প্রণয় পাড়ে সন্ধি পর্ব-০৯

0
537

#প্রণয়_পাড়ে_সন্ধি
|পর্ব ০৯|
লাবিবা ওয়াহিদ

আকাশে আধো আধো আলোর রেশ। শীতল, নরম হাওয়া মন-প্রাণ জুড়ে যাওয়ার মতো। ভোরের এই সময়টা বড্ড স্নিগ্ধ এবং সুন্দর। বারতি কোলাহল নেই, যানবাহনের শব্দ নেই, বায়ুতে দূষণ নেই। নিঃশ্বাস নিলে যেন মনে হয় সুস্থ পরিবেশে অবস্থান করছে। বিশুদ্ধ বাতাস সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে গেলে যেন সকল ক্লান্তি, গ্লানি, খারাপ লাগা নিমিষেই দূর হয়ে যায়। ভোরের হাঁটাহাঁটিও স্বাস্থ্যের জন্যে ভীষণ উপকারী। কিন্তু আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে, এই সোনালী সময়টা সবাই উপভোগ করতে পারে না। শহরে অন্তত সত্তর কিংবা এরও বেশি শতাংশ মানুষজন এসময়ে গভীর ঘুমে নিমজ্জিত থাকে। এখন বলা চলে ঘুমন্ত শহরের সরু ফুটপাতে হেঁটে চলেছে নম্র এবং শতাব্দ। দুজনেই পাশাপাশি, গন্তব্যহীন চলছে। পথে-ঘাটে এখন লোকজন নেই বললেই চলে। দু’একজন দেখা যাচ্ছে।

দেয়ালে বারি খাওয়ার পর থেকে মাথা ব্যথা করছে। তবে ব্যথার চাইতেও প্রখর অনুভূতি তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। ভালোবাসার মানুষটার পাশে প্রিয় মুহূর্তে চলতে পারার চেয়ে আনন্দ খুব কম আছে। দুজন হেঁটে হেঁটে তাদের পাশের এলাকার এক লেকের পাড়ে এসেছে। লেকের পাড় ভোরের আলোতে সুন্দর লাগছে। লেকের চারপাশে গাছ-গাছালির পরিমাণ ভালোই। যার ফলস্বরূপ পাখির কিচিরমিচির এবং বাতাসের শব্দ ব্যতীত অন্য কোনো শব্দ কানে লাগছে না। কারো মুখে কোনো কথা নেই। নম্র খুব করে চাইছে শতাব্দ কিছু বলুক। কিন্তু তার চাওয়াটা পূরণ হচ্ছে না। এজন্যে নিজেই মুখ খুলল সে।
–“লেকটা কত নীরব লাগছে।”

শতাব্দ সেই কথা শুনলেও কিছু সেকেন্ড চুপ রইল। হঠাৎ ভারী গলায় বলে ওঠে,
–“আমার পারফিউমের ঘ্রাণ কী এতই সুন্দর?”

নম্রের মনে হলো তার কানে পোকা ঢুকেছে। সেই পোকাই তাকে তার লুকোচুরির ব্যাপারটা ফিসফিসিয়ে বলল। হঠাৎ তার ঘোর কেটে গেল। শতাব্দ নিজ মুখেই কথাটা উচ্চারণ করেছে। চোর চুরি করে ধরা পড়লে যেমন অবস্থা হয় না? নম্রেরও ঠিক একই হাল হয়েছে। নম্রের ইচ্ছা করল এক্ষুণি এই লেকে ঝাপ দিয়ে নিজের মুখ লুকোতে। কিংবা উলটো দিকে ফিরে দৌড় লাগাতে। কিন্তু আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে সে নড়তেই পারছে না। এক কদম আগে-পিছে যাওয়া তো দূরের ব্যাপার।

নম্র আমতা আমরা করতে লাগল। শতাব্দ তাকাল নম্রের পানে। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে শতাব্দের চোখে চোখ মেলাতে পারছে না। শতাব্দ আবারও থমথমে গলায় বলল,
–“উত্তর দাও।”
–“আ..আপনি ককী ক..রে?”
–“ধাক্কা খাওয়ার সময় বুঝেছিলাম!”

গেল। বাদ-বাকী যেটুকু সম্মান ছিল তাও গেল। অতি উৎকন্ঠায় নম্র ভুলেই বসেছিল পারফিউমের ব্যাপারটা। যদি স্মরণে থাকত অন্তত শতাব্দের কাছে বের হওয়ার আবদার করত না। আবদার তো দূর, তখনি নিঝুমকে উঠিয়ে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা দিত সে। এতে তার সখ-আহ্লাদও মিটে যেত। শতাব্দ আবার বলল,
–“চুপ করে আছ যে? পারফিউমের মালিকের চয়েজ ঠিক ছিল তো?”

কান গরম হয়ে গেল নম্রের। বহু কষ্টে বলল,
–“বাড়ি যাব!”
–“পারফিউমের দাম মেটাবে না?”
নম্র চমকে তাকাল শতাব্দের দিকে। শতাব্দের ভাব-ভঙ্গি স্বাভাবিক। নম্র পুণরায় চোখ নামিয়ে মিনমিন করে বলল, “স্যরি! আর ভুল হবে না!”
–“স্যরি বলার কিছু নেই!”

শতাব্দ কথা না বাড়িয়ে আবার বলল, “চলো!”
সেদিনের জন্যে নম্রের জনমের শিক্ষা হয়েছে। শতাব্দ চুপ থাকলেই ভালো। কথা বললেই বরং সর্বনাশ। তার মুখ যেন আরেকজনকে বাঁশ দেওয়ার জন্যে তৈরি। সেদিন ধরা খাওয়ার পর তিন দিন শতাব্দের মুখোমুখি হয়নি সে। পথে-ঘাটে দূর থেকে শতাব্দকে দেখলেও এড়িয়ে চলে৷

—————————-
আজ আপনমনে ভার্সিটি থেকে হেঁটে আসছে নম্র। বেশ কিছুদিন যাবৎ অনিকের দেখা নেই। কারণ অবশ্য আছে। শোনা যায় এলাকার বড়ো ভাইয়া’রা নাকি অনিককে ধোলাই দিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। এতে নম্র আহামরি অভিব্যক্তি প্রকাশ করেনি। সে উলটো ভেবেছে অনিক এসব কুকাজ করে না বেড়ালে সুস্থ-সবল চলাফেরা করে বেড়াত। শুধু, শুধু নিজের সহ পরিবারের ভোগান্তি পোহাতে হয়। অনিকের বাবা-মা এখনো নম্রের বাসা অবধি পৌঁছাতে পারেনি। অনিকের দিকটা এখনো বড়ো ভাইরাই সামাল দিচ্ছে। তবে নম্রের জানা নেই তারা অনিকের খোঁজ পেল কোথায়?

হাঁটতে হাঁটতে নিজের অজান্তেই নম্র শতাব্দের বেকারীর সামনে পৌঁছাল। নম্র মাথা উঁচিয়ে বেকারির ভেতরে তাকাল। ইন্টেরিয়রের কাজ বোধহয় রিসেন্ট শেষ হয়েছে। এখন লাইটিং এবং বাদ-বাকী কাজ চলছে। বেশ বড়োসড়ো এবং সৌখিন ভাবেই তৈরি হচ্ছে বেকারী। বেকারীর নাম এখনো ঝোলানো হয়নি। শতাব্দকেও বেকরীর মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। নম্র কিছুটা হতাশ হয়ে সামনে এগোতেই শতাব্দের মুখোমুখি হলো। শতাব্দকে দেখে অন্তঃস্থলে অস্থিরতা খেলে গেল। শতাব্দ ভ্রু কুচকে বলল,
–“এখানে কী করছ?”
নম্র আমতা আমতা করে বলল, “এই পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম!”
–“ওহ! সাবধানে যাও!”
বলেই শতাব্দ দুই ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠে কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। নম্র পিছ থেকে শতাব্দকে দেখে বাড়ির পথে হাঁটা দিল। তবে বেশিদূর যেতে পারল না। এর মাঝেই অর্ণা কল দিল নম্রকে। কল রিসিভ করতেই অর্ণা দম না ফেলে বলতে লাগল,
–“আজ কিছু শপিং করতে যেতে চাই। প্লিজ নম্র আমার সাথে আয়! প্লিজ!”

