প্রণয় কাব্য পর্ব-০৭

0
727

#প্রণয়_কাব্য
#লাবিবা_আল_তাসফি

৭.
শীতকালীন ভোর কেমন কুয়াশাচ্ছান্ন। যতদূর চোখ যায় তা কেবল ধূসর রঙের কুয়াশা। গাছগাছলি শিশিরের ছোয়ায় সতেজ হয়ে উঠেছে। গায়ে মোটা কাপড় জড়িয়ে ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে চলছে পুতুল। চোখ দুটোতে ঘুম ঘুম।‌ মাথায় পিচপিংক রঙের টুপি। গায়ের পোশাকটাও কিছুটা গোলাপি রঙের। লম্বা চুলগুলো আজ খোলা। যা মৃদু বাতাসের তালে তালে দুলছে।

পরীক্ষা ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু সিলেবাস এখনো অনেকটা বাকি। ক্লাস শিক্ষক একটা ব্যাচ খুলেছে। পরীক্ষার আগ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের যাবতীয় সমস্যাগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। সাতটা থেকে নয়টা ব্যাচ হবে। স্কুল শুরু হবে দশটায়।মোরের চায়ের দোকানটা খোলা। লাল রঙের বাতি জ্বলছে। পুতুল দোকান রেখে কিছুটা দূরে যেতেই তার মনে হলো তার পায়ে পা মিলিয়ে কেউ তার খুব কাছ ঘেঁষে চলছে। ভয়ে বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো। হাতের মুঠো শক্ত করে বড় পা ফেলে আগাতে লাগলো। স্কুল পর্যন্ত যেতে পারলেই হবে। হঠাৎ করেই একটা শক্ত হাত তার বা হাত টেনে ধরলো। তার ভয় সত্যি‌ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিৎকার করতে যেয়েও যেন গলা থেকে কথা বের হতে চাইছে না। গায়ের শক্তি দিয়ে সে হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলেও পারলো না। চোখ থেকে অনর্গল পানি ঝড়ছে। জীবনটা কি এখানেই শেষ?

‘এমন ছটফট কেন করছিস?’

কন্ঠটা কানে আসতেই পুতুল শান্ত হয়ে এলো। তার ছটফটানি বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু চোখের পানি এখনো ঝড়ছে। কোন কথা না বলে তিহানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। তিহান তখনো পুতুলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে। কেমন কি হলো কিছু বুঝে উঠতে পারেনি সে। অনুভব করলো তার বুকের সাথে লেপ্টে থাকা মেয়েটা থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। তিহান অশান্ত হলো। অস্থির হয়ে পুতুলকে আগলে নিলো। নরম কিন্তু চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করল,

‘পুতুল! কি হয়েছে? আমাকে বল! কাঁদছিস কেন পাখি? তাকা আমার দিকে!’

পুতুল কথা বলল না। একইভাবে লেপ্টে রইলো। তিহান আলতো ভাবে ওকে জড়িয়ে ধরলো। পুতুলের কান্না থেমে এসেছে। তিহানের জ্যাকেটের কিছু অংশ ভিজে গেছে নাকের পানি চোখের পানিতে। এটা ভেবেই পুতুল নড়চড় করছে না। কি ভাববে তিহান তাকে! তাছাড়া নাকের পানি চোখের পানিতে তার পুরো মুখ মেখে আছে। রুমাল বা টিস্যু কিছুই নেই তার কাছে। সে কিভাবে এমন মুখ নিয়ে তিহানের সামনাসামনি হবে! আর এই জড়িয়ে ধরার ব্যাপারটা! এটা কিভাবে কি বলে সামলাবে? এসব ভেবেই পুতুলের আবার ভিষণ কান্না পাচ্ছে। জ্যাকেট নষ্ট করার জন্য কি তিহান তাকে থাপ্পড় মেরে দিবে? এতটা পাষান নশ্চই হবে না!

ততক্ষনে তিহান জোর করেই তাকে সোজা করে দাড় করিয়েছে। পুতুল মাথা নিচু করে দু পা পিছিয়ে দাঁড়াল।

‘সামনে এসে দাড়া!’

পুতুল নড়লো না। ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। বাধ্য হয়ে তিহান এগিয়ে দাঁড়ালো। পুতুল নিচমিচ তাকিয়ে আঙুল দিয়ে নখ খুটছে। তিহান সোজা চোখে তাকালো। কান্না করার দরুন নাক মুখ লাল হয়ে গেছে। চোখ মুখের অবস্থা শোচনীয়। তিহান‌ প্যান্টের পকেট থেকে তার রুমাল বের করে তা পুতুলের দিকে এগিয়ে দিল।‌ পুতুল একবার আড় চোখে তিহানকে দেখলো। রুমাল দিয়ে সুন্দর ভাবে নাক মুখ মুছে নিল। তিহান সামনের দিকে পা বাড়িয়েছে। পুতুল কিছুটা দূরত্ব রেখে তিহান পাশে পাশ হাঁটছে। কুয়াশা অনেকটাই কেটে গেছে। টুকটাক সবকিছুই নজর বন্দি হচ্ছে।

‘স্যর!’

পুতুল মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। তিহানে দৃষ্টি সামনে। পুতুল বুঝলো না তিহান কেন তাকে স্যরি বলেছে। তিহান নিজ থেকেই বলল,

‘হাত ধরেছি তাতে আমার বিন্দুমাত্র গ্লিটি হচ্ছ না। ভবিষ্যতেও ধরবো। বি প্রিপারেড। নেক্সটাইম ভয় পেলে স্যরি বলব না। থাপড়ে দাঁত ফেলে দেব। তোর হাত ধরার মতো শাহস এই তিহান ছাড়া অন্য কেউ দেখাবে না। বুঝেছিস?’

পুতুল মাথা উপর নিচ করল। সে বুঝেছে। কিন্তু এটা বুঝেনি এটা শান্তনা ছিল নাকি হুমকি! পুতুল ঘাড় বাঁকিয়ে তিহানকে দেখলো। কালো রঙের জ্যাকেট পড়িহিত তিহানকে নজরকাড়া লাগছে। ঠোঁট জোড়া অন্য সময়ের থেকেও কালো লাগছে। যেন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পুতুলের মায়া হলো। এভাবে কেউ নিজে নিজের রূপ নষ্ট করে?

‘কি দেখছিস?’

‘পোড়া মাটির ফলক!’

তিহান ভ্রু কুঁচকে তাকালো। পুতুল ততক্ষনে নজর ঘুরিয়ে নিয়েছে। আর যাই হোক এই লোককে বুঝতে দেওয়া যাবে না সে কি বলেছে। নাহলে নির্ঘাত মৃত্যু!

_______________

স্যার পাটি গণিত করাচ্ছেন। স্যারের ভাষ্যমতে তিনি এই মুহূর্তে যে গণিতটা করাচ্ছেন তা ভিষণ ভিষণ ইম্পর্ট্যান্ট। পরীক্ষায় আসার সম্ভাবনা একশোতে দুইশ পার্সেন্ট। কিন্তু পুতুলের তা ভালো লাগছে না। পাটি গণিত তার কখনোই পছন্দ না। পারুল খুব মনোযোগ দিয়ে স্যারের কথা শুনছে। তার আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে এবার পরীক্ষায় সে টপ করবেই। কিন্তু পুতুল খুব ভালো ভাবেই জানে পারুল এবারের পরীক্ষাতেও গণিতে ফেল করবে। যেমন তেমন ফেল নয় ভয়ানক রকম ফেল।

বরাবরের মতো নির্দিষ্ট জায়গাটিতেই তিহান গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। তার সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে তিহান। হাতে সিগারেট। স্কুল গেট থেকে বের হতেই পুতুলের নজর পড়লো সেদিকে। সে বিরক্ত চোখে তাকালো। লোকটা বুঝি ভাতের বদলেও সিগারেট খায়!

পুতুল তিহানকে পুরোপুরি ইগনোর করে পারুলের হাত ধরে বাড়ির পথে হাটছে। তিহান পেছন থেকে বার কয়েক ডাকল কিন্তু পুতুল শুনেও শুনল না যেন। তিহানের মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছে যেন। এই পিচ্চি একটা মেয়ে তাকে এভাবে ইগনোর করার সাহস পায় কিভাবে? সুজন আড় চোখে তিহানকে দেখে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সে এসবের মধ্যে নেই।

‘পুতুল রে! তিহান ভাইতো রেগে আগুন! এমন কেন করলি বইন? তোর সাথে সাথে যে আমার ছোট্ট জীবনটাও শেষ হতে যাচ্ছে!’

‘নো চিন্তা নো টেনশন। আমিতো আছি তাই না! তোর জীবন গোলাপ দিয়ে সাজায়ে দিব।’

‘সেইটাইতো চিন্তার বিষয় যে তুই আছিস!’

পুতুল পাত্তা দিল না। যদিও তার যে ভয় লাগছে না এমন না। তিহানের যা রাগ!

তিহান ঢাকায় ফিরে গেছে শুনেই ভিষণ রকম মন খারাপ হলো পুতুলের। তার কালকের আচরণে রাগ করেই কি চলে গেলো! নয়তো কেন যাবে? এভাবে একদিনের মাথায়তো সে কখনোই যায় না। পুতুল মন খারাপ করে বিছানায় শুয়ে রইলো। সন্ধ্যার আজান পড়েছে। শিউলি ওকে শুয়ে থাকতে দেখে ধমক দিল।

‘সন্ধ্যায় এমনে শুইতে হয়না। ওঠ ওঠ। মাথায় কাপড় দে। বাইরে জামাকাপড় শুকাতে দিছিলাম নিয়ে আয় যা।’

পুতুল উঠলো। চুপচাপ বাহিরে গেল কাপড় তুলতে। শিউলি ততক্ষনে নামাজে দাঁড়িয়েছে।

____________

তিহান এবার যাওয়ার পর থেকে পুতুলের সাথে আর কোনো যোগাযোগ করেনি। পুতুল প্রতিনিয়ত ছটফট করছে। সুজনের সাথে প্রায়শই দেখা হয়। সুজন কেবল মুচকি হাসে। পুতুল লজ্জায় তিহানের কথা জিজ্ঞাসা করতে পারে না। তার সেদিনের ইগনোর করার শাস্তি তিহান তাকে খুব ভালো ভাবেই দিচ্ছে। পুতুলের মনে অভিমান জমেছে। তিহানকে মনে মনে শতখানেক গালি দিয়ে ফেলেছে। পন করেছে এমন খারাপ লোকের কথা সে আর ভাববে না। একদমই ভাববে না।

পড়াশোনার চাপ বেড়েছে। বেশ রাত জেগে পড়া হয়। শিউলি ফ্লাক্স ভর্তি করে চা বানিয়ে পুতুলের পড়ার টেবিলে রেখে দেয়। মাঝে মধ্যে সেও পুতুলের পাশে বসে থেকে রাত জাগে। মেয়ের প্রতি তার গর্ব হয়। সে তো এমনই চেয়েছে। মেয়েকে শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছে।

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে