প্রণয়ে প্রলয়ের সুর
.
পর্ব- ৪
.
ক্ষীণ সময় পরই কেয়া চলে এলো কিচেনে। তরুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো, ‘কি করছিস?’
– ‘এগুলো বের করেছি। তোমার অপেক্ষা করছিলাম, নতুন কিচেন তো, আগামাথা কিছু পাচ্ছি না।’
মুচকি হাসলো কেয়া, তারপর চুলোর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এটা কি?’
– ‘নির্জন ভাই ডিম সিদ্ধতে বসিয়ে গেছে। আচ্ছা, হয়ে গেছে মনে হয়, আমি গিয়ে দিয়ে আসবো?’
– ‘যা, আমিও রেডি করি এদিকে।’
তরুর পুনরায় ছেলেদের মতো ফ্লার্টিং করতে মন চাইল। সে শব্দ করে শ্বাস নিয়ে বললো, ‘ফুপু তুমি পারফিউম দিয়েছো?’
কেয়া ভ্রু-কুঁচকে বললো, – ‘না তো।’
তরু চুলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, ‘পারফিউমের মতো কড়াও লাগছে না। কিন্তু তুমি আসা মাত্র কেমন একটা মিষ্টি ঘ্রাণ পাচ্ছি।’
– ‘কি জানি।’
তরু ডিম দু’টা নামিয়ে বললো, ‘তোমার যন্ত্রণায় জানো বাড়িতে এখনও কত বকা খাই?’
– ‘তাই না-কি, কেন?’
– ‘এইতো ধরো চুল আঁচড়াইনি, আম্মু বকা দিতে গিয়ে তোমাকে টানবে। তারপর বলবে তোর কেয়া ফুপু কিরকম? সারাদিন তো একসঙ্গে থাকতি কিছু শিখেছিস? ধরো কালো হয়ে যাচ্ছি, তো তোমার এখনকার ছবি দেখিয়ে বলবে, দেখ দিন দিন সুন্দর হচ্ছে কেয়া। আর তুই পে*ত্নী হচ্ছিস।’
কেয়া খিলখিল করে হেসে বললো, ‘অকারণ বকে, তুইও তো সুন্দর হয়েছিস আগে থেকে।’
ডিম দু’টা একটা প্লেটে নিয়ে তরু এবার মূল পয়েন্টে গিয়ে কথাটা বললো,
– ‘তবুও আত্মীয়-স্বজন সবাই তো এখন তোমার গুণকীর্তনে অস্থির৷ এত ভালো জায়গায় বিয়ে হয়েছে। ফুপারও অনেক নামডাক চারদিকে। সবার কথা হলো কেয়ার মতো হও, গুণবতী, রূপবতী। আচ্ছা যাই, গিয়ে ডিমটা দিয়ে আসি।’
– ‘আমি গুণবতী, রূপবতী কচু।’
তরু দাঁত কটমট করে তাকিয়ে বললো, ‘আচ্ছা এখন আর কিছু বলবো না। আরেকদিন বলবো। যখন বলি আমি বেশি বলে ফেলি। এটাই আমার দোষ। আর জানো? সবাই আমাকে এখন এটাও বলে। তোর কেয়া ফুপুর মতো শান্তশিষ্ট হ। এত কথা বলিস কেন মেয়ে হয়ে?’
কেয়া মুচকি হেসে বললো, ‘আচ্ছা বল কি বলবি।’
– ‘দরকার নাই, তোমার আদরের ছেলেকে আমি ডিম দিয়ে আসি।’
বলেই তরু প্লেট নিয়ে বাইরে এলো। মিটমিটে হাসছে সে৷ এক অদ্ভুত ক্ষমতা দিনকে দিন তরু নিজের ভেতর টের পায়৷ কাউকে প্রভাবিত করা। বয়স যত বাড়ছে সেই ক্ষমতা ততই প্রকট হচ্ছে ওর। মাঝে মাঝে মানুষকে তার কাছে খুবই শিশুর মতো মনে হয়। যেন যেরকম ইচ্ছা সে নিয়ে খেলতে পারবে। আজ সে সবকিছু খুবই সচেতনভাবে করছে৷ নির্জন সাহেবকে যখন বলেছিল, ‘কোনোকিছু না পেলে কি ফুপুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করবো?’
নির্জন নিষেধ করেছিল৷ কেয়া বিগড়ে গেলে তাকেও বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারে বলেছিল। তখনই তরু রান্না করা নিয়ে ভেতরে ভেতরে সিরিয়াস হয়ে যায়। কারণ রান্নার পর ঠিকই ফুপু জানবেন। তখনই ছুটে যায় সে। ফুপুর পূর্বের আচরণে খুবই আহত হয়েছে সেটা শুরুতে বুঝায়। তারপর রূপের প্রশংসা, বাবা আইফোন ইত্যাদি বলে মন ভালো করার চেষ্টা করে। কাজও হয়। রান্নার অনুমতিও নিয়ে নেয়। নির্জনের সঙ্গেও যা করেছে সবই সচেতনভাবে করা। একজন মানুষ তাকে প্রথমদিনই ‘চুম্মাচাটির গল্প লিখে’ বলে চরম আঘাত করছে। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড অপমানবোধ করলেও নিজেকে সামলে রেখেছে তরু। বাড়িতে এসেও নির্জন সাহেবের একই রকম আক্রমণ। রূঢ় আচরণ। সে কেমন মেয়ে না-কি চিনে। তার ‘জাত’ জানা আছে ইত্যাদি। তরু মোটেও এগুলো স্বাভাবিকভাবে নেয়নি৷ অন্যকোন মেয়ে হলে হয়তো লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতো। চেঁচামেচি করে নির্জনকে কালা বানিয়ে ফেলতো। কিন্তু সে এমন করবে না। কারণ সে তরু। আট-দশটা মেয়ের মতো সে না। তার সম্মুখ ধারণা ফুপুর উপর রাগের কারণেই হয়তো নির্জন সাহেব তার সঙ্গে এরকম কথা বলেছেন। ভিন্ন কিছুও হতে পারে। সেটা পরে সে জানবে৷ কিন্তু এর আগঅবধি সিরিয়াস ঝামেলায় জড়াবে না। ঝামেলায় জড়ানো দূর্বল মনের পরিচয়। সে দূর্বল না৷ এই খেলায় সে যখন সিরিয়াস ঝগড়ায় জড়িয়ে যাবে তখনই হেরে গেছে ধরবে।
কিচেনে তাই উলটো রাগিয়ে দিয়ে নির্জনকে বুঝিয়ে দিয়েছে ওর রাগারাগি দেখে তরু ভীষণ মজা পাচ্ছে৷ কিন্তু না, প্রতিটা কথার হিসাব সে নিবে। এবং তাকে নিয়ে যতপ্রকার খারাপ ধারণা অবশ্যই ভেঙে দেবে। কিন্তু তরু ভাবছে প্রথমদিন হিসাবে কি একটু বেশি হয়ে গেল? তার এই এক সমস্যা, সেটা বয়সের কারণেই কি-না কে জানে, পরিমিতিবোধ কম। সবকিছুতে বেশি বেশি করে। দোতলায় এসে সে মনে মনে নিজেকে উপদেশ দিল, ‘মিস তরু, বেশি বেশি কিছুই করা যাবে না। সবকিছু উপভোগ করো। রিলাক্স। খুবই রিলাক্স।’
দরজার সামনে এসে নক দিল। দরজা খুলে দিল নির্জন। কোনো কথা না বলে হাত বাড়িয়ে প্লেট নিল সে। তরুর কৌতূহলী মন চাচ্ছিল ভেতরটা একটু দেখবে। কিংবা এখন যদি সে বলে ‘ভেতরে একটু আসি?’
নির্জন সাহেব গম্ভীরমুখে বলবেন, ‘কেন?’ সে বলবে, ‘না একটু দেখতাম সুন্দর ছেলেদের রুম কেমন হয়।’
তখন আবার যদি বলে ফেলে, ‘কেন, জীবনে সুন্দর ছেলের রুম দেখেননি?’ আরও বিশ্রীভাবেও বলতে পারে। থাক, বেশি বেশি ভালো না। নির্জন তাকে অন্যমনস্ক দেখে বললো, ‘কিছু বলবেন?’
‘না, কিছু বলার নেই আপনাকে’ কথাটা অজান্তেই চাপা অভিযোগের সুরে বলে ফেললো তরু। যেন কোনো অপরাধ করেছে নির্জন। পাশ ফিরে বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে জিভ কাটলো নিজের। পিছু থেকে নির্জন বিভ্রান্ত হয়ে বললো, ‘কিছুই বুঝলাম না, এখন আবার আমি কি করলাম?’
তরু পিছু না ফিরে নিচে চলে এলো।
নির্জন ডিম খেয়ে সত্যিই রুমে খানিক ব্যায়াম করে নিয়ে গোসল করে নিল। আগে বাইরে থেকে এসে গোসল করেনি। কেবল কাপড় পালটে নিয়ে মাথা মুছে নিয়েছিল।
রান্না শেষে তিনজনই একসঙ্গে বসে খেল। কেয়ার সঙ্গে নির্জনও রান্নার প্রশংসা করতে কার্পণ্য করলো না। খাওয়া শেষে সে চলে গেল বাইরে। তরু দীর্ঘসময় কেয়ার সঙ্গে কাটাতে গিয়ে বুদ্ধি করে নানান কথা বলে মাতিয়ে রেখে ক্রমশই তাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসলো।
এবং একপর্যায়ে বললো, ‘ফুপু।’
কেয়া শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছিল। সে জবাব দিল, ‘কি?’
– ‘তোমরা তাহলে সবসময় বাইরের খাবার খাও?’
– ‘আরে না, বললাম না কাজের মেয়েটি চলে গেছে।’
– ‘আশ্চর্য! তাহলে নির্জন সাহেব বা ফুপা কাজের মেয়ের ব্যবস্থা করবেন না? তুমি কি রান্না ঘরে যাবে না-কি? জানো ছোটবেলায় আমার মনে হতো নায়ক-নায়িকাদের টয়লেটেও যেতে হয় না। আমাদের মতো ওরা এত পচা না। সেরকম এখন তোমাকে দেখে মনে হয় তোমার দ্বারা জীবনেও আগুনের কাছে গিয়ে রান্নাবান্না মানাবে না।’
কেয়া মুচকি হেসে বললো, ‘আমি তো রান্না করতে যাইও না। দেখলি না বাইরে থেকে খাবার আনতে গেছিল।’
– ‘বাইরের খাবারে জানো কত অসুখ-বিসুখ? ওদের উচিত ছিল যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকজনের কাজের মেয়ের ব্যবস্থা করা।’
– ‘ওদের দোষ না, মেজাজ খারাপ হয়েছিল দিয়েছি বিদায় করে। আজকাল হুদাই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।’
– ‘সে তুমি মেজাজ খারাপ করলে মানলাম। তাই বলে চলে যাবে? কাজের মেয়েগুলোও যে কেমন। তুমি ভুলেও কল দিয়ে আসতে বলতে যেও না। দুই পয়সার কাজের মেয়ে মাথায় উঠে নাচবে শেষে।’
– ‘আমি বসে আছি কল দিতে।’
– ‘কিন্তু বাইরে থেকে এনে খাওয়া কেমন দেখায় না? শরীর-স্বাস্থ্যও খারাপ হবে। নির্জন সাহেবকে কল দিয়ে বলে দাও কাজের মেয়েকে আসতে বলতে। তাহলেই তো হয়। তুমি নিজে দিলে সমস্যা।’
– ‘হ্যাঁ ঠিকই তো বলেছিস। বাসার এত কাজকাম কে করবে তাহলে। এগুলোর কথা ভাবিইনি। অসহ্য লাগে একেক সময়। আচ্ছা কল দিচ্ছি নির্জনকে।’
কল দিয়ে কাজের মেয়েকে আনতে জানিয়ে দিল কেয়া। তরু জানে তার ফুপুর জন্যই পুনরায় ফিরিয়ে আনতে সাহস পায়নি নির্জন।
কাজ হলো ম্যাজিকের মতো। সন্ধ্যার আগেই কাজের মেয়ে হুস্না এসে হাজির। রাত আটটার দিকে ইশহাক সাহেবও অফিস থেকে ফিরলেন। সে তখন পড়ার টেবিলে বসে খাতায় আঁকিবুঁকি করছে। হুস্না দরজা খুলে বললো, ‘চাচা আপা এই রুমে।’
ইশহাক সাহেব হাস্যজ্বল মুখে ভেতরে এলেন। এখনও কোট-টাই পরনে। চুল-দাড়িতে কালো কালার করা। তবুও দুইপাশের জুলফির দিকে সাদা চুল উঁকি মারছে।
তরু দাঁড়িয়ে সালাম দিল। তিনি গিয়ে সোফায় বসে বললেন, ‘বসো মা, দাঁড়িয়ে আছো কেন? বাড়ির সবাই ভালো আছেন?’
– ‘হ্যাঁ ফুফাজি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছেন সবাই।’
– ‘তোমার নির্জন ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছো তো? সে একটা ভালো কোচিং সেন্টার দেখে ভর্তি করিয়ে দেবে।’
– ‘হ্যাঁ কথা হয়েছে।’
তারপর আরও খানিক আলাপের পর নির্জনের কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করলেন।
ইতস্তত করে বললেন, ‘মা, তোমার ফুপু তো তোমার কথা অনেক গল্প করেন। তোমরা একসঙ্গে সারাক্ষণ থাকতে।’
তরু লাজুক হেসে বললো, ‘হ্যাঁ।’
– ‘হয়েছে কি মা। বাসাটা তো পুরোপুরি খালি। আমি অফিসে চলে যাই, নির্জনও ভার্সিটিতে, গানে। অবশ্য যা পারে সময় দেয়। তবুও মেয়ে ছাড়া হয়তো ভালো লাগে না। বাসায় তোমার ফুপু একা। তাই ওর সারাক্ষণ মন-মেজাজ খারাপ থাকে। তুমি তার কাছে গিয়ে বসবে। আগের মতো গল্প-গুজব করবে, কেমন?’
– ‘আচ্ছা ফুফাজি, এগুলো সমস্যা না।’
– ‘আর তোমার কোনো দরকার হলে নির্জন বা আমাকে বলবে।’
– ‘জি আচ্ছা।’
‘তাহলে এখন যাই, সবে অফিস থেকে এলাম। অন্য সময় কথা হবে’ বলে তিনি বিদায় নিয়ে চলে এলেন। হেঁটে হেঁটে এলেন নিজের রুমের সামনে। দরজা খুলেই হয়তো কেয়াকে দেখবেন। ওকে দেখলেই এ বয়সে এসেও তিনি বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শিহরণ টের পান। ইচ্ছা করে পৃথিবীর সকল সুখ কেয়ার পায়ের কাছে এনে বিছিয়ে দিতে। নক করলেন। কেয়া খুলে দিল দরজা। ওর পরনে হলুদের মতো একটা কামিজ, ইশহাক সাহেব রঙটা পুরোপুরি ধরতে পারলেন না। চুল একগোছা কপাল বেয়ে এসে পড়েছে। দুই ভ্রুর মাঝখানে ছোট্ট টিপ। চোখ দুটা অদ্ভুত অস্বাভাবিক সুন্দর। তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইলেন। এভাবে তাকিয়ে থাকলে সাধারণত মানুষ পৃথিবীর সবকিছু না-কি ভুলে যায়। কিন্তু ইশহাক সাহেবের একটা কথা মনে পড়ে গেল। তিনি আজ অফিসে একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছেন, তার স্বামী অফিস থেকে ফেরার পর তার জন্য কি নিয়ে ফিরলে খুশি হয়। মেয়েটি হেসে বললো, ‘তেমন কিছু না স্যার, চকলেট আইসক্রিম নিয়ে এলেও মন ভরে যায়।’
তিনিও আজ নিয়ে ফিরছিলেন। কিন্তু সেগুলো নিচে গাড়িতে রয়ে গেছে। কেয়া রূঢ় গলায় বললো, ‘কি হয়েছে? আসবে না-কি দরজা বন্ধ করে দেবো?’
– ‘কেমন আছো?’
– ‘আমাদের কি কয়েক মাস পর দেখা হলো? অফিস থেকে ফিরে ‘কেমন আছো’ কেউ জিজ্ঞেস করে?’
ইশহাক সাহেব বিব্রতবোধ করতে শুরু করলেন।
____চলবে…..
লেখা: জবরুল ইসলাম