#প্রণয়_কাব্য
#লাবিবা_আল_তাসফি
৮.
থেকে থেকে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। টিনের চালের উপর বৃষ্টির ফোটারা ছন্দ তুলেছে। জানালা থেকে মৃদুমন্দ বাতাস শিরশির করে প্রবেশ করছে। গায়ে কম্বল জড়িয়ে পুতুল জানালার সামনে বসে আছে। আজ ঘুমটা খুব সকালেই ভেঙেছে তার। সেই তখন থেকেই সে এভাবে বসে আছে। ঠান্ডায় দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। পুতুল ওর টেবিলের ড্রয়ার থেকে গোপন ডায়েরিটা বের করলো। এখানে ওর না বলা সকল কথা সুন্দর করে লিপিবদ্ধ করা আছে। ওর সকল প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি গুলো ফুটে উঠেছে ছোট এই ডায়েরিটায়।
বৃষ্টি থেমে গেছে বেশ কিছুক্ষণ। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি মাথায় তিহান ফিরেছে। ভিজে চুপচুপে অবস্থা। তিহানৎএবার একা নয় সেমিস্টার ব্রেকে তার কিছু বন্ধুরাও এসেছে। সবার অবস্থা এখন কাপিকাপি! তিহানের মা ব্যস্ত হয়ে সবার জন্য রুম ঠিক করে দিল। ওরা মোট তিনজন এসেছে। তার মধ্যে নিরা নামের একটি মিষ্টি মেয়েও আছে। বাকি দুজনের জন্য একটা রুম দিলেও নিরার জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা করা হলো। রেণুর নিরাকে বেশ পছন্দ হয়েছে। এমন মিষ্টি একটা মেয়ে যদি তার ছেলের বউ হয় তবে খারাপ হয় না!
পুতুলের পরীক্ষা আজ শেষ। কেমন রিল্যাক্স ফিল হচ্ছে। পরীক্ষার হল থেকে খুব উজ্জ্বল মুখ নিয়ে বের হতেই পারুলের সাথে দেখা। মুখ গোমরা করে পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। নিশ্চয়ই পরীক্ষা ভালো হয় নি।
‘আরেএএএ পারু! পরীক্ষা শেষ এখন অত ভাবলে মজা করবো কখন? চল আজ নদীর পাড়ে যাব।’
পারুল অসহায় চোখে তাকালো। মন খারাপ নিয়ে বলল,
‘এবার হয়তো বিয়েটা করতেই হবেরে পুতুল। ওমন ভুরি ওয়ালা লোক জামাই হবে ভাবতেই কলিজা ফেটে যাচ্ছেরে।’
পারুলের কথায় পুতুল খিলখিল করে হেসে ফেলল। নিশ্চয়ই পারুলের মা ওকে ভয় দেখিয়েছে! পুতুল হেসে বলল,
‘খারাপ হয়না কিন্তু পারুল। তোর বাচ্চা গুলোও গুলুগুলু হবে দেখিস!’
বলেই হাসিতে ফেটে পরলো পুতুল। অন্যদিকে পারুল ভাবনায় পরে গেল। তার কপালেকি ভুরি ওয়ালা ঐ মাছুদই আছে শেষ পর্যন্ত! দরকার হলে কচু গাছে গলায় ফাঁস পরবে সে তবুও বিয়ে করবে না সে। একদম না।
_____________
তিহান আজ অনেকদিন বাদে তার ছোট্ট পরিটাকে সামনে থেকে দেখছে। কি সুন্দর খিলখিল করে হাসছে মেয়েটা। নিশ্চয়ই তার কথা এতদিনে ভুলে বসেছে! পুতুলের হাসি তার ভিষন পছন্দের হলেও আজ ভালো লাগলো না। সে তো পুতুলের চোখে মুখে বেদনার ছাপ দেখতে চেয়েছিল। চেয়েছিল মেয়েটা যেন তিহানের অনুপস্থিতিতে আহত হয়। বুঝতে পারে তিহানের প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু সে কি দেখছে? মেয়েটা দিব্যি হেসে খেলে বেরাচ্ছে।
‘এটাই কি তোর পিচ্চি প্রেমিকা তিহান?’
খুব উৎসাহ নিয়ে নিরা তিহানের দিকে তাকালো। তিহানের মুখ গম্ভীর। কেবল মাথা নাড়ল। আসিফ নিরার কথা শুনে পুতুলকে দেখলো। ক্যামেরা তার হাতে থাকায় ঝটপট দু চারটা ছবি তুলে নিল। বন্ধুমহলে জানাতে হবে তো!
‘এই ছবিগুলো তিহানের ফ্যানক্লাবে আপলোড করা হবে। ক্যাপসন হবে আমাদের অন এন্ড অনলি তিহান এই স্কুল পড়ুয়া কিশোরীর প্রেমে ঘোল খাচ্ছে।’
আসিফের কথায় সবাই হেসে ফেলল তিহান বাদে। সে বাকিদের উদ্দেশ্য করে বলল,
‘তোরা রিকশা কিংবা ভ্যান নিয়ে নদীর পাড়ে আসতে থাক।’
রোদচশমাটা চোখে পরে গাড়ির ডোর খুলে ভিতরে ঢুকেই ডোর লক করে দিল সে। বাকিরা কিছু বলার সুযোগ পেল না। সুজন বাকিদের তার সাথে নিল। একটা ভ্যানেই হয়ে গেছে। নিরা খুব আগ্রহ নিয়ে ভ্যানের পেছনে বসেছে। গ্রামটা তার ভালো লাগছে। গ্রাম এত সুন্দর জানলে সে অনেক আগেই চলে আসত।
পুতুল আজ দুপাশে বেণী বেঁধেছে। ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক ও দিয়েছে। তার সাজতে ইচ্ছা হচ্ছিল বলেই এই সামান্য সাজ। নদী স্কুল থেকে কিছুটা দূরে। হেঁটেই যাওয়া যায়। ওরা হেঁটে হেঁটেই যাবে। বাজারের পাশ থেকে নেমে গেছে নদী পথের মাটির প্রসস্থ রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে খেজুর গাছ। বেশ কিছু গাছে মাটির ঠিলা ঝুলানো হয়েছে। কয়েকটা গাছে আবার বোতল কেটে লাগানো হয়েছে। রস জমা হচ্ছে তাতে। প্রতিদিন ভোরে এই ঠিলা নামানো হয়। রাস্তার পাশেই রয়েছে ফসলের জমি। জমি ভরা সোনালী ফসল। বেশ সুন্দর পরিবেশ। এখন দুপুর বারোটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। কিন্তু আকাশের বুকে সূর্যের তাপ নেই। তবে দিনটা বেশ উজ্জ্বল। পুতুলের হাতে বাদামের প্যাকেট। বাদাম ছিলে ছিলে গালে দিচ্ছে। পাশে পারুল তার বিরহের গল্প শোনাচ্ছে। তখনি তাদের পাশে তিহানের গাড়ি এসে থামে। প্রথমে থমকে দাঁড়ালেও পরক্ষণে ওরা নিজেদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
‘এক পা সামনে আগালে পা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিব।’
ব্যাস! সাহস সব হাওয়া হয়ে গেল। দুজনই চুপচাপ নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকল। তিহান গাড়ি টেনে আবার ওদের পাশে থামলো। পারুলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘সুজন ভ্যানে করে আসছে। এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা কর। ওরা আসলে ওরা তোমাকে ভ্যানে তুলে নিবে। এই গাধাটাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। কোনো সমস্যা?’
পারুল দ্রুত গতিতে ডানে বামে মাথা নাড়ল। তার কোনো সমস্যা নেই। তার বলতে ইচ্ছা হলো,’আপনি ওকে নিয়ে চান্দে চলে যান তো ভাই! আমাকে একটু রেহাই দেন!’
‘উঠে আয়।’
তিহানের কথায় পুতুল ডানে বায়ে মাথা নাড়ল। সে যেতে চায় না তিহানের সাথে। তিহান দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইল। মেয়েটা বড্ড বেশি অবাধ্য।
‘তুই আসবি নাকি আমি নামব?’
এতেই কাজ হলো। চুপচাপ লক্ষি মেয়ের মতো উঠে বসলো গাড়িতে। পারুল যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
গাড়ি চলছে খুব স্লো ভাবে। পুতুল বারবার আড় চোখে তিহানকে দেখছে। সেই তখন থেকে তিহান চুপ করে আছে। এটা খারাপের লক্ষণ। পুতুল আর চুপ করে থাকতে পারলো না। একটু কেশে প্রশ্ন করল,
‘কোথায় যাচ্ছি? ঘাট তো রেখে আসলাম।’
‘পালিয়ে যাচ্ছি। সামনেই কাজী অফিস। বিয়ে করে সংসার শুরু করব।’
পুতুল চোখ বড় করে তাকিয়ে রইল। তিহান মজা করছে বলে মনে হচ্ছে না। তার মুখ একদম সিরিয়াস। পুতুলের বুক ডিপডিপ করছে। তারা কি সত্যিই বিয়ে করতে যাচ্ছে? কিন্তু সে তো এখন বিয়ে করতে চায় না।
‘আমি বিয়ে করবো না!’
কান্না মাখা গলায় কথাটা বলতেই তিহান কপাল কুঁচকে তাকালো। পুতুলের চোখ দুটো পানিতে টলটল করছে। তিহান ড্রাইভে নজর দিল। অবাক হয়ে বলল,
‘কখন বললাম তোকে বিয়ে করবো?’
‘এখনই তো বললেন।’
‘বলেছি আমি পালিয়ে যাচ্ছি। বিয়ে করবো। কিন্তু তোকে তো না। তোকে নিয়ে যাচ্ছি সাক্ষী হিসেবে। আমার বিয়ের এক নম্বর সাক্ষী হবি তুই।’
____________
পারুল খুব উদাস হয়ে ঘাসের উপর বসে আছে। তিহান ভাই হয়তো সত্যিই পুতুলকে নিয়ে চান্দে চলে গেছে। নয়তো এখনো কেন আসছে না? তার এভাবে একা ঐকা ভালো লাগছে না। তার উপর সুজনের জন্য তার সময় আরো খারাপ কাটছে। লোকটা খুব বিরক্তিকর। একমাত্র তিহানের বন্ধু বলেই সে বেঁচে আছে নয়তো এই পারুলের হাতেই তার খু*ন হতো।
‘এই লাল ঝুঁটি! আইসক্রিম খাবে? শীতকালে আইসক্রিম খাওয়ার মাঝে দারুন একটা অনুভুতি আছে। জাস্ট ট্রাই ইট। সারাজীবন মনে থাকবে।’
‘আপনি বরং অনুভূতি নিন। আমার দরকার নাই।’
‘এত রুড কেন? মিষ্টি খাও না? আমি তোমাকে দায়িত্ব নিয়ে রোজ একটা করে মিষ্টি খাওয়াব।’
পারুল চোখ মুখ কুঁচকে নিল। এই লোকটা সত্যিই একটা অসহ্য। বসা থেকে উঠে সে নদীর পাড় ধরে হাঁটতে লাগলো। নদী এখন শান্ত কিন্তু গভীরতা অনেক। সুজনকে এখান থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলে কেমন হয়? কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে এটা একটা দুর্ঘটনা। পারুল পেছনে ফিরে সুজনকে দেখলো। সে এখন নিরার চুল নিয়ে বিশ্লেষণ করছে। থেকে থেকে হাসিতে ফেটে পরছে। পারুল দাঁত চিবিয়ে বলল,
‘শুধু অসহ্য না লোকটা সাথে বেহায়াও।’
চলবে………