#প্রণয়_কাব্য
#লাবিবা_আল_তাসফি
১১.
নদীর কোল ঘেঁষে মেলা বসেছে। ছোট বড় অনেকগুলো দোকান। মানুষের ভিড় জমতে শুরু করেছে। পুতুল খুব আগ্রহ নিয়ে চারদিকে দেখছে। তার পাশেই নিরা মোবাইলে এসব কিছু ক্যামেরা বন্দি করতে ব্যস্ত। তিহান আর সুজন ঠিক তাদের পেছনে। বাকি দুজনের টিকিটাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অতি উৎসাহে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে কিনা কি জানি!
নাগর দোলা দেখতেই নিরা লাফিয়ে উঠলো। খুব করে আবদার করলো চড়ার জন্য। সুজন চারটা টিকিট এনেছে। নিরা ততক্ষনে নিজের পছন্দ মতো জায়গায় চেপে বসেছে। সুজন ও দেরি করলো না। কিন্তু সমস্যা হলো পুতুলকে নিয়ে। সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। সে কিছুতেই নাগরদোলায় উঠবে না।
‘কি সমস্যা?’
তিহান ভ্রুকুচু করে জানতে চাইল। পুতুল একবার তিহানকে দেখে নিয়ে ঝটপট জবাব দিলো,
‘আমি নাগর দোলায় উঠটে চাই না। বমি আসে আমার।’
তিহান আর প্রশ্ন করলো না। উল্টপথে পা বাড়িয়ে বলল,
‘ঠিক আমার পাশে পাশে থাকবি। নয়ত হারিয়ে গেলে ফেলে রেখে চলে যাব।’
পুতুল মুখ বাঁকাল। মিনমিন করে বললো,
‘আমি একাই বাড়ি যেতে পারি।’
তিহান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।
‘কিছু বললি?!’
পুতুল ঝটপট দুদিকে মাথা নাড়াল।
_____________
লাল রঙের একটা ব্যাগ বুকে চেপে তিহানের পাশাপাশি হাঁটছে পুতুল। মুখে তার চমৎকার হাসি। বারবার আড় চোখে তিহানকে দেখছে। আজ লোকটাকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে মনে হচ্ছে! বাকিরা জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। বর্তমানে তিহান আর পুতুল ফাঁকা রাস্তায় হাটছে পুতুলের বাড়ির উদ্দেশ্যে। রাত আনুমানিক নয়টা। গ্রামের জন্য এটা অনেক রাত। রাস্তা প্রায় নির্জন। এদিকটায় ল্যাম্প পোস্ট ও নেই। চারদিক নিরব। তাদের দুজনের মাঝেও বিরাজ করছে নিরবতা। পুতুলের এই নিরবতা ভালো লাগছে না। লোকটা কেন কিছু বলছে না? রাস্তা প্রায় শেষ হতে চলল যে!
‘আপনি শহরে ফিরবেন কবে?’
নিরবতা ভেঙে পুতুল কথা বলে উঠলো। তিহান মুচকি হাসলো। অন্ধকারে সেটা দেখা না গেলেও পুতুল অনুভব করতে পারল যেন।
‘কেন? আমি গেলে মিস করবি?’
এমন জবাবে অপ্রস্তুত হলো পুতুল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ছোট করে বলল,
‘এমনিই জানতে চাইছি। এমন…..’
‘আমার কথার উত্তর দে। মিস করবি?’
পুতুল চুপ করে রইলো। জবাব দেওয়ার মতো কিছু খুঁজে পেল না। তার খুব করে আফসোস হচ্ছে সেধে পরে কথা বলার জন্য। মনেমনে নিজেকে নিজে বকলো এমন গাধার মতো কাজ করার জন্য।
‘নিরবতা সম্মতির লক্ষণ জানিস তো!’
পুতুল চোখ বড় করে তাকালো। ঝটপট জবাব দিলো,
‘একদম না। সম্মতি নেই!’
তিহানের মুখভাব বোঝা গেলো না। তবে কিছুক্ষণ থেমে থেকে উত্তর দিলো,
‘বেশ তবে! আজ রাতেই ফিরছি ঢাকায়। এটাই হয়তো আমাদের শেষ দেখা।’
পুতুলের ছোট্ট মনটা আতকে উঠলো। কেঁপে উঠলো যেন তার পুরো পৃথিবী। চোখের কোণে জল জমে উঠলো। ঠায় দাঁড়িয়ে পড়লো রাস্তায়। তিহান যখন তার পাশ শূন্য অনুভব করলো ভয় পেয়ে গেল। মোবাইল টচ জ্বালাতেই সে কিছুটা দূরত্বে মাথা নিচু করে থাকা পুতুলকে দেখতে পেল। মেয়েটা কাঁদছে। কিন্তু কেন? তার কথা কি এই ছোট্ট প্রেয়সীর হৃদয়কে আঘাত করেছে? তিহান ঠোঁট কামড়ে হাসলো। ছোট ছোট পা ফেলে পুতুলের সামনে দাঁড়াল।
‘দাঁড়িয়ে কেন? আমাকে দ্রুত বাড়িতে যেতে হবে। নয়তো বাস মিস হবে।’
পুতুলের শরীর থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। তার কান্নার গতি বাড়লো। তিহান এক হাতে পুতুলের মুখটা উঁচু করে ধরলো। সুন্দর মুখখানি লাল হয়ে গেছে। চোখ দুটোও ফুলে উঠেছে। তিহান তৃপ্তি নিয়ে কান্নায় ভেজা মুখ খানা দেখলো। তার হৃদয়ে অদ্ভুত রকম প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে। এই চোখের জল যেন তার হৃদয়কে শিথিল করে দিচ্ছে। তিহান সুন্দর করে হাসলো। ফিসফিস করে বললো,
‘আমাকে কনভেন্স করার ট্রিক শিখিয়ে দিচ্ছি। ট্রাই করে দেখ। থেকেও যেতে পারি!’
ছলছল চোখে তিহানের চোখে তাকালো পুতুল। লোকটা হাসছে! পাষান লোক!
তিহান আবারো বললো,
‘ট্রিক শিখতে চাস?’
পুতুল উপর নিচ মাথা নাড়ল। তিহান হাসলো। তার হাসিতে দুষ্টামি লুকিয়ে আছে। সে পুতুলকে ছেড়ে দু পি পিছিয়ে দাঁড়ালো। একহাতে ফোন ধরা অন্যহাত পকেটে গুজে বেশ ভাব নিয়ে বললো,
‘আমি এখানেই আছি। সুন্দর করে সরি বলবি। এরপর এটাও বলবি আমাকে মিস করবি কি না। এন্ড লাস্টলি সেদিন ভয় পেয়ে যেভাব হাগ করেছিলি ওমন করে একটা হাগ। এগুলোই ইনাফ। কেঁদেছিস তাই কিছুটা টাস্ক কমিয়ে দিয়েছি। টাইম ফাইভ মিনিট। আমাকে আবার বাস ধরতে হবেতো যদি ফেইল করিস!’
পুতুলের কান্না থেমেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। আপাতত সে তিহানকে মনেমনে গালি দিয়ে ভরিয়ে ফেলছে। অসভ্য লোক। সুযোগ পেয়ে তার মজা উড়াচ্ছে! এর শোধ সেও একদিন নিবে। অবশ্যই নিবে!
_____________
ঘড়ির কাঁটায় রাত একটা বাজে। পুতুলের ছোট রুমটায় এখনো টিমটিম করে বাতি জ্বলছে। জানালা খোলা। শিরশির করে বাতাস কক্ষে প্রবেশ করছে। শীতকালে এভাবে জানালা খুলে বসে থাকা কোনো সুস্থ মানুষের কাজ নয়। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। পুতুলের মনে হলো সে সুস্থ নয়। সে একজন উম্মাদ কিশোরী। আচ্ছা তার মা যদি জাতে পারে তার মেয়ে পাগল উম্মাদ হয়ে গেছে তখন কি হবে? কবিরাজ ডাকবে? তাই-ই করবে। তার মা তো ঐ মন্টু কবিরাজের খুব বড় ভক্ত। জ্বর হলেও কবিরাজের কাছ থেকে কিসব গাছপালা নিয়ে আসে। পুতুলের ওসব গাছ পালার রস খেতে ভালো লাগে না। পাগল হয়ে গেলে এ ব্যাপারটা মায়ের থেকে গোপন করতে হবে। কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না যে সে পাগল হয়েছে!
পুতুলের হাতে থাকা কাঁচের চুড়ি গুলোতে টুং টাং শব্দ হচ্ছে। পুতুল আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করলো চুড়ি গুলো। আজ তিহান তাকে এগুলো কিনে দিয়েছে। ছয় রঙের চুড়ি। প্রত্যেকটা রঙ-ই পুতুলের পছন্দ। এই যে সে এখন লাল রঙের চুড়ি হাতে পড়ে বসে আছে। কেউ দেখছে না। তবুও তার ভালো লাগছে। আয়নায় বারবার হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। কখনো বা লজ্জায় মিহিয়ে যাচ্ছে। ফর্সা মুখ খানা ইতিমধ্যে লাল হয়ে উঠেছে। এ কেমন অনুভূতি!
তারিম আজ বাড়িতে। বহুদিন বাদে পুরো পরিবার একত্রে নাস্তা করতে বসেছে। খাবার টেবিলে নিরবতা বিরাজ করছে। খাওয়ার ফাঁকে সে একবার নিরাকে দেখে নিলো। রেণু রাতে তাকে মেয়েটার কথা বলেছে। বেস ভদ্র ও রূপবতী মেয়েটা। তিহান চুপচাপ মাথা নিচু করে পরোটা চিবুচ্ছে। বাবার সাথে তার সম্পর্কটা অনেক দূরত্বের। ব্যাবসা রাজনীতি এসব কারণে তারিম বরাবরই ব্যস্ত ছিলেন। পরিবার সন্তানকে সময় দেওয়ার মতো সুযোগ সময় কোনোটাই তার ছিল না। একটু বড় হওয়ার পর তিহান শহরে থেকে পড়াশোনা শুরু করে। দূরত্বটা আরো বেড়ে যায়।
‘খাবার শেষ করে রুমে আসো। কথা আছে।’
তিহানকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলেই উঠে গেলেন তারিম। তিহানের বন্ধুরা ফেলফেল করে তাকিয়ে রইল। এত কোল্ড পার্সনালিটাটা বুঝি তিহান তার বাবার কাছ থেকেই পেয়েছে!
সোফায় গা এলিয়ে বসে পেপার পড়ার বৃথা চেষ্টা করছে তারিম। তার নজর দরজার দিকে। সেই কখন ছেলেকে বলেছে আসতে কিন্তু এখনো এলো না। ধুপধাপ পা ফেলে তখনই দরজার সামনে এসে দাঁড়াল তিহান। তাকে দেখতেই পেপারে নজর দিল সে। হাত দিয়ে দরজায় টোকা দিতেই তারিম গম্ভীর গলায় বললো,
‘দাড়িয়ে না থেকে ভেতরে এসো।’
তারিমের মুখ বরাবর সোজা হয়ে বসলো তিহান। কিছুটা ব্যঙ্গ করে বললো,
‘কিছু পড়ছেন বাবা?’
‘হুম। একটি নিউজ পড়ছিলাম। কিন্তু কিভাবে যে লিখেছে! বোঝা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সাংবাদিকদের জন্য ই নিউজ পড়া বন্ধ করেছে জনগণ। যদি লেখা পড়াই না যায় তবে জনগন কেন পেপার টাকা দিয়ে কিনবে?’
তিহান মাথা নাড়ল। কথায় যুক্তি আছে।
‘তবে আমার মনে হয় জনগনের সব অ্যাঙ্গেল থেকে পড়ার চেষ্টা করে দেখা। তাহলে হয়তো তারা সাংবাদিকদের লেখার আসল অর্থ খুঁজে পাবে।’
তারিম কপাল কুঁচকে তাকালো। তিহানের ঠোঁটে মুচকি হাসি। তারিমের মনে হলো কিছু খারাপ হচ্ছে। ছেলের কাছে সে সম্মান হারাতে বসেছে। ভালোভাবে নজর দিতেই বুঝলো শুরু থেকেই সে পেপার উল্ট ভাবে ধরে আছে। এজন্যই তো সব কেমন এলোমেলো লাগছিল! খুব কৌশলে সে পেপারটা সোজা করে নিল। যাই হোক সে আর লজ্জায় পড়তে চায় না।
‘তিহান!’
‘জ্বি বলুন।’
তারিম সোজা হয়ে বসলো। চোখ থেকে চশমা খুলে সাইড টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,
‘আমার প্রতি তোমার অভিযোগের পরিমাণটা ঠিক কত?’
‘অভিযোগ করার মতো সম্পর্ক আমাদের নেই। কখনো ছিল না।’
তারিম মাথা নাড়ল। ছেলে তার মিথ্যা কিছু বলেনি। তাদের সম্পর্ক আদেও কখনো আর পাঁচটা বাবা ছেলের মতো ছিল কখনো? বুক চিরে হতাশার নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো।
চলবে……
(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখবেন।)