#প্রণয়_কাব্য
#লাবিবা_আল_তাসফি
১০.
কথায় আছে ভেজা চুলে নারীকে সবথেকে বেশি মোহনীয় লাগে। কথাটা একচুল ও মিথ্যা নয়। এই যে তিহানের সামনে মোহনীয় এক কিশোরী মেয়ে দাড়িয়ে। হালকা গোলাপি রঙের স্যালোয়ার সেট পরনে তার। কোন সাজ নেই। তবুও যেন রূপের কমতি নেই। কত সহজেই সামান্য গ্রামের একটা কিশোরী মেয়ে এমন তরতাজা যুবককে কাবু করে নিচ্ছে। তিহান ঢোক গিলল। সে ক্রমশ কন্ট্রোল হারাচ্ছে। পা জোড়া যেন দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছে না।
‘পানি খাবেন?’
পুতুলের কথায় নড়ে দাঁড়ালো তিহান। অপ্রস্তুত হয়ে মাথা নাড়ল।
‘হুম।’
‘আনছি দাঁড়ান।’
পুতুল এক ছুটে ঘরের ভেতর চলে গেল। তার বুক অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। ঘনঘন শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করতে চাইল। কিন্তু অবাধ্য হৃৎপিণ্ডটা শান্ত হলো না। ক্রমশ ছুটতে থাকলো দ্রুত গতিতে। তার মোনটা বড্ড অবাধ্য হয়েছে। সাথে কিছুটা অভদ্র ও। কিসব এলোমেলো চিন্তা করে। তিহানের সামনে গেলে যেন অবাধ্যতা বেড়ে যায়। না চাইতেও চোখ জোড়া বারবার তিহানের দিকে ফিরে চায়। এমন কেন হবে? এ তো অন্যায়। মস্ত বড় অন্যায়।
পুতুল ঘরের ভেতরে গিয়েছে গুণে গুণে দশ মিনিট পার হয়েছে। তিহান অধৈর্য হয়ে উঠেছে। পকেটে হাত দিতেই বুঝল ফোনটা সাথে আনা হয়নি। হয়তো রুমেই রেখে এসেছে। হাত উল্টে আরো একবার সময় দেখে নিল। মেয়েটাকি লজ্জা পেয়ে পালিয়েছে?
পুতুল বেডে উপুড় হয়ে মুখ বালিশে চেপে শুয়ে আছে। সে কিছুতেই কিছুক্ষণ আগের ঘটনা ভুলতে পারছে না। বাহিরে তিহান দাঁড়িয়ে আছে সেকথা বেমালুম ভুলে বসেছে সে। দরজাটা টোকার শব্দ পেয়ে চট করে উঠে বসতেই দেখলো তিহান দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। একমনে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পুতুল জিভ কাটলো। নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে বলে রেগে গেছে লোকটা। পাশে থাকা বালিশটা শক্ত করে চেপে ধরে বসে রইল।
‘পানি কি অনলাইনে অর্ডার করেছিস? ডেলিভারি আসতে কত টাইম লাগবে আর?’
পুতুল চট করে তাকালো। ইসস সে তো ভুলেই বসেছে।
‘আপনি বসেন এক্ষুনি আনছি।’
তিহান ওকে থামিয়ে দিল।
‘দরকার নেই। পানি খেয়ে পেট ফুলে উঠেছে। আর খেলে হয়তো মরেই যাবো। ঝটপট রেডি হয়ে নে। টাইম অনলি ফাইভ মিনিট। হারি আপ!’
‘কোথায় যাবো?’
‘বিয়ে করতে।’
পুতুল নাক ফুলাল। কপাট রাগ দেখিয়ে বলল,
‘আমি সাক্ষী হতে পারব না।’
‘কে বলেছে সাক্ষী হতে?’
পুতুল আড় চোখে তাকালো। তিহান বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে। মিটিমিটি হাসছে। লোকটা তার মজা নিচ্ছে।
‘আপনি একটা খারাপ মানুষ।’
‘ধন্যবাদ।’
তিহান ঘুরে দাঁড়ালো। যেতে যেতে বলল,
‘ফাইভ মিনিট অনলি।’
পুতুল ভাবনায় পড়লো। মা যে বাড়িতে নেই! এভাবে তো বের হওয়া যাবে না। মা জানলে খুব মারবে। যাওয়ার সময় বারবার করে না করে গেছে বাহিরে যেতে। পুতুল ধীর পায়ে এগিয়ে গেল উঠানের দিকে। তিহান কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে এভাবে অপেক্ষা করতে সে ভিষণ রকম বিরক্ত হচ্ছে।
‘শোনেন।’
পুতুলের কন্ঠে পেছন ফিরে দাঁড়াতেই তিহান রাগে চোখ বন্ধ করে নিলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘তুই রেডি না হয়ে এখানে কি করছিস? আর কোনো নাটক বাকি আছে?’
পুতুল জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে বলল,
‘না মানে মা বাহিরে বের হতে মানা করেছে। এখন তো অনেক দুপুর। এই সময় মেয়েদের বাহিরে বের হতে হয়না।’
‘কেন?’
‘মা বলেছে জ্বীনে আচর করে তাহলে।’
তিহানের মাথা ধপ করে জ্বলে উঠলো। বিরবির করে বলল বুদ্ধিহীন মেয়ে একটা।
‘আজ জ্বীন না আমি তোকে আচর করবো যদি আগামী দুই মিনিটে তোকে রেডি না দেখি তো!’
পুতুল আর দাঁড়াল না। রেডি হতে রুমের দিকে ছুটলো। আপাতত এই খারাপ লোকটার রাগের শিকার থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিক। মা কে নাহয় পড়ে বুঝাবে। দু একটা মার ও হজম করে নিবে না হয়!
______________
তিহানদের বাড়িতে যে পুতুল আগে কখনো আসেনি এমন না। কিন্তু আজ কেন যেন খুব অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার। বারবার য়াথার ওড়না টেনে ঠিক করে নিচ্ছে। তিহান অবশ্য আড় চোখে সবটাই খেয়াল করছে। পুতুলের ঘনঘন পলক ঝাপটানো, জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজানো, ব্যস্ত চোখে আশপাশে তাকানো সবকিছু খুব সূক্ষ্ম ভাবে খেয়াল করেছে সে।
‘আরে পিচ্চি পড়িটা এসে গেছে যে!’
নিরা দৌড়ে এসে পুতুলকে একপাশে জড়িয়ে ধরলো। পুতুল একটু ভরকে গেল। নিরাকে সে চেনে না। তিহান সোফায় পা তুলে বসে ফোন টিপছে। নিরার কথায় মুচকি হেসে বলল,
‘এমন করে বললে তো আগামী দশ বছরেও আমার বিয়ে করা হবে না। একটু বড় হতে দে!’
তিহানের কথায় বাকিরা হেসে ফেললো। পিয়াস ওর চশমা ঠিক করতে করতে পুতুলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘এই যে পিচ্চি ভাবী! বয়স কত?’
পুতুল বোকা চোখে তাকালো। তিহান এক পলক পুতুলের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। ভাব এমন যে সে কিছুই যানে না। এদিকে পুতুল বুঝতে পারছে না হঠাৎ করে এরা কেন তাকে ভাবী ডাকছে! সুজনের দিকে তাকাতেই সে মেকি হাসলো। বাদবাকি তিনজন তার উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে আছে। পুতুল অস্বস্তি বোধ করলো। আস্তে করে বললো,
‘ষোল!’
এতক্ষণের নিরব পরিবেশ যেন প্রাণ পেল। আসিফ গুণ গুণিয়ে গান ধরলো,
‘তুমি রোদ পোহাবার ছুতোয়
ছাদে আসতে নিয়ে গভীর বাসনা….
আর ওভাবেই জমলো মেলা
আমার বয়স ষোলতে প্রেম প্রেম খেলা…..’
____________
পুতুল তার মায়ের পাশে চুপটি করে বসে আছে। শিউলি তেলের পিঠা ভাজছে। পাশেই রেণু পুলি পিঠার জন্য পূর তৈরি করছে। তিহানের চাচি তানিয়া টুলে বসে পিঠা বানানো দেখছে। সে শহরের মেয়ে। এসব কাজ পারে না। অবশ্য সে কোনো কাজ ই পারেনা। ঘুম আর সিরিয়াল দেখেই দিন কাটে তার। ছোট মেয়েটার খেয়াল রাখার সময় ও তার নেই।
‘এই পুতুল তুমি মুখে কী মাখো বলো তো! একদম ফ্রেস তোমার মুখ।’
তানিয়ার কথায় শিউলি খুব বিরক্ত হলো। বলতে ইচ্ছা হলো যে আমার মেয়ে তোমার মতো আটা ময়দা মাখে না। কিন্তু মুখে কিছুই বলল না। রেণু মুচকি হেসে বলল,
‘হ্যা রে পুতুল চাচিকে একটু বলে দেনা কি মাখিস তুই!’
পুতুল হাসি মুখে বলল,
‘প্রতিদিন সকালে কাঁচা হলুদ আর কল পাড় থেকে নরম মাটি একসাথে মাখিয়ে দশ মিনিট করে মুখে লাগিয়ে রাখি। আর রাতে……’
বাকিটা বলার আগে শিউলি পুতুলকে চোখ গরম দিল। মেয়েটা খুব ফাজিল হয়েছে। বড়দের সাথে মজা করছে। তানিয়া বুঝতে পারলে কি হবে? চেঁচিয়ে পুরো গ্রামের মানুষ এক করবে।
‘আরে থামলে কেন বলো!’
‘আপাতত এই একটা ট্রাই করেন। অন্যদিন রাতেরটা শিখিয়ে দিবনি।’
রেণু মুখ টিপে হাসলো। কেবল শিউলি ক্ষণে ক্ষণে চোখ রাঙিয়ে তাকাচ্ছে।
বছরের শেষের দিকে গ্রামে বেশ বড় করে মেলা বসে। বিভিন্ন রকমের জিনিস ওঠে মেলায়। ঐই দিনটার জন্য গ্রামের সকল ছেলে মেয়েরা আগ্রহ নিয়ে বশে থাকে। রাত দশটা অবদি মেলা থাকে। পুতুল কখনো রাত করে মেলা দেখতে পারেনি। প্রতিবার তাকে সন্ধ্যা গড়াবার আগে বাড়ি ফিরতে হয়। পারুল বলেছে সন্ধ্যার পর মেলা বেশি জমজমাট হয়। চারদিক বাহারি রঙের আলোতে ঝলমল করে ওঠে। ছোট মরিচ বাতি গুলোকে লাল নীল রঙের জোনাকির মতো মনে হয়। পারুল তার বাবার সাথে যায়। পুতুলের মন খারাপ হয়। তার বাবা থাকলে হয়তো তাকেও নিয়ে যেত!
চলবে…..