#প্রণয়
#৫ম পর্ব
#Abir Hasan Niloy
…
অবনি অর্নের কাঁটা হাতে তুলো দিয়ে স্যাভলন লাগাতে থাকে। একবার করে লাগাচ্ছে, তারপর আবার ফুঁ দিচ্ছে। অর্ন তাকিয়ে তাকিয়ে অবনির কাজগুলো দেখছে। অবনি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বলে..
– এভাবে নিজেকে কেনো কষ্ট দিয়েছো? দেখে শুনে কিছু করতে পারো না? বাচ্চাদের মত কাজ করো, কতটা ব্যাথা পেয়েছো। (অবনি)
– ঐ কান্না থামা। বাচ্চাদের মত কেনো কাঁদছিস? (ঝাড়ি দিয়ে বললো অর্ন)
– উহু…উহ….হু হু…. (আরো জোরে কান্না করে)
– ঐ কি শুরু করেছিস? বারণ করলে বেশি জোরে কাঁদছিস? ছাঁড় আমার, আমি ঠিক আছি। সর সামনে থেকে, যা ঘুমা। (অর্ন ঝাড়ি দিয়ে বলে)
অবনি কান্না থামিয়ে চুপচাপ হাত ধরে রাখে। নিজের কোলে হাত রেখে দিয়ে আস্তে আস্তে মলম লাগাতে থাকে। অর্ন যন্ত্রনায় চোখ বন্ধ করে নিল। অবনি মলম লাগাতে লাগাতে অর্নের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে দেখতে থাকে সে অর্নকে। অর্ন চোখ খুলে তাকায়। অবনিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে বললো…
– যা, খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।
– তোমার ফোনটা আমাকে একটু দাও। (অবনি নরম গলায় বললো)
– কেন? (অর্ন গম্ভির হয়ে বলে)
– দাও তো একটু। (অবনি)
– নে.. তবে আম্মাকে কিছু বলিস না এখন। (অর্ন)
– দাও তো…
অর্নের থেকে ফোনটা কেঁড়ে নেয় অবনি। তারপর ডাক্তার সৈয়দ আংকেলকে কল দিতে থাকে। তখন ঘড়িতে রাত প্রায় দুইটা। একবার কল দিয়ে তিনি যখন রিসিভ করে না, অবনি অর্নের কাছে কান্না ভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করে..
– ডাক্তার কাকু ফোন ধরে না কেনো?
– রাত কটা বাজে দেখেছিস? তোর মত কেউ জেগে আছে? আর তুই সামনে থেকে যা, আমার কিছু সহ্য হচ্ছে না। (অর্ন)
– ধুর। আমি ফোন দিবো, দরকার হলে মসজিদের মাইকে মাইকে বলে আসবো আমার বরের হাত কেঁটেছে কে কোথায় ডাক্তার আছো, সবাই চলে আসো। (অবনি)
অর্ন গম্ভীর চাহনি নিয়ে তাকিয়ে ছিল অবনির দিকে এতক্ষণে। কিন্তু হঠাৎ করে অবনির এমন পাগলামি মার্কা কথা শুনে অর্ন বুঝতে পারছে না হাসবে নাকি রাগ দেখাবে। সে চুপচাপ অবনির দিকে তাকিয়ে থাকে। অবনি ডাক্তারকে ফোন দিতে থাকে অটো। এক সময় রিসিভ করে..
– কি হয়েছে অর্ন, এত রাতে ফোন দিয়েছো কেনো? (ডাক্তার)
– কাকু… উহু… হু…হু…. আমি অবনি, ওর হাত কেঁটে গেছে অনেক। রক্ত বের হয়েছে দুই ব্যাগ। তাড়াতাড়ি আসেন, বাড়িতে আছে। (অবনি)
– অর্নের হাত কেঁটেছে? আচ্ছা আমি ১০ মিনিটের ভিতরে আসছি। (ডাক্তার)
– উহু… হু.. তাড়াতাড়ি..
অবনি কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলেছে। অর্ন এবার জোরে ঝাড়ি দেয়। অবনি লাফ দিয়ে ওঠে। চমকে যেতেই সে কান্না থামিয়ে মাথা নিচু করে নিল। অর্ন ঝাড়ি দিয়ে বললো…
– কাঁদবি না, অসহ্য লাগছে একদম। সামনে থেকে যা, আমাকে এখানে থাকতে দে। আম্মা কোথায় গেছে? ওহ, শিলা আপুর বিয়ের কথা ছিল আজ। তুই যা, ফোন দে। (অর্ন)
– ডাক্তার আসতে এত দেরি করে কেনো? আরো না ডাক্তারের নাম্বার আছে? দাঁড়াও কল দিই। (অবনি)
– ধুর…
অবনি অর্নের ঝাড়ি শোনেনা। যতগুলো ডাক্তার পরিচিত নাম্বার ছিল, সবাইকে ফোন দেয় অবনি। সবাই আসছে। অবনি ফোন দিয়ে অর্নের পায়ের কাছে বসে। অর্ন চোখ বন্ধ করে ইরার কথা ভাবছে।
.
“ছেলেটার অনেকখানি হাত কাঁটছে। রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। আমার জন্য কতটাই না পাগলামি করছিল সে। সারাদিন আমার বাসার নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। এতটা ভালোবাসে সে আমাকে? এখন কি তাকে দেখতে যাবো? না থাক, কাল সকালে একবার দেখতে যাবো। ভালোবাসি তো তাকে আমি। সেও বাসে। আমি আমার ভালোবাসা হারাতে দেবো না। অর্নের সাথে এসব নিয়ে কথা বলবো পরে।”
ইরা রুমে পায়চারী করতে করতে কথাগুলো ভাবছিল। অর্নের উপর রাগ জমেছিল ওর অনেক। সে জন্য সারাদিন যখন অর্ন ওর বাসার সামনে ছিল, তখন সে কিছুই অনুভব করেনি। আর রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। যাকে সে ভালোবাসতো, বা যে তাকে ভালোবাসতো, সে অন্যকে হুট করে বিয়ে করলে তো রাগ হবেই। তবে ইরা বুঝে গিয়েছে অর্ন তাকে সত্যিই ভালোবাসে। সে অর্নকে হারাতে চায়না আর। কালকে একবার দেখে আসবে, অবনির সাথে কথা বলবে না একদমই। এরাকমটা ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ে।
এদিকে দরজায় কলিং বেল এর শব্দে অর্ন আরো বিরক্ত হয়ে যায়। অবনি তাড়াতাড়ি দরজা খোলে। দেখে তিনজন ডাক্তার এসে হাজির। অবনি তাড়াতাড়ি ভিতরে নিয়ে আসে ওনাদের। অর্ন তিনজন পরিচিত ডাক্তার দেখে অবাক হয়ে গেলো। প্রশ্ন করে..
– আপনারা তিনজন এতো রাতে?
– তোমার বউ এত পাগলামি করে, আল্লাহ… আসছি বলেছি। তবুও ৩০ বার কল দিয়েছে। শুধু আমার একার না, বাকিদেরও একি অবস্থা হয়েছে। কি হয়েছে হাতে দেখি। (সৈয়দ সাহেব)
সৈয়দ ডাক্তার কথাটা বললো। অর্ন কথা শুনে অবনির দিকে তাকালো। অবনি অর্নের দিকে অপরাধীর মত একবার চাইলো। তারপর অর্নের কাছে এসে নিজেই অর্নের হাত ধরে কোলের মধ্যে নিয়ে ফু দিতে দিতে বলে..
– এই যে এই হাত, দেখেন কি পরিমানে কাঁটছে। একটুও নিজের খেয়াল রাখেনা। এতবার বলেছি সবসময় সাবধানে চলতে। আমার কথা শোনেই না। ভালো ঔষধ দিবেন, ইনজেকশন দেবেন, যেন ইনফেকশন না হয়। আজকে ব্যান্ডেজ করেন, ধুলাবালি যদি যায়? সকালে উঠেই খুলে দিবো। (অবনি)
– হা.. করছি করছি… এত টেনশন নিতে হবেনা। সব করছি.. তুমি বরং খাবার রেডি করো। খাবারের পর ঔষধ আছে। খেতে হবে। (সৈয়দ আংকেল)
ডাক্তার সাহেবেরা অর্নকে দেখতে থাকে। অর্ন শুধু অবনির পাগলামি দেখে অবাক হচ্ছে। এমনটা তো অবনি ছিলনা। বিয়ের আগে এমনিতে অর্নের জ্বর আসলে অবনিই বেশি কেয়ার নিত। মানে ঠিক সময়ে ঔষধ নিয়ে হাজির হতো। বাট এমন পাগলামি সে আগে কনোদিন করেনি। ডাক্তারেরা সবকিছু ঠিকভাবে করে। অবনি খাবার নিয়ে অর্নের সামনে এসে দাঁড়ায়। অর্নের হাতে ব্যান্ডেজ করা শেষে ডাক্তাররা উঠে দাঁড়িয়ে অর্নকে বলে..
– বাবা.. কপাল করে একটা বউ পাইছো। এতটা ভালোবাসা কেউ এই যুগে বাসবে না। অবনির ফোন পেয়ে পেয়ে বিরক্ত হয়ে গিয়েছি। যেভাবে কান্না করেছে, না জানি কি না কি হয়েছে ভেবে আরো তাড়াতাড়ি এসেছি। অবনি তোমাকে অনেক ভালোবাসে। দশ মিনিট ডাক্তার আসার সময় নিয়েছে, এর মধ্যে তিনজন ডাক্তাকে ডাকাও শেষ।
ডাক্তারেরা কথাগুলো বলে সেখান থেকে চলে গেলো। অবনি ঠাই দাঁড়িয়ে আছে খাবার নিয়ে। অর্নকে সাহসের অভাবে খাবার খেতে বলতেও পারছে না। সাহস নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছিল অবনি। তখনি পিছন থেকে সৈয়দ আংকেল এসে বলে..
– এক মিনিট, আরেকটু কাজ বাকি আছে। অবনি দেখি তোমার পায়ের নখে কি হয়েছে? দরজা খোলার পর দেখলাম তুমি খোড়াতে খোড়াতে হাঁটছিলে।
– কিছু হয়নি তো আংকেল। (অবনি)
– আরে দেখি.. ইস কতখানি কাঁটছে। নখ তো প্রায় উঠে গিয়েছে। রক্তই এখনো বন্ধ হয়নি। দেখি দেখি ড্রেসিং করে দিই।
সৈয়দ আংকেল অবনির আংগুলে ভালোমত ট্রিটমেন্ট করে। সৈয়দ আংকেল সবকিছু চেকআপ করতে করতে বলে..
– কোথায় হোঁচট খাইছো বলো।
– ঐ যে চেয়ারের সাথে। (অবনি)
– কেনো? (সৈয়দ আংকেল)
– না মানে… (অবনি)
– চুপ.. বলো কিভাবে? (সৈয়দ আংকেল)
– আসলে, উনি এসে দরজায় কলিংবেল বাজিয়েছিল। তাড়াতাড়ি দরজা খুলতে যেয়ে হঠাৎ নখের সাথে চেয়ার লেগে হোঁচট খাই। সমস্যা নেই। আমি তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিয়েছিলাম। ওনার যেন কষ্ট না হয় সেটা দেখুন। হাতে অনেক ব্যাথা। আমি জানি সব। (অবনি)
অবনির মুখ থেকে কথাগুলো শুনে অর্ন আর ডাক্তার সাহেব দুজনেই অবাক হয়ে গেছে। সৈয়দ ডাক্তার আর কিছু বললো না। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। অর্ন অবনির দিকে রাগি চোখে তাকায়।
– এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? ভয় করে আমার। তবে তাকিয়েও লাভ নেই। এখন খাবার খেতেই হবে। না হলে হাত সারবে না। (অবনি)
– তোর পা কাঁটছে, সেটার খেয়াল না রেখে আমার হাত কাঁটছে, সেটা নিয়ে ছোঁটুছটি তোকে কে করতে বলেছে? তুই নিজের খেয়াল নিজে নিবি। আমি আমারটা। আমি কখনো বলিনা কাউকে আমার খেয়াল নিতে। অসহ্য লাগে। বিরক্তিকর তুই। (অর্ন)
– বকা দাও কেন তুমি? আমি ঠিক আছি। এখন খেয়ে নাও। (অবনি)
– খাবো না আমি। (অর্ন)
– ঔষধ খেতে হবে। (অবনি)
– আরে..দেখছিস না, আমার হাতে ব্যান্ডেজ। তুই যা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। (অর্ন)
– আমি না খেয়ে আছি, তুমি কিভাবে জানো?
