#প্রণয়_পাড়ে_সন্ধি
|পর্ব ১১|
লাবিবা ওয়াহিদ
“ছেলে মানুষের জন্যে কালো পোশাক নিষিদ্ধ করা হোক।” নম্রের হৃদয় এখন এই একটি স্লোগান দিয়ে তীব্র আন্দোলনে নেমেছে। তীব্র আন্দোলনের সঙ্গে মস্তিষ্কটাও আজগুবি চিন্তাভাবনায় মশগুল হয়ে গেছে। চোখে তখনো লেগে আছে কালো শার্ট পরিহিত শতাব্দের সেই রূপ। প্রাণপ্রিয় পুরুষটাকে বহুদিন পর কালো পোশাকে দেখেছে, এতেই তার হৃদয়খানা নড়ে গেছে বোধহয়।
এইতো কিছুক্ষণ আগে। নম্র তার ভেজা চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। নীরবে তীব্র রোদে মাখা সরু রাস্তায় মানুষদের চলাচল দেখছিল, রাস্তার ওপাশের বিদ্যুতের তারে বসা দুটো শালিকের নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে থাকাও পরখ করছিল। এমন সময়ে কী ভেবে চোখ পড়ে রাস্তায়। শতাব্দ দ্রুত পায়ে এই পথ দিয়েই কোথাও যাচ্ছিল। এই গরমে শতাব্দ কালো পোশাক পরেছে, এতে তো গরম বেশি লাগতে পারে। এই চিন্তাটা করার আগে কালো পোশাকে আবৃত সুপুরষকে দেখে নম্র হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। নিজের অজান্তেই হাতের গামছাটা রশিতে টাঙিয়ে দিল। অথচ তখনো চুল বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।
সেদিন নম্র পড়াশোনায় মনোযোগ বসাতে পারেনি। আকাশ-পাতাল শুধু ভেবে গিয়েছে শতাব্দকে। আর চোখে ভেসে গিয়েছে শুধুই শতাব্দ। শতাব্দের ঘোর কাটাতে নম্র চঞ্চলকে বাড়ি এনেছে। চঞ্চলকে পড়ানোর পাশাপাশি চঞ্চলের আজাড়ে বকবক শুনে সেই ঘোর থেকে ভালো ভাবেই বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু ঘুমানোর আগে শতাব্দ’র হোয়াট’স এপে বেশ সময় নিয়ে কিছু লিখছিল আর কাট করছিল। কিন্তু মেসেজ সেন্ড করার সাহস তার মধ্যে নেই। একবার নম্র লিখল,
–“আপনার জন্যে কালো পোশাক নিষিদ্ধ করা হোক।”
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে সর্বনাশ। লাফ দিয়ে উঠে বসে সে। ঘুমের ঘোরে গতকালকের শেষ মেসেজটা নম্র শতাব্দকে সেন্ড করে দিয়েছে। শতাব্দ মেসেজ সীন করেছে ঠিকই, তবে কোনো রিপ্লাই দেয়নি। নম্রের ভেতরে কেউ বোধহয় উচ্চস্বরে ঢোল বাজাচ্ছে। একই সাথে গায়ের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, মাথা ভনভন করছে, পেট মুচড়ে উঠছে। এটা কীভাবে হলো? এরকম সম্মানহানি কেন হয় তার?
অত্যন্ত চিন্তায় বিধ্বস্ত হয়ে নম্র বাথরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। নম্র ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখল নিঝুম ঘুম থেকে উঠে বসেছে। হেসে হেসে কিছু একটা দেখছিল কিন্তু নম্রকে দেখেই চট করে মোবাইলটা সরিয়ে ফেলল। চোখ-মুখে কিছুটা ভীতিও ফুটে ওঠে। নম্র এবার সন্দিহান নজরে তাকায়। ভ্রু কুচকে বলল,
–“ফোনে কী দেখছিলি?”
নিঝুম আমতা আমতা করতে করতে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে যায়। নম্র কী যেন ভেবে দ্রুত ফোন হাতে নিল। লক খুলে হোয়াট’স এপে ঢুকতেই দেখল শতাব্দ মেসেজ দিয়েছে। আর সেই মেসেজ সীনও হয়েছে। নম্রের আর বুঝতে বাকি রইলো না নিঝুম তার ফোনের লক জেনে গেছে। নম্র তড়িঘড়ি মেসেজটা সীন করল। শতাব্দ লিখেছে,
–“বউ বারণ করলে শুনব। তুমি বলার কে?”
নম্র তৎক্ষণাৎ এক চিৎকার দিয়ে বাথরুমের দরজায় জোরে জোরে থাবা বসালো। বলতে লাগল,
–“নিঝুমের বাচ্চা! আজ শুধু তুই বাথরুম থেকে বের হ! আজ আমার চাইতে খারাপ আর কেউ হবে না!”
–“আমি বের হবো না!”
–“রাতে মেসেজটা তুই পাঠিয়েছিস তাই না?”
ভেতর থেকে জবাব এলো না। নীরবতা সম্মতির লক্ষণ। নম্রও যা বোঝার বুঝে নিল। নম্রের চেঁচামেচি শুনে সাবরিনা হন্তদন্ত হয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
–“কী হলো, সকাল বেলা এত চেঁচাচ্ছিস কেন?”
–“সেটা তোমার ছোটো মেয়েকে জিজ্ঞেস করো। ও বাঁদরামি ছাড়বে কবে? একশোবার বলেছি আমার ফোনে হাত না লাগাতে। অকাজ করতে হাত চুলকায় ওর!”
বড়ো মেয়ে রেগে থাকলেও সাবরিনা ছোটো মেয়ের সঙ্গ দিল। বলল,
–“আর করবে না, ছোটো মানুষ। থাক। তুই গিয়ে নাস্তা করে নে। ভার্সিটি যেতে দেরী হয়ে যাচ্ছে!”
নম্রের আগুনে ঘি ঢালল যেন। নম্র ফুঁসতে ফুঁসতে কোনোরকমে রেডি হয়ে না খেয়েই বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। বাসস্ট্যান্ডে এসে নম্র বোধহয় বুঝল অতিরিক্ত রাগার ফলাফল। শতাব্দ দাঁড়িয়ে আছে। শতাব্দকে দেখে নম্রের রাগ উবে গেল। সে শতাব্দকে দেখেও না দেখার ভান করে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। একবারও ফিরে চাইলো না।
–“কী ব্যাপার, চোরের মতো মুখ লুকাচ্ছ কেন?”
নম্র চমকে পাশে তাকাল। কিছু মিনিটের ব্যবধানে শতাব্দ নম্রের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। নম্র শুকনো ঢোঁক গিলে বলল,
–“আমি চোর হতে যাব কেন?”
–“এইযে, আমাকে দেখলে। দেখেও এখানে দাঁড়িয়ে আছ। অথচ রাতের আঁধারে ঠিকই বলো আমার জন্যে কালো পোশাক নিষিদ্ধ। মতলব তো সুবিধার ঠেকছে না!”
অত্যন্ত লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল নম্র। বহু কষ্টে বলল,
–“আমি পাঠাইনি ওই লেখা!”
–“কিন্তু মেসেজটা তো তোমার নাম্বার থেকেই আসল। নাম্বার তো হ্যাক হয় না!”
–“ছোটো বোন থাকলে আলাদা করে হ্যাকারের প্রয়োজন হয় না!”
–“নিজের দোষ নিঝুমের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছ?”
এবার নম্র শতাব্দের চোখে চোখ রেখে বলল,
–“নিঝুম-ই পাঠিয়েছে, আমার অগোচরে। আমাকে হেনস্তা করতে!”
এর মাঝে বাস চলে এলো। শতাব্দ আর কিছু বলল না। নম্র শতাব্দকে মিনমিন করে “আসছি” বলে বাসে উঠে গেল।
—————————
দীপালি বেগম, আরিফ সাহেব একসাথে সোফায় বসেছে। আনিশা ভেতরের রুমে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। রুমা অফিস থেকে ফিরেছে বেশিক্ষণ হয়নি। ফ্রেশ হয়ে কোনোরকমে আরিফ সাহেবের জন্যে চা বানিয়ে এনেছে। দীপালি বেগম হাতে তসবিহ নিয়ে পাঠ করছেন। আরিফ সাহেব চায়ে যখন এক চুমুক দিলেন, তখন দীপালি গলা খাঁকারি দিলেন। রুমার উদ্দেশ্যে বলল,
–“আমার লগে আইয়া বহো। কিছু কথা কমু!”
রুমা তাই করল। দীপালি বেগম তসবিহতে চুমু খেয়ে সেটা অন্যপাশে রাখলেন। বেশ প্রস্তুতি নিয়ে বললেন,
–“নাতি তো আমার ভালোই বড়ো হইল। বিয়া-টিয়ার কথা ভাবো না কেন? আজীবন বিয়া ছাড়া রাখবা নাকি?”
রুমা এবং আরিফ সাহেব উভয়েই কিছুটা চমকালেন। আরিফ একপলক সহধর্মিণীর দিকে চেয়ে বলল,
–“কিন্তু আম্মা, শতাব্দ তার ব্যবসা তো শুরু করল সবে দু’মাস। এর মাঝে কী করে..?”
–“তো কী হইছে? পোলারে কী বুড়া বয়সে বিয়া করাইবা? তোমাগো এই নতুন যুগের কাহিনী মতলব বুঝি না, শতাব্দের বয়সে থাকতে তোমার আব্বায় দুই বাচ্চার বাপ ছিল। আর তুমি কী না আমারে ব্যবসার ভোলন দেও? তাড়াতাড়ি বিয়ার ব্যবস্থা করো!”
আরিফ সাহেব কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। দীপালি বেগম থেমে বললেন,
–“তোমার কী ট্যাকা-পয়সায় টান পড়ছে? নাকি আমার নাতি বিয়া করলে বউরে খাওয়াইতে পারবে না? আল্লাহ নিজে কইছে বিয়া করলেই রিজিক বাড়ে, তুমি আমার নাতিরে এমনে রিজিক থেইক্কা বঞ্চিত করতাছ! এডা তো আমি মানতে পারতেছি না পুঁত! বউমা! আমি কী বলছি শুনছ?”
রুমা শাশুড়ীর পানে চেয়ে ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। আরিফ সাহেবেরও না মেনে উপায় নেই। শত হোক, নিজের মা এই প্রসঙ্গ তুলেছে, কথাও ফেলনা নয়। কিন্তু হুট করে তো আর বিয়ে সম্ভব নয়! পাত্রী দেখা, পরিবার সম্পর্কে খোঁজ করা, বিয়ের কথা আগানো, বহু সময় পার হয়ে যাবে। এই ব্যাপারটা দীপালি বেগমকে বুঝিয়ে বললেন আরিফ সাহেব। কিন্তু দীপালি বেগম সেসব না শুনে বলল,
–“দূরে যাইবা ক্যান? আশেপাশে কী চোখ যায় না?”
রুমা এবং আরিফ একে অপরের দিকে তাকালো। এই পর্যায়ে এসে রুমা মুখল, “আশেপাশে বলতে?”
–“নম্র কী দোষ করছে? আমার তো নম্ররে শতাব্দের জন্যই লাগে। কী সুন্দর মাইয়া, দেখলেই ক্যামন আপন আপন লাগে!”
———————–
পরেরদিন নম্র বেকারীতে যায়। শতাব্দ কাজ করতে করতে নম্রকে খেয়াল করে। নম্র আজ চঞ্চল এবং নিঝুমের জন্যে ফাস্টফুড নিতে এসেছে। শতাব্দকে সে খেয়াল করতেই চোখ নামিয়ে ফেলল। আজকাল শতাব্দ ঘনঘন কালো পোশাক পরছে। যা নম্রকে বারংবার ভেতর থেকে নাড়িয়ে তুলছে। নিজেকে সংগত রেখে শতাব্দকে কিছু বলার আগেই শতাব্দ তার তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে ওঠে,
–“সিয়াম সেদিন বলছিল তুমি এখানে ঘনঘন আমার জন্যেই আসো। কথা কী সত্যি নম্র?”
“নম্র!” কী মধুময় ডাক। শতাব্দের গলায় নম্রের নামটা খুব কম-ই শোনা যায়। তবে যখন শুনে, তখন মনে হয় সে উথাল-পাথাল স্রোতে ভেসে যায়। অন্য এক রূপকথার জগতে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। নিজের নাম শতাব্দের মুখে শুনে নম্র শতাব্দের পুরো কথাটা ভুলেই গেল। শতাব্দ আবার বলল,
–“আমি সিয়ামকে বলেছি তুমি ফাস্টফুড, হাবি-জাবি বেশি পছন্দ করো। এজন্যেই রেগুলার কাস্টমার হয়ে আসো। ঠিক তো?”
নম্রের ধ্যান ভাঙে। পুরো ব্যাপারটা মাথায় আসতেই সঙ্গে সঙ্গে “হ্যাঁ” সূচক মাথা নাড়াল। শতাব্দ বলল, “কী লাগবে?”
নম্র জানালো। খাবারগুলা ওভেনে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সে। নম্র আশেপাশে তাকাচ্ছে ঠিকই কিন্তু আড়চোখে একপলক করে শতাব্দকেও দেখে যাচ্ছে।
–“কালো পোশাক পরলে কী এমন হয় তার এক্সপেরিমেন্ট এ নেমেছি। এখন থেকে ভাবছি রেগুলার হয়ে যাব! কী বলো?”
নম্র চমকে তাকায় শতাব্দের দিকে। আমতা আমতা করে বলল,
–“আমি তো বললাম সেই মেসেজটা নিঝুম পাঠিয়েছে!”
শতাব্দ কাচের উপর দুই হাত প্রসারিত করে ভারী গলায় বলল,
–“নিষিদ্ধ বিষয়ে মানুষের আগ্রহ বেশি থাকে, তাই এক্সপেরিমেন্ট নম্র। তুমিও তো নিষিদ্ধ, বোধহয়!”
শেষ কথাটার মানে কোনো গাণিতিক সূত্র দিয়েই সমাধানে আনতে পারল না নম্র। ব্যাকুল চিত্তে চেয়ে রইলো শতাব্দের পানে। কী বলতে চাইলো সে? শতাব্দ পরমুহূর্তে সরে গিয়ে বলল,
–“আমাদের এভাবে দেখলে সিয়াম নির্ঘাত ভেবে নিবে আমরা প্রেম করছি। তোমার খাবার গরম হয়ে গিয়েছে। পার্সেল করে দিচ্ছি!”
~[ক্রমশ]