#প্রণয়_আসক্তি
#লেখিকাঃমাহযাবীন
পর্বঃ১৮
দু’জন মানব-মানবী দেখে চলছে একে-অপরকে।উভয়ের স্থির দৃষ্টিতে বিস্ময় স্পষ্ট দৃশ্যমান।বিস্ময় কাটিয়ে কেউই কিছু বলছে না।
টানা ৮-১০ টা দিন একটি মানুষকে এক নজর দেখার তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত আঁখিদ্বয়ের তৃষ্ণা হুট করেই এভাবে, অপরিকল্পিতভাবে মিটবে তা সম্পূর্ণ ভাবনাতিত ছিলো আর্শির।’আর্শ ও মিয়ামির বিয়েতে বিহান কি করে এলো?আর কেনোই বা এলো?’ এসব কিছুই আর্শি ভাবছে না।সে তো ব্যস্ত তার চোখের তৃষ্ণা মিটাতে।
আর্শির দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেয়েটিকে বিষ্ময় নিয়ে দেখে চলছে বিহান।অসম্ভব সুন্দর লাগছে আর্শিকে।ছবির থেকে বাস্তবে মেয়েটি কোনো অংশে কম সুন্দর নয়।লম্বা হাতার লাল রং এর একটি গাউন পড়ে আছে সে।গায়ে বড় ওড়নাও জড়ানো আছে তার।উহু,কোনো লাল পরির মতো লাগছে না তাকে।সে মানুষ,খুব সাধারণ একজন মানুষ।অন্য সব মেয়েদের মতোই দেখতে,কোনো পরি বা জান্নাতি হুরের ন্যায় নয়।তবে মেয়েটি মায়াবী ভীষণ।যার মায়ায় হয়তো নিজের অজান্তেই জড়িয়ে যাচ্ছে বিহান।
‘মেয়েটি এ বিয়েতে কি করছে?’ প্রশ্নটির উত্তর বিহানের কাছে নেই।তবে সে জানতে চায়।
এই মুহূর্তে আর্শি ও বিহানের মাঝে প্রায় ৩-৪ হাতের মতো দূরত্ব।আর এই দূরত্বের মাঝের জায়গাটিতে মানুষের যাতায়াত চলছে অবিরত।বিহান তার ও আর্শির মাঝের এই দূরত্বটা কমাবার উদ্দেশ্যে এক পা অগ্রসর হয়।তবে তাকে থেমে যেতে হয় আচমকা নিশির আগমনে।
ঠোঁটে লম্বা হাসি নিয়ে নিশি তার ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে,
-ভাই,তুই এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?
প্রশ্নটি করে বিহানের সামনে বরাবর তাকাতেই আর্শির দেখা পায় নিশি।সে নিজের ঠোঁটের হাসিটি আরো প্রশস্ত করে আর্শিকে ডেকে ওঠে।
নিশির ডাকে ধ্যান ভাঙে আর্শির।এতোটা সময় যে সে বিহানের দিকে তাকিয়ে ছিলো তা ভাবতেই কিছু টা অপ্রস্তুত হয়ে যায় সে।
দ্বিতীয় বার নিশির ডাক কানে আসতেই নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে বিহান ও নিশির কাছে এগিয়ে যেয়ে তাদের সামনে বরাবর দাঁড়ায় আর্শি।নিশি হাসিমাখা কন্ঠে বলে ওঠে,
-আরু(আর্শি) আয় পরিচয় করাই।
কথাটি বলে নিশি তার পাশে দাঁড়ানো বিহানকে ইশারা করে বলে ওঠে,
-ও হচ্ছে আমার বড় ভাই,বিহান খান।
এ কথাটি বলে আর্শির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিজের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নিশি বলে ওঠে,
-ভাই,ও হচ্ছে আমার বান্ধবী আর্শি।আমি,আর্শি আর মিয়ামি একই কোচিং এ পড়ছি।আমরা বেশ ভালো বন্ধু।সেই সাথে আর্শি,মিয়ামির হবু ননদও।মানে আর্শ ভাইয়ার ছোট বোন।
উত্তরে নিজের বোনের দিকে একটু হেসে তাকায় বিহান।পর মুহুর্তেই নিশির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আর্শির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে।বিহানের সাথে চোখাচোখি হতেই আর্শি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে সালাম দিয়ে বলে ওঠে,
-ভালো আছেন,ভাইয়া?
বিহান ঠোঁটে একটু হাসি নিয়ে বলে ওঠে,
-জ্বি,তুমি?
-আলহামদুলিল্লাহ।
বিহানের কথার উত্তর দিয়েই আর্শি নিজের দৃষ্টি নিশির দিকে স্থির করে তড়িঘড়ি করে বলে ওঠে,
-আচ্ছা নিশ,আমি একটু মিমির কাছে গিয়ে দেখি ওর কিছু লাগবে কিনা!
নিশি ঠোঁটে হাসি টেনে সম্মতি দিয়ে বলে ওঠে,
-আচ্ছা যা।
নিশির সম্মতি পেয়ে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না আর্শি।সাথে সাথে স্থান ত্যাগ করে সে।জনসমাগম হতে একটু দূরে এসে নিজের চোখ জোড়া বুজে বেশ কয়েকটি নিঃশ্বাস নিজের মাঝে টেনে নেয় সে।যেনো এতোক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে ছিলো তার।মেয়েটির হৃৎস্পন্দন যেমন বেড়ে গিয়েছে তেমনই চোখ দুটোও ঝাপসা হয়ে এসেছে তার।মনে মনে একটি প্রশ্নই বিরবির করছে সে,
“কেনো আবারও আমার সামনে এলেন,বিহান?”
এমনটি নয় যে,এই ৮-১০ দিন কথা না বলায় আর্শির অনুভূতিগুলো বিহানের প্রতি কিছুটা প্রশমিত হয়েছে।এক বিন্দু পরিমাণও প্রশমিত হয়নি বরং এ কয়দিন কথা না বলে বিহানকে এক নজর দেখার জন্যে, একটি বার কথা বলার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিলো আর্শির মন।অনুভূতিগুলো তীব্র রূপ ধারণ করছিলো।বিহানের থেকে দূরে থেকে হৃদয়ের দহনে জ্বলছিলো সে।
কিন্তু প্রতিটি ক্ষতই তো নিরাময়যোগ্য।প্রয়োজন শুধু সময়ের।সময়ের সাথে সাথে সব ক্ষতই ঠিক হয়ে যায়।তাই তো আর্শি বহু কষ্টে নিজের অবাধ্য মনকে নিয়ন্ত্রণ করে বিহানের থেকে দূরে ছিলো।কিন্তু আজ আবার ছেলেটি সামনে এসে তার ভেতরের সব কিছু আবার ওলট-পালট করে দিলো।
ছেলেটির ঘন চোখের পাপড়ি,ঘন চাপ দাঁড়ি,হলদে ফর্সা গায়ের রং,ছোট্ট খাঁড়া নাক,হালকা কোঁকড়া ছোট ছোট চুল আর ঐযে মুচকি হাসি টা যা সোজা আর্শির হৃদয়ে এসে লাগে,সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো সে তখন।আর ঠিক ঐ মুহূর্ত থেকেই আবারও ছেলেটিকে নিজের,একান্তই নিজের ভাব্বার লোভ বেসামাল হচ্ছে আর্শির।
!!
শুধু মাত্র পরিবারের মানুষদের উপস্থিতিতেই যেহেতু বিয়ে টা হচ্ছে তাই তেমন বড় করে বিয়ের আয়োজন করা হয়নি।মিয়ামিদের বাসার ছাঁদ টা যথেষ্ট বড় হওয়ায় সেখানেই বিয়ের সকল বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
কবুল বলার পূর্বে বর-বৌ এর একে-অপরকে দেখা বারণ হওয়ায় ছাঁদের মাঝ বরাবর বড় পর্দা দ্বারা ছাঁদটি দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে।একটি পাশে মেয়েরা এবং অপর পাশে ছেলেরা।আর পুরো ছাঁদটা বিভিন্ন রকমের ফুল,বেলুন,এলইডি ফেইরি লাইটস দিয়ে সাজানো হয়েছে।মিয়ামি ও আর্শের বসার জায়গাটিও আকর্ষনীয় ভাবে সাজানো হয়েছে। আর এসব ডেকোরেশনের কাজ করেছে আর্শ ও মিয়ামির কাজিনরা মিলে।
আসলে,বন্ধু-বান্ধব ও কাজিনসরা ছাড়া জীবন টা একদম চিনি ছাড়া চায়ের মতো।এরা আমাদের জীবনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে খলনায়কের চরিত্রের অধিকারী হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরাই আমাদের মজ-মাস্তি,আনন্দময় স্মৃতির একটি বিরাট অংশ জুড়ে থাকে।এদের ছাড়া জীবন পানসে!
সন্ধ্যা ৭ টা থেকে বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিলো।এখন বাজে ৮ টা!বাড়ির সবাই ছাঁদে উপস্থিত।বিহান ও নিশিও আছে।এই প্রথমই তারা আর্শি ও মিয়ামির পরিবারের সাথে পরিচিত হলো।কিন্তু এটুকু সময়েই দু’জনেই যেনো এ পরিবারের একটি অংশে পরিণত হয়েছে। প্রত্যেকে মিশুক হওয়ায় বিহান ও নিশি খুব সহজেই সবার সাথে মিশে গিয়েছে।ফলে বিয়েটা খুব খুব উপভোগ করছে তারা।
মেয়েদের মাঝে প্রায় সবাই বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তোলায় ব্যস্ত।আর্শিও ব্যস্ত মিয়ামির ছবি তোলায়।এ অবশ্য উপর থেকে উপর থেকেই।মন তো তার বিহানের কাছেই পরে আছে।তার মন চাইছে এই মুহূর্তে সব কিছু ফেলে বিহানের কাছে যেতে।ছেলেটির বুকে মাথা রেখে অভিমানী কন্ঠে বলতে যে,
“আপনাকে ছাড়া থাকতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, বিহান।আপনি কেনো আমাকে অল্প,একটু,সামান্য পরিমাণও ভালোবাসতে পারলেন না?কেনো ভালোবাসলেন না আমায়?”
মন যা চায় তা অনেক ক্ষেত্রেই পরিস্থিতির কবলে পরে মনেই মাটি চাপা দিতে হয়।যেমনটি আর্শি দিচ্ছে।কারণ, এতোগুলো মানুষকে উপেক্ষা করে বিহানের কাছে যাওয়ার সামর্থ্য তার নেই।আর না আছে অধিকার,বিহানকে জড়িয়ে ধরার বা অভিমান করার।
ছেলেরা সবাই এক হয়ে আড্ডায় মেতে আছে।কেউ কেউ আবার আড্ডার মাঝেই গ্রুপ ফটো তুলছে।সবার সাথে আড্ডায় অংশ গ্রহণ করলেও,আর্শিকে ঐ সময় দেখার পর থেকে বিহানের অশান্ত নয়ন মেয়েটিকেই খুঁজে চলছে।কিন্তু ছেলে ও মেয়েদের মাঝে টানানো পর্দাটির জন্যে মেয়েটিকে দেখার সুযোগটি সে পাচ্ছে না।তবুও আঁখিজোড়া ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেই।
!!
আর্শির আবদারে প্রায় ৫০+ ছবি তুলে ক্লান্ত হয়ে ঠোঁট উল্টে নিজের চেয়ারে বসে পরে মিয়ামি।আজ তার বিয়ে তবুও চেহারায় আনন্দের ছিটে-ফোঁটাও নেই।আর্শি, মিয়ামির মন খারাপ বুঝতে পেরে তার পাশে যেয়ে বসে নিম্ন স্বরে বলে ওঠে,
-কি হইছে?নতুন বৌ নিজের চেহারা বিধবাদের মতো বানায়ে রাখছে কেন?
-বাজে বকিস নাহ।
মেজাজ খারাপ করে কথাটি বলে মিয়ামি।পর মুহূর্তেই অসহায় চোখে আর্শির দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে বলে ওঠে,
-আমি কি আমার বর টারে দেখবো না?এই কবুল বলাবলি কখন হবে?
মিয়ামির কথা ও কথাটি বলার ভঙ্গি দেখে হেসে ওঠে আর্শি।হাসিমাখা কন্ঠেই বলে ওঠে,
-এতো পাগল হওয়ার কি হইলো?আজ থেকে তো জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি এই একই মানুষরে দেখে দেখে বোর হবি।সো চিল কর!
উত্তরে মিয়ামি বলে ওঠে,
-আমার সম্পূর্ণ আয়ুটা এই মানুষটিকে দেখে পাড় করে দিলেও মন ভরবে না।তাকে দেখে মন ভরতে হলে এক জীবন অতি নগন্য সময়।৬ টা বছর ধরে এই মানুষটাকে প্রতিদিন নিয়ম করে দেখে আসছি।তাও একটি দিন না দেখলে মনে হয় শত দিন দেখিনি।সেখানে,”বোর” শব্দটার অস্তিত্ব আছে কি?
মিয়ামির কথায় আর্শির ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ফুটে ওঠে।সে মুগ্ধ কন্ঠে বলে ওঠে,
-আমার ভাইটা অনেক ভাগ্যবান।আলহামদুলিল্লাহ!
আর্শির কথাটি শেষ হতে না হতেই নিশি আর্শির পাশে বসতে বসতে বলে ওঠে,
-ইশ,আমার ভাই টাও যদি এমন লাকি হতো!কোনো একটা মেয়ে যদি আমার ভাইটাকেও এতোটা ভালোবাসতো!
নিশির কথা কানে আসতেই ‘কাটা জায়গায় লবণের ছিটা’ যেমন পীড়া দেয় ঠিক তেমন পীড়াই অনুভব করছে আর্শি।
সে তো ঠিক এতোটাই ভালোবেসেছে কিন্তু এই বুক ভরা ভালোবাসা প্রকাশের অধিকারটা তার নেই।আর এ কষ্টের থেকেও অনেক অনেক বেশি কষ্ট তখন হয় যখন আর্শি ভাবে,বিহান অন্য কারো হবে।অন্য কোনো একটি মেয়ে তার বিহানকে ভালোবাসবে,তার বিহানের উপর অন্য কারো অধিকার হবে।
চিরন্তন সত্যটি হচ্ছে,”আমার প্রিয় মানুষটি আমার নয়” মানা টা যত টা কষ্টের তার থেকেও অনেক বেশি কষ্টের এটি যে,”আমার হৃৎপিণ্ডের বৃহৎ জায়গা জুড়ে যে মানুষটির বসবাস তার হৃৎপিণ্ডের অধিকারী অন্য কেউ”।
আর্শি,মিয়ামি ও নিশির এ সকল কথার মাঝেই মিয়ামির মা মেহরিন বেগম তাদের কাছে এগিয়ে এসে তাড়া দিতে দিতে বলে ওঠেন,
“কাজী সাহেব এসে পরেছেন,শীঘ্রই বিয়ে পড়াবেন।”
মায়ের কথাটি কানে আসতেই ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে মিয়ামির।হৃৎস্পন্দনেরা নিজেদের গতি বাড়িয়ে জানান দিচ্ছে যে,খুব শীগ্রই তারা পরিপূর্ণ হতে যাচ্ছে।যেমনটি আধা আর আধা মিলে পরিপূর্ণ এক হয়।
চলবে।