#প্রণয়_কাব্য
#লাবিবা_আল_তাসফি
১২.
পুতুলের মন আজ ভীষণ খারাপ। সেই কখন থেকে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। নাকের জল চোখের জলে একাকার পুরো মুখ। হাত খোপা করা চুলগুলো লুটিয়ে আছে মেঝেতে। আদুরে মুখখানি রক্ত লাল হয়ে আছে। বাহির থেকে অনেক মানুষের কথা শোনা যাচ্ছে। পপি সেই কখন থেকে দরজার করা নাড়ছে। সেসবে পুতুলের নজর নেই। পপির ডাক তার কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না।
শিউলি রান্নায় ব্যস্ত। এক চুলায় মাংস চাপিয়ে অন্য চুলায় গরম পানি বসিয়েছে। পোলাও করা হবে। একা হাতে কাজ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর মাঝে হন্তদন্ত হয়ে পপি রান্নাঘরে ঢুকলো। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
‘তোমার আদরের কন্যা কি রঙ শুরু করছে মা? সেই থেইকে ডাকতাছি। দরজা খোলার কোনো নাম নাই।’
শিউলিকে চিন্তিত দেখালো। চাল ধুতে ধুতে বলল,
‘আর একবার ডাক মা! নাইলে আমি দেখতাছি।’
রাগে পপির মুখ লাল হয়ে উঠেছে। তার শরীর অনেকটা ভারি হয়ে উঠেছে। হাঁটতে চলতে কষ্ট হয় এখন। হাত পা ও ফুলে ঢোল প্রায়। এর মধ্যে পুতুলের এমন কান্ড তার মোটেই সহ্য হচ্ছে না। ওদিকে তার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা বসে আছে। তার চাচি শ্বাশুড়ি নাজরিন পুতুলকে খুব পছন্দ। সেদিন পুতুলকে দেখেই আবদার করে বসেছে সাগরের জন্য। সে না কিভাবে বলে? তাছাড়া পুতুল যদি ওবাড়ির বউ হয় তার প্রেশার কিছুটা কমবে। সংসারে হয়তো কিছুটা শান্তি আসবে।
‘পুতুলরে ডাকো মা। আমি আর দাঁড়াতে পারতাছিনা।’
‘তুই ঘরে যা। শুয়ে থাক। হাঁটাহাঁটি করিস না। আমি দেখতাছি।’
ঠিক দু ঘন্টা সময় নিয়ে পুতুল রুম থেকে বের হলো। পপি লাল রঙের একটা শাড়ি দিয়েছিল পরার জন্য। কিন্তু সেটা বিছানাতেই পরে আছে। হালকা সবুজ রঙের একটা সুতির কামিজ পরনে তার কেবল। চুলগুলো হাত খোপা করা। চিড়ুনি ছোয়ানো হয়নি তাতে। ওকে এভাবে দেখতেই পপির মেজাজ চটে গেল। এমন এলোমেলো ভাবে কেউ পাত্র পক্ষের সামনে আসে? তার সাজানো সংসারে আবার না এ নিয়ে আগুন লেগে যায়! সে ব্যস্ত পায়ে পুতুলের পাশে এসে দাঁড়াল। গলা নিচু করে বলল,
‘শাড়ি পড়িশনি কেন? ঘরে যা! আমি পড়াই দিব নিজের হাতে।’
‘আমি ঠিক আছি আপু।’
মাথা নিচু করে ছোট করে জবাব দিলো পুতুল।
পপি ফুঁসে উঠলো। ঝাঁঝালো গলায় বললো,
‘তোরা কি আমার সংসারে আগুন লাগাইতে চাস?’
পুতুল অবাক চোখে পপির দিকে তাকালো। পপির চোখ মুখে রাগ উপচে পড়ছে। পুতুলের চোখে পপানি জমলো। এই কি তার সেই বোন? কতটা পরিবর্তন! আগের সেই পপির সাথে এখনের পপির কোনো মিল পেল না সে। মানুষ বুঝি এভাবেই বদলে যায়!
____________
পুতুলদের সামনের রুমটায় খুব বেশি জিনিস পত্র নেই। একটা চকি খাট। লাল রঙের নতুন চদরটা সেখানে স্থান পেয়েছে। খাটের পাশেই কপাট বিহিন বিশাল জানালা। দেয়াল ঘেঁষে রাখা দুটো কাঠের চেয়ার আর একটা চার পায়ার টেবিল। এই তো এগুলোই। সাগর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো পুরো রুমটা। দেখার মতো কোনো বিশেষ কিছু নেই। তবে তার ভালো লাগছে। ভালো লাগার জন্য কোনো সঙ্গার দরকার হয় না। এই যেমন পুতুল নামের মেয়েটাকে তার ভালো লাগে। ভিষণ রকম ভালো লাগে। কিন্তু কেন? সেটা তার জানা নেই। তার মা যেদিন পুতুলের কথা বলল কোনোকারণ ছাড়াই সে খুব তৃপ্তি অনুভব করেছিল। প্রথম বলাতেই সে সম্মতি জানিয়েছিল। কেন করেছিল সে এমন সেটাও সে জানে না। পুতুল নামের মেয়েটাকে নিয়ে তার মস্তিষ্ক কোনো বর্তা বহন করতে পারছে না। পুরোটাই যেন তার নিষ্ঠুর মনের তলবে। এখানে আসার পর থেকে তার মন ছটফট করছে মেয়েটাকে দেখার জন্য। এক পলক দেখেছেও! কিন্তু সেই এক পলক যেন আরো কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছটফটানি বেড়েছে। চোখ বারবার ভেতরে উঁকি দিচ্ছে। এখনো কেন আসছে না? এই মেয়ের দেখা পাওয়া এতো মুশকিল কেন হচ্ছে!
ইংলিশে একটা প্রবাদ আছে,
‘Every precious thing’s is hard to get’
তার পুতুল ও তার কাছে মূল্যবান। এজন্যই হয়তো! মুচকি হাসলো সে। তার ম্যাচিউরিটির এ কি অবস্থা?
নাজরিন বেগম চেয়ারে বসে পান বটছে। পান খাওয়াটা
তার একধরনের নেশা। পান ছাড়া দুদন্ড বসতে পারে না সে। এখানে আসা অবদি তিন চার গাল পান খাওয়া হয়ে গেছে। শিউলি দোকান থেকে দশ টাকার পান এনে রেখেছিল।
‘ওত পান খাইলে মুখ পানসা লাগে না? খাওনের স্বাদ পাওয়া যায়?’
শিউলির কথায় লাল দাঁত বের করে হাসল নাজরিন।
‘কি যে বলেন বেয়াইন! পান খাইলে স্বাদ আরো বারে।’
শিউলি নাক কুঁচকালো। অতিরিক্ত জর্দা খাওয়ায় মহিলার মাথায় গন্ডগোল হইছে বলেই মনে করল সে।
ইতিমধ্যে অতিথিদের জন্য শরবত, সেমাই, নুডুলস, পায়েস দেওয়া হয়েছে। পপির শ্বশুর শাশুড়ি ও এসেছে। তারা উঠানে বসে আছে। শিউলি গেল তাদের ঘরে ডাকতে।
____________
‘চোখে এত পানি কেন? কি ভাবিস এতো?’
‘কিছুনা।’
পুতুলের নরম কন্ঠে মন গলল পপির। পুতুলের ঘোমটা ঠিক করতে করতে বললো,
‘মায়ের কথা ভাবিস না। মার জন্য ও ব্যবস্থা করবে তোর দুলাভাই। আমরা দুই বুনে একসাথে থাকব ভাবতেই আনন্দ লাগে মনে। মনে আছে আমরা আগে একসাথে থাকতাম যখন তখনকার কথা?’
পুতুল মলিন হাসে। সে তো কিচ্ছুটি ভোলেনি। তার সব কিছু মনে আছে। কিন্তু তারা কি সত্যিই আগের জায়গায় যেতে পারবে? তাদের সম্পর্ক আগের মত হবে? বুক চিরে নিঃশ্বাস বেড়িয়ে এলো। তার কিছু ভালো লাগছে না। মন চাচ্ছে ছুটে পালাতে। ইসস তিহান যদি একবার তার হাত গুলো বাড়াতো! পুতুল কিচ্ছু ভাবত না। দ্বিধাহীন চিত্তে তার হাত ধরে সেদিকে পা বাড়াতো। কিন্তু এটা সত্যি হবে না। এটা কেবল তার কল্পনাই থেকে যাবে। তিহান নামক যন্ত্রণা তাকে তিলে তিলে শেষ করে দিবে কিন্তু হায়! তার যে কিছুই করার থাকবে না।
____________
সূর্য উঠেছে। ঝলমল করছে চারদিক। তবে শীতের আমেজ কমেনি সামান্যতম। লেপ, কম্বল রোদে দেওয়া হয়েছে। জমিদার বাড়ি আজ কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। কোনো হইহুল্লোড় নেই। বাড়ির হেঁসেলেও কোনো রমণীর দেখা নেই। উনুন জ্বলেনি আজ এ বাড়িতে। শোক শোক ভাব ছেয়ে গেছে পুরো বাড়িতে। বাড়ির ছোট মেয়েটাও আজ শান্ত। কার্টুন দেখার জন্য তার আবদার নেই আজ। বাড়ির ড্রয়িংরুমে পারিবারিক মিটিং বসেছে। এই মিটিংকে কেন্দ্র করেই এতকিছু। জমিদার সাহেবকে দেখা গেলো সোফায় গম্ভীর হয়ে বসে থাকতে। তার অপরদিকে বসে তিহান। যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার বাবার দিকে তাকিয়ে। রাগে মুখ লাল হয়ে আছে। তার পাশেই রেণু ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে। বাব ছেলের লড়াইয়ের মাঝে সে আটকে আছে। কার হয়ে কথা বলবে সে?
‘এতবছর পর আপনার একজন বাবার দায়িত্বের কথা মনে পড়ল?’
‘আমি কখনোই আমার দায়িত্ব থেকে সরিনি। তোমাকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছি। এটা দায়িত্বর বাহিরে?’
তিহান হাতের মুষ্ঠি বন্ধ করে নিল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘টাকা দেওয়া পর্যন্ত আপনি একজন বাবার দায়িত্ব মনে করেন? টাকাই কি সব?’
‘টাকা না থাকলে গ্রামে নিজের এই অবস্থান তৈরি করতে পারতাম? যে গাড়ি নিয়ে পুরো দেশ চড়ছো সেই গাড়ি কোথা থেকে আসছে? আমার টাকা থেকে।’
খুব শান্ত ভাবে ছেলের কথার জবাব দিলো তারিম। তাকে মোটেও উত্তেজিত দেখালো না। ছেলের সীমা সে জানে। কতদূর যাবে?
‘এত বছর জীবনে আমার জীবনের কোনো ডিসিশন আপনি নেননি। ছোট বড় সব আমি নিজ থেকে নিয়েছি। আজ কেন আমার জীবন নিয়ে এত চিন্তা আপনার? আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এটা। এটাও কেবল আমি নিব। পারলে কিছু করে দেখান।’
তিহান হনহন করে হেঁটে উপরে চলে গেলো। রেণু এখনো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। বাকিরা যে যার রুমে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। তার যথেষ্ট কারণ আছে। তরিম তাদের এই আদেশ দিয়েছে। ছেলের বিয়াদপি অন্যদের সামনে সে তুলে ধরতে চায় না। এটা তার ইমেজের ব্যাপার।
চলবে…….