#প্রণয়_কাব্য
#লাবিবা_আল_তাসফি
৯.
বছরের প্রায় শেষ ঘনিয়ে এসেছে। পচন্ড শীত পড়েছে গ্রামে। একদম গা কাঁপানো শীত। স্কুল বন্ধ। বাড়িতে শুয়ে বসেই দিন কাটছে। সেদিনের পর পাঁচদিন কেটে গেছে। তিহানের সাথে আর কোনো দেখা সাক্ষাত হয়নি পুতুলের। লৌকটা বিয়েটিয়ে করে ফেলেছে কিনা কি জানি? পুতুলের খুব উদাস লাগে। কেমন ছন্নছাড়া মনে হয় নিজেকে। এমন কেন লাগে? এটা কি কোনো রোগ? আর ভাবতে পারে না সে। তিহান বিয়ে করেছে ভাবতেই তার কষ্ট কষ্ট লাগে। খুব দুঃখ হয়। পুতুলের চোখে পানি আসে। বা হাতের পিঠে চোখের জল মুছে ফেলে। পরক্ষণেই একরাশ জলে টলমল করে ওঠে চোখ দুটো।
শিউলি হঠাৎ করেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সকাল সকাল নাড়কেল দিয়ে নাড়ু বানাতে বসেছে। পুতুল ঘুম ঘুম চোখে এসে রান্নাঘরের দরজায় দাড়ালো। বাহিরে এখনো অন্ধকার। কুয়াশায় ঢেকে আছে সব। গায়ে কম্বল পেঁচিয়েও যেন শান্তি নেই। ঠকঠক করে কাঁপছে পুতুল। শিউলি ওকে এভাবে কম্বল পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধমক দিলেন। হাতে অনেক কাজ। একা হাতে সব করা সম্ভব না। মেয়েটা একটু হাত লাগালে তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। পুতুল তখনো দাঁড়িয়ে ঢুলছে।
‘শিগ্গির যা মা। কতেক পিঠাও বানানো লাগব তো। পপি কল দিছিল। ওর নাকি নারকেলের নাড়ু আর পাকখান খাইতে মন চায়। একটু হাত লাগা মা। সূর্য উঠতে দেরি নাই।’
পপির কথা শুনে পুতুলের ঘুম উড়ে গেল। আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
‘আপা কখন কল দিছে মা?’
‘এইতো কালকে রাইতে।’
‘আমার কথা কিছু জিজ্ঞাসা করেনি?’
‘তোর কথা কি জিগাইব?’
পুতুল মন খারাপ করে ফেলল। একসময় এই আপা তাকে ছাড়া এক দন্ড থাকতে পাড়ত না। রোজ কল করে কথা বলতো। দুলাভাই কল দিতে না দিলে লুকাই কল করত। আর এখন? এতটা মাস পার হয়ে যাওয়ার পর ও খোঁজ নেই কোনো। মানুষ এভাবেই সময়ের সাথে পাল্টে যায়? কোই সে তো পাল্টায়নি! তার তো এখনো আপাকে মনে পড়ে। আপার বলা রাজকুমারের গল্প মনে পড়ে।
‘দাড়ায়ে আছিস কেন? কথা কানে যায় না?’
শিউলির চিৎকারে ধ্যান ভাঙে ওর। অলস পায়ে এগিয়ে যায় কলপাড়ে। বাহিরে স্বল্প আলো ফুটেছে। তবে কুয়াশা এখনো কাটেনি। ঠান্ডা পানিতে হাত ছোঁয়াতেই যেন কারেন্ট লাগলো। পানি না যেন বরফ!
______________
পপির শশুর বাড়িটা খুব বেশি গ্রামের মধ্যে না। অনেকটা শহরের উপর। বিশাল বাড়ির চারপাশে বড়বড় নারকেল গাছ। বাড়িটাও বেশ বড়। যৌথ পরিবার বলে কথা! পপি ছাড়াও বাড়িতে আরো পাঁচজন বউ রয়েছে। এখনো বাড়ির একজন ছেলে অবিবাহিত রয়েছে। নাম সাগর। সম্পর্কে পপির চাচাতো দেবর। রাজশাহীতে থেকে পড়াশোনা করছে। পরিবারের বাকি সদস্যদের থেকে সে আলাদা। বুঝদার এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। পুতুলের সাথে কখনো দেখা হয়নি অবশ্য।
পুতুল সাদা আর আসমানী রঙের লম্বা ফ্রক পড়েছে। সাথে সাদা চুড়িদার। গায়ে পশমের সাদা শীত পোশাক। ওড়নাটা সুন্দর ভাবে মাথায় পেঁচানো। এই শীতপোশাকটা বড়-মা কিনে দিয়েছিল গতবার। পুতুল খুব যত্নে তুলে রেখেছিল। সাথে একটা টিফিন ব্যাগ। এর মধ্যে পিঠা আর নাড়ু আছে। আর কাঁধে ঝোলানো ছোট্ট একটা ব্যাগ। আজকের যাত্রা পুতুলের একার। যদিও তার মন টানছে না কিছুতেই। কিন্তু শিউলি কিছুতেই যেতে পারবে না। জমিদার বাড়ি থেকে ডাক এসেছে। তিহানের বন্ধুরা আসায় জমজমাট ভোজন হবে। রান্নায় সাহায্য করতে হবে বড়-মা এর। বাধ্য হয়েই পুতুলকে যেতে হচ্ছে।
পপির চেহারা কেমন সুন্দর হয়ে গেছে। গাল হাত পা গুলো ফুলে ঢোল হয়েছে। কি মিষ্টি লাগছে দেখতে! পুতুল তো নজর ফেরাতে পারছে না। তার উপর যখন থেকে শুনেছে সে খালামনি হতে চলেছে তার আনন্দের যেন শেষ নেই। সে ভাবতে বসেছে বাবুর নাম কি হবে। দুলাভাই বাড়িতে নেই। এক দিয়ে পুতুলের জন্য ভালোই হলো। সে আরামচে বাড়িতে ঘুরতে পারবে।
একতলা ভবনটিতে বারোটা শোবার ঘর। পুতুল এক এক করে গুনে দেখেছে। যদিও শোবার ঘর গুলোর দৈর্ঘ্য খুব বেশি না। অনেকটাই ছোট। এর তুলনায় পুতুলের ছোট্ট রুমটা বেশ ভালো। পুতুল দেখলো প্রতিটা রুমের দরজা দুই কপাটের হলেও একটা রুমের দরজা বেশ আধুনিক ধাচের। ব্যতিক্রমতা তার মনে কৌতুহল জাগালো। কিছু না ভেবে উকি দিতে গেলেই পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,
‘আমার রুমে কেউ উঁকি দিক এটা আমার পছন্দ না।’
পুতুল ভরকে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। তার সামনে চশমা পড়িহিত সুঠম দেহের এক পুরুষ দাঁড়িয়ে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে পুতুলের কাজে সে ভিষণ বিরক্ত।
‘দুঃখীত।’
পুতুল চলে যেতে নিলেই সে বলে উঠলো।
‘আপনাকে ঠিক চিনলাম না!’
‘আমিও আপনাকে চিনি না।’
‘বেশ। আমি সাগর। এ বাড়ির ছোট ছেলে।’
‘ওহ।’
‘আপনার পরিচয়?’
‘আমি মধুপুর গ্রামের একমাত্র রাজকুমারী। এতটুকু যথেষ্ট!’
পুতুল বেশ ভাব নিয়ে ওখান থেকে চলে আসলো। অপমান করে কিনা পরিচয় জানতে চাইছে। শখ কত!
_____________
পুতুল সেদিন বিকেলেই ফিরেছে। ও বাড়িতে তার দম বন্ধ লাগে। পপি অনেক করে থাকতে বলেছিল। কিন্তু পুতুল তাতে রাজি হয়নি।
নিরা বেশ পরিপাটি মিষ্টি একটা মেয়ে। অল্পতেই রেণুর সাথে তার বেশ ভাব জমেছে। এই যে সকাল থেকে হাতে হাতে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। রেণুর মন একদম ভরে উঠেছে। এই মেয়েটা তার ছেলের জন্য একদম ঠিকঠাক। তার শাশুড়ি সালেহা বেগম নাতির বিয়ে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তাকে একবার দেখাতে হবে। এমন মিষ্টি মেয়ে দেখলে সে নিশ্চই অমত করবেন না।
তিহান বেশ কিছুক্ষণ ভেবে অবশেষে রেণুর রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
‘মা আসব?’
রেণু বসেই ছিল। ছেলের কথায় হেসে তাকে ভেতরে ডাকল।
‘একটা কথা বলতাম।’
‘ওমা! এত ফর্মালিটি আবার কবে থেকে শিখেছি?’
‘না মানে বলছিলাম যে শিউলি আন্টিদের সবাইকে আজ এখানে এসে খেতে বলো না! এই এত কষ্ট করে যেয়ে আবার কখন রান্না করবে বলো!’
‘হ্যা সে কথা আমার মাথাতেও আছে। খাবার দিয়ে দিবানি।’
‘না না তা কেন? এখানে বসেই সবার সাথে খাবে!’
রেণু কপাল কুঁচকে তাকালো। বলল,
‘পুতুল এখানে আসতে চায়না।’
‘কেন?’
‘সেকথা আমি কিভাবে জানব?’
‘তুমি ওদের এখানে আসতে বল বাকিটা আমি দেখব।’
কথা শেষ করে তিহান বেরিয়ে যেতে নিল। কিন্তু রেণু তাকে থামিয়ে দিল।
‘নিরা মেয়েটা কেমন?’
‘ভালো।’
‘আচ্ছা।’
‘কেন?’
‘এমনি।’
তিহান অত ভাবলো না। সে বড় বড় পায়ে বেরিয়ে পড়লো।
_____________
পুতুল মাত্রই গোসল করে বেরিয়েছে। কমর পর্যন্ত চুলগুলো থেকে টুপটাপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। উঠানে টুল পেতে রোদে বসে আছে সে। সূর্যের আলোটা সোজা এসে মুখে পড়েছে। চোখ বন্ধ করে সূর্যের উত্তাপ অনুভব করছে সে। তিহান কখন এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে তা সে উপলব্ধি করতে পারেনি।
পুতুলের এমন রূপ এর আগে কখনো তিহান দেখেনি। এতো এক জলকন্যা। যার চোখে মুখে বিন্দু বিন্দু জল মুক্তার মত আলো ছড়াচ্ছে। তিহানের কি যেন হলো। সে আলতো হাতে ছুঁয়ে দিল পুতুলের গোলাপের মতো ঠোঁট জোড়া। অকল্পিত স্পর্শে চমকে উঠলো পুতুল। চোখ মেলে তাকাতেই তার শরীর জমে গেলে অজানা কোনো অনুভূতিতে। তার সামনে দাঁড়িয়ে তার কল্প পুরুষ। সে তাকে ছুঁয়েছে! নাকি এটাও কোনো কল্পনার অংশ!
চলবে………