অর্ন কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলো। বুঝতে পারছে না এখন সে কি বলবে। অবনির দিকে তাকায়। অবনি সরু চোখে চেয়ে থাকে অর্নের দিকে। অর্ন ঝাড়ি দিয়ে বলে..
– আমি খাবো না। তুই যা খুশি কর।
– আমি খাইয়ে দিচ্ছি। তুমি চুপচাপ বসো। হাত ঠিক হয়ে গেলে না হয় আমাকে মেরো, রাগ প্রকাশ করিও। (অবনি)
অবনি সরলভাবে কথাটা বললো। অর্ন স্থির হয়ে বসে আছে। অবনি কোথা থেকে যেন সাহস পেয়ে যায়। ও এগিয়ে যায় অর্নের দিকে। ছোট টেবিলে খাবারের প্লেট রাখে। তারপর মাখিয়ে দিয়ে, অর্নের দিকে হাত বাড়ায়। এক লুকমা হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকে অর্নের দিকে। অর্ন গম্ভির চাহনি নিয়ে চায়লো। উপায় নেই, তাকে খেতে হবে। আর অবনি না খাওয়ানো অবদি ছাঁড়বেই না। অর্ন হা করে, অবনি দেরি করে না। সে খাবার মুখে পুরে দিয়ে অর্নের দিকে তাকায়। অর্ন চিবুতে শুরু করেছে। অবনি তার খাওয়া দেখছে। অর্ন অবনির দিকে না তাকিয়ে খেতে থাকে।
অর্নের খাবার শেষে অবনিও কিছু খেয়ে নেয়। অর্ন ঔষধ খেয়েই সোফাতে বসে ঘুমিয়ে গেলো। অবনি নিজেই অর্নকে ঔষধ দিয়েছে। অবনি আজকে খুশি। কৃষ্ণকলি রমনী সে। মুখে সবসময় কালো মেঘের ছড়াছড়ি। ঈষৎ কালো রঙ যেন অবনির ছোট থেকেই পিছু ছাঁড়েনি। জন্মের পর থেকে ঠিকমত মায়ের দুধ পায়নি অবনি। অর্নের মা ছিল বলেই হয়ত সে বেঁচে আছে। কালো বলে ছেলেরা তাকে পছন্দ করেনি কোনোদিন। অবনির কাছে ভালোবাসাটা ছিল অপ্রাপ্তিতে। শুধু সে দুর থেকেই ভালোবাসা খুজেছে।
সহপাঠী মেয়েদের জন্য কত কত ছেলে সামনে এসে হাত কাঁটতো। তাদেরকে পাওয়ার জন্য পাগলামি প্রকাশ করতো। অবনি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছে। তাকে কাছে পাওয়ার ব্যাকুলতা কেউ কোনোদিন প্রকাশ করেনি। কেউ এসে বলেনি ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ পৃথিবীর সবাই সুন্দরের পূজারি। কালো ছেলে হলেও কেবল টাকার জন্য সুন্দরী বউ পাওয়া যায়। আর কালো মেয়ে হলে বিয়ের জন্য টিভি, ফ্রিজ, বাইক প্রদান করতে হয়। পৃথিবীর কিছু নিয়ম বড়ই অদ্ভুত। যে যতই এই নিয়মগুলো পাল্টানোর চেষ্টা করুক না কেনো, কখনো সে সক্ষম হবেনা।
নিয়ম তৈরী হলে বদলানো যায়। কিন্তু আল্লাহ যে নিয়ম সৃষ্টি করে, সেটা মনুষ্য কখনো বদলাতে পারেনা। একটাই কথা পরিলক্ষিত হয়, তা হল আল্লাহর তৈরী নিয়ম। কালো ছেলে মেয়েদেরকে স্বাভাবিক ভাবে অন্য কোনো ছেলে মেয়ে পছন্দ করেনা। আবার গরীবদেরকে পছন্দ করেনা। যে ভালোবাসা দিতে চায়, তাকে আবার কেউ চায়না। এই নিয়ম বদলানো অসম্ভব।
অবনি দেখতে কালো। শুধু চেহারাটাই তার কালো। কালো বলেই নিজের পরিবারের মানুষ তাকে পছন্দ করেনি। সে অসিত, কৃষ্ণবর্ণ, শ্যাম, শ্যামল, কৃষ্ণ, শ্যামবর্ণ। সঠিকভাবে বলা যায় কালো হল সেসকল বস্তুর রঙ যা দৃশ্যমান বর্ণালীর মধ্যে কোন আলো বিকিরণ বা প্রতিফলন করে না। কালো রঙের বস্তু দৃশ্যমান বর্ণালীর সকল কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট আলো শোষণ করে নেয়। যদিও কখন কখন বর্ণহীন বলতে কালো বলা হয়, তবে ব্যবহারিক অর্থে কালো একটি রঙ। কিন্তু অবনির মধ্যে শ্বেতের কোনো চিহ্ন নেই। শুধু গুন আছে। সমাজ তৈরী করা গুরুদের মতে একটা মানুষ তখনি পারফেক্ট হয়, যার মধ্যে সুন্দর চেহারাও থাকবে, অনেক গুন থাকবে। অথচ মানুষ কখনো কোনোকিছুতে কোনোদিন পারফেক্ট হয়না।
অবনি আবিরের পাশে বসে। সোফায় হেলান দিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে ওর খেয়াল নেই। ঘুমিয়ে পড়ে দুজন সোফাতে। ঘুমের ঘোরে অর্ন অবনির কাছে আসে। অবনিকে কোলবালিশের মত জড়িয়ে ধরতেই অবনির ঘুম ভেঙে যায়। সে চোখের পাতা মেলে তাকিয়ে দেখে অর্ন তাকে জাপটে ধরে, সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। অবনি ওঠার চেষ্টা করলো। কিন্তু অর্ন আরো শক্ত করে জড়িয়ে নেয়। অবনি মনে মনে বলে “ঘুমের ঘোরে হলেও কি.. সে তো আমার কাছে এসেছে, থাকুক এভাবে। না হয় সকালে একটু অপমানিত হবো, বকা শুনবো তবুও থাকুক। ঘুমটা আর ভাঙাবো না।”
অর্ন কষে ধরে রাখে। অবনি আবারো ঘুমিয়ে যায়। ঘুমের ঘোরে অবনি অনুভব করে, অর্ক তার পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে, এক হাত গলার পাশ দিয়ে রেখে পেটের উপর দিয়ে আরেকটা হাত নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। বেশ আরামেই দুজন ঘুমিয়ে যায় এখানে।
.
সকাল হয়ে গেছে। ইরা লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠল। সকাল আটটা বাজে। অর্নের কথা মনে পড়েই বুকটা কেমর ধুক করে উঠল। কালকে হাতে যন্ত্রনা নিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল অর্ন। ইরা তখন অর্নের ভালোবাসাটা বুঝতে পারেনি। কিন্তু রাত থেকে সে অর্নকে অনেক বেশি মিস করছে। তাই সে কোনোরকমে রেডি হয়ে নিল। অর্নকে দেখতে যাবে ইরা। সকালে ইরাকে দেখে অর্ন খুশিই হবে। ‘আমি আসছি অর্ন, আর কষ্ট পেতে হবেনা।’ ইরা অনেককিছু ভাবতে ভাবতে ত্রিশ মিনিটের ভিতরে রেডি হয়ে নিল। নিজের গাড়িতে করে ইরা অর্নের বাড়ির উদ্দেশ্যে আসতে থাকে। হঠাৎ শিহাবের ফোন আসলো। ইরা রিসিভ করে..
– জ্বি ভাইয়া বলুন… (ইরা)
– কোথায় আছো? (শিহাব)
– আসলে আমি অর্নের বাড়িতে যাচ্ছি। কিছু বলবেন? (ইরা)
– ওহ, আমরাও আসছি। চলো একসাথে যাবো। আসলে কালকে একটু বেশিই অর্নকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছিলাম। ফোন দিইনি আর। অবনিকে সে ভালোবাসে না। সে তোমাকেই ভালোবাসে। (শিহাব)
– জানি তো ভাইয়া। যেয়ে দেখবো অর্ন বাইরে বসে বসে ঘুমাচ্ছে। আর অবনি ভিতরে। আমার অর্নকে নিয়ে আসবো। আসুন আমি এগিয়ে যাচ্ছি।
ইরা কথাটা বলে ফোনে কেঁটে দেয়। অর্নদের বাড়ির গেটের কাছাকাছি আসতেই সবার সাথে দেখা হয় ইরার। বাড়ির দারোয়ান ওদের সবাইকে চেনেই। তাই সহজে ভিতরে প্রবেশ করে। বাড়ির মেইন দরজা হালকা খোলা আছে। ইরা আগে ভিতরে প্রবেশ করলো।
অর্ন আর অবনি রাত থেকে একসাথেই সোফাতে ছিল। রুমে যায়নি তারা। অর্ন ঘুমের ঘোরে অবনিকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছিল। অর্নের ঘুম নষ্ট হবে, অর্নের কষ্ট হবে ভেবে আর অর্নকে ডাকেনি। ওভাবেই পাশে হেলান দিয়ে শুয়েছিল। কিন্তু অর্ন অবনিকে নিয়ে শেষ রাতে সমতল ভাবে শুয়ে পড়ে সোফায়। শুধু এতটুকু নয়, অর্ন তাকে জড়িয়েই ধরে ছিল সারাটা রাত। ইরা ভিতরে প্রবেশ করতেই ওর চোখ আটকে যায় অবনি আর অর্নের জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে। শিহাব অর্নকে ডাকতে যাচ্ছিল। কিন্তু ইরা থামিয়ে দেয়। ইরা খাবার টেবিল থেকে একটা কাঁচের গ্লাস হাতে তুলে নিয়ে সজোরে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারলো।
দুজন ফ্লোরে কাঁচের গ্লাস পড়ার শব্দ শুনে লাফ দিয়ে ওঠলেও, অর্ন আর অবনি ওভাবেই জড়িয়ে শুয়ে ছিল। কাঁচের গ্লাসের শব্দের প্রতিধ্বনি চারপাশে বাজতে থাকে। অর্ন বুঝতে পারে অবনিকে সে জড়িয়েই ছিল। অর্ন তাড়াতাড়ি অবনিকে ছেঁড়ে দিয়েই সামনে তাকায়। ইরা দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে অর্নের বন্ধুরাও আছে। অবনিও তাকালো সামনে। ইরার চোখ লাল হয়ে গেছে। সে ফ্লোরে আরো একটা গ্লাস ফেলে দিয়ে বলা শুরু করে..
– বাহ.. কি সুন্দর দৃশ্য। লজ্জা করেনা তোর…? আমার বাড়ির সামনে যেয়ে সারাদিন দাঁড়িয়ে ছিলি, কুকুরের মত তাঁড়িয়ে দিতে চেয়েছি। অথচ তুই সেখানে ছিলি। এখন বাড়িতে এসে বউ পেয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বেশ আরাম করেই ঘুমিয়ে ছিলি তাইনা? ছিহ.. তোকে বিশ্বাস করেছিলাম আমি। বিশ্বাস করেছিলাম অবনিকে কোনোদিন ভালোবাসবিনা। সব ভালোবাসা আমার জন্য থাকবে। এই তোর ভালোবাসা? না জানি বাসর ঘরে কি কি করছিস। ছিহ.. সরি কেনো ছি! ছি! করছি? তোর বউ, যা খুশি তাই করবি। আমার কি? জঘন্য মনের মানুষ তুই। লজ্জা করেনা আমাকে ভালোবাসি বলতে?
ইরা চিৎকার করে কথাগুলো বললো। ইরার কথা শুনে অবনি বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ইনোসেন্ট লুক দিয়ে অবনি প্রথমে কি হয়েছে বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু অর্নের এমন অপমান শুনে অবনি রেগে যায়। তারপর..
চলবে,,