#প্রণয়_বর্ষণ (৫)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_____________
২ পক্ষের তুমুল মা’রা’মা’রি দেখে বাকরুদ্ধ স্পর্শী। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। দুহাত দিয়ে শক্ত করে ধরে আছে ওড়না। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। কোথা থেকে কি হয়ে গেলো তা বুঝে আসে না স্পর্শীর। তখন যখন অচেনা ছেলেটার বা’জে স্পর্শ দৃঢ় হচ্ছিলো ঠিক সেসময়ই কোথা থেকে আরো ১০/১২ জনের মতো দৌড়ে আসলো। স্পর্শীর হাত টেনে একপাশে সরিয়ে দেয়। স্পর্শীর ওড়না তখনো সেই ছেলেটার হাতে। পরে আসা ছেলেগুলো একবারও স্পর্শীর দিকে তাকায়নি। বরং যে ছেলেটা স্পর্শীর ওড়না টেনে নিয়েছিলো তার নাক বরাবর কয়েকটা ঘু’ষি দিয়ে ওড়না নিয়ে স্পর্শীকে দিয়েছে। স্পর্শীর পুরো বিষয়টা হজম করতে সময় লাগে। ততক্ষণে আগের ছেলেগুলোকে মে’রে আধম’রা করে দিয়েছে পরে আসা ছেলেগুলো। স্পর্শীর মাথায় হাজারটা চিন্তার পোকারা যখন নাড়া দিচ্ছে তখন পেছন থেকে কেউ শক্ত করে টেনে ধরে স্পর্শীর হাত। চমকে ওঠে স্পর্শী। পেছনে ফিরে রুদ্রকে দেখে খানিকটা শান্ত হয়৷ কিন্তু সেই শান্ত সময়টা বেশিক্ষণ টিকেনি। রুদ্রর দাবাং মার্কা থা’প্প’ড়ের শব্দে সবাই সেদিকেই তাকায়। স্পর্শী হতভম্ব। রুদ্রের চোখে মুখের দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে। চোখের মধ্যে রক্ত জমে গেলে যেমন হয় ঠিক তেমন অবস্থা। কপালের নীল রগ ফুলে আছে, চুল গুলো একদম এলোমেলো অবস্থা। রুদ্র থা’প্প’ড় দিয়েই ক্ষ্যা’ন্ত হয়নি। শক্ত করে স্পর্শীর বাহু চেপে ধরে। ব্যাথায় আর্তনাদ করে ওঠে স্পর্শী। রুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘জিদ করার রেজাল্ট পেয়েছিস? খুশি এবার? শান্তি পেয়েছিস?’
স্পর্শী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়। জ্ঞান হওয়ার পর আজ পর্যন্ত কখনো রুদ্র তাকে টাচ্ও করেনি। ছোট বেলায় রুদ্র তাকে প্রচুর জ্বালাতো কিন্তু স্পর্শী একটু বড় হওয়ার পরই রুদ্র স্পর্শীর থেকে দূরত্ব রাখতো। আর স্পর্শীর মা মা’রা যাওয়ার পর তো আরোই স্পর্শীকে কোনো ভাবে টাচ্ করতো না। থা’প্প’ড়টা হজম করতে খানিকটা সময় লাগলো। এতক্ষণে রুদ্রের কড়া কড়া কথাগুলো একটাও টের পায়নি সে৷ শেষে যখন রুদ্র হাত ধরে টেনে বাইকের কাছে নিয়ে আসলো তখন তার হুশ ফিরলো। রুদ্র পেছনে ফিরে বাকি ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে বলে,
‘সব কয়টাকে নিয়ে যা। আসতেছি!’
রুদ্রের ভারী কন্ঠে গলা শুকায় সবার। মাথা নাড়িয়ে সম্মতী জানায়। স্পর্শী কোনো কথা বলে না। কয়েক মুহুর্তে এতো কিছু ঘটে গেছে যে সে আর কোনো কথা বলার অবস্থায় নেই৷ রুদ্র রেগে হাওয়ার গতিতে বাইক চালিয়ে আসে। স্পর্শী ভয়ে আঁকড়ে ধরে রুদ্রের কাঁধ। রুদ্রের রাগ সম্পর্কে ধারণা আছে স্পর্শীর। স্পর্শীকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দেয়। স্পর্শী বিনাবাক্যে বাড়ির মধ্যে ঢুকে যায়। বাড়িতে ঢুকতেই কানে আসে শাহাদাৎ শেখের মায়ের কয়েকটা কটু বাক্য। স্পর্শী একবার ঘুরে তাকায় সেদিকে। তার দাদী তার মা’কে তুলেও ব’কা দিচ্ছে। ভীষণ ইচ্ছে করলো প্রতিবাদ করতে কিন্তু গলাা দিয়ে একটা আওয়াজও বের হলো না। যে পরিস্থিতিতে সে আজ পরেছিলো সে পরিস্থিতি একটা মেয়ের কাছে কতটা ভ’য়ং’কর তা কেবল সেই মেয়েটিই জানে। স্পর্শী উত্তর দিলো না৷ চুপচাপ নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ফ্লোরেই বসে পড়ে। দেয়ালে টাঙানো মায়ের ছবির ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ বাহির থেকে ছোট ছোট হাতে দরজা ধাক্কায় স্পর্শ। স্পর্শী জবাব দেয় না। একসময় দরজা ধাক্কানো থেমে যায়। কতটুকু সময় ওভাবে বসে ছিলো জানা নেই তার। একটা সময় দরজা ওপাশ থেকে তানিয়া ব্যস্ত স্বরে ডাকে,
‘এই স্পর্শী! দরজা খোল।’
তানিয়ার ডাকে বেশ অবাকই হয়। আলতো করে উঠে দরজা খুলে দেখে তানিয়া, স্পর্শ আর রেণু আপা দাঁড়িয়ে আছে। তানিয়ার কোলে স্পর্শ। থেমে থেমে ফুঁপিয়ে উঠছে। তানিয়া দ্রুত রুমে ঢোকে। স্পর্শকে বিছানার ওপর বসিয়ে স্পর্শীকে কাছে টেনে এনে বলে,
‘কি হয়ছে? ঠিক আছিস তুই? ভয় পাচ্ছিস?’
স্পর্শী উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘তুই জানলি কিভাবে? কে আসতে বলেছে তোকে?’
তানিয়ার সহজ উত্তর, ‘রুদ্র ভাই।’
__________
স্পর্শীকে বাড়ি রেখে এসে সোজা গোডাউনে চলে আসে রুদ্র। একটা লোহা গরম করে সব রাগ উপড়ায় ছেলেগুলোর ওপর। রুদ্রর চ্যালা হারুণ পাশে দাঁড়ানো রিফাতকে জিজ্ঞেস করে, ‘কি হয়ছে রে? বস এমন চ্যা’তসে ক্যান?’
রিফাত ঢোক গিলে বলে, ‘ভাবির দিকে হাত বাড়ায়ছিলো। তাই হাতের এই অবস্থা করছে।’
হারুণ পরপর কয়েকবার ঢোক গিলে। রুদ্র যখন ক্লান্ত হয়ে যায় তখন ছেলেগুলোকে ছেড়ে একটা চেয়ারে বসে। পানি খেয়ে দম নিয়ে ফোন লাগায় তানিয়ার কাছে। সবটা বলে স্পর্শীর বাড়িতে যেতে বলে। তারপর ফোন রেখে চুপচাপ মাথা চেপে বসে থাকে। রিফাত এগিয়ে এসে বলে,
‘বস ভাবিরে থা’প্প’ড় দিয়া কি ঠিক করছেন?’
রুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘তো কি ওরে চু’মু খেতাম? ডা’ফার কোথাকার! কতবার বলছি আমার সাথে যাবি আমার সাথেই আসবি। সে জিদ দেখাইয়া একা একা ভার্সিটি চলে গেছে। তখন তো আমরা কেউই ছিলাম না ‘ওর’ যদি কোনো বি’পদ হতো তাহলে কি ওর হিরো আসতো বাঁচাইতে?’
হারুণ দাঁত বের করে বলে, ‘বস আপনিই তো উনার হিরো।’
রুদ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। হারুণ চুপ করে যায়। রুদ্র আস্তে করে আওড়ায়, ‘ওর জিদ আর মানা যাবে না। প্রয়োজনে হাত পা বেঁধে সাথে নিয়ে যাবো।’
রিফাত আর হারুণকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘সবগুলো রিকসাওয়ালাকে নিষেধ করে আয় যেনো পর্শীর বাড়ির আশেপাশেও না যায়।’
____
তানিয়ার কোলে মাথা গুজে শুয়ে আছে স্পর্শী। পাশেই রেণু আপা আর স্পর্শও বসে আছে। অদ্ভুত ভাবে আজ একবারও রামিয়া আসেনি স্পর্শকে নিতে। ছোট্ট স্পর্শ বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কিছু না বুঝলেও অবুঝ ছেলেটি এটা বুঝেছে যে তার বোনের কিছু একটা হয়েছে কিন্তু এগুলো যাদের বোঝার কথা তারা ঠিকই অবুঝের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্পর্শর আদরমাখা হাতের ছোঁয়ায় ভীষণ রকম কান্না পেলো স্পর্শী। গত ৫ বছরে সে শুধু একটা দিনেই কাঁদতো তাও তার মায়ের মৃ’ত্যুবার্ষিকীতে। তানিয়া অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলে,
‘স্পর্শী!’
‘হু!’
‘আমার সাথে যাবি? চল না হয়। আমি তো একাই থাকি। আজ না হয় আমার সাথে থাকিস।’
স্পর্শী উঠে বসে৷ স্পর্শকে কোলে নিয়ে তার চুল ঠিক করতে করতে বলে, ‘সমস্যা নেই। একা থাকতে পারবো। তুই যা। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।’
তানিয়া ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘বাই এনি চান্স তুই আমারে তাড়ায় দিচ্ছিস?’
স্পর্শী জবাব দেয় না। তানিয়া বোঝে স্পর্শীর এখন কথা বলার ইচ্ছে নাই। পাশ থেকে রেণু আপা বলে, ‘আপামনি আপনেই না হয় থাইকা যান।’
তানিয়া গাল ফুলিয়ে বলে, ‘নাহ আপা আমি থাকবো না। স্পর্শী আমারে বের করে দিচ্ছে আপনি দেখছেন!’
‘বের করে দিবো কেন তানু? তুই এমনিই তো বাড়ি চলে যেতি। তোর বাড়িওয়ালা কেমন আমি জানি।’
তানিয়া ফিক করে হেঁসে দেয়। স্পর্শী কিছু বলে না। রুদ্র রুমে ঢুকতে ঢুকতে তানিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তুমি বরং বাড়ি চলে যাও। তোমার বান্ধবীকে রেণু আপা সামলে নিবে।’
তানিয়া কি করবে ভেবে পায় না। তবুও তার যেতেই হবে। বাড়িওয়ালা পেয়েছে একটা আসতাগফিরুল্লাহ মার্কা লোক। ব্যাচেলর থাকে তাই তার এতো এতো কথা। রাতে বাহিরে থাকলে নিশ্চিত সকাল বেলা লাগেজ পত্র ধরিয়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দেবে। এ নিয়ে কত শত বকা সে দিয়েছে মনে মনে। প্রতিদিনই বাড়িওয়ালার গোষ্ঠী উদ্ধার করে সে। এত বড় শহরে নতুন ভাড়া বাড়ি পাওয়াটাও চারটে খানি কথা নয়। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে স্পর্শীকে সাবধানে থাকতে বলে নিজেও বেড়িয়ে আসে। রুদ্র কিছু একটা ভেবে তানিয়ার পেছনে যায়। স্পর্শী সেদিকে একপলক তাকিয়ে চুপচাপ স্পর্শ কে নিয়ে বসে থাকে।
কেটে যায় ৫ দিন। এই ৫ দিনে রুম থেকেই বের হয়নি স্পর্শী। সাফিন, সামিরা, নাহিদ, নীরব, তানিয়া সবাই এসে দেখে গেছে। রুদ্র সকাল, বিকাল দুবেলাই দেখা করে গেছে। স্পর্শী ওই ঘটনার পর একদম চুপচাপ হয়ে গেছে। অনেক বড় কিছু না ঘটলেও মনে দাগ কেটে গেছে ঘটনাটা। রুদ্র কাল রাতে এসে অনেকক্ষণ বুঝিয়েছে। স্পর্শী চুপচাপ শুনেছে। রুদ্র একদমই রুড বিহেভ না করে ভালো ভাবে বুঝিয়েছে। স্পর্শীও নিজেকে বুঝিয়েছে ‘এভাবে আর কতদিন!’ আজ সে ভার্সিটি যাবে৷ রুদ্র বাইক নিয়ে আগেই এসেছে। স্পর্শীও কোনোরকম জিদ করলো না। চুপচাপ রুদ্রর বাইকে বসে পড়লো। রুদ্রও কিছু না বলে বাইক চালানো শুরু করলো। ভার্সিটিতে ঢুকতেই রুদ্র বাইক ঘুরিয়ে চলে যায়। স্পর্শী আসে তার বন্ধুদলের কাছে৷ তানিয়া গাল ফুলিয়ে বলে,
‘আরো কয়েকদিন রুমে বসে থাক।’
সামিরা স্পর্শীকে নিজের পাশে বসিয়ে মুখ উচু করে ধরে। আলতো ভাবে বলে, ‘এখনো ওইসব নিয়েই ভাবছিস?’
সাফিন, নীরব, নাহিদ এগিয়ে আসে। সাফিন হাত রাখে স্পর্শীর মাথায়। মৃদু হেঁসে বলে, ‘আমাদের সাহসী স্পর্শী কবে থেকে এতো ভীতু হতে শুরু করলো! আচ্ছা তুই তো এর আগেও অনেক সমস্যার মধ্যে পড়েছিস তাই বলে কি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিস? মানছি এই বিষয়টা অনেক আলাদা। একটা মেয়ের কাছে ভ’য়ং’কর বিষয়। তবুও তুই যদি দমে যাস তাহলে তো যারা তোর ক্ষ’তি করতে চায় তারা জিতে যাবে। তুই নিজেকে গুটিয়ে নিলেই তো তারা তৃপ্তি পাবে। তুই চাস তাদের মতো নোং’রা মানুষদের কাছে হেরে যেতে!’
স্পর্শী চোখ তুলে তাকায়। এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়, ‘আসলেই তো! সে কেনো নিজেকে গুটিয়ে নিবে? জীবনে হাজারটা সমস্যা আসবে যাবে তাই বলে নিজেকে গুটিয়ে নিলে তো হবে না।’
স্পর্শী হালকা হেঁসে বলে, ‘তুই দেখি গার্লফ্রেন্ড ছাড়াও অনেক কিছু জানিস! আমি তো ভেবেছিলাম তোর জীবনে গার্লফ্রেন্ড ছাড়া আর কিছুই জানা নাই।’
সাফিন ভেংচি কেটে শার্টের কলার উচু করে ভাব নিয়ে বলে, ‘আমি অনেক কিছু জানি। শুধু নিজের ট্যালেন্ট গুলো কাউকে দেখাই না আর কি!’
তানিয়া সাফিনের চুল টেনে দিয়ে বলে, ‘২ লাইনের ভাষণ দিয়ে নিজেরে আর তোমার বিদ্যাসাগর প্রমাণ করতে হচ্ছে না হুহ!’
সাফিন আর তানিয়া ঝ’গড়া শুরু করে দেয়। ৫ দিন পর বন্ধুদের খুনশুটি উপভোগ করছে স্পর্শী। নীরব সাফিন আর তানিয়াকে থামিয়ে স্পর্শীকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘স্পর্শী তুই জানিস! তোকে যে ছেলেটা টাচ্ করছিলো ওর হাত কে যেনো পু’ড়িয়ে দিয়েছে।’
আঁতকে উঠে স্পর্শী, সামিরা, তানিয়া। নাহিদ তড়িঘড়ি করে বলে, ‘তোরে কে বললো?’
‘আরেহ আমি সেদিন রুদ্র ভাইয়ের চ্যালাদের বলতে শুনেছি।’
সাফিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আস্তে করে বলে, ‘তাহলে সিউর এটা রুদ্র ভাইয়ের কাজ। বাবাগো বাবা কি ডে’ঞ্জা’রাস!’
স্পর্শী ভাবনায় পড়ে যায়। এটা কি হলো! কে করলো? রুদ্র ভাই? কথাটা মাথায় আসতেই কেঁপে ওঠে সে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয় গেইটের বাহিরে দাঁড়ানো একটা পো’ড়া হাতের অ’ন্ধ ভিক্ষুকের দিকে!
চলবে..