#প্রণয়_কাব্য
#লাবিবা_আল_তাসফি
৬.
পলাশপুর গ্রামের মেয়ে শিউলি। গ্রামে তার বাবার বেশ নাম ডাক ছিল। কিশোরী বেলায় সে বেশ চঞ্চল ছিল। পুতুল একদম তার মতো হয়েছে। পড়াশোনার প্রতি তার আগ্রহ ছিলো প্রবল কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। তার মতো গ্রামের মেয়েদের লেখাপড়ার স্বাধীনতা তখন ছিল না। এজন্যই তো মেয়েদের গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। বড় মেয়েটাকে ভাগ্যের পরিহাসের জন্য বলি দিতে হয়েছে তাকে। কিন্তু পুতুল! ওকে নিয়ে খুব সখ তার। অনেক আশা মেয়েটাকে নিয়ে। কিন্তু সেদিন রাতের ঘটনা তাকে হতাশ করে ফেলেছিল। এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল মেয়েটাকে বোধহয় গড়তে পারল না সে! ব্যর্থ সে। হিতাহিত বোধ হারিয়ে ফেলেছিল। একবারও মনে হয়নি এখানে আসলেই পুতুলের দোষ আছে কি না! জেদের বশবতী হয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মেয়ের পড়াশোনার ইতি এখানেই। পারুলকে সে এ কথা বলাতেই মেয়েটার মুখে আঁধার নেমেছিল। আজ তিহান না আসলে হয়তো তার মেয়েটার জীবন একটা ভুলের জন্য নষ্ট হয়ে যেত!
______________
তিহান ঢাকায় ফিরেছে আজ দুদিন। এই দুদিন ব্যস্ততার কারণে তার পক্ষে সম্ভব হয়নি পুতুলের খোঁজ নেওয়ার। ঘড়িতে এখন রাত আটটা। ক্লান্ত চোখে তিহান ঘড়ির দিকে তাকালো। তার ভেতরটা কেমন অস্থিরতায় কাতর হয়ে পড়েছে। চোখের সামনে ছোট মিষ্টি একটা মেয়ের মুখ ভেসে উঠছে। ইসস এ কি যন্ত্রণা!
পুতুল আজ ও স্কুল থেকে ফেরার পথে আশপাশে তিহানকে খুজল। লোকটাকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া দরকার। আশপাশে তাকাতেই সুজনকে নজরে পড়লো। চায়ের দোকানটাতে বসে সিগারেট ফুঁকছে। পাশেই পড়োশ ভাই। তিহান ভাইয়ের চাচাতো ভাই ইনি। কিছুদিনের জন্য বাহিরে ছিলেন। কিন্তু তিহান ভাই কই? পুতুল ওখানে দাঁড়িয়ে আর একটু উঁকি দিতে গেলেই পড়োশ তাকে দেখে নেয়। মিষ্টি হেসে বলে,
‘এই যে ডল উঁকি ঝুঁকি কেন? এখানে চলে আসো।’
পুতুল হাসার চেষ্টা করল। পারুলের হাত ধরে টেনে তার সাথে নিল। কাছে যেতেই সুজন রসিকতা করে বলল,
‘কাউকে খুঁজছিলে নাকি পিচ্চি ভাবী?’
পুতুল চমকে তাকালো। এই প্রথম সুজন তাকে ভাবী ডকাল। কিন্তু কেন? সে কেন ভাবী হবে? কৌতুহল দমাতে না পেরে প্রশ্ন করে বসলো,
‘আপনার ভাইটা কোথায়?’
সুজন বুঝল না। বোকা চোখে তাকাতেই পুতুল হেসে বলল,
‘বুঝলেন না? বলছিলাম যে আপনার ভাই মানে আমার বর! কোথায় সে?’
সুজন কেবলমাত্র চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক বসিয়েছিল কিন্তু পুতুলের কথায় চা আর গলা দিয়ে না নাক দিয়ে নামলো যেন। পাশ থেকে পড়োশ হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। পারুল ও মুখ টিপে হাসছে। একদম ঠিক হয়েছে। এমন রশিকতা করতে পেরে পুতুল ও যেন বেশ মজা পেয়েছে। কিন্তু তা বেশিক্ষণের জন্য না। পড়োশ তার ফোনটা পুতুলের দিকে এগিয়ে দিয়ে ইশারা করলো। পুতুল ও সাতপাঁচ না ভেবে কানের কাছে নিয়েই বলল,
‘কে বর বলছেন?’
তিহানের গলায় খাবার আটকে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। বড় করে শ্বাস নিলো। ধীর কিন্তু গম্ভীর গলায় বলল,
‘সামনে থাকলে তো মুখ থেকে কথা বের হয় না। এখন খই ফুটছে?’
পুতুলের চোখ বড় হয়ে এলো। এটা তিহান ভাইয়ের গলা না? সুজন আর পড়োশের দিকে তাকাতেই তারা মেকি হাসলো। তার মানে এটা সত্যিই তিহান ভাই। পুতুল ফোন রেখে পালাবে তার আগেই ওপাশ থেকে বলল,
‘কথা না বলে পালানোর চেষ্টা করলে খবর আছে। এই মুহূর্তে গ্রামে এসে তোকে পিষে ফেলব।’
পুতুল থেমে গেলো। চুপচাপ কানে ফোন ঠেকিয়ে দাঁড়ায়ে রইল। অন্যহাতে স্কুল ড্রেসটা শক্ত করে চেপে আছে। দুপাশেই নিরবতা। নিরবতা কাটিয়ে তিহান শান্ত নরম কন্ঠে বলল,
‘ভালো আছিস?’
কথাটা কেমন যেন শোনাল। বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো। পুতুল ছোট্ট করে জবাব দিলো।
‘হু।’
‘আমি কেমন আছি জানতে চাইবি না?’
পুতুল জ্বিব দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। তার গলা শুকিয়ে আসছে। কেমন একটা অনুভুতি তাকে ঘিরে ধরেছে। পুতুলের কোনো জবাব না পেয়ে তিহান নিজ থেকেই বলল,
‘আমি ভালো নেই।’
‘অসুখ করেছে?’
‘ভিষণ রকম।’
পুতুলের চোখ চঞ্চল হয়ে উঠলো। অস্থির হয়ে বলল,
‘ডাক্তার দেখাননি?’
‘উহু। ডাক্তার বুঝতে পারছে না আমার অসুখ।’
পুতুল নাক ফুলিয়ে বলল,
‘অসুখ বুঝেনা তাহলে কেমন ডাক্তার সে? এদের উপর মামলা করা দরকার।’
তিহান নিরবে হাসলো। পুতুলের কথায় সায় দিয়ে বলল,
‘একদম!’
______________
কেটে গেছে এক মাস। এই এক মাসে অনেক কিছুই বদলেছে। সবথেকে ইম্পর্ট্যান্ট যেটা তা হলো তিহানের সাথে তার সম্পর্কটা বদলেছে। এইতো এই একমাসে বেশ কয়েকবার তার তিহানের সাথে কথা হয়েছে। লোকটা আগের মতো করে ধমকায়নি। কখনো আদুরে কখনো নরম কখনো বা শান্ত গলায় কথা বলছে। প্রত্যেকটাই পুতুলের কাছে মধুর মতো ঠেকেছে।
শীত পড়ে গেছে মধুপুর গ্রামে। ভোরের আকাশ কুয়াশাতে ঘেরা। হালকা শীতল বাতাস জানালা গলিয়ে রুমে ঢুকছে। ঠান্ডায় গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে পুতুল। ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে। শিউলি নামাজ পড়তে উঠেছে। পুতুলকে আলতো করে ডাকলো। গায়ে হাত দিতেই বুঝলো মেয়েটার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। কাল সন্ধ্যা করে গোসল করায় এই অবস্থা। শিউলি চিন্তিত হয়ে পড়লো। জলপট্টি দিয়ে কিছুটা তাপ কমানোর চেষ্টা চালালো। সকাল না হলে তো ওষুধ ও আনতে পারবে না।
সেদিন আর স্কুলে যাওয়া হলো না। বিকেলে পারুল এলো। সাথে করে কিছু বাদাম এনেছে। একদিনের জ্বরে পুতুলের চেহারা পাল্টে গেছে। ঠোঁট মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। পারুল পুতুলের কাছ ঘেঁষে বসলো। ফিসফিস করে বলল,
‘তোর মহারাজা তো এসেছেন। তোর খোঁজ করছিলেন।’
পুতুলের মুখে হাসির দেখা মিলল। পারুল মুচকি হাসলো। বাদাম ভাঙতে ভাঙতে সুর করে বলল,
‘তাড়তাড়ি করি সুস্থ হয়ে যা তো সখি। তোরে ছাড়া মোর দিন যে কাটে না।’
পুতুল হেসে ফেলল। এমন সময় শিউলি এলো। হাতে তার ফলের বাটি। বাটিটা খাটের উপর রেখে বলল,
‘নে তো পারুল তুই খা পুতুরেও দে। জমিদার বউটা খুব ভালোবাসে পুতুলরে। অসুখ করছে শনতেই এতগুলিন ফল জোর করি দিয়ে দিলেন।’
শিউলি যেতেই পারুল পুতুলকে ফিসফিস করে বলল,
‘এই জমিদার মা ছেলের কাহিনী বুঝলাম না। দুজনই দেখি তোকে চোখে হারায়। একজন ফল পাঠালো। আর একজন আমার কাছে বাদাম পাঠালো।’
পুতুল চোখ বড় করে তাকালো। পুতুলকে ওমন করে তাকাতে দেখে পারুল বলল,
‘আসার সময় রাস্তায় তোর মহারাজার সাথে দেখা। তোকে দেখতে আসবো শুনে জোর করে বাদাম কিনে দিলেন।’
পুতুল মুচকি হাসলো। তার ভেতরের সত্তা অস্থির হয়ে উঠলো তিহানকে দেখার জন্য। দখিনা বাতাস যেন তার মনে দোল খেয়ে গেলো। লাল নীল শত রঙের ফুল ফুটতে শুরু করেছে তার বুকের মাঝে। বাহারি রঙের প্রজাপতিরা মেলা বসিয়েছে তার ছোট্ট মনটাতে। মনে যে তার রঙ লেগেছে! এটা দোকানের সেই রঙ তুলির রঙ না। এটা আবেগ আর অনুভূতিতে ঘেরা প্রেমের রঙ! পরক্ষণেই নিজের ভাবনা চিন্তায় সে লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। সুন্দর মুখখানিতে লাল আভা ছড়িয়ে পড়লো। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো সে কি একটু বেশি ভেবে ফেলছে?
চলবে………..