নম্রের ভ্রু কুচকে গেল। হঠাৎ শপিং-এর ভূত চাপল কেন অর্ণার মাথায়? আধঘন্টা আগেও তো তারা একসাথে ছিল। তখন না বলে এখন কেন?
–“আধঘন্টা আগে কই ছিলি যে এখন বলছিস?”
–“খেয়াল ছিল না। প্লিজ চল, লাঞ্চ আমার পক্ষ থেকে। প্রমিস!।”
নম্র ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আচ্ছা। আসছি!”
নম্র একটা রিকশা নিয়ে শপিংমলের সামনে চলে গেল। গিয়ে দেখে অর্ণা আগে থেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে। নম্র অর্ণার দিকে এগিয়ে বলল,
–“ক্লান্ত লাগছে। বেশি ঘুরাস না!”
অর্ণা নম্রের কথায় মাথা দোলাল। নম্রের কথাও রাখল। বেশি ঘুরোয়নি। সোজা শতাব্দের মায়ের আউটলেটে গিয়েছে নম্রকে নিয়ে। নম্র অবাক হলো অর্ণার কান্ডে। বলল,
–“কিছুদিন আগেই না এখান থেকে কেনাকাটা করলি?”

অর্ণার মুখ এবার ছোটো হয়ে গেল। মিনমিন করে বলল, “শপিং বাহানা ছিল!”
থেমে গিয়ে ইমনের দিকে ইশারা করল। নম্র সেদিকে তাকাল। অর্ণা আবার বলতে লাগল,
–“অনেকদিন পরে কাউকে ভালো লেগেছে। চোখের দেখা দেখার জন্যে আসছি!”

–“এক সেকেন্ড! তুই ইমন ভাইয়াকে?? মাই গড!”

–“তো কী হইছে? তোর দেবরের বউ-ই হলাম নাহয়। এখন হেল্প করবি নাকি নিজেরটা নিজে বুঝব?”
–“নিজেরটা নিজে বুঝ। আমি কারো প্রেম করিয়ে দিতে পারি না।”
–“পারিস না দেখেই তো নিজেরটাও কপালে জুটে না। গিয়ে এক কোণায় বসে থাক। আমি উপায় খুঁজতে গেলাম!”

নম্র বসতে পারল না। সে জামা-কাপড় দেখতে লাগল। নম্রকে দেখে ইমন আবার এগিয়ে এলো। অর্ণা দূর থেকে তা দেখে দ্রুত পায়ে নম্রের পেছন থেকে ইমনের উদ্দেশ্যে বলল,
–“হাই। চিনতে পেরেছেন? আমি অর্ণা। নম্রের বান্ধুবী!”
ইমন হেসে বলল, “চিনব না কেন? কী অবস্থা?”
অর্ণা তাদের মাঝখানে নম্রকে রেখে ইমনের সাথে আলাপ জুড়ে দিল। নম্র পড়ে গেল অস্বস্তিতে। এভাবে দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকার মানে আছে? নম্র সরে যেতে চাইলেও ইমন তাকে থামিয়ে তার খোঁজ খবর নিতে শুরু করল। সেদিন অর্ণা একদম ইমনের নাম্বার নিয়েই আউটলেট থেকে বেরুলো। আর নম্র আধমরা হয়ে। অবশ্য অর্ণা নম্রকে লাঞ্চও করিয়েছে। সেদিন নম্র আর বাড়ি ফিরতে পারেনি। সোজা স্টুডেন্টের বাড়িতেই চলে গিয়েছে।

——————–
মাসখানেক হলো শতাব্দের বেকারীর উদ্ভোদন হয়েছে। বেশ ভালোই তাল মিলিয়ে চলছে শতাব্দের বেকারী। ভালোরকম কাস্টমারও আছে। বেকারীতে ফাস্টফুড, কেক, বিভিন্ন পদের মিষ্টান্ন, কুকিজ এগুলাই পাওয়া যাচ্ছে। আজকাল কন্টেন্ট ক্রিয়েটরে ছড়াছড়ি দেশজুড়ে। সৌভাগ্যবশত শতাব্দের এক ভালো বন্ধুও কন্টেন্ট ক্রিয়েটর এবং মিডিয়া পাড়াতে বেশ ভালোই খ্যাতি রয়েছে তার। শতাব্দ এই পর্যায়ে তার বন্ধুর থেকে ফেভার নিয়েছে। ভালো বন্ধুকে বেকারীতে ইনভাইটও করেছে সে। এভাবেই নানান ভাবে বেকারীর প্রমোশন করাচ্ছে শতাব্দ। তার একেকটা পদক্ষেপ যেন বুঝিয়ে দেয় এই ব্যবসাতে সে কতটা সিরিয়াস।

নম্র তো প্রায় প্রতিদিন-ই টুকটাক খাবার কিনে আনে বেকারী থেকে। বেকারীতে এখন তার এক পরিচিত মুখ পেয়েছে। সেই ছেলেটার নাম সিয়াম। যে কী না কুকিজ, ফাস্টফুড, কেক, পেস্ট্রি এগুলা নিজের রেসিপি দিয়েই বানায়। একা তো আর সব সামলে উঠতে পারে না। এজন্যে হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে আরও দুজন রয়েছে। সিয়ামের হাতের জাদুই বোধহয় অন্যরকম। তার বানানো প্রত্যেকটা খাবারে আলাদা স্বাদ আছে। যা অবশ্যই তাদের এই বেকারীকে স্পেশাল করেছে। তবে নম্রের তো মনে হয় এর চাইতে ভালো রেস্টুরেন্ট-ই দেওয়া যেত। কেন এসব ফাস্টফুড, বিস্কিটের বেকারী দিল সেটাই বুঝে পায় না।

আজ বেশ কিছুদিন পর সিয়ামের সাথে শতাব্দকেও দেখতে পেল। অন্য দু’জন কাস্টমারের সাথে সিয়াম ব্যস্ত। শতাব্দ আড়চোখে দেখছে নম্রের কর্ম-কান্ড। নম্র চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে আইসক্রিমের ফ্রিজটার পাশে। ফ্রিজটার পাশেই কাচ। সেই কাচে আড়চোখে তাকিয়ে শতাব্দকে লক্ষ্য করছে সে। আস্তে-ধীরে ফ্রিজটা খুলে একটা আইসক্রিম হাতে পেছনে ঘুরতেই গলা শুকিয়ে গেল নম্রের। শতাব্দ তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। শতাব্দ ভ্রু কুচকে বলল,
–“ফ্রিজের কাচটা বন্ধ করোনি!”
নম্র তড়িঘড়ি করে ঢিপ ফ্রিজের কাচটা লাগিয়ে দিল। মিনমিন করে বলল,
–“স্যরি!”
–“খেয়াল কোথায় থাকে? আমার জানামতে তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ডও নেই। আছে নাকি? থাকতেই পারে। আজকালকার মেয়েদের তো নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা করে প্রেমিক পুষা!”

নম্র অবাক না হয়ে পারল না শতাব্দের কথায়। এত বেশি বলে কেন? নম্র শতাব্দের চোখে চোখ রেখে বলল,
–“সব মেয়েকে একই দাড়িপাল্লায় মাপছেন কেন? আপনি মাপলে আমিও তো বলতে পারি আপনি আপনার প্রেমিকার পোষা প্রাণী, মানুষ নন!”

শতাব্দ অধর বাঁকিয়ে হাসল। বলল,
–“শতাব্দ কারো পোষা প্রাণী হয় না। প্রেম করার মতো মূর্খও সে নয়। তবে তুমি চাইলে প্রেম করে মূর্খ হতে পারো। তোমার পার্সোনাল লাইফ। আইসক্রিমের বিল দাও, গলে যাচ্ছে!”

বলেই শতাব্দ আগের জায়গায় চলে গেল। নম্র হ্যাবলার মতো আগের স্থানেই দাঁড়িয়ে রইল। শতাব্দকে বলতে ইচ্ছে করল,
–“”আপনি চুপ-ই থাকেন। চুপ থাকাই আমার জন্যে মঙ্গল। নয়তো আপনার কথা শুনলে মনে হয় আপনি জনসম্মুখে পাতিলের কালি মাখছেন আমার মুখে।”

নম্র বিল মিটিয়ে যাওয়ার পর আর কোনো কাস্টমার ছিল না। সিয়াম দরজার মুখে তাকিয়ে শতাব্দের উদ্দেশ্যে বলল,
–“মেয়েটা প্রায় রোজ-ই আসে। কাকে যেন খুঁজেও। তোমার সাথে কিছু চলছে নাকি ভাই? নয়তো এত ঘনঘন আসবে কেন?”

~[ক্রমশ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে