প্রণয় কাব্য পর্ব-১৫

0
758

#প্রণয়_কাব্য
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৫.
গভীর রজনী। চারদিক কেমন ভয়ংকর রকম নিরব। এমন থমথমে পরিবেশ প্রেম করার জন্য একদম পারফেক্ট। বিরক্ত করার জন্য কেউ নেই। তিহান মোবাইলে সময় দেখলো। পাক্কা বিশ মিনিট পার হয়ে গেছে। পুতুল এখনো আসেনি। তিহান অধৈর্য হলো না। তার অপেক্ষা করতে ভালো লাগছে। চব্বিশ বছর জীবনে এমন অনুভূতি নতুন। ছেলেমানুষীতে ভরা এই অনুভূতিটা তার ভালো লাগছে। ভবিষ্যতে নাতি নাতনিকে তার লুকচুরি প্রেমের গল্প শোনাতে পারবে।
পুতুল এলো ঠিক আধঘন্টা পর। তিহান ততক্ষনে মশার কামড় অতিষ্ঠ হয়ে পায়চারি করতে শুরু করেছে। দূর থেকে তিহানকে দেখে তৃপ্তির হাসি হাসলো পুতুল। তিহানের গায়ের গন্ধ এই হালকা বাতাসেও তার নাকে কড়া নাড়লো। পুতুল চোখ বন্ধ করে নিলো। একবার কি সে শুনবে তিহান কোন পারফিউম ব্যবহার করে? পরক্ষণেই মত বদলে নিলো। লোকটা যদি লজ্জা দিয়ে কথা বলে? তিহানের গায়ে গাড়ো বাদামী রঙের জ্যাকেট। গলায় সাদা কালো কম্বিনেশনে একটা মাফলার প্যাচানো। পায়ের দিকে তাকাতেই পুতুলের হাসি পেল। পায়ে আধখোলা ধরণের খুব সাধারণ একজোড়া সান্ডেল। খুব সম্ভবত এমন স্যান্ডেল সে তিহানের রুমে দেখেছিল। ঘরে পড়ার স্যান্ডেল পায়েই চলে এসেছে লোকটা! মশা কামড়াচ্ছে নিশ্চই? পুতুলের মায়া হলো ভিষণ। ঘর থেকে কয়েল এনে দিবে কি? মা যদি জেগে যায়?

ধীর পায়ে পুতুল এসে দাঁড়াল তিহানের সামনে। তিহান থামলো। ল্যাম্পপোস্টের হালকা আলোতে পুতুলের মুখখানা খুব আদুরে লাগছে। তিহানের চোখ জোড়া পুতুলের মুখে নিবদ্ধ। তার চোখ দুটো তাদের ক্ষুদা মেটাতে ব্যস্ত। পুতুল গোল‌গোল চোখে তাকালো। অস্ফুট স্বরে বলল,

‘অনেক্ষণ অপেক্ষা করিয়েছি বলে রাগ করেছেন?’

তিহান সরু চোখে তাকালো। বাঁকা হেসে বলল,

‘রাগ করলে রাগ ভাঙাবি?’

পুতুল উপর নিচ মাথা নাড়ল। তিহান তার মাথা ঝুঁকল। গভীর‌ গলায় বললো,

‘আমি ভিষণ রেগে আছি। রাগ ভাঙা।’

পুতুল বোকা চোখে তাকিয়ে আছে। তিহানের মুখভাব গম্ভীর। তিহান তাহলে সত্যি রেগে আছে? পুতুলের চোখ ছলছল করে উঠলো। লোকটা কত দূর থেকে তার জন্য এসেছে। আর সে দায়িত্বহীন প্রেমিকার মতো আধঘন্টা দাড় করিয়ে রেখেছে। তাও এই শীতের মধ্যে।

‘আমি কান ধরে উঠবস করলে হবে?’

তিহান সোজা হয়ে দাঁড়ালো। আশপাশে তাকিয় বললো,

‘ওটাতো খুব নরমাল শাস্তি। আমি তোকে ভয়ংকর শাস্তি দিতে চাই। আপত্তি আছে?’

পুতুল দুদিকে ঝটপট মাথা নাড়ল। তার কোনো আপত্তি নেই। তিহান মুচকি হাসলো। এক পা পুতুলের দিকে এগিয়ে এলো। পুতুল শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

‘নে ঝটপট চুমু খা।’

তিহান কথাটা বলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো । পুতুল চট করে চোখ মেলে তাকালো। এ কেমন শাস্তি?

‘আপনি না বললেন ভয়ংকর শাস্তি দিবেন?’

‘এটা তোর কাছে নরমাল লাগছে? আমাকে চুমু খেতে তোকে কত স্ট্রাগেল করতে হবে জানিস? আমার হাইট দেখেছিস?’

তিহান পুতুলের থেকে অনেকটা লম্বা। পুতুল ঢোক গিলল। তার হাত পা কাঁপছে। কি ভয়ংকর লোক! এমন শাস্তি দিবে জানলে সে কিছুতেই রাজি হতো না।

‘তুই বললে আমি হেল্প করতে পারি। হেল্প লাগবে?’

‘হুম।’

তিহান পুতুলের দিকে ঝুঁকে এলো।

‘এবার চটপট টাস্ক কমপ্লিট কর।’

পুতুল সময় নিলো না। টুপ করে তার কোমল ঠোঁট জোড়া দিয়ে ছুয়ে দিল তিহানের গাল। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটল যে তিহান ও প্রস্তুত ছিল না। ততক্ষনে পুতুল দুহাত দূরে সরে গিয়েছে। তিহানের যখন হুশ এলো তাখন সে হাত বুক চেপে ধরলো। চোখ মুখ কুঁচকে নিয়ে বললো,

‘আমি বোদহয় মরে যাচ্ছি পুতুল।’

পুতুল দৌড়ে তিহানের কাছে এলেই তিহান টুপ করে তার গালে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। পুতুল কেঁপে ওঠে। হৃৎপিণ্ড দ্রুত ছুটতে শুরু করে। পুতুলের কিশোরী মন নতুন এক অনুভূতির স্বাদ পায়। এ অনুভূতিটা ভিন্ন। একদম আলাদা। গায়ে কাঁপন করানোর মতো। পুতুল বিরবির করে বলে,

‘আপনার ছলনা ভয়ংকর তিহান!’

_____________

শিউলির ঘুম ভাঙলো অতিরিক্ত নিন্মচাপে। বিছানা ছেড়ে নামে গায়ে শাল জড়িয়ে নিল। পুতুলদের বাথরুমটা ঘরের ঠিক পাশেই। পাকা বাথরুম। যদিও বেশ পুরতন। ঘরের সদর দরজা খোলা কিন্তু আলতো করে চাপানো। শিউলি বিরক্ত হয়ে বিরবির করলো,

‘একটা কাজ ও ঠিক মতন করে না মাইয়াডা। বারবার বলছি দরজা ভালো মতন আটকান লাগে। কানে নেয় না কথা। উঠুক সকালে। লোহার শিক দিয়া কান ঠিক করতাম।’

পুতুল ফিরলো ঠিক তার খানিক বাদেই। শিউলি তখনো বাথরুমে। টিনের দরজার উপরের ফাঁকা থেকে আলো এসে উঠানে পড়ছে। পুতুল উঠানে থমকে দাঁড়াল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। ঠিক এই ভয়টাই সে পাচ্ছিল। সত্যিটা বললে তো শিউলি তাকে মারতে মারতে মেরেই ফেলবে। মিথ্যা বা কি বলবে? এত রাতে কি কাজে সে বাহিরে ছিল? মাথা কাজ করলো না। রুমে গিয়ে ঝটপট জামা পালটে লেপের তলে মাথা গুঁজে নিলো। মনে মনে একটাই দোয়া করতে লাগলো যেন এবারের মতো বেঁচে যায়।

বিরক্তিকর কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙলো পুতুলের। ভোর রাতের দিকে স্বল্প বৃষ্টি হয়েছিল। এমন অসময়ে বৃষ্টি পুতুলের কখনোই ভালো লাগে না। তবে আজ ঘুমটা বেশ সুন্দর হয়েছে। টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ আর ভেজা মাটির গন্ধ যেন তাকে ঘুমের পালঙ্কে রেখে এসেছিল। পুতুল এলোমেলো পায়ে এগিয়ে রুমের ছোট জানালাটা মেলে দিলো। এই অশ্প বৃষ্টিতেই বাহিরের রঙ বদলে গেছে। ঠান্ডাটা যেন ভারী হয়ে এসেছে। ঠান্ডা মৃদু বাতাসে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। শিউলির ডাক এলো। পুতুল রাতের কথা বেমালুম ভুলে বসেছে। শিউলি তাওয়ায় রুটি ছেকছে। পুতুল চুলার ধার ঘেঁষে বসলো। আপ্লুত হয়ে বললো,

‘রুটির সাথে কি আছে মা?’

‘কবুতরের ঝোল।’

‘কবুতর কই পেলে?’

শিউলি বড় করে শ্বাস ফেলল।

‘পপির শ্বশুর বাড়ি থেইকে আনছে।’

পুতুল ঘরের ভিতর উঁকি দিলো। কাউকে নজরে এলো না।

‘আপা আসছে? ঘরে তো কাউকে দেখলাম না।’

‘সাগর আসছে। ও সাথে কইরা নিয়া আসছে।’

সাগরের কথা বলতে গিয়ে শিউলি চমৎকার করে হাসলো। আগ্রহ নিয়ে বললো,

‘ছেলেটা খুব লক্ষী রে। খুব সুন্দর কইরা গুছাইয়া কতা কয়। আইসা বসলো না। বাজারে চইলা গেছে। কত কইরা
মানা করলাম হুনল না।’

পুতুলের মুখ মলিন হয়ে এলো। পুতুল শুনেছে পপির শ্বশুর বাড়ির লোকেদের মধ্যে সাগর সবথেকে বুদ্ধিমান এবং শিক্ষিত। তবুও তার লোকটাকে পছন্দ নয়। পছন্দ নয় এমনটাও ঠিক না। এমন ভদ্র সুপুরুষকে কেন অপছন্দ হবে? কিন্তু সে তো শুধুই তিহানকে চায়। তার ধ্যান জ্ঞান চিন্তা চেতনা জুড়ে কেবল এই একটা মানুষ।
পুতুল নিচ গলায় বললো,

‘ওদের তুমি না কেরেছ? আমি পড়তে চাই। বিয়ের জন্য তো কত সময় আছে।’

রুটি ছেকা শেষ। তরকারির হাড়িটা চুলায় তুলে রেখে শিউলি ঘুরে বসলো। মুচকি হেসে পুতুলকে বললো,

‘মাইয়া মানুষের বিয়া যত তাড়াতাড়ি হইব তত মঙ্গল। সাগর ভালো পোলা। শিক্ষা দীক্ষা আছে। চাকরিও পাইছে। তরে পড়াইতে চায়। তরে নিয়া রাজশাহী শহরে চইলা যাবে। তুই ভালো থাকবি। এমন পোলা পাওন কি মুখের কতা?’

পুতুল ঠোঁট কামড়ে ধরে বসে রইল। তার শেষ ভরসা ছিল তার মা। এখন যে তা-ও রইলো না! কি করবে সে এখন? সে তো কথা দিয়েছে তিহানকে অপেক্ষা করবে বলে! তিহানকে ধোঁকা দেওয়ার মতো সাহস তার নেই। এটা সে কখনোই করতে পারবে না। টুপ টুপ করে চোখ থেক জল গড়াতে লাগলো। শিউলির মন খারাপ হলো। মেয়ের মাথায় হাত রেখে শান্তনা দিতে বললো,

‘আমারে যখন বিয়া দিলো তখন আমিও তর মতোই কানছিলাম। কত জিদ করলাম বিয়া না করবার জন্যে। তখন মায় বুঝাইল বিয়া তো করতেই হইবে আইজ হক বা দুই দিন পর। বিয়ার পর প্রত্তম কয়দিন খারাপ লাগত। আস্তে আস্তে মায়া বাড়ছে সংসারের। মাইয়াগে জীবন এরকম। মানাই নিতে হইব।’

পুতুল ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। সে তার মনের ব্যাথা কিভাবে বুঝবে? কে বুঝবে তার কষ্ট! এঈ যন্ত্রণার মুক্তি ঠিক কোথায়?

চলবে………..

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে