#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২৩তম_পর্ব
দীপ্ত তৃপ্তি নিয়ে চটপটিটা খেলো। একটু ঝাল বটে, কিন্তু ভীষণ মজা। কিন্তু ঝামেলাটা হলো এক ঘন্টা পর, যখন তার পেট মুড়িয়ে উঠলো। শুধু রুম টু বাথরুম আর বাথরুম টু রুম। এক মিনিট যে বসবে তার উপায় নেই। যখন ই বাথরুম সেড়ে একটু জিড়িয়ে নিতে চায়, অবুঝ, অবাধ্য পেটটা পুনরায় মোচড় দেয়। বুঝে উঠতে পারছে না, এতো বিশ্রী ডিসেন্ট্রি হলো কেনো! একটা সময় ক্লান্ত হয়ে পড়লো দীপ্ত। ক্লান্ত, রুগ্ন, শক্তিহীন শরীরটি বসে পড়লো বাথরুমের মেঝেতে।
এদিকে দীপ্ত এর ঘরের বাহিরে ঘাপটি মেরে অবস্থান করছিলো জমজেরা। কান পেতে শুনছিলো দীপ্তের প্রতিটি গতিবিধি, যেনো কোনো নামকরা গোয়েন্দা টিমের সদস্য। যখনই দীপ্তের ঘরের বাথরুমের পুরোনো জং ধরা দরজার শব্দ পাচ্ছিলো তাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিলো। একে অপরের পিঠ চাপড়ে বাহবা দিচ্ছিলো। আসলে দীপ্তের এই পেট মোচড়ের কৃতিত্ব সম্পূর্ণ জমজের। সেদিনের গোবড়কান্ডের পর রুবি তাদের সদর দরজার বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা। সেই সময়ে ঘরে যারাই প্রবেশ করছিলো এই দুজনের অবস্থা দেখে না চাইতেও মুখ টিপে হাসছিলো৷ ব্যাপারটা অপমানজনক। দীপ্ত যদি সেই সময় ওদের পাশে না দাঁড়াতো ওদের গোবড়কান্ড ফাঁস হতো না, কেউ জানতো না, শাস্তি ও পেতে হতো না। ফলে দীপ্তের প্রতি অসামান্য ক্ষোভ জন্মেছে তাদের। এমনিতেও দীপ্ত দিনকে দিন চক্ষুশূল হয়ে উঠছে তাদের৷ ভীষন সন্দেহ হয়। মতিগতি কিছু সুবিধের নয়। ফলে সেদিনের শোধ তুলতেই এই চটপটি বুদ্ধি বের করলো এশা। রহমত পাড়ার বিখ্যাত চটপটিতে মিশিয়ে দিলো নিজের তৈরি ফর্মূলা নম্বরা ২০৩। যদিও আশা বেশি পরিমাণ মিশাতে চেয়েছিলো, তখন এশা বাধা দিয়ে বললো,
“বেশি না, কম মিশা। যেনো অন্তত ১০-১২ বার হয়”
“এতো কম কেন? চেরাগআলীর জন্য সাড়ে চার ঘন্টা ভুতের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওকেও সাড়ে চারঘন্টা বাথরুমে কাটাতে দে”
“একেবারে না, পাখিকে খেলিয়ে খেলিয়ে মা’র’বো। ওই ব্যাটা ঘুঘু দেখেছে ফাঁ’দ দেখে নি। আমরা ওকে ফাঁদে ফেলে বোঝাবো কত ধানে কত চাল! আর একেবারে এতো দিলে সন্দেহের মুখোমুখি হবো। বার কয়েক হলে এটা স্বাভাবিক মনে হবে। এমনেও ব্যাটা বিদেশী মাল, দেশী খাবার পেটে সয় না। দেখিস নি, মিনারেল পানি বাদে খেতে পারে না। তুই যদি বেশি দিস আমাদের জ’ল্লা’দ মা বুঝে যাবে। আর ওই চেরাগআলী ও আমাদের উপর ভরসা করবে না। এটা হতে দেওয়া যাবে না। ধীরে ধীরে ওকে বোঝাতে হবে। আর ফর্মূলা ২০৩ ই তো সব নয়। ওর উপর ফর্মূলা ৩০৩, ৪২০ ও এপ্লাই করবো। শুধু সময় আসতে দে”
এশার কথা শুনে পৈশাচিক হাসি হাসে আশা। হিং’স্র প্রাণী যখন বহু খোঁজের পর তার শিকারকে খুঁজে পায় তখন যেমন তাদের চোখ চকচক করে, জমজদের চোখ ও চকচক করছে। তারা দুজন মিলে “হু হাহা” করে পৈশাচিক হাসি দেবার চেষ্টা করলো। কিন্তু হলো না, স্বরে টান লাগায় উভয় ই কেশে উঠলো। তবে তাদের মনে প্রফুল্লতা কমলো না। দীপ্তকে না’কে দ’ড়ি দিয়ে ঘুরাবার আনন্দ যেনো অমূল্য________
