প্রণয় আসক্তি পর্ব-১২

0
1129

#প্রণয়_আসক্তি
#লেখিকাঃমাহযাবীন
পর্বঃ১২

সানিয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন নিজের ছেলের দিকে।তার সামনেই আর্শ দাঁড়িয়ে নিজের শার্টের বোতাম লাগাতে ব্যস্ত।তিনি বিরক্ত কন্ঠে আর্শকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠেন,
-তুই কি কিছু বলবি নাকি আমি যাবো?কাম-কাজ নাই আমার?ডেকে বসায়ে রাখছিস কি তোর নকশা দেখতে?
সানিয়া বেগমের কথা আর্শের উপর কোনো প্রভাব ফেললো না।সে নিজের মতো করে শার্ট ঠিকঠাক করতে করতে বলে ওঠে,
-মা,তুমি না চাইছিলা মিয়ুকে দ্রুতই নিজের পুত্রবধূ করতে?
-তা তো এখনো চাইছি।
উত্তরে আর্শ মৃদু কেশে নিজের গলা পরিস্কার করে নিয়ে অফিসের ফাইলে চোখ বুলাতে বুলাতে বলে ওঠে,
-তাহলে দেরি কিসের?
সানিয়া বেগম প্রথমে আর্শের ইশারা বুঝতে না পেরে কিছু বলতে মুখ খোলেন কিন্তু শব্দ উচ্চারিত হওয়ার পূর্বেই ব্যাপারটি তার বোধগম্য হয়।সাথে সাথেই অবাক চাহনি নিয়ে তিনি তার ছেলের মুখ পানে তাকান।আর্শ আড় চোখে নিজ মায়ের দিকে এক নজর তাকিয়ে সাথে সাথেই দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে অফিসের ফাইলগুলো নিজের ব্যাগ ভর্তি করায় মনোনিবেশ করে।
একটু সময় নিয়ে নিজের বিষ্ময় কিছুটা কাটিয়ে সানিয়া বেগম বলে ওঠেন,
-তুই বিয়ে করতে চাইছিস?
-আমি কোথায় বিয়ে করতে চাইলাম?তোমরাই তো চাও।তোমাদের ইচ্ছে পূরণ করা আমার দায়িত্ব না?
আর্শের উত্তরে হেসে ওঠেন সানিয়া বেগম। বসা থেকে উঠে নিজের ছেলের কাছে গিয়ে আর্শের কান টেনে বলে ওঠেন,
-খুব দায়িত্ববান ছেলে আমার,তাই না!তা আমাদের সবার নজর এড়িয়ে এই কঠিন জাদু টা মিমি কখন করলো?
মায়ের এমন প্রশ্নের উত্তরে ঠোঁটে সামান্য লাজুক হাসি টেনে নেয় আর্শ।

!!
অস্থির হৃদয়ে অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন নিয়ে ফোনের দিকে দৃষ্টি স্থির করে বসে আছে আর্শি।একটু আগেই সে বিহানকে টেক্সট করেছে,”হাই”।বিহানের উত্তর, “হ্যালো”।এখন কি বলবে আর্শি! সোজাসাপ্টা ” আই লাভ ইউ” বলে দিবে নাকি আগে অন্য কোনো কথা বলবে!বুঝে উঠতে পারছে না সে।একটু সময় নিয়ে ভেবে সে বিহানকে ম্যাসেজ পাঠায়,
-রেগে আছেন এখনো?
-নাহ।
-সত্যি?
-হুম।
এখন সোজা ভালোবাসার কথাটি বলা ছাড়া আর বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না আর্শি।তাই অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন ও অস্থিরতা নিয়েই একটি লম্বা নিঃশ্বাস নিজের মাঝে টেনে নিয়ে অবশেষে আর্শি সেই বিশেষ তিনটি শব্দ লিখেই ফেলে,
-আই লাভ ইউ।
-স্যরি?
-কি?
-তুমি আমাকে ভালোবাসো?
-হু।
-ভালোবাসার বয়স হইছে তোমার?এইসব ভূত মাথা দিয়ে নামায়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দেও।এখনো কলেজ শেষ করলো না আসছে প্রেম করতে!

বিহানের ম্যাসেজটি পড়ে নিজের অজান্তেই আর্শির চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে।এক বিন্দু জল গাল গড়িয়ে পরতে ও সময় লাগলো না। আর্শি দ্রুত নিজের চোখ মুছে নিয়ে বলে ওঠে,
-আচ্ছা স্যরি।ভালো থেকেন।
বলেই বিহানের ইনবক্স হতে বেরিয়ে নিজের আইডিটি ডিএক্টিভ করে দিলো।
নিজের উপরই নিজের ভীষণ রাগ লাগছে আর্শির।কি দরকার ছিলো তার নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে এভাবে অপমানিত হওয়ার! রাগ,অভিমান, কষ্ট সব একসাথে আর্শির হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। একটি বাক্যতেই মেয়েটির জীবন মুহূর্তেই বদলে গেলো।সে নিজের সব থেকে ভালো একজন বন্ধু, নিজের মন ভালো করার মেশিন টাকে হারিয়ে ফেললো।হয়তো এ জন্যেই এই বাক্যটাকে “ম্যাজিকাল থ্রি ওয়ার্ডাস” বলে।

!!
বিছানায় শুয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে মিয়ামি।একটু আগেই সে গুগলে সার্চ দিয়েছিলো ড্রাগ অ্যাডিকশন ও এ হতে পরিত্রাণ এর উপায় সমন্ধে জানতে।এখন ঠিক এটি নিয়েই গবেষণা চলছে তার।কিন্তু এ গবেষণা আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না ফোনে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত কল আসায়।
মিয়ামি তার চোখদুটো রসগোল্লার ন্যায় বড় বড় করে তাকিয়ে আছে তার ফোনে ভেসে ওঠা ইংরেজি অক্ষরে “Kharus” লিখে সেভ করা নামটির দিকে।তার বিষ্ময়টি কাটার আগেই ফোনটি এক দফা বেজে বন্ধ হয়ে যায়।কিন্তু অনতিবিলম্বে ফোনটি দ্বিতীয় দফা বাজতে আরম্ভ করে।এবার মিয়ামি নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে কলটি রিসিভ করে কানে ধরে।ফোনের ওপাশ থেকে এক ভারী পুরুষালী কন্ঠস্বর কানে এসে পৌঁছায় মিয়ামির।ওমনি নিজের চোখজোড়া বুজে নেয় সে এবং ঠোঁটে আপনা-আপনিই মুগ্ধতার হাসি ফুটে ওঠে তার।
মিয়ামির সাড়া না পেয়ে আর্শ আবারও বলে ওঠে,
-আছো?
এবার মৃদু স্বরে মিয়ামি বলে ওঠে,
-জ্বি।
-মন খারাপ?এতো নিরব যে?
-তুমি সত্যিই আমাকে কল দিয়েছো?নাকি আমি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি?
মিয়ামির কথায় একটু হাসি এসে জায়গা করে নেয় আর্শের ঠোঁটে।তবে উত্তরে সে কিচ্ছুটি বলে না।
আর্শকে নিরব থাকতে দেখে মিয়ামি বলে ওঠে,
-ভাইটু আছো?
এবার চোখে-মুখে বিরক্তি ফুটে ওঠে আর্শের।সে বিরক্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
-আমি তোমার কোন জন্মের ভাই?ভাইটু কেমন ডাক!
আর্শের কথায় হেসে ওঠে মিয়ামি।সে ঠোঁটে হাসি নিয়েই বলে ওঠে,
-“ভাইটু” ডাকাও একটা ফ্লার্টিং যদিও তুমি বোঝ না।
-ভাই ডাকা আবার কেমন ফ্লার্টিং?
-আমার একটা অতি প্রিয় সিনেমা “শুধু তোমারই জন্য”। এই মুভিতে নায়িকা নায়কের উপর ফিদা হবার পরও নায়ককের সাথে মজা করার উদ্দেশ্যে নায়ককে ” ভাইটু” বলে ডাকতো।তুমিও তো আমার নায়ক। তাই আমিও নায়িকার মতো তোমাকে “ভাইটু” বলে ডাকি।
মিয়ামির কথায় আবারও হাসি ফুটে ওঠে আর্শের ঠোঁটে।সে ঠোঁটে হাসি টেনেই বলে ওঠে,
-বাহ, কি লজিক!
-সর্বোত্তম লজিক।
এ কথায় দু’জনই হেসে ওঠে।অতঃপর হাসি থামিয়ে আর্শ একটু গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,
-মিয়ু,কাল তুমি সবটি জেনেছো।আমি ড্রাগ আসক্ত জেনেও তুমি আমায় বিয়ে করতে চাও?
-তোমার ড্রাগ আসক্তির থেকে আমার আর্শ আসক্তি ভয়ংকর তীব্র,ভাইটু।তোমার এই ড্রাগ আসক্তি আমার আর্শ আসক্তির কাছে বারংবার মাথা নুয়াতে বাধ্য।তুমি চিন্তা করো না,খুব শীগ্রই তুমি ড্রাগ ভুলে মিয়ামিতে আসক্ত হবা,ওয়াদা রইলো।
একটি মেয়েতে ঠিক কতবার মুগ্ধ হওয়া যায়!এ মেয়েটির মতো করে আদৌও কোনো মানুষ অপর মানুষকে এতোটা তীব্রভাবে ভালোবাসে পারে বলে আর্শের মনে হয় না।এক জীবনে এমন প্রেম পাওয়া যেনো দুনিয়ার জান্নাত নসিব হওয়া।তাই তো মাঝে মাঝে আর্শের নিজের উপরই নিজের হিংসে হয়।

!!
মাঝরাত অব্দি আর্শের সাথে কথা বলার পর ঘুমের ডাকে সাড়া দিয়ে চোখ জোড়া বুজেছিলো মিয়ামি।এখন যখন চোখ মেললো তখন কড়া রোদ পর্দা ভেদ করে এসে তার কক্ষ আলোকিত করে রেখেছে।মিয়ামি দু’হাতে তার চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে।অতঃপর ধীরে ধীরে চোখ মেলে নিজের সামনে বরাবর তাকাতেই চোখ রসগোল্লার ন্যায় বড় হয়ে যায় তার।কিছুটা সময় অপলক তাকিয়ে থেকে সে তার বাম হাতটি বাড়িয়ে তার সামনে ঠোঁটে হাসি নিয়ে বসে থাকা মানবটিকে স্পর্শ করতে চায়।কিন্তু তার স্পর্শ করার পূর্বেই মানবটি তার হাত খপ করে ধরে বসে।ওমনি ভয়ে চিল্লিয়ে উঠতে যেয়েও পারলো না মিয়ামি।কারণ তার আগেই আর্শ একহাতে তার মুখ চেপে ধরে।ছেলেটি এক হাতে মিয়ামির হাত ধরে আছে এবং তার অপর হাত মিয়ামির ঠোঁটদ্বয়ের উপর।উভয়ের চোখ অপলক একে অপরকে দেখে চলছে।এভাবে থাকা অবস্থাতেই আর্শ মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-কেউ জানে না আমি তোমার রুমে।এভাবে চিল্লালে সবাই তোমার রুমে চলে আসবে আর আমার ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যাবে।
আর্শের কথায় হেসে ওঠে মিয়ামি।নিজের মুখ থেকে আর্শের হাত সরিয়ে বলে ওঠে,
-সকাল সকাল আমার বাসায় কি করছো?
-আমার শশুরবাড়ি আমি আসছি।তোমার কি?
এবার মিয়ামি ঠোঁটে হাসি নিয়ে এক ব্রু উঁচু করে বলে ওঠে,
-আমার ডায়লগ আমাকেই ফেরত দেওয়া হচ্ছে?
উত্তরে আর্শ কিছু না বলে ঠোঁটে হাসি টেনে নেয়। মিয়ামি আর্শের মুখ পানে মুগ্ধতা নিয়ে কিছুটা সময় তাকিয়ে থাকার পর বলে ওঠে,
-সর,ফ্রেশ হয়ে আসি।
মিয়ামির কথায় আর্শ মিয়ামির চোখ হতে দৃষ্টি সরিয়ে তার মাথা থেকে পা অব্দি চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে ওঠে,
-লুকিং হট।
বলেই চোখ মারে সে।মিয়ামি বিস্ফোরিত চোখে আর্শের দিকে তাকায়।হুট করে ছেলেটার হলোটা কি!আর্শের এতো পরিবর্তন ঠিক হজম হচ্ছে না মিয়ামির।তাও কিছুটা হজম করে সে বলে ওঠে,
-যেদিন শাড়ি পরায়ে দিছিলা সেদিন কি চোখ কপালে ছিলো না?এখন আসছে ঢিলাঢালা টি-শার্টে হট বলতে,হুহ!
-সেদিন তো পুরাই আগুন লাগছিলো!মারাত্মক রকমের সুন্দর লাগছিলো।মন চাইছিলো খেয়ে ফেলি।
এবার লজ্জা লাগছে মিয়ামির।মুহুর্তেই মুখে লাল আভা ফুটে উঠেছে তার।তবু্ও নিজের লজ্জা সংবরণ করে সে বলে ওঠে,
-সেদিন বলোনি কেনো তাহলে?
মিয়ামির কথায় আর্শ নিজের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি নিয়ে ধীরে ধীরে মিয়ামির খুব কাছে চলে আসে।এক হাতে মিয়ামির গাল স্পর্শ করে কানের কাছ টায় ২-৩ বার নাক ঘষে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-তখন এর অনুমতি ছিলো না,প্রিয়।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে