#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২১তম_পর্ব
মাহির কথাটা শেষ না হতেই দিগন্তের আগমণ ঘটলো। ছুটে এসে বলল,
“কুইজ ক্যান্সেল, অনল স্যারের শরীর খারাপ”
কথাটা কর্ণপাত হতেই থমকে গেলো ধারা। শরীর খারাপ, কিন্তু কেনো! আজ সকাল অবধি তো দিব্যি সে ফিটবাবুটি সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো, তাহলে এই সামান্য সময়ে কি এমন হলো! অনলের অসুস্থতা শুনতেই ধারার ভেতরের সকল রাগ, ক্রোধ, অভিমান বিগলিত হতে লাগলো। বরং উদ্বিগ্নতা তৈরি হলো অনলের জন্য। এক অসামান্য হাহাকার তৈরি হলো অন্তস্থলে। চিনচিনে তীক্ষ্ণ ব্যাথা ছেয়ে গেলো হৃদয়ে। অস্থিরতা মস্তিষ্ককে গ্রাস করলো। অস্থির কন্ঠে বললো,
“কি হয়েছে তার?”
“সেভাবে তো জানি না, তবে যা জানি তা হলো তাকে ধরে টরে মেডিক্যালে নিয়ে গেছে। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছেন হয়তো সিড়ি থেকে”
দিগন্ত নির্লিপ্ত স্বরে কথাটা বলেই চেয়ার টেনে বসলো। কিন্তু শেষ কথাটায় বুক কাঁপলো ধারার। কেমন আছে সে! মাহি ধারার দিকে তাকালো। তাকে রক্তশূন্য লাগছে। মেয়েটি হয়তো ভেতরে ভেতরে বেশ চিন্তিত। কিন্তু দিগন্তের সামনে তা প্রকাশ করতে পারছে না। প্রকাশ করাটা বুদ্ধিমানেরও হবে না। তাই ফন্দি আঁটলো মাহি। ধারাকে বললো,
“যেহেতু কুইজ হচ্ছে না, চল ধারা অনল ভাই কে দেখে আসি”
“কেনো কেনো? তোদের যেতে হবে কেনো? সামান্য মাথা ঘুরে পড়েছে। এতে এতো আদিক্ষেতা কেনো?”
সাথে সাথেই দিগন্ত বাঁধ সাধলো। মাহিও কম নয়, উলটো চোখ গরম করে বললো,
“কেনো রে! মানবিকতা থাকতে নেই নাকি! স্যার আমাদের সে। হুট করে মাথা ঘুরে সিড়ি থেকে পড়ে গেছেন, ব্যাপারটা ভয়ংকর। কেমন আছেন জানবো না? আর ভুলে যাস না সে ধারার আপন জন, চল তো ধারা। এই পা’গ’লে’র কথা শুনে লাভ নেই”
“হ্যা, হ্যা। আমি পা’গ’ল, আর তুই কি! চু’ন্নী মাহি। আমি বুঝি না তাই না? তোর মতলব তো অন্যখানে, আর ধারাকে বানাচ্ছিস ঢাল”
“খুব বুঝছো তুমি! এবার অফ যেয়ে আমাদের ধন্য করো”
“তুই অফ যা”
এক কথায় দু কথায় ঝগড়া লাগলো মাহি এবং দিগন্তের। এই দুজনের জন্য এটা নতুন কিছু না। সর্বদা এদের মাঝে কিছু একটা নিয়ে ঝামেলা চলবেই। দিগন্ত উত্তর বললে, মাহি দক্ষিণ বলবে। মাহি কোনো কথা বললেই সেখানে ভেটো দিবে দিগন্ত। আর দিগন্তের কথা একেবারেই সহ্য হবে না মাহির। তখনই লাগে তৃতীয় বি’শ্ব’যু’দ্ধ। আর সেই যু’দ্ধে আ’হ’ত হয় ধারা, নীরব এবং অভীক। আজও তাই হচ্ছে। ধারার মেজাজ বিগড়ে গেলো। একেই অনল ভাই এর চিন্তায় বুক কাঁপছে, ভেতরটা অস্থিরতায় অশান্ত হয়ে আছে। এর মাঝে এই দুটো মানব মানবী নিজের তর্কযুদ্ধ করছে। একটা সময় তীব্র স্বরে বলে উঠলো,
“থাম না তোরা, একটা মানুষ অসুস্থ আর এদিকে তোরা ঝগড়া করছিস! এমন কেনো রে তোরা?”
“আমাকে বকছিস কেনো! এই মা’থা’মো’টা দিগন্ত ই তো আমার সাথে তর্ক জুড়লো, তুই বরং উঠ। আমরা অনল ভাইকে দেখে আসি”
ধারা মাথা নাড়লো। তার পক্ষে বসে থাকাটা অসহনীয় লাগছে। সে দেরি করলো না, বই খাতা বন্ধ করে মাহির সাথে বেড়িয়ে গেলো। দিগন্তের কাছে ব্যাপারটা বড্ড অটপটে লাগলো। যে তীক্ষ্ম দৃষ্টির তাকিয়ে রইলো ধারা এবং মাহির যাবার পানে। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
“যত দোষ নন্দঘোষ”
ভার্সিটির মেডিক্যাল সেন্টারটি পশ্চিম দিকে বড় মসজিদের পাশে। লাইব্রেরি থেকে যেতে পনেরো মিনিট লাগে। সেই দূরত্বটি ধারা এবং মাহি দশ মিনিটে পার করলো। মাহির মনে হলো ধারার পায়ে যেনো কেউ রোলারস্কেটের চাকা লাগিয়েছে। সে হাটছে না ছুটছে। তার সাথে তাল মিলাতে যেয়ে হাঁফসে উঠলো মাহি। মেডিক্যাল সেন্টারে যেয়ে সামনের ডেস্কে বসা মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করতেই সে রুম দেখিয়ে দিলো। রুমের সামনে যেতেই প্লাবণের দেখা পেলো ধারা। প্লাবণের দেখা পেতেই হন্তদন্ত হয়ে বললো,
“অনলভাই কেমন আছে?”
প্লাবণ মৃদু হাসলো। তারপর মজার ছলে বললো,
“বরের প্রতি কি টান! তা এতই যখন টান ওড়নায় বেঁধে রাখো না কেনো?”
“মজা বাদ দাও প্লাবণ ভাই। ভালো লাগছে না। সে কেমন আছে তাই বলে উদ্ধার করো তো!”
“ভেতরে যেয়েই দেখো না, আর শোন মান অভিমানটা মিটিয়ে নিও”
প্লাবণের শেষ উক্তির উত্তর দিলো না ধারা। হনহন করে ছুটলো ভেতরে। এদিকে মাহি বাহিরেই দাঁড়িয়ে থাকলো। পাহারা দেবারো একটা ব্যাপার থাকে। হুট করে কেউ চলে এলে ধারাকে সংকেত দিতে হবে তো! প্লাবণ হেসে শুধালো,
“তুমি যাবে না?”
“স্বামী স্ত্রীর মাঝে আমার কি কাজ? বরং বান্ধবীর প্রেমে যাতে বাধা না পরে সেই ব্যাবস্থা করি”
“সহমত প্রকাশ করলাম। আমারো সেই একই কাজ”
বলেই প্লাবণ হেসে দিলো। মাহির মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা গেলো অনলকে শুভ্র, ছোট বিছানায় আধশোয়া অবস্থায়। বালিশটায় হেলান দিয়ে বা হাতখানা চোখের উপর দিয়ে শুয়ে রয়েছে সে। তার বা পায়ের গোড়ালির দিয়ে সফেদ ব্যান্ডেজ দেখা যাচ্ছে। ধারা ধীর পায়ে এগিয়ে বিছানার পাশে দাঁড়ালো। ধীর স্বরে বললো,
“কিভাবে হলো?”
ধারার চিকন কন্ঠ কর্ণপাত হতেই হাত সরিয়ে চোখ মেলে তাকালো অনল। নড়ে চড়ে উঠলো সে। কিভাবে হলো সে নিজেও জানে না। বাড়ি থেকে রওনা দেবার মাঝপথেই অঝোর বর্ষণের প্রকোপে পড়তে হলো তাকে। ছাতাও ছিলো না সাথে, বাইকের উন্মুক্ত থাকায় আপাদমস্তক কাকভেজা হলো সে। বৃষ্টির ধারা বাড়ার সাথেই সাথেই মাথায় এলো ধারারাণীকে বাসায় ফেলেই চলে এসেছে। আর তাদের গলির চিরন্তন নিয়ম, একটু বৃষ্টি হলেই আশেপাশের সকল রিক্সা যেনো গায়েব হয়ে যায়। অবশ্য হবে না কেনো একটু বৃষ্টিতেই তো তাদের রোড পানিতে টুইটুম্বর হয়ে উঠে। তাই এই অঝর ধারায় ধারারানীর জন্য রিক্সা খুঁজতে ব্যাকুল হয়ে উঠলো অনল। এদিকে নিজে ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই। বহু খোঁজার পর এক যুবকের রিক্সা পেলো সে। তাকে একশত টাকার নোট ধরিয়ে বললো,
“রহমত পাড়া চেনো? বা দিয়ে ঢুকে ডানে!”
“জ্বী চিনি”
“ওখানে ঢুকে একদম শেষে কালো কেঁচি গেটে দেখবে একটি মেয়ে দাঁড়ানো। ও যেখানে যাবে নিয়ে যেও”
“ভাড়া নিমু?”
“হ্যা, নিবে। কিন্তু আমি ঠিক করে দিয়েছি সেটা প্রকাশ করবে না। আর এই টাকাটা রেখে দাও”
যুবকের চোখ চকচক করে উঠলো। এই অক্লান্ত বৃষ্টিতে ফ্রি কাস্টোমারের সাথে একশত টাকা পেলে যে কারোর ই মন ভাল হয়ে যায়। যুবক উৎফুল্ল মনে অনলের বলা জায়গায় গেলো। অনল ও পিছু পিছু বাইক চালিয়ে গেলো। কিন্তু সামনে এলো না। লুকিয়ে থাকলো দু বাড়ি পেছনে। সে যা আন্দাজ করেছিলো তাই হয়েছে, ধারা মুখ লম্বা করে দাঁড়িয়ে আছে। রিক্সাটি তাকে যাবার কথা বলতেই সে উঠে পড়লো৷ রিক্সাটি যাওয়া অবধি অপেক্ষা করলো সে। যতই মান অভিমান চলুক নিজের বউকে তো বৃষ্টিতে ভিজতে দেওয়া যায় না। রিক্সা যাবার পর অনল ও রওনা দিলো ভার্সিটির দিকে। ভার্সিটিতে যখন পৌছালো তখন তার অবস্থা সুনামির সময় নদী পথে আটকে পড়া মাঝির ন্যায়। ভাগ্যিস নিজ রুমে এক্সট্রা এক জোড়া শার্ট, প্যান্ট ছিলো। তাড়াতাড়ি ভেজা কাপড় বদলে নিলেও ঠান্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচলো না। দুটো ক্লাস করার পর ই প্রবল মাথা ব্যাথা, সারা গায়ে অসহনীয় উত্তাপ। কড়া লাল চা পানির মতো পাঁচ ছ বার খেয়েও যেনো রেহাই হলো না। সিড়ি দিয়ে যখন নামছিলো তখন মনে হলো দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে। শরীরের উত্তাপ যেনো দুটো চোখে এসে জমেছে। চোখ জোড়া যেনো হয়ে উঠেছে জ্বলন্ত কয়লা। রক্তিম চোখজোড়া ডান হাত দিয়ে ঘষলো অনল। কিন্তু লাভ হলো না। মাথাটা ভার হয়ে এসেছে। ফলে সিড়ি থেকে নামতে গিয়ে একটা সিড়ি অজান্তেই বাদ পড়ে গেলো। টাল সামলাতে না পাড়ায় অনল যেয়ে পড়লো একেবারে তিনসিড়ি পর। ওখানে উপস্থিত ছাত্ররা তাকে টেনে টুললো। উঠতেই টের পেলো পা টা মচকেছে। কোনো মতে ধরে তাকে মেডিক্যাল সেন্টারে নিয়ে আসা হলো। উপস্থিত ডাক্তার কপালে হাত দিতেই বললেন,
“আপনার তো জ্বর, গা পুড়ে যাচ্ছে! ঔষধ খান নি?”
“জ্বরটা হুট করে হলো মনে হচ্ছে, টের পাই নি”
“বৃষ্টিতে ভিজেছিলেন?”
“অসময়ের বৃষ্টি, ভিজতে না চাইলেও ভেজা হয়”
“বুঝেছি, ঔষধ দিচ্ছি। আর পা টা ভোগাবে দু একদিন। ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি, সিরিয়াস না তেমন”
অনল শুধু মাথাই দোলালো। অনলের সিড়ি থেকে পড়ে যাবার কথা কানে আসতেই প্লাবন ছুটে এলো। বন্ধুকে এই প্রথম এতোটা অসাবধান এবং দায়িত্বহীন দেখলো প্লাবণ। এদিকে অনলের এই পড়ে যাওয়ার কাহিনী আগুনের মতো ছড়িয়ে গেলো। কৃতিত্বটি দিগন্তকে দেওয়াই যায়। কারণ সেই সময় সে উপস্থিত ছিলো ঘটনাস্থলে। তবে অনলকে সাহায্য করার থেকে তথ্যটা ছড়ানো বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। যাকে অপছন্দের সারিতে রাখা হয় তাকে সাহায্য করার নীতি দিগন্ত রাখে না। অবশ্য তাতে লাভ একটা হলো, ধারা শোনামাত্র ছুটে এলো।
অনল এখনো নিশ্চুপ। ধারা এখনো অপেক্ষা করছে উত্তরের। কিন্তু উত্তরটি পাওয়া হলো না। অনল অন্য দিকে তাকিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়েছে। ধারা মুখ গোল করে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর এগিয়ে এসে অনলের পাশে বসলো। ডানহাতটা আলতোভাবে তার কপালে রাখলো। তাপমাত্রা মাপলে পারদের থার্মোমিটারে ১০২ তো হবেই।এবার কোমল কন্ঠে বললো,
“তুমি জানো তোমার ঠান্ডার ধাঁচ আছে তাহলে কেনো বৃষ্টিতে ভিজলে?”
“শখে কি কেউ ভিজে?”
অবশেষে মুখ খুললো অনল। ধারা আর কিছু বললো না। কারণ কিছু বললেও সোজা উত্তর মিলবে না। হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে নিস্প্রভ কন্ঠে বললো,
“তুমি অসুস্থ হলে আমার উদ্বিগ্নতা বাড়ে। তাই দয়া করে অসুস্থ হয়ো না। যখন কানে এলো তুমি পড়ে গেছো, মাথায় অনেক অনর্থক চিন্তা এসেছিলো। এখন হয়তো এটা তোমার কাছে আবেগের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। তবে আমি জানি আমার ভেতরে কি চলছিলো!”
অনল অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ধারার দিকে। ধারার ব্যাথিত চোখজোড়া তাকেও ব্যাথা দিচ্ছে যেনো। কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলো! বুকের ভেতর জমা কথাগুলো দলা পেঁচিয়ে অন্তস্থলেই রয়ে গেলো________
******
প্লাবণের সহায়তায় অনলকে নিয়ে বাসায় ফিরলো ধারা। অনলের বাইকটি বাড়ি অবধি পৌছে দিলো অফিসের পিয়ন পিয়াস। বাড়িতে আসতেই দেখলো সদর দরজায় কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে জমজ বি’চ্ছু। অনল অবাক কন্ঠে শুধালো,
“এবার তোরা কি করেছিস?”
