প্রণয় আসক্তি পর্ব-২০

0
1251

#প্রণয়_আসক্তি
#লেখিকাঃমাহযাবীন
পর্বঃ২০

রেস্টুরেন্টের এক কোণে পেতে রাখা ৪ টি চেয়ারের ৩ টি দখল করে বসে আছে মিয়ামি,আর্শ ও বিহান।তাদের সামনের টেবিলে ৩ কাপ কফি রাখা তবে কেউই তা পান করবার জন্যে হাতে তুলছে না আবার কারো মুখে কোনো কথাও নেই।সাধারণ কথাবার্তা শেষে বিহান সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করতেই পরিবেশটি এমন গম্ভীর রূপ ধারণ করেছে।বিষয়টা লক্ষ্য করেছে বিহান।তবে এখন সে মিয়ামি ও আর্শ উভয়কেই পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত।কিছুটা সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণের পর বিহান নড়েচড়ে বসে বলে ওঠে,
-তো বলুন আর্শ,কি সমস্যায় ভুগছেন?
বিহানের প্রশ্নে অবাক হয় মিয়ামি ও আর্শ উভয়ই।বিহান কি করে বুঝলো,সমস্যাটা আর্শেরই!
স্বামী-স্ত্রী উভয়ের চোখেই বিস্ময় দেখে বিহান ঠোঁটে আলতো হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে,
-ডাক্তারি পেশায় আসার পর সুস্থ ও অসুস্থ মানুষের চেহারার মাঝের পার্থক্য টা অনেকখানি বুঝতে শিখে গিয়েছি।আর্শ!আপনার ঠোঁট কালো,চেহারায় একটা ক্লান্তি ভাব,চোখজোড়াও স্বাভাবিক নয়।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে না দেখলে এই বিষয়গুলো সহজে কারো নজরে পরবে না তবে আমি ডাক্তার হওয়ায় আমার চাহনি অন্যদের থেকে আলাদা হবে এটিই স্বাভাবিক।
বিহানের কথায় একটু নড়েচড়ে বসে আর্শ।বিস্ময় কাটিয়ে নরম কন্ঠে বলে ওঠে,
-জ্বি,সমস্যা টা আমারই।
আর্শের কথায় নিজের ঠোঁটের হাসিটি মৃদু প্রস্তুত করে বিহান।এর অর্থ তার আন্দাজ টা সঠিক হয়েছে!সময় ব্যয় না করেই সে স্বাভাবিক স্বরে বলে ওঠে,
-জ্বি বলুন,কি সমস্যা?
-ড্রাগ অ্যাডিকশন।
ধীরে ধীরে শুরু থেকেই এই ড্রাগ আসক্তির পুরো কাহিনি বিহানকে বিস্তারিত বলে আর্শ।আর্শের বলা শেষ হতেই বিহান নিজের চেয়ারে একটু নড়ে বসে কফির মগটি হাতে নেয়।এতোটা সময় আর্শের কথাগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনেছে সে।কফিতে এক চুমুক বসিয়ে বিহান বলে ওঠে,
-আপনাদের আমি আমার এক বন্ধুর কাহিনি শোনাতে চাইছি।আপনারা কি শুনবেন?
উত্তরে মিয়ামি ও আর্শ উভয়ই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।বিহান আবারও কফিতে একটি চুমুক বসিয়ে বলে ওঠে,
-তখন আমরা কলেজে পড়তাম।হাতে গুনা ৫ জনের ফ্রেন্ড গ্রুপ ছিলো আমাদের।আর এই ৫ জনের মধ্যে ৪ জনই ড্রাগ অ্যাডিক্টেড ছিলো।যে একজন এই ৪ জনের থেকে ব্যতিক্রম সেই একজন টা আমি।তার কারণ একটিই ছিলো,আমার পরিবারের শিক্ষা।আমার বাবা ভিষণ রাগী মানুষ ছিলেন।সেই সাথে নিজের ছেলেকে কিভাবে মানুষ করবেন সে বিষয়ে তিনি কখনো অবহেলা করেননি।ছোট থেকেই আমাকে বিভিন্ন দায়িত্ব দিয়ে দিয়ে দায়িত্ব নেওয়াটা শিখিয়েছিলেন।আমার বয়সের সাথে সাথে তার দেওয়া দায়িত্বের ভারও বাড়তে থাকে।বাস্তবতা সম্বন্ধে তার দেওয়া জ্ঞান, দায়িত্বের ভার,ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন সব মিলিয়ে আমি অন্য সবার থেকে আলাদাই ছিলাম।সে যাই হোক, আমার যে বন্ধুটির কথা বলবো তার নাম রাসিফ।একটা অভিজাত ও সুখী পরিবারের ছেলে ও।ওর স্বপ্নও ছিলো বড়।সেই সাথে মেধাবী ও পরিশ্রমী ছেলে।কিন্তু হয়তো আমি আমার বাবার থেকে বাস্তবতা সম্পর্কে যে জ্ঞান পেয়েছি তা ও পায়নি।ফলে বাকি ৩ বন্ধুর পাল্লায় পরে অন্যদের মতো ও নিজেও ড্রাগস এ আসক্ত হয়ে পরে।প্রথমে কম তারপর সময়ের সাথে সাথে ড্রাগস সেবনের মাত্রা বাড়তে থাকে এবং ও গভীরভাবে এতে আসক্ত হয়ে পরে।আসক্তি এতোটাই বেড়ে গিয়েছিলো যে তার ছাপ স্পষ্ট ওর চেহারায় প্রকাশ পেতো।কেমন চাপা ভেঙে গিয়েছিলো,চোখের নিচে কালো দাগ,ঠোঁট কালো,চেহারায় ক্লান্তির ছাপ লেগেই থাকতো।ওকে দেখেই বুঝা যেতো ও অসুস্থ। নিজের এতো ভালো বন্ধুর এই অবস্থা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না।উপায় না পেয়ে আমি ওর পরিবারে ওর এই আসক্তির কথা জানিয়ে দেই।আঙ্কেল এটি জানার পর রাসিফকে একটি থাপ্পড় মারলেও সেই রাতেই ছেলের রুমে গিয়ে নিজের কোলে শুইয়ে অনেক কিছু বুঝান তিনি।জীবনে প্রথম বারের মতো ছেলের কাছে নিজের অসীম ভালোবাসাটা ব্যক্ত করেন।বাবার ভালোবাসা পেয়ে রাসিফ নরম হয়ে যায়।তাকে আঙ্কেল যা যা বুঝিয়েছিলো সবটা খুব মনোযোগ নিয়ে শুনেছিলো রাসিফ।সেই রাতের পরের দিনই আঙ্কেল ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।ডাক্তার পরামর্শ দেয় রাসিফকে হাসপাতেই কয়েক মাস রাখতে কারণ বাইরে থাকলে ড্রাগসের থেকে দূরে থাকা টা সম্ভব হতো না।
ঠিক সেই দিনই আঙ্কেল রাসিফকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়।ঐ হাসপাতালে সব ড্রাগ আসক্ত মানুষদেরই রাখা হয়।সেই হাসপাতালে ৩ মাস কাটিয়ে একদম সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসে রাসিফ।এই সবটাই সম্ভব হয়েছিলো আঙ্কেলের বিচক্ষণতা ও রাসিফের মনোবল দ্বারা।সেদিন যদি আঙ্কেল ড্রাগসের ব্যাপারটি জেনে রাসিফকে ভালোবেসে না বুঝিয়ে রাগারাগি বা গালমন্দ করতো তাহলে হয়তো তিনি আজ নিজের সন্তান হারিয়ে ফেলতেন।আসলে পিতা-মাতার ভূমিকা আমাদের জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ।
কথাগুলো বলে এবার থামে বিহান।আর্শ ও মিয়ামি উভয়ই মনোযোগী শ্রোতা।বিহানের কথা অনুযায়ী রাসিফের আসক্তি অনেক বেশি হবার পরও পরিবারের সহায়তা ও নিজের মনোবলের জন্যে রাসিফ সুস্থ হয়ে উঠেছিলো সৃষ্টিকর্তার হুকুমে।অর্থাৎ আর্শেরও খুব শীগ্রই সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।বিষয়টি ভেবে মিয়ামি ঠোঁটে হাসি নিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বিহানকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-তাহলে আপনার ফ্রেন্ড রাসিফ এখন পুরোপুরি সুস্থ?অর্থাৎ আর্শও শীঘ্রই সুস্থ হয়ে যাবে?
ঠোঁটে হাসি নিয়ে সম্মতি দেয় বিহান।অতঃপর বলে ওঠে,
-রাসিফের অবস্থা যতটা খাপার হয়েছিলো ততটাও খারাপ অবস্থা নয় আর্শের।আশা করা যায় আর্শ তার নিজের বাড়িতে থেকেই এই আসক্তি থেকে বেড়িয়ে আসতে পারবে।তবে মিয়ামি,তোমার সাহায্যটা অতন্ত্য বেশি প্রয়োজন।আর্শের অনেক যত্ন নিতে হবে তোমার।তাকে কখনো একা রাখা যাবে না।সেই সাথে তাকে মানসিক ভাবে সবসময় চিন্তা মুক্ত ও সুখী রাখার চেষ্টা করতে হবে।
বিহানের কথায় ঠোঁটে হাসি বজায়ে রেখে মিয়ামি বলে ওঠে,
-আমার চেষ্টায় ইন শাহ আল্লাহ কমতি থাকবে না,ভাইয়া।
মিয়ামির উত্তরে সন্তুষ্ট বিহান।নিশির কাছ থেকে জেনেছিলো সে,আর্শের প্রতি মিয়ামির ভালোবাসার গভীরত্ব টা কতোখানি তাই মিয়ামির উপর তার পূর্ণ আস্থা আছে।
মিয়ামির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বিহান আর্শের দিকে তাকায়।স্বাভাবিক কন্ঠে বলে ওঠে,
-আর্শ,আজ থেকে আপনি নিজেই নিজেকে ওয়াদা করবেন যে আর কখনো ড্রাগস ছুঁয়েও দেখবেন না।প্রথম প্রথম ব্যাপারটা যথেষ্ট কষ্টের হয়ে দাঁড়াবে আপনার কাছে।রাগ অনিয়ন্ত্রিত হতে পারে।তাই হাতে একটি বল রাখার চেষ্টা করবেন।রাগ উঠলে সেই বলটা হাতের মুঠোয় চেপে ওটার উপর রাগ ঝাড়বেন।সেই সাথে আমি আপনাকে একটি স্লিপিং পিলস সাজেস্ট করবো।এই পিলটা শুধু তখনই নিবেন যখন নিজের মাঝে ড্রাগস সেবনের তীব্রতা অনুভব করবেন।আর চেষ্টা করবেন প্রতিদিন সকালে মেডিটেশন করার।আর নিজেকে ব্যস্ত রাখবেন।ইন শাহ আল্লাহ, এসব করলে ধীরে ধীরে আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন।বিশেষ করে মিয়ামির সঙ্গ ও তার ভালোবাসাই আপনার প্রধান হাতিয়ার।আমার বিশ্বাস,আপনি দ্রুতই সুস্থ হয়ে যাবেন।
বিহানের এমন ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়ে আর্শ ও মিয়ামি উভয়ের ঠোঁটের প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠেছে। উভয়ই এখন চিন্তামুক্ত।আর্শ ঠোঁটে হাসি নিয়ে বিহানকে বলে ওঠে,
-ধন্যবাদ বিহান।এ কয় বছরে এই প্রথম নিজেকে যথেষ্ট হালকা অনুভব করছি।
আর্শের কথা শেষ হতে না হতেই মিয়ামি বলে ওঠে,
-অনেক বেশি ধন্যবাদ,ভাইয়া।আপনার এই পজিটিভ কথাগুলো আমাদের মাঝে মনোবল বৃদ্ধি করেছে।
ঠোঁটের হাসিটি প্রসস্থ করে বিহান বলে ওঠে,
-শুধু ধন্যবাদ দিলে হবে?
মিয়ামি সাথে সাথে পাল্টা প্রশ্ন করে ওঠে,
-কি লাগবে,শুধু বলুন একবার!
বিহান একটু ভাবুক কন্ঠে বলে ওঠে,
-বয়স তো কম না,২৮ হয়ে গিয়েছে।এখন এ বয়সে একটা পাত্রী ছাড়া আর কিই বা লাগতে পারে?
কথাটি মজা করেই বলেছে বিহান যা আর্শ ও মিয়ামি উভয়ই বুঝেছে।উত্তরে মিয়ামিও মজা করে বলে ওঠে,
-আমার ননদ আর্শি একদম পিওর সিঙ্গেল।সেটিং করে দিবো নাকি?
কথাটি বলেই ঠোঁট চেপে হাসে মিয়ামি।কিন্তু মিয়ামির কথায় বাকি দুজনের কাশি শুরু হয়ে যায়। বিহানের কাশি থামার আগেই আর্শ কাশি থামিয়ে নিম্ন স্বরে বলে ওঠে,
-কিসব বলছো,মিয়ু?
উত্তরে মিয়ামি শুধু হাসে।এদিকে বিহানের অবস্থা এমন যেনো চোরের মন পুলিশ পুলিশ!আর্শির নামটি শুনতেই আলাদা একটি অনুভূতি অনুভব করে বিহান তবে তা যেনো কোনো ভাবেই প্রকাশ না পায় তারই চেষ্টায় লেগে আছে সে।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে