প্রণয় ডোরে বেঁধেছি পর্ব-০১

0
991

#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#সূচনা_পর্ব
#নাজিয়া_শিফা(লেখনীতে)

” আপনি একটু আমার সিটটায় বসবেন? ”

উক্ত বাক্য শুনে ফোনের দিকে আবদ্ধ দৃষ্টিজোড়া স্থির হলো সামনে বসে থাকা মেয়েটার পানে। প্রণয়ের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। মেয়েটা জড়োসড়ো হয়ে বসে রয়েছে। মেয়েটাকে ভালো করে পরখ করে বলল,

” কেন? কোনো সমস্যা? ”

” হ্যাঁ আসলে..”

মেয়েটা পুরো কথা শেষ করল না, ইতস্তত বোধ করল বোধহয়। প্রণয়ের ভ্রু জোড়া তখনো কুঞ্চিত। খানিক বিরক্তির সুরে বলল,

” জানালার পাশেই তো সিট, একই তো। বদলানোর কী আছে? বুঝলামনা। ”

মেয়েটা সম্ভবত একটু অপমানিত বোধ করল। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল, কিছু বলল না আর। মিনিট দুয়েক বাদেই প্রণয় নিজের ফোন আর পানির বোতল টা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তাকে দাঁড়াতে দেখেও মেয়েটার ভ্রুক্ষেপহীন ঠায় বসে রইল। নড়ল না পর্যন্ত। প্রণয় ফের বিরক্তি নিয়ে বলল,

” না উঠলে কী আপনার কোলে বসব? ”

প্রণয়ের এহেন বিরক্তি মাখা উক্তিতে হকচকায় মেয়েটি। চকিত নেত্রে প্রণয়ের দিকে তাকাল, সাথে সাথে ই উঠে দাঁড়াল। দুজনে নিজেদের জায়গায় বদল করল। প্রণয় ফের ব্যস্ত হলো ফোনে। প্রচন্ড মাথা ব্যথা, সাথে মাইগ্রেনের সমস্যা। তার ওপর ট্রেনের দুলুনি আর শব্দ যেন মাথা ব্যথা তীব্র করছে মেয়েটার। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা ঔষধ বের করল সে। ঔষধ খেয়ে নিয়ে মাথাটা পেছন দিকে এলিয়ে দিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে রাখল। এর পরপরই মেয়েটার দিকে তাকাল প্রণয়। হালকা গোলাপি রঙের গাউন তার সাথে নীল রঙা হিজাব পড়া মেয়েটা। সাদামাটা, হলদেটে ফর্সা বর্ণের গোলগাল মুখ, ঈষৎ বোঁচা নাক, তাতে সোনালী রঙের নথ পর্যন্ত সব কিছু ই খেয়াল করল প্রণয়। মেয়েটা সুন্দর, প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ার মতো সুন্দর। তার কী প্রেমে পড়া উচিত? প্রশ্নটি মস্তিষ্কে নাড়া দিতেই নড়েচড়ে বসল প্রণয়। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই লক্ষ্য করল হাতের ডান পাশে তার সিট থেকে দুই সিট সামনে একটা মোটামুটি বয়স্ক লোক তাকিয়ে আছে। প্রণয়ের মনে সন্দেহ জাগে, মেয়েটা কী এজন্য ই সিট পরিবর্তন করল? এমন হলে তো সে খারাপ ব্যবহার করেছে মেয়েটার সঙ্গে। তার কী ক্ষমা চাওয়া উচিত? সিদ্ধান্ত নিতে পারে না সে। বেশ কিছু সময় নীরবতা বিরাজমান। ট্রেন চলতে থাকে নিজ গতিতে।


প্রকৃতির চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য দেখতে মাথা ব্যথা নিয়ে ও মেয়েটা জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে। প্রণয় কিছুক্ষণ যাবৎ চেষ্টা করছে কথা বলার কিন্তু পারছে না। পাছে মেয়েটা যদি মনে করে‚ মেয়ে দেখেই ভাব জমাতে এসেছে!

” আপনি কিছু বলবেন? ”

সহজ গলায় করা প্রশ্ন। প্রণয় উহুম শব্দে গলা ঠিক করে, তারপর বলে,

” হ্যাঁ আসলে আপনি সিট পরিবর্তন করেছেন কী এর জন্য? ”

সামনের দিকে চোখ দিয়ে ইশারা করে বলে প্রণয়। প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে ঠিকই বোঝে মেয়েটা। ইতস্তত ভাব রেখেই বলে,

” হ্যাঁ আসলে সামনের ঐ লোকটা বসার পর থেকে ই কেমন দৃষ্টি তে যেন তাকিয়ে ছিল। অস্বস্তি হচ্ছিল তাই..”

” বুঝতে পেরেছি। সরি আমি খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। ”

” সমস্যা নেই। ”

মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে মেয়েটা। প্রণয় ঈষৎ হেসে জিজ্ঞেস করে,

” আপনার নাম? ”

” সূচনা কবির তানজুম। আপনার? ”

” প্রণয় আহমেদ। ”

” গন্তব্য? ”

” চট্টগ্রাম। আপনার? ”

” চট্টগ্রাম ই। ”

ছোট্ট জবাবের পর প্রণয় আর কিছু বলল না। পিন পতন নীরবতায় কা টে কিছুক্ষণ। মাথা ব্যথা খানিক কমে যাওয়ায় এখন অনেকটাই শান্তি লাগছে। প্রণয় চোরাচোখে এক পলক তাকায় তার দিক। ফের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। জরুরি তলবে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে হচ্ছে তার। জরুরি কারণ টা ঠিক কী সেটা জানে না ও। শুধু এতটুকুই জানে, বাবা যেতে বলেছেন সুতরাং যেতে হবে। বাবার আদেশ পেয়ে তৎক্ষনাৎ ছুট লাগিয়েছে। তৈরি হয়ে রওনা হয়েছে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। এত তাড়া দিয়ে গ্রামে নেয়ার কারণ টা সে জানে আর তেমন পাত্তা ও দেয় না। অথচ ছেলেটা জানেই না তার জীবন গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিতে চলছে।


টানা চার ঘন্টার জার্নি শেষে নিজের বাসায় এসে পৌঁছায় প্রণয়। সূচনা নামের মেয়েটাকে সে হারিয়ে ফেলেছে স্টেশনেই। আর দেখলোই না ট্রেন থেকে নামার পর। প্রণয়ের ভারি অবাক লাগে, মেয়েটা গেল কই! পরমুহূর্তেই ভাবে স্টেশনে এত ভীড়ের মধ্যে একটা মেয়েকে এভাবে খুজেঁ পাওয়া তো সহজ নয়। সে ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়েঁ ফেলার চেষ্টা করে। বাড়িতে পোঁছেই মাকে ডাকতে শুরু করে। নুরাইয়া ছেলের গলার আওয়াজ পেয়ে এক প্রকার দৌড়ে আসেন রান্নাঘর হতে। এতদিন পর ছেলেকে দেখে মুখে হাসির সাথে সাথে আঁখি জোড়া সিক্তও হয়। ছেলের বাহুতে হাত রেখে কপালে আদুরে চুমু খান। আহ্লাদী স্বরে কত কথা বলেন। প্রণয় নিজেও মায়ের খোঁজ নেয়। ততক্ষণে ছোট বোন ইরা ও ভেতরের কক্ষ হতে বেরিয়ে আসে। ভাইকে দেখেই সালাম দিয়ে হালচাল জেনে নেয়। প্রণয় তন্মধ্যে ই জিজ্ঞেস করে,

” বাবা কোথায়? ”

নুরাইয়া বলেন,

” আগে হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নেয় তারপর দেখা করিস। ওনার জরুরি কথা শুরু হলে খাওয়ার দেরি হয়ে যাবে। কত পথ জার্নি করে আসছিস! ”


পুরো বাড়ি সাজানো, অথচ বাড়িটাতে বিয়ে বাড়ির ন্যায় কোনো আমেজই নেই। সব কেমন নিস্তব্ধতায় মোড়ানো। বাড়ির উঠোনে পা দিতেই সূচনার বুক কেমন করে ওঠে। এত নীরবতা কেন! সে টিপটিপ পায়ে সদর দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। বাড়ির ভেতরের মানুষ দের নজরে পড়তেই কেউ একজন বলে ওঠে,

” আহারে, সূচনা। কত আশা নিয়ে বিয়ে করতে রাজি হইছিলি আর কী হয়ে গেল! ”

সূচনার কানে আসে কথা কিন্তু মস্তিষ্ক কাজ করে না, কথার মানে বুঝতে পারে না। খেয়াল করে কথাখানা তার বড় খালা বলেছে। মুখে আঁচল চেপে উদাস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন ওর দিক। এর মধ্যেই সূচনার মা দিশা ছুটে এলেন। সূচনা কে টেনে নিয়ে গেলেন কোথাও। কোনো কক্ষে! কক্ষের দরজা ও বন্ধ করে দিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তেমন কিছু ই বোধগম্য হলো না মেয়েটার। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো শুধু।

বাবা ম রা মেয়ে, তার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে খবরটা ইতিমধ্যে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। সূচনাও একটু আগে অবগত হয়েছে সে সম্পর্কে। তার মা দিশাই জানিয়েছে তাকে। এমন খবরে সূচনা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। সে বুঝতে পারছে না তার এই মুহূর্তে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত। তার থমথমে মুখ দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে, বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার শোকে মেয়ে টা পাথর হয়ে গেছে।তার মায়েরও এমন মনে হচ্ছে। উনি বিচলিত হয়ে উঠলেন, কান্নারত কণ্ঠে বললেন,

” কিরে কিছু বল! চুপ করে আছিস কেন! ”

” একটু একা থাকতে দিবে? ”

আর কিছু বলতে পারলেন না দিশা। বিনা বাক্য ব্যয়ে ঘর থেকে চলে গেলেন। থমথমে মুখ এতক্ষণে কোমল হলো। পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। কেমন শ্রান্ত‚ বিবর্ণ রূপ ধারণ করেছে। কিয়ৎক্ষণের মাঝেই নেত্রযুগল সিক্ত হলো। জীবনে উত্থান পতন কী তাদের কম হলো! অভাব, অপমান, নিন্দা তাও তো কম ছিল না। এখন নতুন করে আরেকটা!


স্বাভাবিক, স্থির দৃষ্টিতে বাবার দিকে নেত্রযুগল আবদ্ধ প্রণয়ের। কিঞ্চিৎ পরিমাণ বিষ্ময়ও বটে। কিঞ্চিৎ পরিমাণ বললে ভুল হবে। পরিমাণটা এরও অধিক হতে পারে। মায়ের মুখে সেই একই কথা শুনে মাথা হ্যাং হয়ে গিয়েছে তার। নিস্তব্ধ, নির্বাক প্রণয় চুপটি করে বিছানার উপর ঠায় বসে রইল। কী বলছে তারা! বিয়ে করে নেয়! বললো আর বিয়ে করে নিল! তাও এমন একজনকে যাকে এই অবধি দেখেনি। এহতেশাম আহমেদ ততক্ষণে কক্ষ ত্যাগ করেছেন। প্রণয় এবার সাহস করে মুখ খুললো। মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,

” মা তোমরা কী শুরু করেছো এসব? ”

নুরাইয়া থমথমে গলায় বললেন,

” দেখ প্রণয়, এবার আর তোর মর্জি চলবেনা। যা যা করতে চেয়েছিস সব করতে দিয়েছি। শহরে যেয়ে পড়তে চেয়েছিস দিয়েছি। তোর বাবার বিরুদ্ধে যেয়েও, কথাও শুনেছি। কিন্তু এবার না। এবার উনি যা বলছেন তাই কর। বাপ ম রা মেয়ে, মা কষ্ট করে বড় করেছে। যথেষ্ট ভালো, দেখতে সুন্দর, পড়াশোনায় ও ভালো। আমাদের ইরা শহরে যে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে ও সেখানেই ভর্তি হয়েছে। বিয়ে ও ঠিক হয়েছিল সেই শহরে ই। কিন্তু বিয়ে তো ভেঙ্গে গেল। গ্রামের অবস্থা তো বুঝিস ই৷ একটা কিছু হলে কেউ সাহায্য করতে না পারলেও ব দ না ম ঠিকই রটাতে পারে। আর এটাতো বিয়ের মতো ব্যাপার। ”

” সেই মেয়েকে বাঁচাতে বাবা তার ছেলেকেই কু র বা নি দিয়ে এলো! ”

” এভাবে বলিস না। মেয়েটা তোর অযোগ্য না কোনো অংশে। হয়তো পরিবার, টাকা-পয়সার দিক দিয়ে কম আছে। ”

” সবে তিনমাস হয়েছে চাকরি পেয়েছি এর মধ্যে ই এত বড় দায়িত্ব দিতে চাচ্ছো! আর বাবা যে শহরে বাড়ির কাজ করছে! এর মধ্যে এসব! ”

” বাড়ির কাজ প্রায় শেষ, আর তোর বাবা যা বলছে তা নিশ্চয়ই ভেবে চিন্তে বলছে। বাবার ওপর বিশ্বাস নেই? ”

নুরাইয়ার কথায় টনক নড়ে ওঠে তার। বাবার ওপর তো তার বিশ্বাস আছে। থাকবে না কেন! কিন্তু!

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে