#প্রণয়_কাব্য
#লাবিবা_আল_তাসফি
১৩.
ফোনের রিংটনে ঘুম ভাঙল পুতুলের। শিউলি বেঘর ঘুমাচ্ছেন। সারাদিনের ঝামেলায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। পুতুল আর ডাকল না তাকে। ঘুম ঘুম চোখে কল রিসিভ করে কানে চেপে ধরল। হ্যালো বললে ওপাশ থেকে কোনো শব্দ এলো না। কেবল নিঃশ্বাসের ভারী শব্দ শোনা গেল। ঘুমে কাতর পুতুল বিরক্ত হলো। কল কেটে ফোন পাশে রেখে আবারো ডুব দিলো ঘুমের দেশে। কিন্তু তার এমন ঘুম হয়তো অপর প্রান্তের মানুষের পছন্দ হলো না। আবারো তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বেজে উঠলো ফোন। পুতুল রিসিব করলো না। মাথার নিচের বালিশ উঠিয়ে কানে চেপে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ফোননটা অবিরাম বেজে চলছে। থামার যেন নাম নেই। শিউলির ঘুম খুব গভীর। এত শব্দ তাকে জাগাতে পারলো না। কেবল ভ্রুদ্বয়ের মাঝে খানিকটা ঘোচ পড়ল। পুতুল উঠে বসলো। সময় নিয়ে কল রিসিভ করলো। ঝাঁঝালো গলায় বললো,
‘কি সমস্যা? এত রাতে কি চাই?’
তিহান বড় করে শ্বাস ফেলল। আনমনে খানিকটা হাসলোও। মেয়েটা তবে রাগ করতেও জানে?
‘পুতুল! আমি তিহান।’
তিহান নামটা কানে যেতেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সতেজ হয়ে উঠলো। বার কয়েক পলক ঝাপটাতেই চোখ থেকে ঘুমের রেস কিছুটা কাটলো। কাঁপা হাতে এখবার নাম্বারটা দেখে নিলো। হ্যা এটা তিহানের নাম্বার। বুকের ভেতরের কান্না গুলো দলা পাকিয়ে আসতে চাইছে। যেন চিৎকার করে বলতে চাইছে, ‘তিহান বাঁচান আমাকে! ওরা আমায় আপনার থেকে কেড়ে নিতে চায়! আমি যেতে চাই না। আমিতো শুধু আপনার হতে চাই!’
কিন্তু এমন কিছুই সে বললো না। মনের কথা গুলো গিলে ফেলে মুচকি হেসে বললো,
‘এত রাতে কল করলেন যে? কিছু বলবেন?’
‘আমি ঢাকা চলে এসেছি পুতুল। হয়তো বেশ কিছুদিন দেখা হবে না। কথাও না হতে পারে। মন খারাপ করবিনা কেমন? খুব জলদি ফিরে আসবো আমি। এবার আসলে সাথে তোকে পারমানেন্ট ভাবে আমার করে নিব। ওকে?’
পুতুলের চোখ গড়িয়ে এক ফোঁটা পানি পড়লো। বুকের ভেতর দামামা বাজছে। এত কষ্ট হচ্ছে কেন তার? মনে হচ্ছে তার পুরো দুনিয়া শুন্য হয়ে গেছে।
‘কথা বলছিস না কেন?’
‘সাবধানে থাকবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন।’
তিহান হাসলো। চোখ বন্ধ করে তার ছোট্ট পুতুলকে কল্পনা করার চেষ্টা করল। এই মেয়েটার জন্য সে সব করতে পারবে। নিজের বাবার বিপক্ষে যেতেও দুবার ভাববে না সে। পুতুলের নাক টানার শব্দ আসছে। মেয়েটা নিশ্চই কাঁদছে।
‘আমাকে কয়েকটা দিন সময় দে পাখি। তোকে রেখে আর একদম দূরে যাব না। এটাই শেষ। তাই একটু অপেক্ষা কর।’
‘আচ্ছা।’
‘আর হ্যা! একদম কাঁদবি না। কাঁদলে তোকে একদম পেঁচার মতো লাগে।’
পুতুল হেসে ফেললো। বা হাতে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,
‘আপনি নিজেকে আয়নায় দেখেছেন? গরিলার মতো নাক আপনার।’
রাতটা এভাবেই কেটে গেল। দুষ্ট মিষ্টি ভালোবাসা আর একবুক আশা নিয়ে ফজরের দিকে চোখ বুঝলো পুতুল। তিহানের চোখে ঘুম এলো না। নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বাবার কাছে পুতুলকে আবদার করতে পারবে না সে। কিন্তু তার কেবল অনার্স শেষ হয়েছে। দেশের যা অবস্থা অনার্স শেষ করে একটা ভালো চাকরি পাওয়া মুশকিল। তিহানকে হতাশ দেখালো। মাথিটাও ধরেছে খুব। এক মগ কফি হলে ভালো হতো। কিন্তু তার ইচ্ছা হলোনা বানিয়ে খেতে। মাথার উপর এক হাত রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো।
_______________
ওবাড়ি থেকে কল এসেছে। পুতুলকে তাদের পছন্দ হয়েছে। এখন দিন তারিখ ঠিক হলেই হবে। শিউলির খুশি হবার কথা থাকলেও সে খুশি হতে পারলো না। এক মেয়ের সংসার বাঁচাতে অন্য মেয়েকেও সেই একই আগুনে ফেলবে সে? তার মন এ বিয়েতে কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। পুতুল এখনো ওঠেনি। শিউলি দরজায় তালা লাগিয়ে জমিদার বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। ও বাড়ির বউ কত ভালোবাসে পুতুলকে। সে একটা সমাধান ঠিক দিতে পারবে।
রেণুর শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। ছেলের শোকে তাকে কব্জা করে নিয়েছে। ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়া করেন না। সারাদিন ঘরে ঘাপটি মেরে বসে থাকেন। তারিমকে একথা জানানো হলে সে সরাসরি বলেদিয়েছেন যে যেমন থাকতে চায় তাকে তেমন থাকতে দিতে। এ নিয়ে দ্বিতীয় কথা সে শুনতে চায় না। ব্যাস হয়ে গেল। কেউ আর দুটো বার উঁকি মেরে দেখেনি। বাড়ির দায়িত্ব বর্তমানে তানিয়ার হাতে। কাজের লোকেরা রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছে তার আদেশ মানতে মানতে। এখন সে রান্নাঘরে গেছে দুপুরের খাবার মেনু লিস্ট দিতে।
‘এই মর্জিনা চুলায় কি বসিয়েছিস?’
‘আফা ভাত হইয়া গেছে এহন কাতলা মাছের ঝোল করবার লাগি মশলা কষাইতাছি।’
তানিয়া কপাল কুঁচকে তাকালো।
‘এগুলো কে করতে বলছে?’
মর্জিনা আমতা আমতা করলো।
‘কেউ কয়নায়। আমি…..’
‘ওগুলো তোর বাড়িতে নিয়ে যাস। এখন আমি যা বলি তাই কর। শোন মাটন কষা, পরোটা, আলুর দম আর মুরগির ঝাল মাংস।’
‘আফা দুপুরের খাওনে কোন মানুষ পরোটা খায়?’
‘যা বলছি কর। বেশি কথা বলবি না। হয়তো চাকরি নট হয়ে যাবে।’
তানিয়া যেতেই মর্জিনার মুখের বুলেট ছুটতে লাগলো।
‘দুইদিন বড় আফা কাজ দেখতাছেনা ওমনি হাতের চান্দ পাইয়া গেছে। আবার চাকরি নট করবে! এই মর্জিনা ওতো সস্তা না। এই মর্জিনার মতো রান্নার মানুষ দুই গ্রামেও পাওন যাইব না। আর উনি চাকরি নট করবে।….’
___________
শিউলিকে জমিদার বাড়ির গেট থেকে ফিরে আসতে হলো। দাড়োয়ানের কাছে রেণুর অবস্থার কথা শুনে সে আর ভেতরে যায়নি। বাড়িতে ফিরে দেখে পুতুল উঠে পড়েছে। তালা খুলে দিতেই পুতুল রুম থেকে বের হলো। ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে গালে ঢুকালো। ঘুরে শিউলিকে বললো,
‘কোথায় গেছিলে?’
‘জমিদার বাড়ি।’
‘কেন?’
‘তর বড়-মার শরীর ভালো না। কি অবস্থা তাই শুনতে।’
পুতুল মাথা নাড়ল। পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে কলপাড়ের দিক হাঁটতে লাগলো। শিউলি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে পুতুলের দিকে তাকিয়ে রইল। তার এমন লক্ষী, চাঁদের মতো মেয়েটার সাথে কোনো অন্যায় সে করতে পারবে না। পপির শ্বশুর বাড়ির লোকেরা ভালো না। সাগর যদিও একটু আলাদা কিন্তু রক্ত তো সেই একই!
পারুল এসেছে চারটার দিক। হাতে ছোট একটা বাটি। তার মধ্যে আছে গাজরের হালুয়া। পুতুলের ভিষণ পছন্দের এটা। পারুলদের বাড়িতে এই হালুয়া রান্না হলেও পারুল চুরি করে পুতুলের জন্য কিছুটা নিয়ে আসে। পুতুল আয়েশ করে বসে হালুয়ার স্বাদ নিচ্ছে। পারুল বিছানায় উপুর হয়ে গালে হাত দিয়ে শুয়ে পুতুলের দিকে তাকিয়ে। মুখে তার মিটিমিটি হাসি। পুতুল সেদিন নজর দিচ্ছে না। তার নজর কেবল হালুয়ার দিকে। পারুল অধর্য হলো। উঠে বসে পুতুলের দিকে কিছুটা ঝুঁকল।
‘তোর আর তিহান ভাইয়ের মাঝে কি চলছে রে?’
‘কি চলবে?’
‘কিছু চলছে না?’
‘এই চলাচলি বলতে ঠিক কি শুনতে চাইছিস?’
পারুল দাঁত বের করে হাসলো।
‘চলাচলি মানে ঐ প্রেমপিরিতি ধরনের কাহিনী আরকি। চলছে না?’
‘তোর কি মনে হয়?’
‘আমার তো মনে হয় চলছে। চলছে মানে ছুটছে টাইপ!’
‘তাহলে আবার জিজ্ঞাস কেন?’
‘তরমানে আমি সত্যি!’
পারুলের চিৎকার শিউলি বাহির থেকে ধমক দিলো।
‘মাইয়া মানুষের গলা এত বড় কেন? পুরা গ্রাম শুনতে পায়। আর যেন শব্দ না শুনি।’
‘আচ্ছা কাকি। মুখে তালা লাগাচ্ছি।’
পুতুল বিরক্ত চোখে পারুলের দিকে তাকালো। এই পেট পাতলা মেয়ে না জানি তার মায়ের সাথেই তিহান আর তাকে নিয়ে গল্প করতে বসে যায়! বিশ্বাস নেই এর উপর।
পুতুল এগিয়ে এসে পারুলের পাশে বসলো। পারুলকে সোজা করে ধরে বলল,
‘যা শুনেছিস এখন এইখান থেকেই সব ভুলে যা। তুই কিছুই জানিস না। ঠিক আছে? সব তোর খারাপ স্বপ্ন ছিল।’
পারুল দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলল,
‘আমার এসব ভুলতে খুব কষ্ট হয় রে। তবে তুই যদি মেলায় নিয়ে গরম গরম জিলাপি আর চানাবুট খাওয়াস তাইলে ভোলার সম্ভাবনা আছে একটা!’
চলবে………