে”
বেশ বিজ্ঞভাব নিয়ে দিগন্ত কথাটা বললো। বন্ধুমহল ও সায় দিলো দিগন্তের কথায়। বের তো করতেই হবে মাধবীর এমন পরিবর্তিত আচারণের কারণ_______
বাসায় ফিরে নিজ ঘরে যেতেই কানে এলো এশা আশার কথা। ধারা দরজা ঠেলে উঁকি দিলো তাদের ঘরে। তারা বেশ সুন্দর করে সাজগোজ করছে। এশা নিজেকে আয়নার সামনে ঘুরে ঘুরে দেখছে। তারপর আশাকে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন লাগছে?”
আশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“তুই কেনো জিজ্ঞেস করছিস সত্যি বুঝতে পারছি না। তুই যাই পড়িস তোকে শা’ক’চু’ন্নি’র মতোই লাগে”
সাথেই সাথেই তাদের চু’লো’চু’লি শুরু হয়ে গেলো। সুন্দর বাঁধা চুলগুলো হয়ে গেলো এলোমেলো। অবস্থা বেগতিক দেখে ধারা দুটোর কান ম’লে দিলো। তারপর দুটোকে আলাদা করলো। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“এতো সাজের বাহার কেনো?”
নিজের কান ঢলতে ঢলতে এশা বললো,
“ঘুরতে যাচ্ছি”
“কোথায়?”
“পাশের বাড়ির ফাইজার জন্মদিন। আজ রাত ওখানেই থাকবো। তাই সাজগোজ করছি। সবার সামনে ভাবের ব্যাপার আছে তো”
ধারা কি উত্তর দিবে বুঝে পেলো৷ না। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“এটাকেই বলে কারোর পৌষমাস, কারোর সর্বনাশ।”
“পৌষমাস না ধারাপু এটা শ্রাবণ মাস। তাও শেষের দিক। তুমি তো দেখি মাস ও জানো না। আবার বলো ভার্সিটিতে পড়ি”
আশার কথায় এশাও দাঁত বের করে হাসলো। ধারা আশার কান টে’নে বললো,
“এবার বল, কি বলছিলি! আমি কি জানি না”
“ছাড়ো ছাড়ো, তুমি জানো না এমন কোনো জিনিস আছে। তুমি তো সর্বজ্ঞানী, মহামহিলা”
“মহামহিলা কি!”
“মহাপুরুষের স্ত্রীবাচক শব্দ মহামহিলা। এভাবে তো জেন্ডার ডিসক্রিমিনিশন করা ঠিক না। মহিলারাও তো মহান হতে পারে। তাই আমরা এই শব্দটির আবিষ্কার করেছি”
ধারা হতাশ হয়ে উঠলো। শুধু শুধু কি এদের কেউ পড়াতে চায় না। এদের সাথে কথা বলা আর পিলারে মা’থা ঠোকানো এক। ধারা কিছু না বলেই বেড়িয়ে গেলো। আশা বললো,
“ধারাপু কি হতাশ?”
“হ্যা, আমাদের মতো জ্ঞানীদের সামনে দাঁড়াতে পারছে না। তাই হতাশ হয়ে গেছে।”
এশার কথায় সায় দিলো আশা। তারা নিজেদের গোছগাছেই ব্যাস্ত_______
নিজের ঘরের এককোনার সোফায় বসে আছেন সেলিম সাহেব। তার হাতে একটি ছবি, ছবিটিতে একটি নারীর কোলে একটি ছোট বাচ্চা। বাচ্চাটির বয়স তিন কি চার। দুটো ছোট ছোট ঝুটি মাথায়। চোখ বুঝে, সব দাঁত বের করে মেয়েটি হাসছে। তাকে দেখে নারীটিও হাসছে। সেলিম সাহেব বারবার ছুয়ে দেখছেন ছবিটি। এই ছবিটি সুরাইয়া এবং ধারার৷ অস্ট্রেলিয়ায় যাবার সময় এই ছবিটিই নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কে জানতো এটাই তার কাছে সুরাইয়ার শেষ ছবি হবে। মাঝে মাঝে আফসোসগুলো অনুতাপে পরিণত হয়। কাটার মতো বিধে হৃদয়ে। এমন সময় আগমন হয় দীপ্তের। দীপ্তকে দেখেই ছবিটা উলটে রাখেন সেলিম সাহেব। তার অগোচরে অশ্রু মুছে নিলেন। তারপর হাসি ফুটিয়ে বললেন,
“কি খবর?”
“অনলের ভার্সিটিতে ঝামেলা হয়েছে। মে বি ওকে সাসপেন্ড করা হবে”
“তাহলে আমাদের অফারটি দিয়ে দাও”
“জ্বী, আংকেল”
বলেই দীপ্ত কিছুসময় দাঁড়ালো। তার মুখে জিজ্ঞাসা স্পষ্ট। সেলিম সাহেব নিজের চশমা টগিক করে বললেন,
“কিছু বলবে?”
“আংকেল এগুলো করা কি ঠিক হচ্ছে। দে আর হ্যাপি, আর অনল ইজ এ গুড গায়। ও ধারাকে অনেক লাভ করে”
“আকাঙ্ক্ষা ভালো দীপ্ত, কিন্তু উচ্চাকাঙ্খা পতনের মূল। মানুষ উচ্চাকাঙ্খার জন্যই অনেক ভুল করে। আমি চাই না আমার জন্য সে পরিণতি সুরাইয়ার হয়েছে সেই পরিণতি আমার মেয়ের হোক। সে না মানলেও আমার তো দায়িত্ব আছে”
“সাপোজ অনল এক্সসেপ্ট করে নিলো আমাদের অফার তখন?”
একটু থেমে প্রশ্নটি করলো দীপ্ত। সেলিম সাহেব হাসলেন। তারপর বললেন,
“ফেল ঘোষণা করবো, আমিও দেখি ওর কাছে কোনটা জরুরী। ক্যারিয়ার না আমার মেয়ে”
দীপ্ত আর কথা বাড়ালো না। সে জানে এই লোকের মাথায় ঠিক চলছে তা বোঝা খুব ই দুষ্কর ব্যাপার। তাই সে বেড়িয়ে আসলো ঘর থেকে। তখন ই কারেন্ট চলে গেলো তাদের বাসার। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ফোনের ফ্লাস লাইটটা জ্বালালো দীপ্ত। তারপর কোনো মতে নিজ ঘরে গেলো সে। নিজ ঘরে যেতেই অনুভূত হলো ঘরে সে একা নয়। কেউ তো আছে ঘরে। তখন ই দেখতে পেলো জানালার উপর একটি নিকষকালো ছায়া। দীপ্ত ফ্লাস লাইটটি তাক করতেই যেনো মিলিয়ে গেলো ছায়াটি। মনের ভুল ভেবে দীপ্ত গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। সাথে সাথেই একটি ভয়ংকর হাসির শব্দ কানে এলো তার। ভয়ংকর চিকন কন্ঠে বললো,
“চলে যা, চলে যা। আমার ঘর থেকে চলে যা”
কন্ঠটি শুনতেই বুক কেঁপে উঠলো দীপ্তের। গতকাল ই শুনেছিলো এই বাড়িতে নাকি একটি মেয়ে আ’ত্ম’হ’ত্যা করেছিলো। তখন তার বিশ্বাস না হলেও এখন যেনো অজানা ভয় মস্তিষ্ককে কাবু করে তুলেছে। তড়িঘড়ি করে উঠতেই মনে হলো হাতে কোনো গরম তরল লেগে আছে। ফ্লাস লাইটটা হাতের কাছে মারতেই দেখলো টকটকে লাল তরল। অজানা ভয়টি ক্রমশ তীব্র হলো দীপ্তের। অমনেই চিৎকার করে জ্ঞান হারালো সে। এদিকে উপর তালার জানালায় কান লাগানো জমজেরা তার চিৎকার শুনেই হাই ফাইভ দিয়ে বলে উঠলো,
“চেরাগআলী এবার বাছা কই যাবা”…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি