#প্রণয়_কাব্য
#লাবিবা_আল_তাসফি
১৪.
ঘড়িতে রাত দশটা মাত্র। পুতুল বিরক্ত চোখে বাহিরে তাকালো। আকাশে তারা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু উজ্জ্বল নয়। বালিশের তলায় লুকিয়ে রাখা ফোনটা বেজে উঠলো হঠাৎ। পুতুল চমকালো। কাঁপা হাতে ফোন বের করতেই দেখা গেলো কলটা পপি করেছে। হতাশা জেঁকে ধরলো তাকে। আপা কল করেছে মানে বিয়ে নিয়ে কিছু বলবে। শিউলি কিছুক্ষণ হলো বাতি নিভিয়ে শুয়েছে। সে আজ অন্য ঘরেই শুয়েছে। পুতুল পা টিপে শিউলির ঘরে উঁকি দিলো। আলতো গলায় দু একবার ডাকদিলো।
‘মা! তুমি ঘুম?’
উত্তর এলো না। পুতুল আবারো নিজের রুমে ফিরে আসলো। কলটা কেটে গেছে ততক্ষনে। পুতুল বিছানায় বসে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল। আবারো কল এসেছে।
‘হ্যালো?’
‘কে পুতুল?’
‘হুম।’
‘মোবাইল তোর কাছে কেন? মা কই?’
‘ঘুমাচ্ছে।’
‘ঠিকাছে। সকালে কল করব। আর মোবাইল মার বালিশের কাছে রাইখা আয়।’
‘আচ্ছা।’
কল কেটে গেল। পুতুল তপ্ত শ্বাস ফেলল। সবকিছু কেমন যেন কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার জন্য। আগের মতো নেই কিছুই।
তিহান কল করল ঠিক রাত তিনটায়। পুতুল অপেক্ষা করতে করতে টেবিলেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। ফোনের তীব্র ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল তার। ব্যস্ত হাতে কল ধরতেই ওপাশ থেকে ক্লান্ত গলায় তিহান বলল,
‘অপেক্ষায় ছিলি?’
পুতুল উত্তর দিলো না। তার মন খারাপ হয়েছে ভীষণ। সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছে সে। কিন্তু লোকটার কল করার সময় হলো এখন!
‘কথা বলছিস না কেন? রেগে আছিস?’
এবারো কোনো জবাব এলো না। তিহান তার রুমের ফ্যানটা ছেড়ে দিল। এই শীতেও সে ঘেমে একাকার। এখানে আসার পর থেকে সে তার গাড়ি ব্যবহার করেনি একদিন ও। লোকাল বাস কিংবা ট্যাক্সিতেই আসা যাওয়া। এত রাতে কোনো ট্যাক্স না পেয়ে প্রায় এক ঘন্টার রাস্তা হেঁটে এসেছে সে। ফ্লাটে ঢুকে দু গ্লাস পানি খেয়েছে। গলা বুক শুকিয়ে একাকার।
‘একটা কাজে আটকা পড়েছিলাম পাখি। রাগ করিস না। কান ধরছি। কথা বল।’
তিহানের কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ঘনঘন শ্বাস ফেলছে সে। ফোনের ওপাশ থেকে পুতুল স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। তার অভিমান গলে গেলো। অস্থিরতা বাড়লো।
‘আপনার কষ্ট হচ্ছে? অসুস্থ আপনি?’
তিহান হাসলো। মুচকি হেসে বললো,
‘খুব কষ্ট হচ্ছে পুতুল। ভিষণ অসুস্থ আমি। তোকে আর একদিন দেখতে না পেলে মরে যাব শিওর।’
পুতুল কেঁদে ফেলল। লোকটা সবসময় তার সাথে মজা করে। সিরিয়াস বিষয়েও মজা করে।
‘আপনি খুব খারাপ লোক।’
‘এই খারাপ লোকটার জন্যই তো কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিস!’
ওপাশ থেকে কেবল তীব্র ফোঁপানোর শব্দ আসছে। তিহান সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইল। জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
‘আর একবার যদি কান্নার শব্দ পাই এই মুহূর্তে আমি চলে আসবো। এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবো। দুদিনের ছাড়ব না। পুরো মহল্লা এক হয়ে গেলেও না। যদি রাজি থাকিস দেন ইউ কেন ক্যারি অন।’
শব্দ কিছুটা কমলো। তিহান বন্ধ চোখে হাসলো। পাগলী মেয়ে। একদম বোকা রাণী। এ যুগে এমন বোকা মেয়ে এখনো পাওয়া যায়?
‘পুতুল?’
‘হুম।’
‘চল লুকিয়ে দেখা করি।’
পুতুল চমকে তাকালো। বিষ্ময় নিয়ে বলল,
‘কিভাবে?’
‘ওটা আমার উপর ছেড়ে দে। তুই শুধু বল তুই আমাকে দেখতে চাস কি না?’
‘হুম।’
‘হুম কি?’
পুতুল পড়লো মহা ঝামেলায়। তার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। তিহান মুচকি মুচকি হাসছে। সে ইচ্ছা করেই পুতুলকে জ্বালাচ্ছে। পুতুল আঙ্গুল দিয়ে বিছানার চাদর খুটছে। তার মন অশান্ত। এই সামান্য উত্তর দিতে যেন সে আকাশ সমান লজ্জায় ডুবে যাচ্ছে।
‘নিরবতা মানে কি ধরে নিব? তুই দেখা করতে চাস না? তাই তো?’
পুতুল ব্যস্ত উত্তর দিলো,
‘চাই।’
______________
শিউলির ডাকাডাকিতে সকাল সকাল ঘুম ভাঙল পুতুলের। চৌখে রাজ্য সমান ঘুম নিয়ে বিছানা ছাড়তে হলো। উঠানে নেমে দাঁড়াতেই ঠান্ডা বাতাসে গা কেঁপে উঠলো। পুতুল খুব বিরক্ত নিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকলো।
‘আর একটু ঘুমাতে দিলে কি হতো মা?’
‘বেলা কত হইছে সেই জ্ঞান আছে?’
ঘরিতে তাকিয়ে পুতুলের চোখ পুরো আকাশে। দুপুর একটা বাজে। আকাশে রোদ নেই। কেমন ঝিমিয়ে পড়া পরিবেশ। এমন পরিবেশে কেন যেন ভিষণ মন খারাপ হয়। কোনো কারণ ছাড়াই মন খারাপ হয়। পুতুলের ও তেমন হচ্ছে। তার ভিষণ মন খারাপ করেছে। কিন্তু কেন তা সে জানে না।
শিউলি মাদুর পেতে পুতুলকে ডাকল। প্লেটে ভাত তুলতে তুলতে বললো,
‘পপির দেওররে তর কেমন লাগে?’
পুতুল খুব স্বাভাবিক উত্তর দিলো,
‘ভালো।’
‘আচ্ছা।’
পুতুল আড় চোখে তাকালো। সন্দিহান কন্ঠে বললো,
‘কেনো?’
‘ওই বাড়ি থেইকে কল দিছিল। ওগে তরে পছন্দ হইছে। বিয়ার দিন তারিখ ঠিক করবার জন্যি বলছে।’
পুতুলের হাত থেমে গেলে। ভাত গলায় আটকালো। গ্লাসের পানিটুকু ঢকঢক করে খেয়ে থামলো সে। ছলছল চোখে শিউলিকে বললো,
‘মা আমি বিয়ে করতে চাই না। আমাকে তোমার কাছে রাখতে কি তোমার খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে?’
পুতুলের কথাটা শিউলার বুকে লাগল যেন। শিউলি হেসে বললো,
‘ধুর মাইয়া। কষ্ট কেন হইবে? তুই বিয়া করবি না কইছস আমিও তরে বিয়া দিতাম না।’
পুতুল হেসে ফেলে। তার মা যে এই সামান্য কথা বলতে গিয়েই কেঁদে ফেলেছে! পুতুল আলতো করে এক হাতে জড়িয়ে ধরলো শিউলিকে।
‘হইছে ভাত খাওয়া শেষ কর আগে। আল্লাদ পরে।’
_______________
চোখের পলকে সময় কেটে গেল। বিকেল তারপর সন্ধ্যা তারপর রাত। জগতের সবকিছু কি সুন্দর নিয়ম মেনে চলে! কখনো নিয়মের আগ পর হয় না।
রাত দুইটার দিক কল এলো। পুতুল মোমবাতি জ্বালিয়ে বই পড়ছিল। হুমায়ূন সমগ্র। এটা সে উপহার পেয়েছিল গতবার সাহিত্য প্রতিজগিতায় প্রথম হয়ে। মোম বাতির লাল রঙের শিখার নিচে রেখে বই পড়তে তার বেশ দারুন লাগে। ফোনের শব্দে তার পড়ায় ব্যাঘাত ঘটল। কপালে ভাঁজ ফেলে বালিসের তলা থেকে ফোন বের করতেই চোখ বড় হয়ে এলো। এ তো তিহান! ঘড়িতে চোখ যেতেই দেখলো সেখানে রাত দুটো বেজে বারো মিনিট। কল রিসিভ করে কানে চেপে ধরতেই ওপাশ থেকে তিহানের কন্ঠ ভেসে এলো।
‘গেট খুলে সোজা বাড়ির পেছনে চলে আয়। আ’ম ওয়েটিং!’
টুটটুট শব্দে কল কেটে গেলে। পুতুলের মাথা হ্যাং হয়ে আছে। সে কি সত্যি শুনেছি নাকি মতি ভ্রম হয়েছে তার? ফোনের ডায়াল লিস্ট চেক করলে সেখানে তিহানের নাম্বার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পুতুলের মুখে বিস্তার হাসি খেলে গেলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল সেট করে নিলো। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক ও পড়লো। গায়ের জামাটার রঙ চটে গেছে। কেমন বেমানান লাগছে। ড্রয়ার খুলে হালকা গোলাপি রঙের স্যালোয়ার সেট বের করে চেঞ্জ করে নিলো। ওড়নাটা কিভাবে নিবে? মাথায় দিবে? নাকি গায়ে ছড়িয়ে দিবে? অনেক ভেবেচিন্তে শেষে সুন্দর করে মাথায় জড়িয়ে নিল। তাক থেকে মোটা শাল নিয়ে গায়ে জড়িয়ে হাতের মুঠোয় ফোন নিয়ে চুপিচুপি বেড়িয়ে পড়লো তার প্রিয়তমর সাথে দেখা করতে। ধুকধুক বুকে একরাশ আশা নিয়ে রাতের অন্ধকারে বাহিরে পা ফেলল। এই অনুভূতিটা নতুন। ভয়ংকর কিন্তু মিষ্টি। কলপাড় থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। দূরে কোথাও কুকুর ডাকছে। হরি কাকার ধলা হয়তো! অকারণেই হুংকার ছাড়ে পাজি কুকুরটা।
চলবে…….