#প্রণয়_আসক্তি
#লেখিকাঃমাহযাবীন
পর্বঃ১৩
“কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না?
ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে…
হারাই-হারাই সদা হয় ভয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে।
কী করিলে বলো পাইব তোমারে,রাখিব আঁখিতে আঁখিতে!”
এক ধ্যানে আকাশ পানে তাকিয়ে গানটি গাইছে আর্শি।আকাশে যেমন মেঘেদের মেলা,আর্শির মনেও মেঘ জমেছে খুব।বৃষ্টি হবে হবে আবহাওয়া।কিন্তু এক রাশ অভিমানেরা জোর করে কষ্টকে রাগের নিচে চাপা দেওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত।তাই তো রাগ ভেঙে কষ্ট গুলোর বৃষ্টি রূপে বর্ষণের অনুমতি নেই।
“আর্শি?এই আর্শি?”
হটাৎ মায়ের ডাক কানে আসতেই ধ্যান ভাঙ্গে আর্শির।সে দ্রুত পদে বারান্দা হতে নিজ কক্ষের দিকে অগ্রসর হয়।
আর্শি নিজ কক্ষে প্রবেশ করতেই সানিয়া বেগমের হাসি মাখা মুখ খানা চোখে পড়ে তার।মায়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বলে ওঠে,
-কি ব্যাপার?খুব খুশি খুশি লাগছে তোমায়?
-কোমরে কাপড় বেঁধে কাজে গেলে পর।সময় বেশি নেই।
-কিসের কাজ?
-তোর ভাইর বিয়ে ঠিক করে আসলাম আমি আর তোর বাবা।মিয়ামির বাবা-মা উভয়ই এখন বিয়ে টা করিয়ে দিতে রাজি হয়ে গিয়েছে।আর রাজি হবেও বা না কেন! আমার এমন সোনার টুকরো ছেলে মেহরিন হাজার খুঁজেও দ্বিতীয়টি পাবে নাকি?
ঠোঁটে দীর্ঘ হাসি নিয়েই কথা গুলো বললেন সানিয়া বেগম।মায়ের কথাগুলো কানে আসতেই আর্শির ঠোঁটেও হাসি ফুটে ওঠে।অবশেষে তার ভাই ও তার কলিজার বান্ধবীর বিয়েটা হচ্ছে!একটি তীব্র প্রেম একটি হালাল সম্পর্কের নাম পাবে।এসব ভাবতেই আর্শির মনে প্রশান্তি নেমে এলো।
!!
নিজ বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে আছে মিয়ামি।ডান হাতে নিজের ফোনটি ধরে তা কানের সাথে চেপে ধরে রেখেছে সে।ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে রেখেই একটি লম্বা শ্বাস নিজের মাঝে টেনে নিয়ে মিয়ামি বলে ওঠে,
-আমাদের বিয়েটা সত্যিই হচ্ছে?
মিয়ামির কথায় আর্শের ঠোঁটেও মৃদু হাসি ফুটে ওঠে।আজ সকালেই তার ও মিয়ামির উপস্থিতিতে উভয়ের বাবা-মায়েরা আলাপ-আলোচনা করে তাদের বিয়ে টা ঠিক করেছে।ঠিক তখন থেকেই প্রতিটি মুহূর্ত দু’জনের কাছেই স্বপ্নের মতো।অতি কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটিকে পাওয়ার প্রতিক্ষায় এবার ইতি টানতে চলেছে উভয়ই।
মিয়ামির প্রশ্নের উত্তরে আর্শ মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-হচ্ছে।
-সত্যি সত্যি হচ্ছে?
এবার ঠোঁটের হাসিটি আরেকটু প্রসস্থ হয় আর্শের।সে আবারও একই ভাবে বলে ওঠে,
-হচ্ছে।
আর্শের উত্তর কানে আসতেই নিজ ঠোঁটের হাসিটি প্রসস্থ করে নেয় মিয়ামি।ফোন কানে চেপে ধরে তারা উভয়ই নিশ্চুপ থেকে হাসিমাখা ঠোঁটে কয়েক দফা প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিজেদের মাঝে টেনে নেয়।এভাবেই কিছুটা সময় নিরাবতা চলার পর মিয়ামি চোখ বুজেই শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
-আমার না বিশ্বাস হচ্ছে না!আমাদের প্রণয় এতোটা সহজেই পরিনতি পেতে চলেছে?কেনো যেনো মনে হচ্ছে, আমি স্বপ্ন দেখছি আর ঠিক ঠিক আমাদের বিয়ের দিনে কবুল বলার আগেই স্বপ্নটা ভেঙ্গে যাবে।
মিয়ামির উক্তি কানে এসে পৌঁছাতেই আর্শের ঠোঁটের হাসিটি বিলীন হয়ে যায়।হৃদয় কেঁপে ওঠে তার।তবুও তা মিয়ামিকে বুঝতে না দিয়ে সে বলে ওঠে,
-সহজ কোথায়?এত বছরের প্রতিক্ষা সহজ তো ছিলো না।
নিজের মাঝে উৎপন্ন হওয়া নেতিবাচক চিন্তাগুলোকে প্রশ্রয় না দিয়ে মিয়ামি আর্শের কথার উত্তরে সম্মতি দিয়ে বলে ওঠে,
-হু।
আবারও উভয়ই নিশ্চুপ।কিন্তু এ নিরাবতা বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে না দিয়ে মিয়ামি বলে ওঠে,
-আজ ড্রাগস নিয়েছো?
-নাহ।
-ক’দিন পর পর নেও?
-আগে প্রতিদিনই নেওয়া হতো।কিন্তু যখন থেকে এ আসক্তি হতে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করছি তখন থেকে ১ দিন পর পর।
-সর্বোচ্চ কত দিন না নিয়ে থাকতে পারো?
-দু’দিন।
-ঠিক আছে।তাহলে তোমার প্রথম চ্যালেন্জ,এবার তুমি ৩ দিন নিবা না।
-এখন না, মিয়ু।বিয়ে টা হয়ে যাক তারপর।
-নাহ নাহ নাহ এখনই।
-ড্রাগস না নিলে আমি আমার মাঝে থাকি না।মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়।কার সাথে কেমন ব্যবহার করে ফেলি তার ঠিক নেই।
-গত কাল নিয়েছিলা?
-নাহ।
-দেখছো, তার মানে আজ দুদিন তুমি নেওনি।তাও ঠিক আছো।
-একটু পরেই ধীরে ধীরে নেশা উঠবে।কারণ আমি প্রতিদিন ঘুমের একটু আগে নেই।নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো কি না জানি না।
-পারবে ভাইটু।আমার জন্যে হলেও তোমার পারতে হবে।
মিয়ামির কথায় একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে আর্শ।নিজের উপরই ভীষণ রাগ লাগছে তার।কেনো বন্ধু বানানোর আগে সর্তকতা অবলম্বন করলো না!কেনো এতো সহজে তার বন্ধুদের বিশ্বাস করলো!
আর্শের কোনো সাড়া না পেয়ে মিয়ামি জোর গলায় বলে ওঠে,
-আমি কিচ্ছু জানি না।চ্যালেন্জ দিয়েছি আর তোমার এটি নিতেই হবে।আমি জানি,তুমি পারবে।
আর্শ খুব ভালোই জানে তার প্রেয়সী কতোটা জিদ্দি। মেয়েটির জিদের কাছে তার হার মানতে হবেই হবে।যেমনটি সদা সর্বদা মেনে আসছে সে।
আর্শ ঠোঁটে একটু হাসি টেনে বলে ওঠে,
-আচ্ছা।
উত্তরে আনন্দিত কন্ঠে মিয়ামি বলে ওঠে,
-ওয়াদা?
-হু।
!!
সকাল সকাল পরিবারের সবাই অর্থাৎ আর্শি,সানিয়া বেগম,আরহান সাহেব সবাই একত্রে সোফায় বসে আছেন।আর্শ অফিসে থাকায় সে এখানে অনুপস্থিত। আর্শির হাতে একটি কলম এবং কোলে একটি খাতা।প্রায় আধ ঘন্টা বসে শুধু বাজারের তালিকাটা সারলো তারা।এবার পালা মেহমান কাকে কাকে দাওয়াত পাঠাতে হবে তাদের নামের তালিকা তৈরি করবার।
-আর্শি, বিয়ে টা তো ঘরোয়া ভাবেই করতে চাইছি সবাই।তা শুধু হলুদ আর কাবিনটা করলেই তো হয়, কি বলিস?
-একদম না,মা।বৌভাত না করতে চাইলে করতে হবে না।কিন্তু মিয়ামি আর আমার আমাদের দু’জনেরই খুব ইচ্ছে আমাদের বিয়েতে মেহেদী,সংগীত,হলুদ সব হবে।
-এতে অনেক ঝামেলা! আগামী সপ্তাহে বিয়ে।সময় কই?
-আমরা বান্ধবীরা আর কাজিনরা মিলেই সব করে নিতে পারবো।তোমরা বড়রা শুধু টাকা দিলেই হবে।
-ভেবে বলছিস?আমি কিন্তু কোনো ঝামেলা করতে পারবো না।
-বলছি তো পারবো।
-ঠিক আছে।শুনছেন?আপনার কোনো পরামর্শ আছে?
মেয়ের কথার উত্তর দিয়ে নিজ স্বামীর চেহারা পানে তাকিয়ে প্রশ্নটি করে ওঠে সানিয়া বেগম।আরহান সাহেব নড়েচড়ে বসে বলে ওঠেন,
-বলছি, এখনই সবাইকে দাওয়াত দিলে থাকায় অসুবিধে হয়ে যাবে।এক কাজ করো,প্রথমে বাচ্চারা যারা আছে অর্থাৎ আর্শের কাজিনদের সবাইকে চলে আসতে বলো।এই মেহেদী, সংগীত এসব ওরা বাচ্চারা মিলে করুক।বড়রা নাহয় হলুদের আগে আগে এসে বিয়ে টায় উপস্থিত হবে।
-জ্বি ঠিক বলেছেন।বিয়ের মজা তো বাচ্চাদেরই।ওরাই আসুক আগে।
স্বামীর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শেষ করে আর্শির দিকে দৃষ্টি ফেরান সানিয়া বেগম। মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠেন,
-তাহলে তুই এক কাজ কর,তোর মামাতো,ফুফাতো, চাচাতো,খালাতো সব ভাইবোনকে কল দিয়ে দিয়ে আমাকে ধরায়ে দে।ওদের এখন ফোনে দাওয়াত দিয়ে দেই। তারপর বিয়ের কার্ড তৈরি হলে হলুদের আগে আগে সবাইকে কার্ড পাঠায়ে দিবোনে।
ঠোঁটে হাসি টেনে মায়ের কথায় সম্মতি দেয় আর্শি।
!!
রাত প্রায় ১১ঃ০০-১১ঃ৩০।গত রাতে শেষ কথা হয়েছে মিয়ামি ও আর্শের।এরপর আর্শের অফিস থাকায় সারাদিনে আর তাদের কথা হয়নি।
কলেজের পড়া শেষ করে সেই সন্ধ্যা থেকে ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে মিয়ামি।কয়েকবার আর্শের নাম্বার ডায়াল করেছিলো সে কিন্তু ছেলেটি কল রিসিভ করেনি আর না নিজে কল ব্যাক করেছে।চিন্তা হচ্ছে মিয়ামির।ছেলেটির হটাৎ করে কি হলো!
এসব ভাবার মাঝেই মিয়ামির মনে পরে যায় আজ ৩য় দিন চলছে আর্শ ড্রাগস নেয়নি।ওমনি একরাশ ভয় এসে জায়গা করে নেয় মিয়ামির মনে।”ছেলেটি ঠিক আছে তো!” মনে হতেই অস্থির হয়ে ওঠে তার হৃদয়।কোনোকিছু না ভেবেই মিয়ামি,আর্শির নাম্বারটি ডায়াল করে,
-কিরে নতুন বৌ,জামাইরে কল না দিয়ে আমার কাছে কি?
কলটি রিসিভ করে দুষ্টু কন্ঠে কথাটি বলে ওঠে আর্শি।মিয়ামি তার কথার উত্তরে কিছু না বলে দ্রুত বেগে প্রশ্ন করে ওঠে,
-তোর ভাই কই?
মিয়ামির প্রশ্নের উত্তরে চিন্তিত কন্ঠে আর্শি বলে ওঠে,
-ওর রুমেই তো।কিছু হইছে?
-যেয়ে দেখ তো,দরজা খোলা কিনা!
-আচ্ছা দাঁড়া।
কথাটি বলেই নিজের কক্ষ ত্যাগ করে আর্শের কক্ষের দিকে অগ্রসর হয় আর্শি।
-দরজা তো বন্ধ।
আর্শির উত্তরে মিয়ামির চিন্তা আরো কয়েক ধাপ বেড়ে গেলো।ছেলেটি তো রুমের দরজা সবসময় খোলাই রাখে বলতে গেলে।মিয়ামি চিন্তিত কন্ঠেই আর্শিকে বলে ওঠে,
-দোস্ত,আমি এখনই তোদের বাসায় আসতেছি।আমাকে একটু লুকায়ে বাসায় ঢুকার ব্যবস্থা করে দিবি?
-কিন্তু কেন?কোনো সমস্যা?
-অনেক বড় সমস্যা।আমার জামাইরে দেখার জন্য আমার কইলজা ফেটে যাইতেছে।তাড়াতাড়ি কিছু কর নাইলে আমার কইলজাটা ফাটার জন্য তুই দ্বায়ী থাকবি।
মিয়ামির এমন কথায় শব্দ করে হেসে ওঠে আর্শি।একটু সময় নিয়ে হাসি থামিয়ে বলে ওঠে,
-আচ্ছা আয়।আমি ব্যবস্থা করতেছি।শুধু শুধু নিষ্পাপ কইলজা টা ফাটাইস নাহ।
চলবে।