#প্রণয়
#১ম পর্ব
#Abir Hasan Niloy
….
অর্ন রেড ওয়াইনের বোতলে তার নরম ঠোঁট রেখে, বোতলটা উঁচু করে ঢক ঢক করে ওয়াইন খেতে খেতে, রুমের মধ্যে প্রবেশ করে। অর্নের লোচনযুগল ঈষৎলাল হয়ে আছে। অর্নের নাকে ওয়াইনের কঁড়া গন্ধ লেগে থাকা সত্তেও, তার নাসিকাতে হলুদ গাঁদা, সাদা রজনীগন্ধা ফুলের সৌরভ এসে জানান দেয়, এটা সাধারন কোনো রুম না। এটা বাসর ঘর। আর অর্ন তার ভাইয়ের বাসর ঘরে সদ্ব্য আনা দামী মদের বোতল হাতে নিয়ে, তা খেতে খেতে রুমে প্রবেশ করেছে। রুমের চারপাশ ফূলে সমোরিত। মনোহরী, হৃদয় হরনী, সুকেশিনী, সুলভ সুহাশিনী নয়, বরং তিক্ত, বিরক্ত কৃষ্ণবর্ণ মহিয়সী, বিছানার মাঝে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। অর্ন গম্ভীর হয়ে বিছানার দিকে তাকালো। অর্নের চোখে মুখে স্বচ্ছ ক্রোধের বিলাস। সেই বিলাসিতা প্রদানের সুবর্ণ সুযোগের অপেক্ষা অর্নের। অর্ন বলা শুরু করে..
“কেনো আমার জীবনটা তুই নষ্ট করলি? তোকে কে বিয়ে করতো? কেউ না? আমার কপালেই তুই এসে জুটলি? তোর কি লজ্জা করেনা? এত এত অপমান করার পরও আমার সাথে জড়িয়ে গিয়েছিস?”
ফুলে সজ্জিত বিছানার রংটা যেন ভালোবাসা প্রদানের আহ্বান জানায়। কিন্তু বিছানার উপর মাথা নিচু করে বসে থাকা অবনি যেন এট্রাকশনের মোনালিসা নয়। সে যেন সক্রেটিসের অনুরূপ রঙ এর গঢ়ন। অবনি কাঁদছে। শব্দহীন তবে ফোঁপানোর আওয়াজ মাঝে মাঝে বদ্ধ ঘরের কার্ণিশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। অর্ন বোতলে আরো একবার চুমুক দিয়ে অবনির দিকে এগিয়ে যায়। অবনি তখনো চুপ হয়ে আছে। অর্ন কাছে যেয়ে বলে..
– তুই না ভাইয়ার বউ। আমার ভাবি তুই।
– আমি তোর বউ। (অবনি)
– চুপ কর.. শোন, আমার বউ হয়েছিস, খবরদার আমার কাছে আসবি না। আমার কাছে পৃথিবীর সবচাইতে বিরক্তিকর হচ্ছিস তুই। ঘোমটা কেনো দিয়ে আছিস? খোল ওটা.. তোর রুপ দেখার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। যে রুপে আকর্ষণতা নেই, সেই রূপে থুথু দিতেও লজ্জা করে।
অর্ন কথাটা বলেই, অবনির মুখের উপর থেকে বেনারসির ঘোমটা কাপড় তুলে ফেলে দেয়। অর্ন আর দেরি করে না। হাতে থাকা ওয়াইনের বোতলে, যতটুকু মদ ছিল সব ওর মাথায় ঢালা শুরু করে। কিছুটা মদের অংশ ক্ষীপ্র গতিতে অবনির মুখের উপর ছুঁড়ে মারে। অবনি চোখ বন্ধ করে নিল। কয়েক ন্যানো সেকেন্ড দেরি করলে হয়ত মদের পুরোটা চোখের মধ্যে চলে যেতো। তবুও অতি সামান্য তরল ওর চোখে যাওয়াতে জ্বালা করা শুরু হয়ে গেছে। অর্ন শব্দ করে হাসতে থাকে। অবনি নিরবে কেঁদে যাচ্ছে। হাসতে হাসতে বলে..
– কি ভাবছিস? আমার মত ছেলেকে বিয়ে করে, তুই সব পেয়ে গিয়েছিস? তুই জানিস না তুই কত বড় ভুল করেছিস।
– আমার কি দোষ? আমি তো.. (অবনি)
– চুপ কর তুই।
অর্ন কথাটা বলে অবনির গালে ঠাস করে একটা চড় লাগিয়ে দেয়। অবনির এমনিতে চোখ জ্বালা করছিল। তার উপর অর্নের থেকে খুব জোরে চড় খেয়ে সে যেন দিশেহারা, বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অর্ন বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। অবনিকে টেনে, বিছানা থেকে নামিয়ে ফ্লোরে দাঁড় করালো। অবনি নিশ্চুপ। সে কিছুই বলতে পারছে না। কেবল কান্নায় করে যাচ্ছে। বাসর ঘরে স্বামীর থেকে মেয়েরা ভালোবাসা পেয়ে থাকে। কিন্তু অবনি যা পাচ্ছে সেটা ভালোবাসা নয়, বরং নির্যাতন।
এমনিতেই অবনি বিকেল থেকে কান্না করেছে। অর্নের ভাই আনাফ বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে যায়। সবাই বলাবলি করছিল, কালো মেয়ের জন্য এমনিতেই ছেলে পাচ্ছিল না। কাজিন ধরে বিয়ে করিয়ে দিচ্ছে, সেই ভেগে গিয়েছে। ছি ছি কি কান্ডটাই না ঘটেছে। কে করবে এর বিয়ে? অবনির কানে যখন অনুষ্ঠানে আসা মানুষের কথা আসে। তখন থেকেই কাঁদছিল। কান্নাটা যেনো এখনো থামছে না। অর্ন অবনির দিকে তাকিয়ে বলে..
– ঐ নেকা কান্না থামা বুঝেছিস? ওয়াশ রুম আছে। যা চোখে পানি দিয়ে আয়।
অবনি মাথা নিচু করে কোনোরকমে তাকিয়ে সামনে এগি যাওয়ার প্রস্তুত নেয়। অর্ন আবার থামিয়ে দিয়ে বলে..
– ঐ দাঁড়া। গা থেকে সব খোল।
– অর্ন… (অবনি)
– চুপ কর।
অবনির কোনো কথা শোনার মুডে অর্ন নেই। সে অবনির কাছে যেয়ে সজোরে টান দিয়ে, অবনির তনু থেকে কাঁপড় সরিয়ে ফেলে। অবনি আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। দৌড়ে ঔয়াশ রুমে চলে যায়। অবনি তাড়াতাড়ি ট্যাপ ছেঁড়ে দিয়ে, পানি হাতে নিয়ে মুখে ছেঁটাতে থাকে। কয়েকবার পানি ছিটিয়ে চোখ ঠান্ডা করে নিল। সে আয়নাতে তাকায়। নিজের চেহারা আজ সে বিগত ১০ বছর ধরে দেখেনি। দশ বছর পর আজ প্রথমবারের মত সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছে। আয়নাতে নিজের চেহারা দেখে চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। কারন সে কালো এটার জন্য কাঁদছে না। কপোলের ডান পাশে স্পষ্ট থাপ্পড়ের দাগ। অবনি আরো ঢুকরে কেঁদে ওঠে। কারন, সে কালো বলে তার স্বামী এভাবে কথা শুনিয়েছে। সদ্ব্য বিয়ে করা স্বামী যেন বড়ই নিষ্ঠুর।
অবনি নিজের গায়ের দিকে তাকায়। শাঁড়িটা আধাখোলা হয়ে আছে। বুকের প্রস্বস্থ অধনা যেন দৃশ্যমানের বিলাসিতা বহন করলেও, অর্নের কাছে তা বড়ই তুচ্ছ। অবনির মনে নিসান্দ তৈরী করে তুলেছে। সে গায়ে শাঁড়ি পেঁচিয়ে নেয়। তারপর আবারো আয়নাতে চোখ দিল ও। বহু বছর ধরে না দেখা নিজের প্রতিভিম্ব অবলকন করতে থাকে ও।
.
অর্ন টেবিলের ড্রয়ার খুললো। নতুন সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট বের করে তাতে আগুন জ্বালালো। হাতে সিগারেট নিয়ে সে রুমের সোফাতে যেয়ে বসে। দু ঘন্টা ধরে ও পাঁচ বোতল ওয়াইন শেষ করেছে। কিন্তু কিছুতেই যেন ওর নেশা হচ্ছে না। মাথার মধ্যে অবনির মুখটাই ভেসে উঠছে বারবার। আর যখনি ভাসছে তখনি সব নেশা ছুঁটে যেয়ে রাগ আবির্ভাবে মেঘের আড়ম্বর সৃষ্টি করছে। সে সিগারেটে টান দিয়ে চোখটা একটু বন্ধ করলো। সাথে সাথেই ইরার মুখ ভেঁসে ওঠে। সে চোখ মেলে তাকায়। ইরার হাসি মুখটা যেন ওর বুকে জমে থাকা রাগের ঘনঘটা উচ্চতর বানিয়ে দিয়েছে। অনুধাবনের শেষ অংশে প্রয়োগের মিমাংসাই ব্যস্ত হয়ে যার রাগের অনুভুতি।
অবনি নিজেকে কিছুটা সামলে নেয়। সে গায়ে ভালোমত শাঁড়িটা পেঁচিয়ে বাইরে বের হয়ে আসলো। লোচনযুগল যেন লাল তুরূপে ভর্তি। অর্ন সিগারেটে টান দিয়ে অবনিকে ডাকলো..
– দাঁড়া.. কোথায় যাচ্ছিস?
– বিছানায়। (অবনি)
– কেনো? কি ভাবছিস হা তোকে নিয়ে বাসর রাতের প্রমোদনা তৈরী করবো তাইনা?
অর্ন এগিয়ে আসে কাছে। আবারো শাঁড়ি ধরে হেঁচকা টান দেয়। শাঁড়িটা আগের মত খুলে গেলো। অর্ন এক হাতে শাঁড়ি ধরে থাকে। অবনি নিজেকে দুই হাত দিয়ে ঢেকে নেয়। অর্ন শব্দ করে হাসতে থাকে। অবনি অর্নের হাসির কারন বুঝতে পারে না। অর্ন হাসতে হাসতে বলে..
– শোন.. তোর এই শরীরের উপর আমার কোনো চাহিদা নেই। যার মাঝে কালোতে ভর্তি, তাকে ছুঁয়ে দেখার কোনো ইন্টারেস্ট আমার মধ্যে নেই। আফসোস, তোর জন্য ইরা আমার থেকে চিরজীবন হারিয়ে গেলো। (অর্ন)
– ইরা.. কে ইরা? (অবনি)
– আমার ভালোবাসা। যাকে আমি খুব করে ভালোবাসতাম। শুধু তোর জন্য সে আমার হলো না। (অর্ন)
– আমি কি করলাম? (অবনি)
অবনির মুখ থেকে এমন কথা শুনে, অর্ন আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না। আবারো গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়। অবনি ঘুরে যেতেই, শাঁড়ি দিয়ে অবনির মুখ বিহ্বর একটু চেপে ধরে। তারপর জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে অবনির খোলা পিঠের নিচ অংশে জোরে চেপে ধরে। অবনি চিৎকার দিতে যেয়েও শব্দ বের করতে পারে না। অর্ন ক্ষীপ্ত, ক্ষোভের চরম সীমায় পৌঁছে, সলাকায় যতক্ষণ আগুন ছিল, ততক্ষণ অবদি চেপে ধরে রাখলো। এরপর এক ধাক্কায় বিছানায় ফেলে দেয় অবনিকে। অবনি যেন একটু হাপ ছেঁড়ে বাঁচে। কিন্তু পিঠের উপরিভাগে সিগারেটের আগুন লাগায় যেন সে জ্বলন্ত পীড়ার এক ডোবায় পড়ে যায়। অবনি চিৎকার করতে পারেনা। চিৎকার কেনোই বা করবে? অবনিকে একমাত্র অর্নের মা ছাড়া এ বাড়িতে কেউ পছন্দ করে না। এমনকি অবনির নিজের মা’ও অবনিকে ঘেন্না করে। তার আত্বচিৎকার যে বৃথা যাবে এটা অবনি নিশ্চিত।
নতুন স্বামীর থেকে এমন নির্যাতিত ব্যবহার হয়ত এর আগে কোনো মেয়ে পায়নি। অবনি আজকে তার লোচনযুগলে বিশালবারিধারার এই ধারাপতনে চুপিসারে সব সহ্য করার অনুভবতা প্রকাশ করছে। যা অন্য কোনো মেয়ে হয়ত করবে না। অর্ন থেমে নেই। সে এক দু পা করে এগিয়ে আসছে অবনির দিকে। অবনি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকায় অর্নের চোখযুগলে। সেখানে রাগের অববাহিকায় এক জ্বলন্ত রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। অবনি থেমে থেমে বলতে থাকে..
-কি করছো? আমাকে ভালোবেসে চাও। আমি সবটাই তোমাকে দেবো। এভাবে কেনো আসছো?
– চুপ কর..
অর্ন কথাটা বলে অবনির আরো কাছে আসে। অবনি ভয়ে একটা ঢোক গিলল। অর্ন হাত উঠিয়ে, সোজা অবনির বুকের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। অবনি শঙ্কায় চুপসে যেতে থাকে। অর্ন তার বুকের কাছে হাত এনেই থেমে যায়। অবনি চোখ বড় বড় করে দেখতে থাকে। অর্ন হাসতে থাকে। অবনি ওর হাসির রহস্য বুঝতে পারে না। অর্ন হাসতে হাসতে বলতে থাকে..
– কি ভাবছিস? তোর মত একটা জঘন্য গায়ের রঙ এর মেয়েকে আমি স্পর্শ করবো? তোকে ভালোবেসে স্পর্শ করবো? কিভাবে ভেবেছিস তুই?
অর্ন কথাটা বলে অবনির পিছনে থাকা বালিশ হাতে তুলে নেয়। তারপর কিছু সময় অবনির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই তাকানোতে রাগের হিংস্রতা প্রকাশ পাচ্ছে। অবনি এমন চাহনিতে ভয় পাচ্ছে অনেক। একটা নারীর স্বামী মানেই সকল আশ্রয়স্থল হয়। কিন্তু অবনির কাছে এই অর্ন নামক স্বামীর কাছে থাকাটাও যেন বিশাল ভয়ের ব্যাপার। কিন্তু কোনো উপায় নেই তার। কোথায় যাবে সে? কার কাছে বলবে ও? অর্ন চলে আসার আগে অবনিকে বলে..
– শোন.. তোকে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে আমার কোনোদিন ছিল না। তোকে নিয়ে কল্পনাতেও কোনোদিন এমন দিনের কথাও ভাবিনি। আমার থেকে দুরে থাকবি। এটা ভালো করেই জানিস, দাদু আমাকে কতটা ভালোবাসে। তাই ওনার সামনে কখনো ন্যাকা কান্না করবিনা। আমার মায়ের সামনেও কখনো মন খারাপ করে থাকবি না। আর বাইরে কারো সাথে আমি যে তোর বর, এটা ভুলেও বলবি না। যদি এসবের বাহিরে কিছু করেছিস, বুঝতেই পারছিস তোর জন্য কত খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে। আরেকটা কথা আমার থেকে সবসময় দুরে থাকার চেষ্টা করবি। স্বামীর অধিকার কখনো পাবিনা তুই। আমার জীবনটা আজ তোর জন্য নষ্ট হয়ে গেছে। আমার ভালোবাসাটাও শেষ। শুধু তোর মত একটা বাজে দেখতে মেয়েকে বিয়ে করেছি বোলে।
অর্ন কথাটা বলে সোফাতে যেয়ে বসে। অবনি বিছানার উপর পা উঠিয়ে গাটোসাটো হয়ে বসলো। গায়ে শাঁড়িটা কোনোরকমে জড়িয়ে নেয়। অর্ন সোফার উপর বালিশ রেখে শুয়ে পড়ে। অবনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অর্নের মুখের দিকে। এই বাড়ির সবচাইতে হ্যান্ডস্যাম ছেলে অর্ন। ওর সাথে পরিচিত হওয়া মেয়েগুলো আঠার মত পড়ে থাকতে দেখেছে অবনি। বাড়িতেও কত মেয়ে নিয়ে এসে ফ্রেন্ড বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে অর্ন। সেই মেয়েগুলো একেকটা যেন অপ্সরা। অবনি কখনো কারো সামনে যায়নি। হয়ত তারা অপমান করবে ভেবে সে কখনো সামনে যেতো না। কিন্তু একদিন অর্নের মায়ের কারনে ওদের সামনে যায়। অর্ন অনেক বন্ধুদের বাড়িতে আনে। সেদিন ওদের জন্য নাস্তা রেডি করার পর অর্নের মা অবনিকে বলে..
– কিরে ওভাবে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস? সব খাবার তো তুই নিজে বানাইছিস। এবার যা, ওদেরকে দিয়ে আয়।
– না খালাম্মু, আমি যাবো না। তুমি তো রোজ নিয়ে যাও। তুমি যাও এখন। (অবনি)
– আরে কি সমস্যা হা? যা তো নিয়ে যা। অর্ন আছে তো ওখানে সমস্যা কি? যা আমি কাজ করছি এখন।
সেদিন অবনি অর্নের মায়ের জোরাজুরিতে আসে ওদের সামনে। মাথার উপর লম্বা একটা কাঁপড় দিয়ে সে খাবারের ট্রে নিয়ে এগিয়ে আসে অবনি। অবনিকে দেখেই অর্নের বন্ধু শিহাব বলা শুরু করে..
– কিরে মামা.. এটা না তোর খালাতো বোন অবনি? এভাবে কেনো আসছে? (শিহাব)
– এমনিতে। (অর্ন)
– শিহাব তুই ওনার হাতের দিকে তাকা। হাতের কালার দেখছিস? কালো বিশ্রী দেখতে মেয়েটা। এ জন্য কি মাথা থেকে কাঁপড় সরায়? (মিহি)
– আরে হ্যা তো.. কই দেখি আপু তোমাকে একটু। (নিশি)
নিশি কথাটা বলেই অবনির মাথা থেকে কাঁপড়টা টেনে নামিয়ে দেয়। অবনির কালো চেহারাটা সবার চোখের সামনে। মেয়েটা দেখতে বেশ হলেও গায়ের রঙ টাই যত ঝামেলা। এ জন্য কেউ ওকে পছন্দ করেনা। আর পছন্দ করে না বলেই অবনি তার মায়ের থেকে দুরে থাকে। অবনি দৌড়ে চলে আসার প্রস্তুতি নিতেই মিহি বলা শুরু করে..
– ছিহ.. এত বিশ্রি দেখতে মেয়ের হাত থেকে আর কি খাবো? এত কালো কেনো তুমি? তোমার তো আমাদের সামনে খাবার আনার যোগ্যতাও নেই। বেঁচে আছো কেনো? নিজেকে কখনো দেখেছো? ভয় পাওনা তুমি?
মিহির কথা শুনে সবাই হো হো করে হাসতে থাকে। অবনি স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। ওর পা যেন চলছে না। সে কি বলবে সেটাও বুঝতে পারছে না। সবকিছু যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। এত অপমান সে অনেক বছর হল হয়নি। কারন সে কখনো বাড়ি থেকে বের হতো না। বের হলেও হাত, চোখ মুখ সবকিছু ভালোভাবে বোরখার সাথে ঢেকে বের হয়েছে। যেন কেউ ওর কালো গায়ের রঙ না বুঝতে পারে। তবে আজ অর্নের মায়ের জোরাজুরিতে এখানে এসে সে অনেক বড় ভুল করেছে। যার জন্য অপমান সহ্য করতে হচ্ছে তার। চোখে পানি টলমল করছে অবনির। কেউ নেই ওর পাশে। এ বাড়িতে কখনো ওর সাপোর্ট নিয়ে কেউ কথা বলেনি। হঠাৎ অবনি শুনতে পায়.
– তোরা কি শুরু করেছিস? সে কি ইচ্ছে করে কালো হয়েছে? আজব ধরনের কথা বলছিস। তোরা আসছিস বেড়াতে, কেনো অবনির পিছনে পড়েছিস? অবনি, তুই যা। আর এসব কথায় মন খারাপ করিস না। (অর্ন)
অবনি দৌড়ে সেখান থেকে চলে আসে। আড়ালে এসে অর্নের দিকে তাকায়। অর্ন এই প্রথমবার অবনির সাপোর্ট নিয়ে কথা বলেছে। যা কখনো এর আগে হয়নি। তাই অর্নকে সে দেখতে থাকে। ছেলেটা সবার মধ্যে বেশি আকর্ষনীয়। তবে অবনিকে সাপোর্ট করার মাধ্যমে মেয়েটা অর্নির প্রতি এক অন্যরকম ভালোলাগা অনুভব করে।
.
অর্ন সোফা থেকে উঠে বসে। টেবিলের ড্রয়ারে সিগারেটের প্যাকেট। উঠে এসে সেখান থেকে একটা সিগারেট নিয়ে সে আগুন জ্বালায়। ধোয়াগুলো উপরের দিকে ছাঁড়তে থাকে। হঠাৎ সিগারেটের ধোয়ায় অবনি কেঁশে উঠল। কাঁশতে কাঁশতে বলে..
– সিগারেট খাচ্ছো কেনো? জানো না এটা ক্ষতিকর। আর আমার খুব কাশি হয় সিগারেটের ধোয়ায়। (অবনি)
– তো? তোর কাঁশি হলে হবে। তাতে আমার কি? (অর্ন)
– বাহিরে যেয়ে খাও। (অবনি)
– রুমটা আমার। তোকে থাকতে দিয়েছি এটাই অনেক। আমাকে বলছিস বাহিরে যেতে? তোকে আমি.. না থাক, তোকে স্পর্শ করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। তুই আমার থেকে দুরে দুরে থাকবি।
অর্ন কথাটা বলে সোফাতে চলে যায়। বদ্ধ ঘরে দুজন বিপরীত লিঙ্গের মানুষ। একজনের মনে অন্যজনের কাছ থেকে সামান্য ভালোবাসা পাওয়ার বাসনায় প্রহর গোনা হচ্ছে। আরেকজনের মনে বিকৃত গায়ের রঙে নিজেকে বিষাদগ্রস্ত করে তুৃলেছে। দুজনের মনেই কষ্ট। অর্ন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না অবনির সাথে বিয়ে হওয়ার ব্যাপারটা। বেশ তো হাসিখুশি ছিল ছেলেটা। হঠাৎ করে এভাবে যার সাথে অর্নের মানাবে না, যাকে অর্ন সবসময় অপছন্দ করে এসেছে। তার সাথেই বিয়ে দিয়েছে তাকে। ও যেন এখনো স্বপ্নের ঘোরে আছে। কিন্তু সবাই জানে, অর্নের সাথে অবনির বিয়েটা কোনো স্বপ্ন নয়। এটা বাস্তব।
অবনি লাইট অফ করে বালিশে মুখ গুজে কান্না করতে থাকে। সে যেন খেলার পুতুল। আনাফের সাথে বিয়ে হচ্ছিল ওর। কিন্তু হঠাৎ করে হাওয়া বদলে অর্নের বউ ও। যদিও অবনি অর্নকে আগে থেকেই পছন্দ করতো। কিন্তু অর্নের স্মার্টনেসের কাছে যোগ্যতার বিবেচনায় অবনির এই পছন্দবোধ হাসির খোরাক ছাড়া কিছুই নয়। সে মনে মনে আজ দিনের কথা ভাবতে থাকে। কিভাবে সে অর্নের বউ হল, সবকিছু কল্পনা করতে থাকে। আর তা হল…
চলবে,,