#প্রণয়_কাব্য
#লাবিবা_আল_তাসফি
৫.
মধুপুর গ্রামে বিকেল নেমেছে। আকাশ লাল আলতার মতো রঙিন হয়ে উঠেছে। অজানা কিছু পাখির ডাক ভেসে আসছে। পুতুলদের ঘরের ডান দিকটাতে কলপাড়। কলপাড়ে একটা শিউলি ফুল গাছ রয়েছে। গাছটা পুতুল নিজে লাগিয়েছে। তার মায়ের নাম শিউলি হওয়ায় এই ফুলটা তার ভিষণ পছন্দের। গাছটা খুব বেশি বড় না হলেও শরৎকালে গাছটা ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। কলপাড়টা তখন শিউলি ফুলে ভরে যায়। পুতুল কলপাড়ে দাঁড়িয়ে তিহানের শার্টটা উল্টেপাল্টে দেখছে। শার্টটা থেকে মিষ্টি গন্ধ আসছে। নতুন কাপরের ঘ্রাণ এটা। পুতুল সাবান দিয়ে খুব ভালো ভাবে শার্টটা ধুয়ে শুকাতে দিলো। মনে মনে তিহানকে বকাঝকা করতে ভুলল না। আজ তিহানের জন্যই আম কুড়াতে যাওয়া হয়নি। নয়তো এতক্ষণে সে হরি কাকার বাগানে থাকতো।
সন্ধ্যা পড়ে গেছে। শার্টের কিছু অংশ এখনো ভেজা। এই সময় জমিদার বাড়িতে যাওয়া সম্ভব না। হেঁটে যেতে দশ মিনিটের মতো লাগে। শিউলি এই সময়ে কিছুতেই তাকে বাহিরে বের হতে দিবে না। পুতুল আপাতত তিহানের কথা বাদ দিয়ে পড়তে বসলো। তার পড়ার টেবিলটা জানালার সামনে। সাদা ফ্যাকাসে পর্দাটা অল্প বাতাসে উড়ছে। মাথার উপর বিকট শব্দে ফ্যান ঘুরছে। এই ফ্যানটার বয়স হয়তো তার থেকেও বেশি। ব্যাগ থেকে বাংলা বইটা বের করে খুলতেই তার মাঝখান থেকে বেরিয়ে এলো ভাঁজ করা একটা কাগজ। পুতুল চোখ পিটপিট করে কাগজটা খুলল।
প্রিয় পুতুল,
আমার এক বুক ভালোবাসা আমি তোমার নামে উজাড় করলাম। বিনিময়ে তুমি তোমার মনে আমাকে সামান্য জায়গা দিও। আমার……
বাকিটা পড়ার আগেই কেউ ছো মেরে তার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে নিলো। শিউলি অশিক্ষিত হলেও বানান করে করে পড়তে পারে। পুতুল ভয়ে সেটিয়ে গেলো। কাঁপা গলায় বললো,
‘মা বিশ্বাস করো কে দিছে এইটা আমি জানি না। আমিতো পড়তে বসছি। বইয়ের মধ্যে পাইছি। আমি সত্যিই কিছু জানি না।’
শিউলি ততক্ষনে সম্পূর্ণ চিঠিটা পড়ে ফেলেছে। রাগে তার হাত পা কাঁপছে। আজ সে দুনিয়ার কারো কথা শুনবে না। সে কি এই দিন দেখার জন্য মেয়েকে কষ্ট করে লেখাপড়া করাচ্ছে। এইভাবে বুঝি তার নাম উজ্জ্বল করবে মেয়ে? পুতুল তখনও একাধারে মাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। শিউলি রান্নাঘরের তাকের পেছন থেকে বেত বের করলো। আজ কোনো শক্তি তাকে আটকাতে পারবে না। মেয়ে বেশি বড় হয়ে গেছে। আজ সে দেখবে কতখানি বড় হয়েছে মেয়ে। পুতুলের চিৎকার আর মা মা বলে আর্তনাদ রাতের আঁধারকে যেন ভারী করে তুলল। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ বন্ধ হয়ে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যে যেন সবটা শান্ত হয়ে গেলো। একদম নিশ্চুপ নিরব। পুতুলের গোঙানির আওয়াজটাও পাওয়া গেল না আর।
_____________
আজ আকাশে সূর্যটা বোধহয় দেরী করে উঠলো। মোরগটাও ডাক ছাড়লো না। অন্যদিন এমন সময় ডেকে ডেকে বাড়ি মাথায় তুলে নেয়। পুতুল এলোমেলো ভাবে উঠে বসলো। গায় গতর ব্যাথায় টনটন করছে। হাত পায়ের কিছু জায়গা ফুলে আছে। চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। মা বোধহয় তাকে বিন্দু পরিমাণ ও ভালোবাসে না। বাসলেকি এভাবে মারতে পারতো। গাল গড়িয়ে পানি পড়লো। চোখ পড়ল দরজার দিকে। দরজাটা একইভাবে চাপানো যেমনটা পুতুল গত রাতে চাপিয়ে রেখেছিল। কষ্ট হলো খুব। মা একবারও তাকে দেখতে আসেনি! ফোলা চোখগুলো অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। প্রচন্ড ক্ষিদায় শরীর যেন আরো দুর্বল হয়ে পড়েছে। রাতে খাওয়া হয়নি। পুতুলের উঠে কিছু খেতে ইচ্ছা হলো না। পুনরায় শুয়ে পড়লো। চোখ গুলো লেগে আসছে। এত কেন ঘুম পাচ্ছে?
আজ দুদিন পুতুলের কোনো রকম খোঁজ পাচ্ছে না তিহান। মেয়েটা স্কুলেও আসছে না। তার ছুটি প্রায় শেষের দিকে। একদিন বাদেই ঢাকা ফিরতে হবে। অতিষ্ঠ হয়ে পায়চারি করছে। সুজন ঘুমে ঢুলছে। রাত জেগে প্রেম করতে গিয়ে এই হাল তার। গার্লফ্রেন্ডের মন রাখতে গিয়েই তাকে সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটাতে হয়েছে আর এখন বন্ধুর মন রাখতে না ঘুমিয়ে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার জন্মটাই কি মানুষের মন রাখার জন্য হয়েছে নাকি? আশ্চর্য! সুজন কিছু বলতে নিয়েও তিহানের চোখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলো। ছেলেটার চোখে স্পষ্ট অস্থিরতা। মুখে বেদনার ছাপ। অনার্স পড়ুয়া একটা ছেলের চোখে ক্লাস এইটে পড়া বাচ্চা একটা মেয়ের জন্য এমন অনুভূতি দেখে সুজনের হাসি পেলো। এত মেয়ে থাকতে এই বাচ্চা মেয়েটাই কেন? সুজন মুচকি হেসে তিহানের কাঁধে হাত রাখলো।
‘তুই কি পুতুলের ব্যাপারে সিরিয়াস? আই মিন তোকে এমন অস্থির হতে আগে কখনো দেখিনি।’
তিহান চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবলো। সুজনের দিকে তাকিয়ে খুব কনফিডেন্স নিয়ে বলল,
‘আ’ম নট শিওর।’
সুজনের হাসি মিলিয়ে গেল। হুদাই এত আগ্রহ দেখালো।
পারুলকে মন মরা লাগছে। দুপাশে বেণী করা চুল গুলো ধরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে সামনে আগাচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝেই ঘন্টা পরে যাবে। কিন্তু তার মাঝে কোনো হেলদোল নেই। তিহানদের কাছাকাছি আসতেই সুজন পারুলকে ডাকল।
‘এই যে লাল ঝুঁটি!’
পারুল তাকালো। সুজন দাঁত কেলিয়ে হাসছে। অন্য সময় হলে পারুল সুজনকে খুব করে কথা শোনাত। পারুলের লাল ফিতা দিয়ে চুল বাঁধতে বেশ লাগে। এজন্যইতো সবসময় সে লাল ফিতা দিয়ে চুল বাঁধে। পারুল সুজনকে উপেক্ষা করে পা বাড়াতেই তিহান তাকে ডাকল। না চাইতেও পারুল এগিয়ে গেল তিহানদের দিকে। এই একটা মানুষকে সে উপেক্ষা করতে পারে না। ঠিক কি কারণে তা সে নিজেও জানে না।
_______________
বাড়িতে আজ চুলা জ্বলেনি। উঠানে পাটি বিছিয়ে বসে কাঁথা সেলাই করছে শিউলি। রাত থেকে সেও না খেয়ে আছে। শরীর আর চলতে চাইছে না। কিন্তু জেদের কাছে পেটের টান কিছুই না। দুপুর ঘনিয়ে আসছে। পুতুল এখনো ঘর থেকে বের হয়নি। শিউলির কিছুটা চিন্তা হচ্ছে। একবার দেখে আসবে কি?
পুতুলদের বাড়িটা বড় রাস্তা রেখে কিছুটা ভেতরে। সরু রাস্তার পাশেই বিশাল বিল। বিলটিতে সাদা রঙের শাপলা না থাকলেও সাদা গোলাপি রঙের কচুরি ফুলে ভরপুর। কাচা মাটির রাস্তাটার পাশে বেশ কিছু নারকেল গাছও রয়েছে। তিহান এই প্রথম এদিকটাতে এসেছে। কিছুটা এগিয়ে যেতেই তারা মরিচা পড়া লাল রঙের গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। বাড়িটা একতলা বিশিষ্ট। দালান ঘর হলেও উপরের চালটা টিনের। রঙচটা দালানটির বেশ কিছু জায়গা থেকেই সিমেন্ট খসে পড়েছে। তবে তবে বাড়িটার আঙিনা বেশ পরিস্কার। গেট ঠেলতেই বিকট শব্দ করে উঠলো। এ বাড়িতে কলিং বেলের কখনো দরকার হবে বলে তিহানের মনে হয় না। এই গেট একসাথে ডবল কাজ করে দিচ্ছে। উঠানে পা রাখতেই শিউলির কন্ঠ ভেসে আসলো।
‘কে আসলো রে? ফুলির মা নাকি?’
সুজন তিহানের পাশে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। এমন না যে সে ভয় পাচ্ছে। কিন্তু বন্ধুর না হওয়া ছোট্ট প্রেমিকার বাড়িতে হানা দেওয়াটা কেমন একটা না? তিহানের কিছুটা অস্বস্তি হলেও সে সুন্দর করে সামলে নিল।
‘আসসালামুআলাইকুম চাচী। আমি তিহান?’
তিহানের নাম শুনে শিউলি হাতের কাজ ফেলে দৌড়ে বের হলো। জমিদারের ছেলে বাড়িতে তার এসেছে ভেবে সে ভিষণ অবাক। বারান্দায় চেয়ার পেতে বসতে বলল দুজনকে। পুতুলটা এখনো ঘুম। মরার মতো ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। ঘরে খেতে দেওয়ার মতো কিচ্ছু নেই। তিহান শিউলিকে এভাবে ব্যস্ত হতে দেখে বলল,
‘চাচী ব্যস্ত হবেন না। কিছু কথা বলার জন্য এসেছিলাম। এখনি বের হতে হবে আবার। আপনি যদি একটু বসে কথাটা শুনতেন ভালো হতো।’
চলবে……….