অনলের প্রশ্নে এশা হতাশ কন্ঠে বললো,
“আমরা সত্যি নিরপরাধ, অস্ট্রেলিয়ান চেরাগআলী আমাদের বিনা অপরাধে ফাঁসিয়েছে। আর আমাদের নির্দয় মা, আমাদের শাস্তি দিচ্ছে।
অনলের বুঝতে বাকি রইলো না তার প্রখ্যাত বোনেরা কিছু একটা কান্ড তো করেছে। নয়তো ছোট চাচীর শাস্তি দেবার কথা নয়। আসলে তখনের গোবরকান্ড ফাঁস হয়েছে। রোগাপটকা লোকটা ছিলো এশা আশার তৃতীয় শিক্ষক, যিনি তাদের সুনাম পুরো মহল্লায় ছড়িয়েছে। তাই তার উপর শোধ তুলতেই সেই কাজ করেছিলো তারা। কিন্তু দীপ্তের কারণে ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে গেছে। লোকটি চেঁচামেচি করায় বাসায় মানুষ ও জড়ো হয়। ফলে সবাই জেনে যায় মুল ঘটনা। সেকারণেই রুবি দুটোকে সদর দরজায় কান ধরে দাঁড় করে রেখেছে। অনল বা ধারা পাত্তা দিলো না এশা আশার উপর। এদিকে অনলের পায়ের ব্যান্ডেজ দেখেই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন সুভাসিনী বেগম। হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হলো তারা। মনে হলো কোনো ইন্টারোগেশন রুমে বসে আছে। সুভাসিনী বেগম বুলেটের মতো প্রশ্ন করছে, “কিভাবে হলো?” “কেনো হলো?” “জ্বর বাঁধালো কেনো?” “যখন শরীর খারাপ ছিলো বাড়ি ফিরে এলো না কেনো?”। অনল ধারা যেনো হাফসিয়ে উঠলো। শেষমেশ না পেড়ে অনল
বলেই উঠলো,
“মা, এবার থামো। ভুল হয়ে গেছে পা মচকালাম, এবার ক্ষান্ত হও। আর এই বাঁ’দ’র দুটোকে ভেতরে ঢোকাও। লাগছে কেমন? যেনো চিড়িয়াখানা থেকে উঠে আসা হ’নু’মা’ন”
অবশেষে ক্ষান্ত হলেন সুভাসিনী বেগম এবং অনলের জন্য এশা আশাও ঘরে প্রবেশ করতে পারলো। ধারা কোনোমতে অনলকে নিজ রুমে নিয়ে গেলো। তবে একটা ব্যাপার খেয়াল করলো, দীপ্ত নামক আগুন্তককে দেখা যাচ্ছে না। তবে ব্যাপারটা তাকে আনন্দ ই দিলো। যাক ব্যাটা হয়তো ভেগেছে। কিন্তু ধারা তো জানে না, সে গোবরকান্ডে এতোটাই ভয় পেয়েছে যে ঘর থেকেই বের হচ্ছে না। বলা তো যায় না, আবার কোন পরিস্থিতিতে তাকে ফাঁসিয়ে দেয় তারা।
*****
নিগুঢ় রাত, নিস্তব্ধতা ঘিরে আছে ঘরটিতে। শুধু পুরোনো ফ্যানের ক্যাচর ক্যাচর শব্দ কানে আসছে। বাহিরে প্রবল আষাঢ়িয়া বর্ষণ। ঝমঝম বৃষ্টির মধুর শব্দ ক্ষীন ঢুকছে ঘরটিতে। কিন্তু ফ্যানের শব্দে তা হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। কাঠের জানালার ফাঁক দিয়ে দিয়ে পানির ছিটে আসছে। জানালাটা ঠিক করবে করবে করেও করা হচ্ছে না। এদিকে কাঁথা গলা অবধি টেনে ঘুমিয়ে আছে ধারা। বৃষ্টির কারণে অসহনীয় গরমটা আর লাগছে না। হঠাৎ চাপা আর্তনাদ ভেসে আসলো কানে। পাতলা ঘুমটা নিমিষেই চুরমার হয়ে গেলো। উঠে বসলো সে। হাতের কাছের ল্যাম্পটি জ্বালালো। পাশে তাকাতেই দেখলো কাঁপছে অনল। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধারার ডান হাত চলে গেলো তার কপালে। উত্তাপে শরীর পুড়ে যাচ্ছে যেনো। খাবার আগেও জ্বরটা ছিলো বললেই চলে। ঔষধ ও দিয়েছিলো সে অনলকে। তবুও আবারো কেনো জ্বর এলো বুঝলো না। উঠে গিয়ে ঔষদের বাক্সটা হাতে নিলো সে। পারদের থার্মোমিটার দিয়ে মাপলো জ্বরটা। পারদের মাত্রা ১০৪ ছুই ছুই। অনলকে মৃদু স্বরে ডাকলো, কিন্তু কোনো সাড়া পেলো না। জ্বরের কারণে প্রবল ঘোরে যেনো ডুবে আসে সে। ধারা দেয়ালের ঝুলন্ত ঘড়ির দিকে তাকালো। তিনটে ছুই ছুই। এই সময় বাড়ির প্রতিটি প্রানী গভীর ঘুমে। সুতরাং কাউকে ডেকে লাভ নেই। যা করার নিজেকেই করতে হবে। কোনো মতে অনলকে ডাকলো সে। অস্পষ্ট স্বরে অনল বললো,
“হু”
ধারা গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। কোনো মতে পাহাড় সম মানুষটাকে তুললো সে। পেছনে বালিশ ঠেকিয়ে বসালো। দুটো প্যারাসিটামল খাওয়ালো কোনো মতে। ঘোরের মাঝে অনল তা খেলো ও। তারপর আবার তাকে সটান শোয়ালো। অনলকে উঠাতে আর শোয়াতে যেনো হাঁপিয়ে উঠলো ধারা। মানুষটির এতো ভার কল্পনাও করে নি। মুখ গোল করে নিঃশ্বাস ছাঁড়লো সে। তারপর কাঁথাটা টেনে দিলো অনলের গলা অবধি। ফ্যান বন্ধ করে দিলো, যেনো ঠান্ডা না লাগে। ঠান্ডা পানির একটা মগ ওয়াশরুম থেকে আনলো। তারপর ছোটবেলার জ্বর কমানোর টেকনিক খাটালো, তা হল জলপট্টি। এভাবেই কাটলো রাত। ভোরের আলো পূর্ব আকাশে ফুটতেই দুনিয়ার ঘুম চেপে বসলো ধারার চোখে। অনলের জ্বর এখন নেই বললেই চলে। মানুষটি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। তাই ধারাও ক্লান্ত চোখজোড়া বুজে নিলো। অনলের রুক্ষ্ম, শক্ত হাতটা নিজের নরম হাতের মাঝে রেখেই ঘুমিয়ে গেলো সে_____
ব্যস্ত শহর, নরম সূর্যোলোক কাঠের জানালা ভেদ করে প্রবেশ করছে ঘরে। সারারাত বৃষ্টি হওয়ায় তার তাপ নেই এর কাছাকাছি। শীতল সমীরে উড়ছে জানালার গোলাপি পর্দাটি। কুসুম প্রভা চোখে লাগাতেই ঘুম ভাঙ্গলো অনলের। মাথায় এখনো প্রবল যন্ত্রনা। জ্বর নেই, তবে মনে হচ্ছে সারা শরীরে হাতি দাঁপিয়ে গেছে। অসহনীয় ব্যাথা। উঠে বসতেই বা হাতে প্রবল ভার অনুভূত হলো। পাশ ফিরতেই দেখলো কিশোরী বউ টি তার হাতের উপর মাথা ঠেকিয়ে নিবিড় ঘুমে মগ্ন। পাশের টেবিলের ঔষধের এলোমেলো বাক্স, অবহেলায় পড়ে থাকা মগ এবং অর্ধশুকনো রুমালটি দেখেই আন্দাজ করতে পারলো, কেনো তার এখন জ্বর নেই। ব্যাপারখানা ভাবতেই অজান্তেই মনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। মনের আকাশে এক নবরঙধনুর আবির্ভাব হলো। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো প্রসন্ন, স্নিগ্ধ হাসি। অপলক নজরে দেখলো নিজের কিশোরী বউকে। তার কপালে পড়ে থাকা অবাধ্য চুলগুলোকে সরিয়ে দিলো সে। কপালে উষ্ম ঠোঁটের আলতো পরশ বুলিয়ে নরম স্বরে বললো,
“আবারো ম’র’লাম আমি, আবারো হারলাম। তবে এই মৃ’ত্যুতে যে জন্মের শান্তি, এই হারে যে প্রবল প্রশান্তি। ভালোবাসি বউ, প্রচন্ড ভালোবাসি”..………….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২২তম_পর্ব
কপালে উষ্ম ঠোঁটের আলতো পরশ বুলিয়ে নরম স্বরে বললো,
“আবারো ম’র’লাম আমি, আবারো হারলাম। তবে এই মৃ’ত্যুতে যে জন্মের শান্তি, এই হারে যে প্রবল প্রশান্তি। ভালোবাসি বউ, প্রচন্ড ভালোবাসি”
অনলের স্বগোতক্তি শেষ হবার সাথে সাথেই চোখ মেলে তাকালো ধারা। যেনো সে এতোটা সময় চোখ বুজে অপেক্ষা করছিলো কখন অনল তার হৃদয়ের অন্তস্থলে জমে থাকা কথাগুলো নিজ মুখে বলবে। ধারা সটান হয়ে উঠে বসলো। ধারার উঠে বসা দেখে ঈষৎ বিস্মিত হলো অনল। সে ভেবেছিলো ধারা গভীর ঘুমে। ধারা কিছুসময় গোল গোল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর ডানহাতটা অনলের কপালে ঠেকালো। ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,
“যাক জ্বর নেমে গেছে, উফ রাতে যে কি একটা ভয় পেয়েছিলাম! হুট করে জ্বরটা বাড়লো কেনো বুঝলাম না!”
অনল একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে ধারার মুখশ্রীর দিকে। চুলগুলো অবিন্যস্ত হয়ে নেমে গেছে ঘাড় বেয়ে। চোখগুলো এখন ঘুমের মাদকতা থেকে বের হয় নি। মুখখানা ঈষৎ ফোলা। গোলাপ ফুলের মতো স্নিগ্ধ ঠোঁটজোড়া দেখে কিছু নিষিদ্ধ ইচ্ছে উঁকি দিলো হৃদয়ের ভেতরে। কিন্তু পর মূহুর্তেই তা দমিয়ে নিলো। ঠোঁটে টেনে নিলো স্নিগ্ধ হাসি। তারপর মুখখানা একটু এগিয়ে নিয়ে নরম গলায় বললো,
“জ্বর না আসলে বউ এর এতো যত্ন পেতাম কি করে?”
অনলের কথাটা কর্ণপাত হতেই ঘুমগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো যেনো ধারার। অনলের “বউ” ডাকে যেনো এক অসামান্য সম্মোহনী শক্তি আছে। যা পাগলের মতো টানে ধারাকে। সে কিছুসময় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো। অনল এখনো হাসছে, দূর্বোধ্য সেই হাসি এবং একই সময় মারাত্মক বুকে লাগা হাসি। মারাত্মক সুন্দর, মাদকাসক্ত। পুরুষের হাসি সাধারণত সুন্দর হয় না। তবে অনলের হাসিটি বরাবর ই ধারাকে মুগ্ধ করে। হয়তো সে সর্বদা হাসে না তাই। কিন্তু পরমূহুর্তেই গতদিনের বাক বিতন্ডার কথাটা মনে পড়তেই মনের ভেতর একটা তিতকুটে অনুভূতির সৃষ্টি হলো। মুখ ফিরিয়ে নিলো ধারা। ঠোঁট ভিজিয়ে অভিমানী স্বরে বললো,
“কেনো? এগুলো তো কিশোরীর আবেগমাত্র!”
“ভুল হয়ে গেছে! ক্ষমা করে দে। এই দেখ কান ধরছি”
বলেই হাতদুটো কানের কাছে নিয়ে গেলো অনল। ধারা সাথে সাথে হাতদুটো নামিয়ে নিলো। গম্ভীর স্বরে বললো,
“আমি কি কান ধরতে বলেছি? কান ধরিয়ে বিশ্বজয় করার ইচ্ছে নেই”
“তাহলে মহারানীর রাগ ভাঙ্গাই কি করে?”
কথাটা বলেই ধারার কোমড় আকড়ে ধরলো অনল। অনলের নিবিড় স্পর্শে কেঁপে উঠলো ধারা। মেরুদন্ড বেয়ে উষ্ণ রক্তের ধারা বয়ে গেলো। অনলের উষ্ণ স্পর্শে হৃদয়ের তপ্ত জমিনে যেনো এক পশলা শীতল বর্ষন হলো। হিম হয়ে গেলো তার হাত পা। আরোও বিস্ময় জমলো যখন কানে মুখ ঠেকিয়ে অনল মাদকাসক্ত কন্ঠে বললো,
“বউ এর মান ভাঙ্গাতে হলে কি করতে হবে এই অ’ধ’ম’কে?”
ধারা অনুভব করলো তার গাল উষ্ণ হয়ে উঠলো। কথাগুলো দলা পাকালো। তবুও একরাশ সাহস নিয়ে বললো,
“যা ঘুমন্ত অবস্থায় বলেছো, তাই সজ্ঞানে শুনতে চাই”
অনল বুঝলো তার কিশোরী বউ তার স্বগোতক্তি শুনেছে। সুতরাং লুকোচুরি শেষ। অবশ্য আর লুকোচুরি করেও লাভ নেই। কারণ অনলের ভেতরটাও হাহাকার করছে। ধারাকে একান্ত করে পাবার ইচ্ছে তাকে বেসামাল করে তুলছে। সে মাথা ঠেকালো ধারার কাঁধে। কন্ঠ নরম করে বললো,
“একটা গল্প শুনবি?”
“সুন্দর গল্প হতে হবে, কিন্তু!”
“আমার প্রথম প্রণয়ের গল্প, শুনবি?”
ধারার বুকে মোচড় পড়লো। বাহিরে তখন আবারো বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে। কাঠের জানালা ভেদ করে পানি ছিটকে পড়ছে শীতল ঘরটিতে। অনল তখন তার কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে বসে রয়েছে। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আঁছড়ে পড়ছে তার দেহে। ধারা মাথা উপর নিচ দোলালো। মানে সে শুনবে। অনলের হাসি বিস্তারিত হলো। তারপর সে মৃদু কন্ঠে বলা শুরু করলো,
“আমি তখন স্কুলে। এই বাড়িতে আমার একার রাজত্ব। আমার চেয়ে ছোট কেউ নেই। সবার আদরের মনি আমি। তখন জন্ম হয় একটা ছোট্ট শিশুর। ছোট একটি মানুষ, গোল মুখ, ছোট ছোট নরম হাত পা তার। অথচ এই মানুষটি আমার নয়বছরের রাজত্ব গুড়িয়ে দেয়। আমার আধিপত্যে নিঃশব্দে ভাগ বসায় সে। জানিস কে সে? তুই! বিনা কিছু করেই ছোট হবার দরুন সকলের আদরের মনি হয়ে উঠিস তুই। যে ফুপি আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না সেই ফুপির সারাদিন কাটতো তোর যত্নে। নয়বছরের বালকের পক্ষে নিজের সিংহাসন ছেড়ে দেওয়া মোটেই সহজ হলো না। আজব এক হিংসে জন্মালো। তাই তোকে ভালোবাসতে ভালো লাগলো না। ফুপি যখন ই তোকে নিয়ে এ বাড়ি আসতো আমার বিরক্ত লাগলো। চাচু যে কিনা প্রতি বিকালে আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হতো সেই চাচু তোকে কোলে নিয়ে ঘুরতে লাগলো। আমার বাবা আমার আগে তোকে চকলেট দিতো। খুব রাগ হতো জানিস। তারপর একদিন ফুপা অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেলো। তুই ফুপির সাথে এলি এ বাড়িতে। আমার হিংসে দ্বিগুন হলো। তোর মনে আছে কি না জানি না, একবার আমি তোকে সিড়ি থেকে ফেলে দিয়েছিলাম। বা পায়ে খুব ব্যাথা পাস তুই। মা খুব রেগে গিয়েছিলো আমার উপর। কিন্তু সকলকে অবাক করে তুই বলেছিলি তুই নাকি নিজ থেকেই পড়ে গিয়েছিলি। এতে আমার দোষ নেই। সেইদিন প্রথম আমার তোকে ভালো লেগেছিলো। একটা পাঁচ বছরের মেয়ে এতো চমৎকার করে হাসতে পারে সেদিন প্রথম দেখেছিলাম। চৌদ্দ বছরের ছেলেটির বুকে যেয়ে লাগলো সেই মারাত্মক মোহনীয় হাসিটি। যাই হোক, ইতিমধ্যে আমার রাজত্বে ভাগ বসাতে আরোও মানুষ চলে এলো, আফিয়া, এশা, আশা, আফসার, আলিজা। আমার অভিমান চুরমার হলো। তাই অন্য একটা ফন্দি আটলাম, রাজত্বটা তোদের উপর খাটাবো। বড় হবার দরুন তোরা সবাই আমাকে হুজুর হুজুর করতে লাগলি! আমার দাপট ও চললো! তারপর ফুপির অসুখ ধরা পড়লো। মাত্র মাস দুয়েক মাঝেই সে আমাদের ছেড়ে চলে গেলো। তখন তুই ছয় বছর। মৃতরা যে ফিরে না ব্যাপারটা তখন ও বুঝতে পারছিলি না। বারবার বলছিলি “মা ঘুমিয়ে আছে, ডেকো না। মা অসুস্থ”। সেদিন তোর প্রতি এক অসামান্য মায়া কাজ করলো জানিস, মনে হলো এই মেয়েটাকে আগলে রাখাই যেনো আমার কাজ। পনেরো বছরের ছেলের পক্ষে প্রণয় কি বোঝাটা অসম্ভব, শুধু এটুকু বুঝছিলাম তুই প্রচুর জরুরি আমার জন্য। আমার মনে খোড়াক, তোকে না জ্বালালে তো আমার ভাত ই হজম হয় না। এর পর ফুপা ফিরলেন তোকে নিয়ে যাবার জোর করতে লাগলেন। তার সাথে একজন নারীও এলো। যাকে দেখে তুই জেদ ধরলি তুই যাবি না। লুকিয়ে বসে রইলি ছাঁদের চিলেকোঠায়। সেদিন আমি প্রথম ভয় পেয়েছিলাম। ভয় পেয়েছিলাম তোকে হারাবার। তুই চলে গেলে আমি কার চুল টানতাম? তার চুলে চুইংগাম লাগাতাম? কার উপর হুকুম ঝারতাম? কার জন্য পাড়ায় ঝগড়া করতাম? কাকে পাহারা দিতাম যেতো কোনো ছেলে তার আশেপাশে না ঘুরে! যাক গে, দাদাজানের সামনে ফুপার জোর খাটলো না। আমার জীবন আবার আগের মতো হয়ে উঠলো। তুই থেকে গেলি, আমার চিরজীবনের খেলার সাথী। এর মাঝে স্কুল থেকে আসার সময় আমি ছেলেধরার কবলে পড়ি। দিনটা আমার জীবনের সবথেকে কালো দিনের একটা। ওরা আমাকে একটা অন্ধকার ঘরে আটকে রাখে। তিন দিন আমি ওই ঘরেই থাকি, বিনা খাবার, বিনা পানি তে। তিনদিন পর আমাকে উদ্ধার করা হয়। আমার তখন নিজের ছায়াকেও ভয় করতে শুরু হয়। নিজেকে ঘরে আটকে রাখতাম। একদিন দেখলাম আমার ঘরের দরজার নিচে একটা চকলেট আর একটা এবড়োখেবড়ো হাতের লেখার চিরকুট। যাতে লেখা ছিলো “অনল ভাই, আমি তোমাকে পাহারা দিচ্ছি”। ভাবা যায় একটা সাত বছরের একটা মেয়ে কিনা ষোল বছরের ছেলেকে পাহারা দিবে। সেদিন প্রথমবারের মতো ম’রে’ছি’লা’ম। বুঝলাম আমি হেরে গেছি তোর চঞ্চলতার কাছে। তোর প্রতিটা কাজে মুগ্ধ হতাম। তুই বড় হতে থাকলি, আমার সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকলো তোর। একই বাড়িতে থাকা স্বত্তেও আমাদের মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব। আমার প্রতি তোর বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখে নিজেকে আরোও বেশি গুটিয়ে গেলাম আমি। তোর প্রতি আসক্তিটা লুকিয়ে রাখলাম এক অজানা প্রকোষ্ঠে। যেদিন আমাদের বাড়ি প্রথম প্লাবণ এলো সেদিন আমি তোর মাঝে এক অকল্পনীয় পরিবর্তন দেখলাম। একটা মেয়েলীভাব এলো তোর মাঝে, সাজগোজ করা, সুন্দর লাগা ব্যাপারগুলো যেনো তোকে বড্ড ভাবাতে লাগলো। প্রথমে খেয়াল না করলেও যত দিন গেলো বুঝলাম তোর প্লাবণের প্রতি একটা আবেগ জমেছে। তোর প্লাবণের প্রতি আবেগ আমার ভেতরের ঈর্ষার দাবানল তৈরি করলো। আমি এজন্য ওকে বারণ করতাম আসতে। তোর আসে পাশে না ঘেষতে। কিন্তু ছেলেটা শুনতো না, তোর আবেগে হাওয়া দিতো আর সেটা আরো বেগে জ্বলতো। না পেরে জিজ্ঞেস করে বসলাম ওকে, কেনো এগুলো করে। ছেলেটা উত্তরে বললো, তোকে দেখলে তার নিজের আপন বোনের মতো মনে হয়। আমি আর বাধা দিতে পারলাম না। আর তোকে যে বোঝাবো সে জোর রইলো না, কারণ আমার প্রতি তোর আচারণ ছিলো বড্ড বিচিত্র। তোর মনে আছে যেদিন তোর এস.এস.সি এর রেজাল্ট দিলো, মার কড়া লাল শাড়িটা জোর করে পড়লি?”
“আর তুমি ইচ্ছে মতো আমাকে বকে ছিলে”
“কারণ তোকে সেদিন বউ বউ লাগছিলো। সেদিন দ্বিতীয়বারের মতো ম’রে’ছি’লা’ম। তোর কাজলকালো চোখে নিজেকে আবারো হারিয়েছিলাম। কেনো তোকে এতোটা মায়াবিনী হতে হবে! পাড়ার সব কটা ছেলের চোখ শুধু তোকে গিলছিলো। সহ্য হলো না। তোর সাথে খারাপ ব্যাবহার করলাম। সেদিনের পর থেকে আমার সাথে সোজা মুখে কথা বলাই ছেড়ে দিলি তুই। আমিও আমার প্রণয়কে আরো একবার গুটিয়ে নিলাম। এর পর দাদাজানের অসুস্থতা, আমাদের বিয়ে সব কিছু যেনো এলোমেলো করে দিলো। প্রথমে না করলেও শেষমেশ মনের হারতেই হলো। রাজি হলাম বিয়েতে। কিন্তুআমি বুঝছিলাম না ঠিক কি করা উচিত। তোকে নিজের করে পাবার আনন্দটা যেমন হচ্ছিলো, তোকে হারানোর ভয়টা আরোও মাত্রা ছাড়াচ্ছিলো। আমি বড্ড ভয় পাই, ভয় পাই আঘাতের। ভয় পাই নিজেকে হারিয়ে নিঃস্ব হবার। ভয় পাই শূন্যতার। এতো ভয়ের মাঝেও অবুঝ হৃদয়টা তোর প্রতি আকৃষ্ট হয় বারেবারে। বারবার তোর প্রতি বেসামাল প্রণয় আমাকে কাবু করে। তাই তো মৃ’ত মানুষটি আবার ম’রে, পরাজিত হৃদয় আবার হারে। হ্যা, ভালোবাসি তোকে। প্রচন্ড ভালোবাসি। আমার ভালোবাসাকে কখনো পায়ে ঠেলে দিস না। সইতে পারবো না”
ধারা অনুভব করলো তার কাধে উষ্ণ তরল গড়াচ্ছে। সেই তরলে ভিজে যাচ্ছে তার কাঁধ। অজান্তেই তার চোখ থেকেও গড়িয়ে পড়লো নোনাজলের রেখা। একমূহুর্ত দেরী না করেই জড়িয়ে ধরলো সে অনলকে। বলিষ্ঠ শক্ত বুকে লেপ্টে রইলো সে। ধরা গলায় বললো,
“শেষ নিঃশ্বাস অবধি এই প্রণয় কে আগলে রাখবো। কথা দিলাম।”
“ভালোবাসিস?”
“কারণ অকারণে ভালোবাসি, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি”
অনলের বেষ্টনী আরোও নিবিড় হলো। কিশোরী বউ কে আগলে ধরলো তার শক্ত বাহুবেষ্টনীতে গভীরভাবে। বাহিরে ঝুম আষাঢ়িয়া বৃষ্টি। ব্যাস্ত শহর ভিজে যাচ্ছে। নিস্তব্ধ রুমেও তখন চলছে প্রণয়ের বর্ষণ, কি মধুর সেই বর্ষণ_________
****
ব্যস্ত শহরে নামলো সন্ধ্যা। ঘুটঘুটে আলো সন্ধ্যা। সেই সাথে চলছে আষাঢ় মাসের চিরন্তর নৃত্য। ঝুমঝুম করে বৃষ্টি আর মেঘের গর্জন। অবশ্য সকালের কড়া, তেজী উত্তাপের জ্বালানো শহরটি ঠান্ডা করার প্রয়োজন ছিলো। বাংলাদেশে না আসলে হয়তো এই অলীক মায়াটার সাক্ষী হতে পারতো না দীপ্ত৷ সে এখনো ধারাদের বাড়িতেই ঘাপটি মেরে আছে। জামাল সাহেবের সাথে বনাবনি হয় নি মোটেই। কিন্তু রাজ্জাক সাহেবের দয়ার পাত্র সে হয়ে গিয়েছে। হাতে টাকা নেই, লাগেজ নেই। অনলের কাপড় পড়ে দিব্যি দিন কাটছে তার। এদিকে অনলের পা ঠিক হয়ে গিয়েছে। লোকটি বেশ ত্যাদর, দীপ্তকে মোটেই ধারার ধার ঘেষতে দিচ্ছে না। অবশ্য দীপ্ত ধৈর্য্যশীল ছেলে। পাঁচদিন চুপচাপ ই রয়েছে। সে অবশ্য জমজদের খুব ভয় পায়। ভুলে ও ও পথ মা’রা’য় না।
দীপ্ত কাঠের জানালাটা খুলে দিলো। সাথে সাথেই পানির ছিটে মুখে পড়তে লাগলো। তবুও মোহনীয় দৃষ্টিতে বাহিরে তালিয়ে রইলো সে। সোডিয়ামের রোড লাইট গুলো একের পর এক জ্বলে উঠছে রাস্তার ধারে। বৃষ্টির শব্দ যেনো কোনো সুখময় গান। এই গানে বাধা দিলো কাঠের দরজার ঠক ঠক আওয়াজ। ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে খুলতে অবাক হলো সে। জমজেরা বাটি হাতে বিনীত হাসি একে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাবড়ানো কন্ঠে শুধালো দীপ্ত,
“কি চাই?”
“ক্ষমা”
একসাথে বলে উঠলো এশা আশা। খানিকটা বিস্মিত হলো দীপ্ত। মুখে সন্দেহের ছাপ। সন্দীহান কন্ঠে বললো,
“কিসের ক্ষমা?”
“বাহ রে! আমাদের জন্য আপনাকে কি অপমানটাই না হতে হলো। সেটার ক্ষমা চাইতে এসেছি। আর দেখুন আপনার জন্য এই বৃষ্টিতে ভিজে রহমাত পাড়া বিখ্যাত চটপটি নিয়ে এসেছি। আমাদের এবার ক্ষমা করে দিন দীপ্ত ভাই”
এশা এতোটা নরম এবং বিনয়ী স্বরে বললো যে দীপ্ত মানা করতে পারলো না। আর কেনো জানে জমজগুলোকে তার ভীষণ ভালো লাগে। ইচ্ছে করে গাল টিপে দিতে। তাই হাসি মুখে চটপটির বাটিটা নিলো। তারপর বললো,
“থ্যাংক ইউ। আমরা তাহলে বন্ধু?”
“একদম, আপনি তাহলে আমাদের ক্ষমা করেছেন তো?”
“তা আর বলতে, এটা কি স্পাইসি?”
“হালকা, তবে বেশ মজা। আপনি খান আমরা তাহলে আসি”
“তোমরা খাবে না?”
সাথে সাথেই আশা বলে উঠলো,
“আমাদের খাওয়া যাবে না”
“হ্যা?”
“না আসলে আমরা খেয়েছি, ওয়েদার খারাপ তো। তাই বেশি খাওয়া যাবে না। আশা পা’গ’লী বোঝাতে পারে নি”
আশাকে কনুইয়ের গুতো দিয়ে এশা কথাটা বললো। তারপর তারা “আসি” বলেই বিদায় নিলো। দীপ্ত তৃপ্তি নিয়ে চটপটিটা খেলো। একটু ঝাল বটে, কিন্তু ভীষণ মজা। কিন্তু ঝামেলাটা হলো এক ঘন্টা পর, যখন তার পেট মুড়িয়ে উঠলো। শুধু রুম টু বাথরুম আর বাথরুম টু রুম। এক মিনিট যে বসবে তার উপায় নেই……….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি