#প্রণয়_কাব্য
#লাবিবা_আল_তাসফি
৪.
গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে তিহানের। এ অসময়ে জ্বর আসার কোনো কারণ সে খুঁজে পেল না। বিছানা থেকে শরীর টেনে তুলতে পারছে না অবদি। ডাক্তার বাড়িতে এসে দেখে গেছেন। রেস্টে থাকতে বলেছেন। এভাবে শুয়ে বসে থাকা তার কাজ না। ওদিকে তার মা কঠোর পাহারার ব্যবস্থা করেছেন। এত জ্বর নিয়ে কিছুতেই সে ছেলেকে বাহিরে যেতে দিবেন না। মুখের কথায় কাজ না হলে শেষ অস্ত্র চোখের পানি দিয়ে ছেলেকে আটকে রেখেছেন। অগ্যত সে এখন ঘরবন্দি।
বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে শুয়ে আছে তিহান। মোবাইলের হিডেন ফোল্ডার থেকে এক কিশোরীর ছবি বের করলো। মিষ্টি একটা মেয়ে। এই তো মাস ছয়েক আগে তোলা ছবি। সেমিস্টার শেষে ছুটিতে বাড়িতে এসেছে তখন সে। পড়াশোনার জন্য খুব একটা আসা হতো না। মা খুব করে কান্নাকাটি করলে তবেই আসা হতো। গ্রামে আসলে বাজারেই সময় কাটানো হয় বেশি। সকাল বেলা বন্ধুদের সাথে বাজারের চায়ের দোকানে আড্ডআ বসেছিল। এতশত গল্পের মাঝে তার চোখ পড়ে দু পাশে বেনি করা স্কুল ড্রএস পড়া একটা মেয়ের উপর। সাজসজ্জা বিহিন শুভ্র মেয়েটা স্কুল গেটের সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দেরী করার দরুন তাকে স্কুলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বড়বড় চোখ দিয়ে বারবার এদিক ওদিক করছে। চোখগুলো ছলছলে। তিহানের খারাপ লাগা উচিত ছিল। কিন্তু তার ঠোঁটে অজানা কারণে হাসির দেখা মিলল। কাল বিলম্ব না করে টুক করে কয়েকটা ছবি তুলে নিল তার ফোনে। এরপর থেকে ওই রাস্তায় তার প্রতিনিয়ত আনাগোনা শুরু হলো। মেয়েটার চঞ্চলতা বারবার তাকে মুগ্ধ করতো। যে তিহান ছমাসেও গ্রামে আসেনা সে সপ্তাহ অন্তর অন্তর আসা শুরু করলো। ছোট্ট একটা মেয়ে নিজের অজান্তেই একটা ছেলেকে নিজের বশ করে নিল যেন।
____________
ভোরে অল্প বৃষ্টি হয়েছে। পরিবেশ বেশ ফুরফুরে। রাস্তার ধারের গাছগুলোর পাতার ময়লা ধুয়ে গেছে। এখন বেশ লাগছে দেখতে। চারপাশ সবুজে ভরা। বাতাস হলেই পাতায় জমে থাকা পানিকণাগুলো টুপটাপ করে ঝরছে। পুতুলের স্কুল ড্রেসের অনেকটাই ভিজে গেছে তাতে।
‘দূরে সরে হাট পুতুল। ভিজে যাচ্ছিস তো। অসময়ে জ্বর বাদাস না।’
কে শুনল ও কথা? বরং যেসব ডাল নিচু হয়ে আছে তা ঝাঁকিয়ে পানি গায়ে ফেলছে সে। পারুল হতাশ হয়। মেয়েটা এত বেপরোয়া কেন?
ক্লাসরুমের সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে পুতুল আর পারুল। এটা নতুন কিছু না। পড়াশোনায় ভালো হলেও টাইম মেইনটেইনের বেলায় ভীষণ কাঁচা মেয়েটা। কান ধরা অবস্থাতেই পুতুল ফিসফিস করে পারুলকে ডাকল।
‘আম কুড়াতে যাবি? হরি কাকা শহরে গেছেন। দৌড়ানি খাওয়ার ভয় নাই।’
পারুল শুনল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এই মেয়ের কথায় সায় দিলে আজ নির্ঘাত মৃত্যু।
টিফিনের ঘন্টা পড়েছে। সকালে তাড়াহুড়ো করে কিচ্ছুটি খাওয়া হয়নি। পেটের মধ্যে ইঁদুরের উপদ্রব শুরু হয়েছে। বাজারে সাথির বাবার দোকানে ভালো সিঙ্গারা পাওয়া যায়। প্রতি পিস তিন টাকা। সাথে কাঁচা পেঁয়াজ কুচি আর টক-ঝাল চাটনি। পুতুল ওর ছোট্ট টাকার ব্যাগটা খুলল। সব মিলিয়ে তার কাছে দুইশত পঁচাত্তর টাকা আছে। এগুলো সে মায়ের আড়ালে গুছিয়েছে। এখানে এক টাকার কয়েন থেকে শুরু করে বিশ টাকার নোট ও আছে। পুতুল গুনে গুনে ছয় টাকা নিল। এ দিয়ে দুইটা সিঙ্গারা হয়ে যাবে। একটা তার অন্যটা পারুলের জন্য।
রাস্তার পাশেই সাদা রঙের গাড়িটা দাঁড়িয়ে। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়ানো তিহান। আঙুলের ভাঁজে চেপে রাখা সিগারেটটা শেষ হয়ে এসেছে। পাশেই সুজন গাড়ির উপর বসে আছে। তার নজর তিহানের দিকে স্থির। সেই ছোট থেকে সে তিহানের সাথে আছে। ছেলেটার আগা গোড়া পুরোটা মুখস্ত তার।
‘না বের হলে কি হতো না? কাকিমা শুধু শুধু চিন্তা করছে।’
‘দমবন্ধ লাগে।’
কথাটা বলে হাতে থাকা সিগারেটটা দূরে ছুড়ে ফেলল। মাথা ঘুরিয়ে একবার স্কুল গেটের দিকে তাকালো। টিফিন টাইমতো শুরু মেয়েটা এখনো বের হচ্ছে না কেন? গেট দিয়ে ছেলে মেয়েরা ছুটে বের হচ্ছে। তিহান তার কাঙ্খিত মানুষটিকেও দেখলো। পারুলের হাত ধরে ছুটছে। তার ধ্যান ভাঙল সুজনের কথায়।
‘এখন চল। দেখা তো শেষ!’
বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নিলো তিহান। তার শরীরটাও ভীষণ খারাপ লাগছে। শরীরের তাপ বেরেছে। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও সুজনকে বললো,
‘রাস্তা ফাঁকা আছে। চাইলে চলে যেতে পারিস। নতুবা কিপ ইওর মাউথ শাট।’
পুতুল খুব আনন্দের সাথে সিঙ্গারায় কামর বসালো। এটা তার ভিষণ পছন্দের। সে এখনো তিহানকে দেখতে পায়নি। পারুলের চোখ পরতেই সে পুতুলকে চিমটি কাটলো।
‘দেখ তোর মহারাজা আসছে।’
পারুলের বুক কেঁপে উঠলো। এই লোককে দেখলে তার বুক কাঁপে এখনতো তার নাম শুনলেও কাঁপছে।
‘পারুল! আমি কি মরে যাচ্ছি? আমাকে একটু বাঁচা। আড়াল কর আমাকে।’
‘লাভ নেই। তাকায় দেখ তোকেই ডাকতিছে।’
তিহান হাত নেড়ে পুতুলকে ডাকছে। পুতুলের বুকের মধ্যে কেমন করে উঠলো। ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে গেল। তিহানের থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়াতেই তিহান বাজখাঁই গলায় ধমক দিলো।
‘এগিয়ে আয়।’
পুতুল কেঁপে উঠলো। কিছুটা এগিয়ে গেল। কিন্তু তিহান তার হাত ধরে টেনে গাড়ির সাথে লাগিয়ে দাড় করালো। পুতুল হাঁসফাঁস করে উঠলো। এভাবে এতটা কাছে দাঁড়িয়ে এর আগে কখনো কথা বলেনি সে।
‘কি খাচ্ছিস এটা?’
পুতুলের হাতে আধখাওয়া সিঙ্গারার দিকে ইশারা করলো তিহান। পুতুল সেদিন তাকিয়ে ছোট করে জবাব দিলো,
‘সিঙ্গারা…’
‘আমাকে দে! আমিও খেয়ে দেখি কেমন খেতে।’
পুতুল সাথে সাথে জবাব দিলো,
‘একটু অপেক্ষা করেন। এক্ষুনি আনছি।’
পুতুল উল্ট দিকে পা বাড়াবে তার আগেই তিহান খপ করে হাতটা ধরে ফেলল।
‘কোথায় যাচ্ছিস?’
পুতুল চোখের পাতা ঝাপটালো। বোকা গলায় বললো,
‘আপনি না বললেন…’
ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই তিহান আ করলো। নরম গলায় বলল,
‘তোর হাতের ওটুকুতেই চলবে। আমি এখন হাত নোংরা করব না। খাইয়ে দে।’
‘কিন্তু..’
তিহান আর কোনো কথা শোনার অপেক্ষা করলো না। পুতুলের হাত ধরে অবশিষ্ট খাবারটুকু গালে নিয়ে নিলো। পুতুল বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকলো। তিহানের ভেতর কোনো পরিবর্তন দেখা গেলো না। পাশ থেকে পারুল এসব দেখে মরে যায় যায় অবস্থা। এ সে কি দেখছে! অযান্তেই হাত মুখে চলে গেলো।
তিহানের চোখ লাল হয়ে এসেছে। পুতুল আড় চোখে বার কয়েক পর্যবেক্ষণ করলো। বেশ কিছুক্ষণ উশখুশ করে অবশেষে বলল,
‘অসুস্থ আপনি?’
তিহান তাকালো। সুজন ঠোঁট চেপে হাসছে। তিহানের ঠোঁট কোণেও হাসি দেখা গেলো। তার রমনীর তবে তার দিকে নজর পারলো!
‘তেমন কিছু না। একটু ঠান্ডা লেগেছে কাপড় কাচতে যেয়ে।’
তিহানের মিথ্যা কথা শুনে সুজনের চোখ বড় হয়ে গেলো। তিহান আর কাপর কাচা! তবুও মুখ বন্ধ রেখে পরের কথা শোনার জন্য কান পাতলো। তিহান গাড়ি থেকে একটা শার্ট বের করলো। পুতুলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘এটা আমার কাল লাগবে। মায়ের মাজার ব্যাথাটা বেড়েছে তাই তাকে বলতে পারলাম না। এটা একটু ধুয়ে আজ রাতে আগে দিয়ে আসবি কেমন?’
পুতুল শার্টটা উল্টে পাল্টে দেখলো। শার্টটাতো একদম পরিষ্কার। দেখে মনে হচ্ছে একদম নতুন। সুজন শার্টটা দেখেই মুখ ফসকে বলে ফেলল,
‘এটা না ঢাকা থেকে আসার দিন নিউমার্কেট থেকে নিলি? এ তো এখনো পরিসনি নোংরা কীভাবে হলো?’
তিহান চোখ গরম করে তাকালো। চোখ দিয়েই যেন সুজনকে মেরে ফেলবে। দাঁতে দাঁত পিষে মুচকি হেঁসে বলল,
‘সেটা তোর না জানলেও চলবে। আমি ব্যস্ত, এখন আমাকে যেতে হবে।’
গাড়িতে উঠে ধুম করে ডোরটা বন্ধ করে দিলো। পুতুল কেঁপে উঠলো। সুজন বোকা হেঁসে একবার পুতুলের দিকে আরেকবার পারুলের দিকে তাকালো। তার মুখটাতে লাগাম পরাতে হবে। এভাবে চললে তো তিহানের হাতে তার সম্মানের সাথে সাথে তার প্রাণ ও নাশ হবে!
চলবে……
(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখবেন।)