ডাইনিং টেবিলে সকলে একত্রিত হলো। আজ একটি বিশেষ দিন। আজ জীবনে প্রথমবারের মতো ধারা রান্না করেছে। মামা বাড়িতে সর্বদা আদর এবং স্নেহে মানুষ হবার দরুন রান্নাঘরে কারণ ব্যাতীত যাওয়া পড়ে নি তার। ধারার মনে আছে, সে যখন ক্লাস টেনে পড়তো অতি উৎসাহী হয়ে নানাভাই কে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াবার জিদ ধরে। বড়মার হাজারো মানার পর ও সে রান্না করে। রান্না যেমন ই হোক না কেনো, গোল বাধে যখন ডিম ফু’টে তেল ছি’টে পড়ে ধারার হাতে। বেশ ক জায়গায় গরম তেল পড়ায় পু’ড়ে যায়। ফলে সুভাসিনী বেগম এবং জামাল সাহেব কড়া নিয়ম জারি করে, ধারার প্রয়োজন ব্যতীত রান্না করার প্রয়োজন নেই। তার পর থেকে চা বানানো ব্যতীত কোনো রান্না ধারা করে নি। তবে আজ করছে। করছে কেবল অনলের জন্য। সুভাসিনী বেগম গাইগুই করেছেন বহুবার। কিন্তু ধারা শুনে নি। অনলের পছন্দের খাবার রান্না করবে সে। অনলের বরাবরই খিঁচুড়ি, ডিমভুনা এবং বেগুনের আঁচার বড্ড পছন্দ। উপরন্তু আজ বর্ষার দিন। বৃষ্টির ভেজা রাতে খিঁচুড়ি না হলে যেনো বাঙ্গালীর মন ভরে না। তাই ধারাও নিজের প্রণয়নের জন্য রান্না করলো এই তিনপদ। জামাল সাহেব অতি উৎসাহী, যদি ও হার্টের ব্যামোর জন্য ডিমের কুসুম অংশ, ঘি খাওয়ায় তার বাধ্যবাধকতা আছে। তবুও ধারারানীর হাতের রান্না সে খাবেই। ধারা সকলকে বেড়ে দিলো খাবার। অনলের দিকে তাকিয়ে আছে সে অধীর আগ্রহে। টেবিলে নিজের কিশোরী বউ এর সন্ধ্যা থেকে করা কষ্টের অমূল্য ফল দেখে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো অনলের। একমুগ্ধতা নিয়ে তাকালো সে ধারার দিকে। অনলের হাসি লেপ্টানো মুখখানা দেখে সকল কষ্ট পরিশ্রম যেনো সার্থক মনে হলো ধারার। অনল সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে নিজের পাশের চেয়ার খানা একটু সরিয়ে দিলো। বোঝালো, “এখানে এসে বস”। ধারাও সেই ইঙ্গিত অনুসরণ তার পাশে গিয়ে বসলো। ধারা বসতেই অনলের রুক্ষ্ণ হাতটা তার কোমল হাতটি আয়ত্ত করে নিলো। এতোসময় পানির কাজ করায় হাতটি ঠান্ডা হয়ে আছে। ফলে অনলের হাতের উষ্ণতা নিমিষেই ছড়িয়ে পড়লো ধারার হাতে। ধারা মাথা নামিয়ে নিলো। ভীষণ লজ্জা তাকে ভর করেছে। এরমাঝেও যেনো একরাশ ভালোলাগা মিশে আছে।
জামাল সাহেব খাবার মুখে তুললেন। খাবার খেয়েই তার চোখ টলমল করে উঠলো। ভেতরটা আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠলো অজান্তেই। প্রয়াত মেয়ের কথা মনে পড়ছে। প্রতিটি বাবার কাছে তার মেয়ের রান্না মায়ের রান্নার সমতূল্য। সুরাইয়ার রান্নাও জামাল সাহেবের অতিপ্রিয় ছিলো। অতি সচেতন মানুষটিও তখন অসচেতন হয়ে যেতো, গোগ্রাসে গিলতেন মেয়ের রান্না। আজ এতোটা বছর পর তার মনে হলো তিনি সুরাইয়ার হাতের রান্না খাচ্ছেন। ফলে অজান্তেই পেটের সাথে মনটিও তৃপ্ত হয়ে উঠলো।
এর মাঝেই ডাইনিং এ উপস্থিত হলো দীপ্ত। তার শুভ্র চেহারাটি মূর্ছা গেছে, কোকড়ানো বাদামী চুল ঘামে অবিন্যস্ত হয়ে আছে। চোখগুলো নিস্প্রভ, ঠোঁটজোড়া শুকনো। দেখে মনে হচ্ছে যেনো ঝড় চলে গেছে তার উপর। তাকে দেখেই সুভাসিনী বেগম শুধালেন,
“দীপ্ত খাবে না?”
“না আন্টি, আই এম নট ফিলিং ওয়েল। পেটটা ভালো নেই”
“এ বাবা ডাইরিয়া হলো নাকি?”
“মে বি?”
“তুমি কি কিছু উলটা পালটা খেয়েছিলে?”
দীপ্ত এবার জমজদের দিকে করুন দৃষ্টিতে চাইলো। কিন্তু তারা নির্বিকার। বরং উলটো অতি আগ্রহী চাহনীতে দীপ্তের দিকে চেয়ে রয়েছে। দীপ্ত একটু রয়ে সয়ে বলল,
“টুইন্স গেভ মি এ বাউল অফ চটপটি। সেটা এই পাড়ায় ফেমাস নাকি! ওটাই খেয়েছিলাম। তারপর থেকে এই অবস্থা?”
“তুমি চটপটি খেতে গেলে কেনো? তোমার বিদেশি পেটে কি অগুলো সইবে?”
দীপ্তের কথা শেষ না হলেই ফট করে কথাটা বলে উঠলো ইলিয়াস। ইলিয়াসের কথা শুনে মুখশ্রীতে বিজ্ঞ ভাব টেনে এশা বললো,
“ও, দাদাজান এই ঘটনাকেই কি বলে “কু’ত্তার পেটে ঘি সয় না”?
এশার কথা কর্ণপাত হতেই হো হো করে হেসে উঠলেন জামাল সাহেব। উপস্থিত সকলেও হাসি কোনোমতে আটকালো। দীপ্ত খেয়াল করলো ধারা দু হাত দিয়ে মুখ চেপে বসে রয়েছে। সে কোনো মতেই নিজ হাসি আটকাতে পারছে না। প্রবাদটির অর্থ না জানলেও দীপ্ত ঠিক বুঝলো এটার অর্থ বেশ সুবিধার নয়। নিজের করুন অবস্থাতে বেশ লজ্জিত হলো সে। শুভ্র মুখশ্রীটা লজ্জা এবং অপমানে কালচে বর্ণ ধারণ করলো। এশা তখন বিনয়ী স্বরে বললো,
“দীপ্ত ভাই, আমি কিন্তু আপনাকে কু’ত্তা বলি নি। আসলে প্রবাদ তো, বই তে পড়েছি। সেটাকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা করলাম মাত্র। আপনি কিন্তু রাগ করবেন না। আসলে বুঝিতে পারি নি আপনার পেট খারাপ হবে। জানলে কখনোই চটপটি দিতাম না। ভাবলাম বৃষ্টির দিন সবাই যেহেতু খাচ্ছে আপনিও উপভোগ করুন। কিন্তু এতে যে আপনার এই হাল হবে কে জানতো! সরি”
দীপ্ত নিস্প্রভ, মলিন হাসি হাসলো। নিজের অবস্থার জন্য তো বাচ্চা মেয়ে দুটোকে দায়ী করা যায় না, যেখানে তারা তো বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে এসেছিলো। ধারা নিজের হাসি আটকাতে পারছে না, সে তো জানে তার মামাতো বোনেদের প্রখ্যাত স্বভাব। দীপ্তকে দেখে প্লাবণের কথাটা স্মরণ হলো। না চাইতেও শব্দ করে হেসে উঠলো সে। তাকে থামাতে অনল তার হাটু চেপে ধরলো। ইশারা করে বোঝালো, “হাসি বন্ধ”। কিন্তু ধারা তো ধারা, মুখ চেপে হাসতে লাগলো অনবরত। এর মাঝে জামাল সাহেব বাজখাঁই কন্ঠে বলে উঠলেন,
” সুভাসিনী”
“জ্বী, আব্বা?”
“এই বিদেশী ফকিরটারে একটু চিড়া আর দই মাখায় দাও। আমি চাই না, কেউ বলুক জামালের বাড়িতে মানুষ না খাইয়া ঘুমায়। আর ওরে কও স্যালাইন খাইতে, সামান্য চটপটি যে খাইতে পারে সে আইছে আমগোর দেশে। হাহ, যতসব”
সুভাসিনী তাই করলো, একটা বাটিতে চিড়া আর দই মেখে দিলো। দীপ্ত কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলো। এতোসময় বাথরুম টু ঘর আর ঘর টু বাথরুম করে সত্যি ক্ষুদা লেগেছিলো, কিন্তু খিঁচুড়ী দেখে ভয়ে খেতে চাচ্ছিলো না। বলা তো যায় না, রাতটা না বাথরুমেই কাটে_____
খাবার শেষে জমজেরা নিজের ঘরে যেতে ধরলে ধারা তাদের খপ করে ধরলো। চোখ ছোট ছোট করে সন্দীহান কন্ঠে বললো,
“সত্যি করে বল তো, চটপটিতে কি মিশিয়েছিস? ফর্মূলা ২০৩?
“ধারাপু এটা ঠিক নয়, তুমি বরাবর আমাদের সন্দেহ করো। আমরা কি কাউকে বিনা কিছু মিশিয়ে দিয়ে পারি না? আমরা সত্যি অনুতপ্ত!”
ভীষণ করুন গলায় বললো আশা। এশা ও চোখগুলো আহত বিড়ালের মতো করে রাখলো। তাদের করুন মুখশ্রীতেও ধারার মন গললো না। ঝাঁঝালো স্বরে বললো,
“মার কাছে মাসির গল্প দিও না। সত্যি করে বল! আমি কিন্তু ছোট মামীকে বলে দিবো। এবার কান ধরিয়ে পাঁড়ার ল্যাম্পপোস্টে দাঁড় করাবে”
“থাক আশা, এই নির্দয় মহিলা আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না। ছেড়ে দে”
হতাশ দুঃখভরাক্রান্ত কন্ঠে কথাটা বললো এশা। আশাও তাল মিলালো,
“এটাই যা’লি’ম সমাজ, সত্যের দাম নেই। আমাদের মতো অসহায়রা কোথায় যাবে”
ধারার না চাইতেও হাসি পেলো, কিন্তু নিপুন ভাবে তা গোপন করে গেলো। নিজের বোনদের এই নাটক তার জানা। এই দুটোর হাড় নয়, অস্থিমজ্জাও তার পরিচিত। এর মধ্যেই পুরুষালী গম্ভীর কন্ঠ কানে আসে,
“কি রে! গান্ধীর তিন বা’দ’র এখানে জট পাকিয়েছিস কেনো?”
অনল তখন দীপ্তকে ঔষধের বাক্স দিয়ে এসেছে। অনলের কথা শুনে তিনজন সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ধারা গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“জিজ্ঞাসাবাদ চলে, এই দুটোর চটপটি কারসাজির জিজ্ঞাসাবাদ”
এশা আশা শুকনো ঢোক গিলে। অনলের সামনে তাদের সব অভিনয়গুলো যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ভেবেছিলো অনল ভাইও হয়তো জিজ্ঞাসাবাদ করবে। কিন্তু তাদের অবাক করে অনল বলে,
“যা করছিস কর, ধরা পড়িস না। আর একটা কথা, চোখ কান খোলা রাখবি। ওই দীপ্ত যেনো আমার বউ এর ত্রিসীমানায় না থাকে। মনে থাকবে?”
“আই আই ক্যাপ্টেন”
বলেই দুটো একসাথে অনলকে স্যালুট দেয়। অনল ঠোঁট বাকিয়ে হাসে। তারপর ধারার হাতটা নিজের হাতের ফাঁকে নেয় এবং পা বাড়ায় নিজ ঘরের দিকে। অনল চলে গেলে আশা এশাকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
“বুঝলি কিছু?”
“হুম, বুঝছি”
“কি?”
“অনল ভাই এর মাথা গেছে”
*******
নিজ রুমে আসতেই ধারা অনলের টিশার্টের কোনা টেনে ধরে। ধারার এমন আচারণে খানিকটা প্রফুল্ল হলেও তা প্রকাশ করে না অনল। স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
“কি চাই?”
“রান্না কেমন ছিলো?”
ধারা লাজুক স্বরে কথাটা বলে। যেনো কোনো নববধু তার স্বামীর মুখে নিজের প্রশংসা শুনবার জন্য অধীর হয়ে আছে। ওড়নাটা নিজ হাতের ফাঁকে নিজে দলা পাকাতে পাকাতে বললো,
“আমি তোমার জন্য রান্না করেছি। বললে না তো রান্নাটা কেমন হয়েছে?”
অনল সময় নিলো। কিছুসময় অপলক নজরে তাকিয়ে রইলো সামনে দাঁড়ানো কিশোরী মেয়েটির পানে। সে প্রতীক্ষিত। প্রতীক্ষা ভালোবাসার মানুষটির মুখে নিজের প্রশংসা শোনার। যদিও খিঁচুড়িটি হালকা লবণ ছিলো, ডিমভোনায় হালকা ঝাল বেশি হয়েছিলো আর বেগুনের আঁচার ঈষৎ পুড়ে গিয়েছিলো; কিন্তু খাবারগুলো ধারার ভালোবাসায় ছিলো পরিপূর্ণ। মেয়েটি সন্ধ্যা থেকে ধৈর্য্য ধরে রান্নাটা করেছে। অনল স্মিত হাসলো। অনলের বলতে ইচ্ছে হলো,
“খাবার এতো সুস্বাদু হয়েছে যে আমার ইচ্ছে করছিলো রাধুনীর হাতে একটা শীতল চুমু একে দেই”
কিন্তু সেটা সে বললো না। উলটো একটা দুষ্ট বুদ্ধি চাপলো মাথায়। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“মন্দ হয় নি, খাওয়া যাচ্ছিলো বটে। তবে এতোটা কষ্ট করে রাধলি একটা পুরস্কার তো পাওনা তোর”
“কি পুরষ্কার? কি দিবে আমায়?”
উৎসাহী কন্ঠে বললো ধারা। অনল একটু থেমে বললো,
“চোখ বন্ধ কর, সারপ্রাইজ বলে কথা”
ধারা সাথে সাথে চোখ বুজলো। মস্তিষ্কে হাজারো কল্পনা জাগলো। কি হতে পারে সারপ্রাইজ? কি দিবে অনল ভাই? বেলীর মালা! নাকি একজোড়া নুপুর! নাকি ধারার অতি পছন্দের এক পাতা কাগজের টিপ! নাকি গোছা কয়েক রেশমি চুড়ি! ধারা বই তে পড়েছিলো, নায়কেরা নায়িকাদের চমকে দিতে নানারকম উপহার দেয়। নায়িকার মুখে হাসি ফোটার জন্য কেউ কেউ তো অঝর বর্ষায় ভিজে নিয়ে আসে বছরের প্রথম ফোটা সিন্ধুপুষ্প। অনল ও কি তেমন হবে! আসলে আত্মদাম্ভিক, কঠিন, জেদী মানুষটি অকপটে প্রেম নিবেদন করলেও প্রণয়ের প্রকাশটি করবার ধরণ তার বড্ড বিচিত্র। তার ভালোবাসার ধরণ বড্ড বিচিত্র। কাছে আসার আগ্রহটি যেনো ধারার ই বেশি। অনল বরাবরের মতোই নির্লিপ্ত। ধারা উন্মুখ হয়ে আছে তার সারপ্রাইজের জন্য। মিনিট পাঁচেক বাদে অনল বললো,
“হাত এগিয়ে দে”
ধারা মন প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। হাতখানা নির্দ্বিধায় এগিয়ে দিলো। অনল তার হাতে কিছু রাখলো। যার ভারে হাত ভেঙ্গে আসার জোগায়। ধারা সাথেই চোখ খুললো। চোখ খুলতেই তার মুখ বিস্ম্যে হা হয়ে গেলো। অবাক কন্ঠে বললো,
“এগুলো কি?”
“ইংলিশে বলে নোট আর খাস বাংলায় বলে চোঁ’থা”
ধারায় মাথায় যেনো আগুন জ্বললো। এই মানুষটা এমন কেনো! তার জন্য গরমে ঘেমে নেয়ে এতো সময় রান্না করেছে আর সে কি না এই বস্তা ভর্তি গণিতে ভরা কাগজ ধরিয়ে বলে এটা সারপ্রাইজ। ক্ষিপ্ত কন্ঠ বললো,
“তুমি এমন আনরোমান্টিক কেনো বলতো? একদম খা’চ্চ’র, বেরসিক, চরম আমরোমান্টিক একটা বর। কার বর তার বউ কে উপহার স্বরুপ এই নোটপত্র দেয়, শুনি?
কাগজের স্তুপ সজোরে টেবিলে রাখলো সে। ধারা রীতিমতো রাগে ফুসছে। তার চোখ মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। অনল মুগ্ধ নজরে তার বউ কে দেখলো কিছুসময়। তারপর এগিয়ে এসে তার চোখে চোখ রেখে নরম স্বরে বললো,
“তা আমার বউ এর ঠিক কেমন রোমান্টিক স্বামী চাই?”………
চলবে
#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২৪তম_পর্ব
ধারা রীতিমতো রাগে ফুসছে। তার চোখ মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। অনল মুগ্ধ নজরে তার বউ কে দেখলো কিছুসময়। তারপর এগিয়ে এসে তার চোখে চোখ রেখে নরম স্বরে বললো,
“তা আমার বউ এর ঠিক কেমন রোমান্টিক স্বামী চাই?”
প্রশ্নটি কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই ঝংকার তুললো মস্তিষ্কে। ধারা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার সামনে ঈষৎ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকা মানবের দিকে৷ শ্যাম মুখশ্রীর মানবটি তার চোখে দৃষ্টি আবদ্ধ করে রেখেছে, ঘোর লাগা সেই দৃষ্টি। চুলগুলো বড্ড অবহেলায় পড়ে রয়েছে তার শ্যাম ললাটে। তার কন্ঠে অসামান্য মাদকতা, তার বা হাতটা ট্রাউজারের পকেটে। ঠোঁটের কোনে লেপ্টে থাকা বাঁকা হাসিতে হাজারো দুষ্টুমি। প্রিন্স উইলিয়ামের মুখশ্রীর দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটায় চিনচিনে এক সূক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভূত হলো। ব্যাথাটি বিষাদের নয়, বড্ড বিচিত্র সেই ব্যাথা। ব্যাথাও কি সুখময় হয়, হয় হয়তো। ধারা বোবার ন্যায় কিছুসময় চেয়ে রইলো। তার ক্রোধ, রাগ সব যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। প্রিন্স উইলিয়ামের সেই মাদকতা দৃষ্টি তাকে নিঃস্ব করে তুলছে ক্রমশ। অনুভূতি গুলো ভোঁতা হচ্ছে, ধারার মনে হচ্ছে সে কোনো প্রবল ঘোরে বাঁধা পড়েছে। এই ঘোরের নাম জানা নেই, তবে অনলঘোর দিলে হয়তো মন্দ হবে না। অনল আরোও একটু ঝুঁকে এলো। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আঁছড়ে পড়ছে ধারার শুভ্র মুখে। রুক্ষ্ণ বিশাল হাতটি আলতো করে ছুলো তার মুখশ্রী। অসমৃণ আঙ্গুলে ঢগা বিচরণ করছে তার গালে। ঘোরলাগা কন্ঠে বললো,
“কি হলো, বললি না! কেমন রোমান্টিক বর চাই?”
ধারা এখনো নিশ্চুপ। তার শব্দগুলো যেনো সমীরে ভাসছে। হাত বাড়ালেও খুঁজে পাচ্ছে না। আবেশে আবেশিত ধারার গালজোড়া উষ্ণ হয়ে উঠলো মূহুর্তেই। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো মাত্রাতিরিক্ত। চোখে জড়ো হলো এক রাশ লজ্জা। অনলের মাদকতা মেশানো দৃষ্টিতে উঁকি দিচ্ছে কিছু নিষিদ্ধ অভিপ্রায়। সাথে সাথেই ধারা নামিয়ে নিলো দৃষ্টি। পা জোড়া আঁকড়ে ধরলো মেঝে। হাতটা ওড়নার কোনা নিজের মুঠোবন্দি করলো। অনল তার কিশোরী বউ কে দেখছে ঘোরলাগা চোখে। তার দৃষ্টি এসে ঠেকলো ধারার ঈষৎ কম্পনরত গোলাপের ন্যায় ঠোঁটজোড়াতে। ঠোঁটের হাসিখানা বিস্তারিত হলো। বিনা সংকোচে আরোও একটু কাছে এলো সে৷ তাদের মাঝের দূরত্ব নেই এর সমতূল্য। অনল ধারার কানে ঠেকালো মুখ। ফিসফিসিয়ে বললো,
“আমি রোমান্টিক রুপ নিলে সইতে পারবি তো? একটু কাছে আসতেই তো মোমের মতো গলে যাস। লজ্জাবতীর মতো নুয়ে যাস। ভেজা গোলাপের মতো কাঁপিস। আমার অবাধ্য ইচ্ছের জোয়ার সামলাতে পারবি?”
“অসভ্য”
অস্পষ্ট স্বরে কোনোমতে কথাটা মুখ থেকে বের হলো ধারার। লজ্জায় আরোও নুয়ে গেলো সে। অনলের এমন আচারণ যেনো অসহনীয় হয়ে উঠলো। ছোট বক্ষপিঞ্জরটার মাঝে দামাদোল শুরু হয়েছে সেই কখন থেকে। অথচ এই মানুষটির কোনো লজ্জা নেই, নির্লজ্জের মতো কথাগুলো বলছে। ধারা চট করেই খানিকটা সরে যেতে নিলো। কিন্তু সেটা আর হলো না। কারণ লোকটা তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। বাঁকা হাসি হেসে বললো,
“পালাচ্ছিস কেনো? ভয় পাচ্ছিস?”
“ভয় পাবো কেনো? তোমাকে ভয় পাবার কি আছে! বা’ঘ না ভা’ল্লু’ক তুমি?”
ধারা আড়ষ্ট কন্ঠে কথাটা বললো। কিন্তু তাতে থামলো না অনল। বরং তার কোমড়খানা শক্ত বাহুর বেস্টনীতে আবদ্ধ করলো নিবিড় ভাবে। ঝুকে এলো ধারার ঈষৎ কম্পনরত ঠোঁটের দিকে। অনলের মনোবাঞ্ছার আবেশ পেতেই চোখ বুজে নিলো ধারা। এই প্রথম তারা এতো কাছাকাছি। ধারার মনে হলো সময়টা থমকে গেছে। ঘরের নিস্তদ্ধতা বাড়লো। বাহিরের মেঘের ঘর্ষণ ক্ষীন শোনা যাচ্ছে। হয়তো আবারো বৃষ্টি হবে। অনল তার কিশোরী বউ এর উন্মুখ হওয়া মুখশ্রী দেখে নিঃশব্দে হাসলো সে। তারপর সটান হয়ে দাঁড়িয়ে ধারার মাথায় আলতো গা’ট্টা মেরে দূরে সরে গেলো অনল। নির্লিপ্ত ভরাট কন্ঠে বললো,
“মাথাটা ভর্তি নষ্ট চিন্তা! যা, অংক করতে বয়। আজ বাদে কাল পরীক্ষা উনি এসেছে রোমান্টিক বর খুঁজতে”
অনলের কথা শুনতেই বিস্মিত হলো ধারা। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো অনল তার থেকে দূরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। এতো সময়ের সকল অনুভূতিগুলো যেনো দুম করেই উড়ে গেলো। বুঝতে বাকি রইলো না অনল তার সাথে মজা করছিলো। অনলের এমন কার্যে পূর্বের রাগটা যেনো দ্বিগুন মাত্রায় বাড়লো। কিন্তু লজ্জার কারণে সেটা প্রকাশ করতে পারলো না। অগ্নিদৃষ্টিতে যদি কাউকে পো’ড়া’নো যেতো তাহলে হয়তো অনলকে দৃষ্টিতেই কুপোকাত করতো ধারা। হনহন করে টেবিলের কাছে যেয়ে সজোরে চেয়ারখানা টানলো। ধপ করে বসলো। অনলের সারা সন্ধ্যায় কড়া নোটগুলো চরম বিরক্তি নিয়ে উল্টাতে লাগলো। ধারার রাগী মুখখানা অনলের প্রফুল্লতা বাড়ালো। সে নির্বিকার ভাবে বসলো পাশে। অসহায়ের ভান করে বললো,
“আমার রাগ কাগজের উপর ঝাড়িস না। সে বিকাল থেকে কষ্ট করে বানিয়েছি।”
কথাটার প্রত্যুত্তরে ধারা কেবল জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালো। যার অর্থ, “চুপ না করলে তোমার মাথা ভে’ঙ্গে দিবো”। অনল সন্তপর্ণে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। মনে মনে বলল,
“আমারও কাছে আসতে ইচ্ছে হয়, তোর মাঝে ডুবে যেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু পরমূহুর্তেই নিজেকে সামলে রাখি, আটকে রাখি। তুই যে বড্ড ছোট রে ধারা। আরেকটু বড় হো! আরেকটু!”
তারপর বা হাত দিয়ে আলতো করে ধারার সামনের চুলগুলো সরিয়ে দেয়। তারপর ভরাট গলায় বলে,
“উপহারটা পাওনা থাকলো। সময় হলে ঠিক পাবি। আর এবার যদি সিজি ৩.২৫ এর বেশি উঠাতে পারিস, আমি তোকে ঘুরতে নিয়ে যাবো। সেদিন কুথাচ্ছিলি, তোর হানিমুন হয় নি! সেই ইচ্ছে পূরণ করে দিবো। কথা দিচ্ছি”
কথাটা শুনতেই ধারা ফট করে তাকালো। অবাক কন্ঠে বললো,
“সত্যি?”
“সত্যি, সত্যি, সত্যি”
ধারার মনে হলো একগুচ্ছ গ্যাস বেলুন যেনো উড়ে গেলো তার মনের আকাশে। অনলের উপর জমা সকল মেকি রাগ কর্পুর হয়ে গেলো। তার মুখখানা মূহুর্তেই চকচক করে উঠলো। যেনো ছোট বাচ্চা বহু চাইবার পর তার পছন্দের খেলনাটি পেয়েছে। ফলে আবেগে আত্মহারা হয়ে অনলকে জড়িয়ে ধরলো সে। ধারার এই কাজে যত না অবাক হলো অনল, তার থেকে অবাক হলো যখন ধারার নরম ঠোঁটজোড়া ছুলো তার গাল। নরম ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া পেতেই ঈষৎ নড়ে চড়ে উঠলো অনল। তার মনে হলো মেরুদন্ড বেয়ে যেনো উষ্ণ রক্ত প্রবাহিত হলো। কিন্তু ধারা নির্বিকার৷ তার ঠোঁটে একরাশ মুগ্ধ হাসি। সুন্দর উৎসাহিত মনে তার জায়গায় ফিরে গেলো। দ্বিগুন উৎসাহে পড়তে লাগলো। অথচ অনল এখনো বসে আছে। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে দ্বিগুন, কান হয়ে উঠেছে রক্তিম। নারীর উষ্ণ ছোঁয়া বুঝি এমন ই হয়! আর সেই নারী যদি হয় প্রণয়িনী তবে তো কথাই নেই____________
******
পরীক্ষার রুটিন ঝুলছে করিডোরের দেওয়ালে বাধানো কাঠের ফ্রেমে। পরীক্ষার রুটিন মানেই পরীক্ষা শুরু। যা এই জুনের গরমকে করে তুললো আরোও উত্তপ্ত। এই না কিছুদিন আগে শুরু হলো সেমেস্টার। আর এর মাঝে শেষ ও হয়ে গেলো! ভাবা যায়। সময় তো না এ যেনো কোনো রেলগাড়ি। আড্ডা, গল্প, হাসাহাসির মাঝে একটা বছর কেটে যাচ্ছে। এই সেমেস্টার শেষ হলেই বন্ধুমহল উঠে যাবে সেকেন্ড ইয়ারে। তখন তারাও সিনিয়ার। এভাবেই কেটে যাবে এই ভার্সিটির চারটে বছর। চারটে বছর বাদে থেকে যাবে শুধু কিছু হাসি কান্নার স্মৃতি। বন্ধুমহল তাকিয়ে আছে রুটিনের দিকে। নীরব ব্যাতীত বাকি চারটে মুখ উদাস। তাদের মনে হচ্ছে তারা কিছু পারে না। দিগন্ত বলে উঠলো,
“ক্লাস করাচ্ছে করাক না, এই পরীক্ষা নামক ত’লো”য়া’র গলায় ঝো”লা”নো”র কি আছে রে বাপু!”
“ঠিক। ক্লাস করে যেতাম, কি ভালোই না হতো। এখন পড়া লাগবে। আমি শিওর লিনিয়ার এলজ্যাবরা আর ক্যালকুলাস এ আমি ধরা খাবোই খাবো”
দিগন্তের কথার সাথেই সাথেই অভীক তাল মেলালো। মাহি শুধু তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। এই গণিতের ডিপার্টমেন্টে কেনো ভর্তি হতে গিয়েছে কে জানে। সব যেনো মাথার উপর দিয়ে প্রজেক্টাইল এর মতো উড়ে যায়। এবার সকলে এক সাথে তাকালো নীরবের দিকে। বন্ধুমহলের এই একটা মানুষ ই আছে যা তাদের ডুবন্ত নৌকা বাঁচাতে পারে। নীরব সকলের চাহনী দেখে হতাশ কন্ঠে বললো,
“নোট পেয়ে যাবি কান্দিস না”
“তুমি এতো ভালো কেনো বন্ধু?”
অভীক তার গলা জড়িয়ে বললো। এর মাঝেই তারা শুনতে পেলো কেউ ক্ষীণ কন্ঠে ডাকছে ধারাকে। মাহি এদিক ওদিক চেয়ে বলল,
“ধারা, তোকে ওই অদ্ভুত লোকটা ডাকছে”
কথাটা শুনতেই মাহির দেখানো দিক অনুসরণ করে তাকায় ধারা। স্বয়ংক্রিয় ভাবেই তার মুখ হা হয়ে যায়। অস্পষ্ট স্বরে বলে,
“এই ব্যাটা এখানে কেনো?”
বিল্ডিং এর ঠিক বাহিরে উৎসাহিত মনে দাঁড়িয়ে আছে দীপ্ত। তাকে দেখে স্বভাবতই অবাক হলো ধারা। লোকটির এখানে আসার কথা নয়। শুধু তাই নয়, ধারা তার সাথে পারতে কথা বলে না। সুতরাং তার ভার্সিটির ঠিকানাও লোকটির জানার কথা নয়। ধারাকে দেখতে পেয়ে অতিউৎসাহী মানব হাত উঁচিয়ে ইশারা করছে, শুধু তাই নয় তাকে সজোরে ডাকছেও। ফলে পথযাত্রী শিক্ষার্থী যারা ধারাকে চিনে তারা অবাক নয়নে ধারার দিকে তাকাচ্ছে। ব্যাপারটা লজ্জাজনক। তাই আর না পেরে এগিয়ে যায় ধারা। বন্ধুমহল সাথে যায়। দীপ্তের কাছে যেতেই কাঠ কাঠ গলায় প্রশ্ন ছুড়ে,
“আপনি এখানে কি করছেন?”
“তুমি তো আমাকে সময় দিবে না, তাই ভাবলাম আমি নিজেই তোমার সময়ে ঢুকে পড়ি”
দীপ্তের কথায় ভ্রু কুঞ্চিত হয় ধারার। এক রাশ বিরক্তি মুখে ভেসে উঠে। লোকটি অতি গায়ে পড়া স্বভাব অসহনীয়। এর মাঝেই দিগন্ত প্রশ্ন করে,
“আপনি কে হন?”
“ওহ, লেট মি ইন্ট্রোডিউজ মাইসেল্ফ। আমি দীপ্ত। ধারার…”
“আমাদের অতিথি হন”
দীপ্তের কথা শেষ না হতেই ধারা কথাটা বলে। দীপ্ত ও থেমে যায়। অমলিন হাসি হেসে বলে,
“ইয়াপ”
বন্ধুমহলের সাথে পরিচিত হতে সময় নেয় না দীপ্ত। দীপ্তের মিশুক স্বভাবের কারণে তারাও বেশ ভালো ভাবেই দীপ্তের সাথে আচারণ করে। তবে ব্যাপারটা সহ্য হলো না ধারার। সে বললো,
“দীপ্ত ভাই, আপনি বরং বাড়ি যান। সামনে পরীক্ষা তো নোট গুছিয়ে আমি বাড়ি যাবো”
“দিস ইজ আনফেয়ার। বাসায় তুমি ব্যাস্ততা, পড়াশোনার বাহানা দিয়ে এড়িয়ে যাও। আমি ভাবলাম অন্তত এখন তুমি আমাকে সময় দিবে। এখনো তাই করছো। বিয়ে হয়েছে বলে কি ফ্রেন্ডশিপ করা যাবে না?”
বিয়ে কথাটা বিশাল বজ্রপাতের ন্যায় বন্ধুমহলের মাথায় পড়লো। ধারার এতোদিনের সুপ্ত ঘটনাটা এতো নিপুনভাবে ফাঁস হবে কে জানতো! সকলের মুখে বিস্ময়। নিজেদের বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গেছে ব্যাপারটা কেনো মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে ঘর্ষণ তৈরি করেছে। দিগন্তের মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ভার্সিটির প্রথম ভালোলাগার মানুষটির বিয়ে টা যেনো হজম হচ্ছে না। অভীক অবাক কন্ঠে বলল,
“বিয়ে? ধারার?”
“হ্যা, তোমরা জানো না? ধারা বলে নি”
নিজের মিথ্যের হাড়ি সকলের সামনে এভাবে ভেঙ্গে যাবে মোটেই কল্পনা করে নি ধারা। সে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। বুঝতে পারলো দীপ্ত তার বিয়ের কথাটা সম্পূর্ণ বলে দিবে। এবং হলো, দীপ্ত বলতে লাগলো,
“ধারা তো বিবাহিত। ইভেন ওর বরকেও তোমরা চিনো”
বরের নামটি সেই মুখে আনবে। অমনি ধারা তার মুখ চেপে ধরলো। চোখ গরম করে বলল,
“আপনার না শরীর খারাপ, এতো কথা বলাটা ঠিক নয়”
বলেই তাকে টেনে হিচড়ে বেশ দূরে নিয়ে আসে। বন্ধুমহল তখনও নিস্তব্ধ। ধারা এতো বড় খবরটা চেপে গেলো। সাথে সাথেই অভীক তাকালো মাহির দিকে। হিনহিনে কন্ঠে বললো,
“মাহি চু’ন্নী, তুই জানতি তাই না?”
মাহি শুকনো ঢোক গিললো। হ্যা, সে জানতো। কিন্তু এখন স্বীকার গেলে এই হিং’স্র প্রা”ণী তাকে আস্তো রাখবে না। অভীকের প্রশ্নে একই সাথে তাকালো দিগন্ত এবং নীরব। মাহি চট করে নিজের ভোল পাল্টালো। অবাক, বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“আমিও তো অবাক, এটা তো একটা ব্রান্ড নিউ ইনফরমেশন। ধারা আমাকেও বলে নি। ব্যাপারটা গোপনীয় হয়তো”
অভিনয় কতটুকু কাজে দিলো জানা নেই। তবে বন্ধুদের তীর্যক শ’কু’নী নজরটা একটু শান্ত হলো।
এদিকে ধারা ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠলো,
“আপনার সমস্যা কি? ওখানে বাজে কথা বলছিলেন কেনো?”
ধারা দীপ্তকে এভাবে টেনে আনবে ব্যাপারটা আকস্মিক ছিলো দীপ্তের কাছে। কিন্তু প্রকাশ করলো না। উলটো বাঁকা হেসে বললো,
“তুমি তোমার বিয়ের কথা ওদের ও জানাও নি”
“আমার বিয়ে, আমার ইচ্ছে। কাকে জানাবো না জানাবো সেটার কৈফিয়ত আপনাকে দিতে হবে?”
“একেবারেই না। তবে মুখটা তো আমার। তাই আমার ইচ্ছে, আমার মুখে কি কথা বের হবে না হবে সেটার কৈফিয়ত ও তোমাকে দিবো না। তবে একটা শর্তে ব্যাপারটা গোপন করে ফেলতে পারি। ওয়ান কন্ডিশন”
ধারার বিরক্তি বাড়লো। সাথে রাগে মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। তার মনে হলো তার শরীর রাগে জ্ব’ল’ছে। নির্লজ্জ লোকটিকে মে’রে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু প্রবাদ আছে “হাতি যখন কাঁদায় পড়ে, চামচিকাও লা’থি মারে”। সেই অনুভূতিটুকুই হচ্ছে ধারার। সে চায় না অনল এবং তার বিয়েটা এখন ই সবাই জানুক। অহেতুক কথায় কথা বাড়বে, উপরন্তু অনল তাদের ক্লাস ও নেই। এই ভার্সিটির নিয়ম, যদি টিচারের ফ্যামিলি ম্যাম্বার ক্লাসে থাকে তবে সেই ক্লাসটির কোর্স টিচার হওয়া যায় না। কিন্তু অনল তাদের কোর্স টিচার। ফলে ব্যাপারটা নিয়ে অহেতুক জলঘোলা হবে। সব ভেবেই দীপ্তকে মা’রা’র পরিকল্পনা ছেড়ে দিলো ধারা। মুখ গোল করে নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। তারপর বলল,
” কি শর্ত?”
ধারাকে বাগে পেয়ে দূর্বোধ্য হাসি হাসলো দীপ্ত। এতোদিনের মনোকামনা তবে পূরণ হলো________
ব্যস্ত শহরের উত্তপ্ত, ভাপ উড়ানো দিনকে নিমিষেই শীতল করে দিলো এক পশলা বৃষ্টি। পিচের রাস্তায় জমলো কর্দমাক্ত পানি। বৃষ্টির কারণে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়ালো। ব্যস্ত শহরের উত্তপ্ত দিনকে ইতি টেনে নেমে এলো শীতল, ঘুটঘুটে সন্ধ্যে। দীপ্তের শর্ত অনুযায়ী তাকে ঢাকা ঘোরালো ধারা। উপায় নেই বলে এই বিরক্তিকর মানুষটির সাথে বিকাল কাটালো সে। তার আজব আজব কৌতুহলের উত্তর দিতে হলো তাকে। মাঝে ইচ্ছে হয়েছিলো বটে, ঝাকড়া চুলগুলো টে’নে ছি’ড়ে ফেলতে। কিন্তু নিজেকে সংযম রাখলো। সন্ধ্যা নামার আগেই ফিরতো। কিন্তু বৃষ্টির জন্য আটকে পড়লো তারা। ফলে বাড়ির কালো কেঁচি গেটে যখন পৌছালো তখন বাজে রাত আটটা। কেঁচি গেট থেকে ঢুকতেই মুখোমুখি হলো শক্ত কঠিন মানবের। রক্তচক্ষু নিয়ে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে অনল। অনলের কঠিন মুখের দিকে তাকাতেই শুকনো ঢোক গিললো ধারা। অনল কোনো প্রশ্ন করলো না, শুধু ক্রোধাগ্নি ছুড়লো দৃষ্টি দিয়ে। দীপ্ত নির্বিকার। অনলের রক্তিম দৃষ্টি তাকে নড়ালো না। বরং হেসে বললো,
“ধারা ধন্যবাদ, আজকের দিনটা সারাজীবন মনে থাকবে”
ধারা উত্তর দিলো না। তার বদলে অনল বরফ শীতল কন্ঠে বললো,
“ধারা, ড্রেস চেঞ্জ করে পড়তে বয় যা”
ধারা মাথা নিচু করে বাড়িতে ঢুকে পড়লো। দীপ্তও তার পিছু পিছু ঢুকতে গেলে বাধা দিলো অনল৷ দীপ্ত চোখে বিস্ময় নিয়ে তাকালে অনল বললো,
“আপনার সাথে কথা আছে”
“বলুন”
দীপ্ত শান্ত গলায় বললো। অনল তার মুখোমুখি অথচ তার মাঝে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। অনল একটু সময় নিয়ে বললো,
“আপনি যে মিথ্যে কথা বলে এখানে ঢুকেছেন কেউ না জানুক আমি জানি। ওই ছিনতাই এর কথাটা সম্পূর্ণ বানোয়াট ছিলো। একটা মুভির লাইন টু লাইন কপি। বাড়ির সবাই বিশ্বাস করলেও আমি কিন্তু করি নি। কারণ মিথ্যের লংকায় একটা সত্যের আগুন ই যথেষ্ট। আপনার সব চুরি হলো, দামি ঘড়িটা থেকে গেলো অদ্ভুত না? যাই হোক, আমি বাধা দেই নি কারণ আপনি দাদাজানের চিকিৎসা করেছিলেন। তবে আপনার মতলব যে খুব সুবিধার নয় সেটা আমি জানি। আজ লুকোচুরি ছেড়ে সরাসরি জানতে চাচ্ছি, কি মতলবে এসেছেন আপনি?…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি