#প্রণয়_আসক্তি
#লেখিকাঃমাহযাবীন
পর্বঃ১১
আর্শের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছে মিয়ামি।উভয়ে নিশ্চুপ।তবে হৃৎস্পন্দনেরা পাল্লা দিয়ে কথা বলে চলছে।কয়েক সেকেন্ড এভাবে অতিবাহিত হতেই আর্শ স্বাভাবিক স্বরে বলে ওঠে,
-আজ রাত টা আমায় দিবে,মিয়ু?
চোখ বুজে আর্শের বুকে কান পেতে হৃৎস্পন্দন গুনতে ব্যস্ত হয়ে ছিলো মিয়ামি।এরই মাঝে আর্শের করা প্রশ্নটি কানে আসে তার।সে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-হু।
আর্শের ঠোঁটে আলতো হাসি ফুটে ওঠে।সে মিয়ামিকে বাঁধন মুক্ত করে ছাঁদের চারপাশটায় একবার চোখ বুলিয়ে বলে ওঠে,
-ছাঁদে তো পাটি বা বসার মতো কিছু দেখছি না।কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবা?
-বাসায় পাটি আছে।আমি নিয়ে আসি।
-দাঁড়াও।আগে বলো,রাতে খাইছো?
মিয়ামি নিজের মাথা ডানে-বামে ঘুরিয়ে বলে ওঠে,
-উহু।
-দুপুরে?
-উহু।
-সকালে?
-স্যুপ খাইয়ে দিয়েছিলো আম্মু জোর করে।
-মন চাইতেছে,থাপ্রায়ে সব ক’টি দাঁত ফেলে দেই।খাস নাই কেন?খুব বড় হয়ে গেছিস?নিজেরে শাহরুখ খান এর মতো দেবদাস প্রমাণ করতে চাইতেছিলি?
উত্তরে মিয়ামি ঠোঁট উল্টে বলে ওঠে,
-শাহরুখ খান তো ছেলে,আমি তো মেয়ে।দেবদাস তো হতে পারবো না তবে দেবদাসী হতে পারতাম, তাই না?
শেষের কথাটি বলেই দাঁত বের হেসে ওঠে মিয়ামি।আর্শ মিয়ামির দিকে রাগী দৃষ্টি স্থির রেখেই বলে ওঠে,
-বাসায় চলো।এখনই আগে খেয়ে নিবা।
মিয়ামিও ঠোঁটে হাসি নিয়ে নিঃশব্দে সম্মতি জানায়।
!!
এক বড়সড় ঝগড়া হয়েছে আর্শি ও বিহানের মাঝে।আর্শি ইচ্ছে করে বিহানকে রাগাবার উদ্দেশ্যে বলেছিলো,তাদের আর কথা হবে না।সেই সাথে এ ও বলেছিলো যে,কথা না হলেও আর্শি এক বিন্দু মনে করবেনা বিহানের কথা।ব্যাস এতেই রেগে যায় বিহান।আর সেদিন থেকেই বিহান ও আর্শি কথা বলা বন্ধ হয়ে আছে।ওসব কথায় বিহানের রাগ হওয়াটায় বেশ ভালো লেগেছে আর্শির।কারণ এই রাগ এক প্রকার অভিমান।আর এতে এও প্রমাণিত হয় যে বিহানের উপর আর্শির কথা,কাজ,আচারণ প্রভাব ফেলে।বিষয়টি ভাবতেই ভালোলাগায় ছেয়ে যায় আর্শির হৃদয়। বিহানকে সে বলেছিলো সে বিন্দু পরিমাণ ও মনে করবে না বিহানকে কিন্তু কথা বন্ধ হওয়ার পর মুহূর্ত থেকে প্রতিটি মুহূর্ত আর্শির মনে বিহানেরই বিচরণ।ঘুমুতে যাওয়ার আগে,ঘুমের মাঝে স্বপ্নতে, সকালে ওঠেই মনে আসা প্রথম ব্যক্তি এবং সারা দিনের কাজের মাঝে হাজারো বার শুধুই বিহানের চিন্তা ঘুরপাক খায় আর্শির মনে।এভাবে প্রায় ৭ দিন পাড় হয়ে গিয়েছে।
এখন মধ্য রাত,আর্শি বিছানায় শুয়ে এপাশ,ওপাশ করছে কিন্তু ঘুম আসার সম্ভাবনা শূন্যতে অবস্থান করছে তার।ভীষণ মনে পরছে আর্শির তার হৃদহরণকারী পুরুষটির কথা।
এতো দিন ভেবে আর্শি একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।সে ঠিক জানে না যে,তার এ সিদ্ধান্ত টি আদৌও ঠিক কি নয়! কিন্তু সে মনে করে জীবনে এমন একটি আফসোস কখনো রাখা উচিৎ না যে, “ইশ,একবার কেনো চেষ্টা করে দেখলাম না/একবার কেনো বললাম না”।
জীবন টা অতি ক্ষুদ্র।তাই মিথ্যে অহংকার বজায়ে রাখতে গিয়ে সহজ জীবনটাকে কঠিন করে তোলার মানেই হয় না।
এসব টা ভেবে নিয়ে আর্শি এখন শুধু সকালের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।সকালের নতুন ভরের সাথে সাথে হয়তো বিহান ও তার সম্পর্ক একটি নতুন নাম পাবে নতুবা শেষ হয়ে যাবে।হ্যা,আগামী দিনে সে বিহানকে তার ভালোবাসার কথাটি বলবে।
!!
ছাঁদে পাটি বিছিয়ে নিয়ে তার উপর দু’টি বালিশ পেতে মিয়ামি ও আর্শ উভয়ই তার উপর গা এলিয়ে দিয়েছে।অর্ধ চাঁদ টার দিকেই দৃষ্টি স্থির দু’জনার।লম্বা সময়ের মান-অভিমান চুকে গিয়ে তাদের প্রয়ণের শুরু টা হয় “বউ” শব্দটি দ্বারা।আর এই শব্দ টি প্রতিটি মেয়েই হয়তো তার মন হরণকারী প্রিয় মানবটির মুখ হতে বারংবার হাজারবার শুনতে চায়।প্রিয় মানুষটির মুখে এই শব্দটি শুনা মাত্রই এক অদ্ভুত ভালো লাগার অনুভূতিতে ছেয়ে যায় তাদের হৃদয় এবং বেশ খানিকটা লজ্জা এসেও জায়গা করে নেয় সেথায়।যেমনটি এখন মিয়ামির মনে এসে জায়গা করে নিয়েছে।ঐ মুহূর্তটি মনে করতেই অন্য রকম সুখ অনুভব করছে সে।এই মুগ্ধতার মাঝে সেই ড্রাগস এর কথাটি যেনো মেয়েটি ভুলেই গিয়েছে।
আর্শ চন্দ্র পানে তাকিয়েই তার অতীত হতে একবার ঘুরে এসে মিয়ামিকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-মিয়ু,তোমার মনে আছে তুমি ঠিক কোন ক্লাসে থাকতে প্রথম আমাদের বাসায় এসেছিলে?
-হু।ক্লাস ফাইভে থাকতে।
-হ্যা।তখন আমি ছিলাম এসএসসি শিক্ষার্থী।বয়স ১৭।এ বয়সে নাকি ছেলে-মেয়েদের প্রেমে পড়ার রোগ হয়!আমারও হয়েছিলো।একটি ক্লাস ফাইভের মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম আমি।ব্যাপার টা হাস্যকর না?ক্লাস ফাইভের একটা পিচ্চি মেয়ের প্রেমে পরেছিলাম,ভাবা যায়!!
কথাটি বলতে বলতে বেশ দীর্ঘ হাসি নিয়েই আর্শ তাকায় মিয়ামির দিকে।আর তাকানোর সাথে সাথেই হাসি হাওয়া হয়ে যায় তার।মেয়েটি ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।আর্শ নিন্ম স্বরে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-কি হয়েছে?
-কার প্রেমে পরছিলা তুমি?কোন শাঁকচুন্নির?
একটু থেমে মিয়ামি ঠোঁট উল্টে আবার বলে ওঠে,
-এর মানে আমি তোমার জীবনে প্রথম প্রেম না?
মিয়ামির কথাগুলো শুনে আর্শের হাওয়া হয়ে যাওয়া হাসিটি তার ঠোঁটে ফিরে এলো।সে মিয়ামির থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে আকাশ পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে ওঠে,
-উম, ঠিক বলেছো।তুমি আমার প্রথম প্রেম নও।আমার প্রথম প্রেম সেই ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া পিচ্চি মেয়েটি।যার নাম মিয়ামি রাহমান।
আর্শের ঠোঁটে নিজের নাম উচ্চারিত হতে শুনতেই অবাক হওয়ার পাশাপাশি খুশিতে ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে মিয়ামির।সে উত্তেজিত কন্ঠে বলতে চায়,”এ তো আমার নাম” কিন্তু তা আর বলা হয়ে ওঠে না তার।আর্শ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
-কোনো কথা নয়।চুপচাপ,মনোযোগ দিয়ে শোনো যা বলছি।
মিয়ামিও ভদ্র মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বলে ওঠে,
-ঠিক আছে।
আর্শ নিজের স্থির দৃষ্টি আকাশ পানে রেখে স্বাভাবিক কন্ঠে বলতে আরম্ভ করে,
-মেয়েটি প্রায়ই আর্শির সাথে আমাদের বাসায় আসতো।তাদের বাসায় ও যাওয়া হতো আমার,আর্শির সাথে।আবার আর্শিকে স্কুল বা কোচিং এ পৌঁছে দেওয়ার সময়ও মেয়েটির সাথে দেখা হতো।এভাবেই বলতে গেলে মেয়েটি আমার চোখের সামনেই ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে।সেই সাথে ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে তার প্রতি আমার অনুভূতি গুলো।
এবার একটু থামে আর্শ।তারপর আবারও বলে ওঠে,
-আমি না ভালোবাসা প্রকাশে একদম আনাড়ি।কেনোই যেনো ফ্লার্টিং করা বা অন্য যেকোনো ভাবে আমি ভালোবাসা সেভাবে প্রকাশ করতে পারি না।কিন্তু আমি যার প্রেমে পরে আছি সে খুব দক্ষ ভালোবাসা প্রকাশে।সেই সাথে ভালোবাসা আদায় করে নিতেও।
বলে একটু হাসে আর্শ।হাসি মাখা ঠোঁটেই আবার বলে ওঠে,
-মেয়েটি আমাদের বাসায় আসলেই যে,তার ব্যস্ত চোখ দুটো আমায় খুঁজতো তা বেশ ভালোই উপলব্ধি করতাম আমি।আমি কখন বাসায় থাকি তা আর্শির থেকে জেনে তারপর সে আমাদের বাসায় আসতো আমাকে এক নজর দেখার জন্যে।যেসব পড়া সে পারে তা না পারার ভান করে আমার কাছে পড়তে বসতো সে।আমার বাইকে উঠার সুযোগ খুঁজে বেরাতো।সকাল সকাল আমাদের বাসায় এসে চুপিচুপি আমার রুমে ঢুকে আমার ঘুমন্ত মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতো, আমার একটু জ্বর হলে সে অস্থির হয়ে যেতো, নিজের পড়াশোনা সব কিছু বাদ দিয়ে আমার বাসায়,আমার সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকতো।বাচ্চা মেয়েটা যে আমাকে এতো ভালোবাসতে পারবে তা আমি কল্পনাও করিনি।মেয়েটি সময়ের সাথে সাথে তার ভালোবাসার এক মজবুত বাঁধনে খুব যত্নে আমায় তার সাথে বেঁধে নিয়েছে।
অতি সুখের বহিঃপ্রকাশ মানবজাতির ঠোঁটের সাথে সাথে চোখের মাধ্যমেও হয়।তীব্র সুখে তাদের আঁখি অশ্রু বিসর্জন দেয়।যেমনটি এই মুহূর্তে মিয়ামির চোখজোড়া হতে সুখ কণা গড়িয়ে পরছে। এতো বছর থেকে সে যাকে এক তরফাভাবে ভালোবেসে আসছে তা আসলে এক তরফা কখনো ছিলোই না।আর্শের যেসব যত্নে সে ভালোবাসা খুঁজে পেতো তা সত্যিই ভালোবাসা ছিলো।এতো এতো প্রতিক্ষার পর আজ মিয়ামি সফল।সে সফল তার ভালোবাসার মানুষটির ভালোবাসা পেতে।
এসব কথা বলে একটু চুপ থেকে আর্শ একটি বড় নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।অতঃপর বলে ওঠে,
-জানো মিয়ু,যখন আমি জানতে পারি যে আমি ড্রাগস অ্যাডিক্টেড তখন শুধু আর শুধু মাত্র তোমার কথা ভেবেই আমার মাঝে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছিল।প্রশ্ন জাগছিলো, তুমি কি কখনো এমন নেশাখোর কোনো ছেলেকে ভালোবাসবে?তোমার পরিবার জানলে কি কখনো তারা আমার সাথে তোমার বিয়ে দিবে? আর সব থেকে বড় প্রশ্ন,আমি কি তোমাকে আদৌও সুখে রাখতে পারবো?
কথাগুলো বলে আর্শ মিয়ামির দিকে তাকায়।দেরি না করে আবারও বলে ওঠে,
-আমি জানি, তোমার এই ড্রাগস সেবনের ভয়াবহতা নিয়ে কোনো ধারণা নেই।সেজন্যেই আমি ড্রাগস অ্যাডিক্টেড শুনেও তুমি তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাওনি।মিয়ু,ড্রাগ অ্যাডিকশন কোনো ছোটখাটো বিষয় নয়।এর জন্য মানুষের শরীরে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি হয় আর এতে মানুষ মারাও যেতে পারে।কিন্তু এর থেকেও ভয়ংকর বিষয় কি জানো? একজন অ্যাডিক্টেড মানুষ এই পৃথিবীর কারো আপন হয় না বা হতে পারে না।কারণ এই ড্রাগস মানুষকে ধীরে ধীরে দূর্বল করে ফেলে। এতে মানুষ নিজের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।সে নিজের মস্তিষ্ককে নিজের আয়ত্তে আনতে পারে না।এসব মানুষের দ্বারা যেকোনো কিছু সম্ভব।এই মানুষদের যখন নেশা উঠে যায় আর এরা ড্রাগস কাছে পায় না তখন তারা এতো টাই ভয়ংকর হয়ে ওঠে যে এরা নিজেকে নিজে খুন করতেও দ্বিধা করে না।এখন তুমিই বলো আমার এমন একটি জঘন্য জীবনের সাথে তোমাকে কিভাবে জড়িয়ে নিতাম?
অসহায় চোখে মিয়ামির চোখে চোখ রেখে প্রশ্নটি করে একটু থামে আর্শ।তারপর আবার সোজা হয়ে শুয়ে চোখজোড়া বুজে বলে ওঠে,
-অনেক চেষ্টা করেছি,মিয়ু।তোমার কথা,নিজের পরিবারের কথা চিন্তা করে বহুবার চেষ্টা করেছি এই নেশার জগত থেকে বেরিয়ে আসতে কিন্তু আমি অসফল।পারিনি আমি।
চোখ বুজে কথাটি শেষ করার পর পরই আর্শ নিজের বুকে একটু ভারী অনুভব করে।চটজলদি নিজের চোখ মেলে তাকাতেই দেখে মিয়ামি তার বুকে মাথা রেখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।ভিজা চোখ ও ঠোঁটে একটু হাসি নিয়ে মিয়ামি বলে ওঠে,
-পারোনি তুমি।কিন্তু আমরা পারবো ইন শাহ আল্লাহ।চোরাবালিতে পরলে মানুষ একা একা সেখান থেকে উঠতে পারে না কিন্তু একটি সাহায্যের হাত পেলে ঠিকই উঠতে পারে।
চলবে।