প্রণয় আসক্তি পর্ব-১৫

0
1263

#প্রণয়_আসক্তি
#লেখিকাঃমাহযাবীন
পর্বঃ১৫

আকাশ কালো মেঘে পরিপূর্ণ।ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ গর্জে উঠছে।ঠান্ডা বাতাস প্রবাহের ফলে পরিবেশ টা শীতল হয়ে আছে।সেই সাথে রহমত নিয়ে সহস্র বৃষ্টি ফোঁটা আসমান হতে পাতালে আছড়ে পড়ছে।
বারান্দায় পাতানো একটি চেয়ারে বসে মুগ্ধ নয়নে বৃষ্টি ভেজা শহর পানে তাকিয়ে আছে মিয়ামি।ঠান্ডা বাতাসের বেগে অল্প স্বল্প বৃষ্টি কণা বারান্দায় ভেতরে প্রবেশ করে আলতো করে তার শরীর স্পর্শ করে যাচ্ছে।বৃষ্টির মন মাতানো ঘ্রাণ ও আলতো স্পর্শে মিয়ামির হৃদয় মুগ্ধতায় ভরে উঠছে।ঠিক এমন সময়ই ফোনটি বেজে ওঠে তার।বিরক্তি নিয়ে ফোনটি হাতে নিলেও স্ক্রিনে চোখ পরতেই বিরক্তিরা বিদায় জানায় এবং একরাশ আনন্দে যেনো নেচে উঠে তার মন।সে অনতিবিলম্বে কলটি রিসিভ করে কানে ধরে বলে ওঠে,
-তুমি অফিসে যাওনি?
-অফিসেই তো।
-অফিসে বসে তো তুমি কক্ষনো খুব জরুরী কিছু না হলে ফোন হাতেই নেও না।আর আজ নিজে কল দিলে যে!কিছু কি হয়েছে?
চিন্তিত কন্ঠে প্রশ্নটি করে মিয়ামি।আর্শ স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে ওঠে,
-কাজ তেমন নেই আজ তাই।
-আচ্ছা।
-গত রাতে নিজের বাসায় কখন গিয়েছো?
-তুমি ঘুমাবার ১ ঘন্টা হতে না হতেই আর্শি দরজায় কড়া নাড়ে।তাই আর দেরি না করে তোমার মাথার নিচে বালিশ পেতে দিয়ে আমি আর্শির রুমে যাই।তারপর আর্শিই আমাকে সাহায্য করে সাবধানে সবার দৃষ্টির আড়ালে বাসা থেকে বের হতে।
-আমার হাতে ব্যান্ডেজ কখন করেছো?
-তখন রুম থেকে বেরোনোর আগ মুহূর্তে।
ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে আর্শের।এতো সব কাহিনির মাঝেও মেয়েটি তার হাতের ক্ষত টাকে ভোলেনি।তাড়াহুড়ো বা ধরা পরার ভয়ের মাঝেও যাবার আগে ঠিকই তার হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে কক্ষ ত্যাগ করেছিলো।
এতোটুকু একটা মেয়ে কতোটা দায়িত্ব নিতে,যত্ন নিতে জানে!এ মেয়েটিতে বারংবার, সহস্র বার মুগ্ধ হয় সে।কিন্তু সে তো প্রকাশ করতে জানে না।তাই এবারও মিয়ামির প্রসংশায় একটিও বাক্য ব্যয় করলো না সে।আর না নিজের অনুভূতি কোনো শব্দে প্রকাশ করলো।সদা সর্বদার ন্যায় এবারও নিজের মুগ্ধতাগুলোকে নিজের মাঝে অতি যত্নে চেপে রেখে সে বলে ওঠে,
-কি করছো?
-বৃষ্টি দেখছি।ভাইটু,আমার না খুব খুব খুব ইচ্ছে করছে তোমার সাথে বৃষ্টি বিলাস করতে।কিভাবে জানো?আমি সাদা শাড়ি পরবো,ঠোঁটে লাল লিপস্টিক ও তার সাথে চোখে হালকা কাজল লাগাবো।আর তুমি একটা সাদা শার্ট ও জিন্স প্যান্ট পড়বা।ঠিক এমন সাজেই নদীর মাঝে একটি নৌকায় আমি ও তুমি অর্থাৎ আমরা একসাথে বৃষ্টি বিলাস করবো।খুব খুব ইচ্ছে করছে।করবা প্লিজ?
উৎফুল্ল কন্ঠে কথা গুলো বলে ওঠে মিয়ামি।তার কথা গুলো কানে আসতেই ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে আর্শের।সে নিজেও তো মেয়েটিকে নিয়ে কতশত বৃষ্টি বিলাসের স্বপ্ন বুনে রেখেছে।তার হৃদয় ও তো ব্যাকুল হয়ে আছে সে সকল স্বপ্ন পূরণের জন্যে।কিন্তু সব কিছুর একটি সঠিক সময় আছে।তাদের এ সকল অপূর্ণ, অব্যক্ত স্বপ্ন গুলো পূরণের সঠিক সময় আজ থেকে ঠিক ঠিক ৫ দিন পর থেকে।যখন তারা সঠিক অর্থে একে-অপরের হয়ে যাবে।
আর্শ তার ঠোঁটে হাসিটি নিয়েই মিয়ামির প্রশ্নের উত্তরে বলে ওঠে,
-করবো তো।কিন্তু সে দিনটি আজ নয়।
-কেনো?আজ খুব ব্যস্ত?
উত্তরে আর্শ নিন্ম স্বরে বলে ওঠে,
-হু।
আর্শের কথায় মন একটু খারাপ হলেও তা উপেক্ষা করে মিয়ামি নিন্ম স্বরে বলে ওঠে,
-ড্রাগস নিয়েছিলা?
-নিয়েছি।
-ওহ।সে যাই হোক,আমি এতেই খুব খুশি যে তুমি তোমার প্রথম চ্যালেন্জে হারোনি।
-তুমি হারতে দেওনি।
ঠোঁটে ভরসামাখা হাসি টেনে নিয়ে মিয়ামি বলে ওঠে,
-আর দিবোও না।ভাইটু শোনো,আমি ভেবে নিয়েছি।আগামী এক-দু’দিনের মাঝেই আমরা ডাক্তারের কাছে যাবো।একজন ডাক্তারের পরামর্শ খুব প্রয়োজন।
-বিয়ের আগে নয়,মিয়ু।আগামীকালই আমার সব কাজিনরা চলে আসবে।আর শুনেছি তোমার খালারাও কাল তোমাদের বাসায় আসবেন।আগামী ক’দিনের ব্যস্ততা শেষ হোক।
আর্শের কথায় সম্মতি দেওয়ার ইচ্ছে বিন্দু পরিমাণ নেই মিয়ামির।ছেলেটি কেনো বুঝতে চাইছে না যে,সে তার প্রিয়কে দ্রুতই সুস্থ করতে চায়।প্রিয় মানুষটির কষ্ট টা যে বড্ড অসহনীয়।নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে আর্শের সাথে সম্মতিজ্ঞাপন করে মিয়ামি বলে ওঠে,
-আচ্ছা।
উত্তরে মিয়ামির সম্মতি পাবার পর আর্শও আর কথা বাড়ায় না।ড্রাগসের বিষয়ে কথা হলেই তার মাঝে প্রচন্ড অপরাধবোধ কাজ করে।নিজেকে মিয়ামির অযোগ্য মনে হতে আরম্ভ করে।তখন,মিয়ামিকে বিয়ে করার সাহসটিও হারিয়ে ফেলে সে।কিন্তু মেয়েটিকে হারানোর সামর্থ্য তো তার নেই।সেই সাথে আর্শ এ ও খুব ভালোই জানে যে,মিয়ামি তাকে না পেলে কোনো দিনও অন্য কোনো পুরুষের সাথে ভালো থাকবে না।হয়তো বাস্তবতার কবলে পড়ে মেয়েটি অন্য কারো সংসার করবে কিন্তু তার কিশোরী বয়সের সবটুকু আবেগ,অনুভূতি দিয়ে কল্পনার জগতে গড়া সংসার টা তো হতে হতেও না হওয়াই রয়ে যাবে।এই ক্ষত টা কি আদৌও কখনো পূরণ হওয়া সম্ভব?
একটু ঝুঁকি নিয়ে যদি ভালোবাসায় পূর্ণ দুটি মন এক হয় তাহলে ঝুঁকি নেওয়াটাই উচিৎ নয় কি?একটু ঝুঁকি নাহয় তারা নিয়েই নিলো।

!!
অভিমান হলো রাগ ও কষ্টের মিশ্র রূপ।অনেকে অভিমানকে রাগের নাম দেয়।বোকা তারা! রাগ তো পর মানুষের প্রতি তৈরি হয়।আর অভিমান আপন মানুষের প্রতি।কারণ অতি প্রিয় মানুষগুলোই কষ্ট দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।এ ক্ষমতা টি তো অপ্রিয় মানুষদের নেই।
আবার,ভালোবাসার একটি বাজে বৈশিষ্ট্য হলো মানুষ চাইলেও তার প্রিয় মানুষটির প্রতি দীর্ঘ সময় অভিমান ধরে রাখতে পারে না।শত চেষ্টা চালাবার পরও ব্যর্থ হয় তারা।যেমনটি ব্যর্থ হচ্ছে আর্শি।অভিমান গলে প্রিয় মানুষটির সাথে কথা বলার ইচ্ছে জাগছে তার।তাই আজ ৫ম দিনের দিন সে নিজের আইডি তে লগ ইন করে।
এক মন বলছে বিহানকে ম্যাসেজ দিতে তো অপর মন বলছে,”খবরদার!বেহায়ামির ও একটি সীমা থাকা অতি প্রয়োজন”।
ম্যাসেন্জারে ঢুকতেই আর্শির চোখে পরে ছেলেটি এক্টিভ আছে।ওমনি হৃৎস্পন্দন ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে আরম্ভ করে তার।মনে দ্বিধা,সংকোচ নিয়ে সে বিহানের ইনবক্সে ঢোকে।ঢুকতেই তাদের হওয়া শেষ কথোপকথন গুলোয় চোখ পরে আর্শির।তাতে চোখ বুলিয়ে নিয়েই আর এক মুহূর্ত সময় অপচয় করে না সে।বিহানের ইনবক্স দিয়ে বেরিয়ে আবারও নিজের আইডি টি ডিএক্টিভ করে দেয়।তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে বিহানের বলা শেষ কথাটি,
“ভালোবাসার বয়স হইছে তোমার?এইসব ভূত মাথা দিয়ে নামায়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দেও।এখনো কলেজ শেষ করলো না আসছে প্রেম করতে!”।
চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে আর্শির।গলে যাওয়া অভিমান আবারও আগের ন্যায় কাঠিন্যতা লাভ করেছে।নাহ!সে আর ফিরবে না বিহানের কাছে।

এ ক’দিনে আর্শির কথা বেশ মনে পরেছে বিহানের।একটি মানুষের সাথে এতো মাস ধরে নিয়মিত কথা বলে আসলে খুব স্বাভাবিক যে,মানুষটি অভ্যেসে পরিণত হবে।আর্শিও বিহানের অভ্যাস।প্রতিদিনই সে আর্শির সাথে হওয়া কথোপকথনগুলোকে মনে করে, একটি শূন্যতাও অনুভব করে সে।
আজ হটাৎই আর্শির আইডিটি এক্টিভ দেখে বেশ খুশি হয় বিহান।ভেবে নেয়,মেয়েটি ফিরে এসেছে। কিন্তু তার এই ভাবনাটি মুহূর্তেই ভুল প্রমাণিত হয়ে যায়।কারণ আর্শির ইনবক্সে ঢুকতেই সে দেখতে পায় মেয়েটি আবারও নিজের আইডি ডিএক্টিভ করে দিয়েছে।

!!
দু’বাড়িতেই বিয়ের আয়োজন শুরু।আর্শের বাড়ির নিরাবতা ধীরে ধীরে তার অস্তিত্ব হারিয়ে এখন কাজিনদের আগমনে ঘরে জমজমাট পরিবেশ।মামাতো দুই ভাই,চাচাতো এক ভাই ও এক বোন, খালাতো এক বোন সব মিলিয়ে পাঁচ জন কাজিনই পুরো ঘর আনন্দে মাতিয়ে রাখছে।হাজারো পরিকল্পনা তাদের,আর্শের বিয়ে নিয়ে।আর হবেও বা না কেন! কাজিনদের মাঝে প্রথম বিয়ে এটি।আর্শের অন্যান্য ভাই-বোন কারো এখনো বিয়ে হয়নি।
মিয়ামির বাড়িতেই তার খালা,খালু ও দুই বোন এসে পরেছে।যেহেতু মিয়ামির চাচা,মামা,ফুপু কেউই নেই তাই তার তরফ থেকে শুধু তার খালাই বিয়েতে উপস্থিত হবেন।
দাদা-দাদি,নানা-নানির দোয়া পাবার ভাগ্য টা আর্শ ও মিয়ামি উভয়ের কারোরই নেই।নানা-নানি,দাদা-দাদি প্রচুর আদর ও ভালোবাসার অপর নাম।এদের জীবিত পাওয়াটা চরম সৌভাগ্য।আর এমন সৌভাগ্য লাভ হওয়া টা সবার নসিবে থাকে না,যাদের থাকে তাদের উচিৎ এই মানুষগুলোকে ভালোবাসা ও যত্নে মুড়িয়ে রাখা।

আর্শিসহ পরিবারের বাকি সবার পরিকল্পনা অনুযায়ী আজ তারা বিয়ের কেনাকাটা করতে যাবে।সাথে যাবে মিয়ামিও।বিয়ে প্রতিটি মানুষের জীবনেই একটি বিশেষ দিন।সবারই এই দিন নিয়ে প্রচুর জল্পনা-কল্পনা থাকে।ছেলেদের থেকে মেয়েদের একটু বেশিই থাকে।মেয়েরা ছোট বয়স থেকেই মনে স্বপ্ন বুনে রাখে যে,সে তার বিয়ের দিনে কেমন কাপড় পরবে,কি রঙ এ তাকে বেশি ভালো লাগবে ইত্যাদি ইত্যাদি।তাই ছেলে পক্ষের অবশ্যই উচিৎ,বিয়ের কেনাকাটায় পাত্রীর কাপড়,গহনা কিনার ক্ষেত্রে সব কিছুতেই পাত্রীর পছন্দকে গুরুত্ব দেওয়া।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে