প্রণয়ে প্রলয়ের সুর পর্ব-৩৭

0
770

#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_৩৭
.
রাত চারটায় নির্জনের হুট করে ঘুম ভেঙে গেল। সারারাত সে দুঃস্বপ্ন দেখেছে। সেসব স্বপ্নের কিছুই এখন আর মনে নেই তার। কিন্তু বুক ধড়ফড় করছে। গলা প্রচণ্ড শুকিয়ে গেছে। ভয়ের কোনো স্বপ্ন দেখেছিল কি? দেখলে এত দ্রুত ভুলে গেল কীভাবে বুঝতে পারছে না।
বিছানা থেকে নেমে এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার এসে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ঘুম এলো না। বিছানার পাশ থেকে মোবাইল হাতে নিল। রাতে হঠাৎ তরু অফলাইনে চলে গিয়েছিল। আর আসেনি। পরে সেও ঘুমিয়ে পড়ে। ওয়াই-ফাই অন করতেই তরুর একটি মেসেজ এলো। অনেক লম্বা মেসেজ। কেন যেন আঁতকে উঠলো তার বুক। উঠে বসলো বিছানায়। পড়তে লাগলো মেসেজ।

“নির্জন, আফতাব স্যার আব্বাকে তোমার নাম্বার দিয়ে সবকিছু জানিয়ে দিয়েছে। সে চায় তোমার সঙ্গে যেন কোনো সম্পর্ক না রাখি। তাহলে বিয়ে করতে সমস্যা নেই। বাড়ির সবাই প্রচণ্ড রেগে আছে। আপাতত ওরা যাতে মোবাইল কেড়ে না নেয় আমি তোমার সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করবো। না হলে যোগাযোগ রাখতে পারবো না। অন্যদিকে পালিয়ে যাওয়ার আমি কখনও যেতে চাই না। ব্যাপারটা ভাবতেও পারি না। তুমি আগে বিয়ের প্রস্তাব দাও। দাদা এমনিতেই তোমার আব্বাকে কল দিবে। তুমি আঙ্কেলকে আমাদের কথা বলে দাও। মেসেজ দেখে পাগল না হয়ে ঠান্ডা মাথায় কিছু করো। ফোন আমি রেখে দেবো। শুধু একবার ডাটা অন করে হাতে নেব৷ ওরা যদি টের পায় তোমার সঙ্গে রিলেশন, তাহলে মোবাইল নিয়ে নিবে। তোমার প্রস্তাবের পর জানুক। এখনই বলে ঝামেলা হোক চাই না। আর আমি বলেছি স্যারের নাম্বার কোথায় পেয়েছো জানি না। না হলে এখনই ফোন নিয়ে নিতো।”

মেসেজটি দেখে নির্জন অস্থির হয়ে গেল। ‘হাই, হ্যালো’ দিয়ে অফলাইনে পেল ওকে। সিগারেট ধরিয়ে টেনে রুমে পায়চারি করে কাটলো পরের পুরোটা রাত। সিগারেট শেষ হয়ে যাওয়ায় ভোরেই উঠে বাইরে চলে গেল সে। হাঁটা-হাঁটি করে ফিরে এলো আটটার দিকে। তাকে দেখেই আছমা চৌধুরী বললেন, ‘কিরে তুই ভোরে উঠে কোথায় চলে গেছিস, ভাই খুঁজছেন।’

সে এসে সিটিংরুমে বসলো। ইশহাক সাহেবকে ডেকে আনলেন আছমা চৌধুরী। হুস্না এনে চা দিল তাদের। ইশহাক সাহেব সোফায় বসে বললেন, ‘তোমার চোখ-টোখ এত লাল কেন? আর এত ভোরে বাইরে গিয়েছিলে কেন?’

– ‘এমনিই, খুঁজছিলে কেন বলো?’

– ‘আরিফুল সাহেব আমাকে রাতে কল দিয়েছিলেন। আমি রিসিভ না করে সাইলেন্ট করে রেখে দিয়েছি। ভোরে আবার নিজেই ব্যাক করলাম। ওরা কি বলে এসব?’

– ‘কি বলছে?’

– ‘বললো তরুর বিয়ে তুমি ভেঙে দিয়েছো। বরপক্ষকে তুমি না-কি বলেছো ওর সঙ্গে সম্পর্ক।’

– ‘আব্বু তুমি শান্ত হয়ে শুনলে আমার কিছু কথা বলার আছে।’

– ‘আমি শান্ত এবং সুস্থ আছি। তুমি যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে চা খেয়ে বলো।’

– ‘না, আমি ঠিক আছি, বলি।’

– ‘বাইরে থেকে এসেছো। আগে ফ্রেশ হও, চা খাও। এরপর বলো।’

নির্জন উঠে চলে গেল। ইশহাক সাহেব আছমা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

– ‘তোর কথাই ঠিক।’

‘দেখলে তো, আমি আগেই বলেছি নির্জন তরুকে পছন্দ করে। ওরা দু’জনের ছবিও দেখেছি।’

– ‘হ্যাঁ, সেটা জেনেই তো আমি তোকে বললাম ওর সামনে তরুকে নিয়ে কিছু না বলতে। আমিও তার কথামতো চু*রির টাকা কেয়াকেও দিয়ে দিলাম।’

– ‘তুমি তাহলে সত্যিই মেনে নিবে তরুকে?’

– ‘এক কথা কয়দিন বলবো? নির্জন চাইলে অবশ্যই মানবো। ওদের পরিবার রাজি না হলে তো আমার কিছু করার নেই।’

– ‘তাহলে কেয়ার সাথে ওইদিন ভালো আচরণ করতে পারতে। আমি এজন্যই ওইদিন বাড়াবাড়ি করিনি।’

– ‘কেয়ার বিষয় আলাদা। ওকে মেনে না নেয়ার আমার অনেক কারণ আছে। তরুকে নির্জন পছন্দ করে। ওর পরিবার তার কাছে বিয়ে দেবে৷ ওদের তো কোনো দোষ নেই। হ্যাঁ, আমি জানি ব্যাপারটা কেমন বিশ্রী হয়ে গেছে। কিন্তু বাচ্চা সহ ডিভোর্স হলেও তো দু’টো পরিবারের মুখ দেখাদেখি হয়। সন্তানের জন্মদিন, স্কুল-কলেজের কাজে মিলতে হয়। নির্জন বিয়ে করলে আমি ওর প্রয়োজনে যতটুকু মিলতে হয় মিলবো। এগুলো নিয়ে এত ইজ্জত চলে যাবে৷ গায়ে লাগবে। মুখ দেখতে হবে কেয়ার। তাই ওই পরিবারে বিয়ে অসম্ভব বলা মানুষ আমি না।

আছমা চৌধুরী হেসে বললেন, ‘তোমার মনে আছে তুমি টাকার বিষয়ে বলতে গিয়ে একদিন বলেছিলে এমন পরিবারের সাথে সম্পর্ক অসম্ভব।’

ইশহাক সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘রাগের মাথায় বলেছি। তাছাড়া তখন তো জানতাম না ওদের সম্পর্ক।’

– ‘তখন নির্জনের মুখ দেখার মতো ছিল। সঙ্গে সঙ্গে মলিন হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া আমিও না জেনে ওর সামনে তরুকে অনেক দোষারোপ করেছি।’

– ‘তুই তো আরেক পাগল। তরুর কীসের দোষ? কেউ কি নিজের পরিবারের বদনাম বলবে? আগে প্রেম করেছে এটা বলার মতো কিছু না। আর শ্রীমঙ্গল দুইদিনের জন্য যেতেই এমন ঘটনা ঘটবে সে জেনে বসে ছিল না-কি।’

নির্জন আসছে দেখে আছমা চৌধুরী আর কিছু বললেন না। তিনি উঠে তাকে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চা বদলে আরেক কাপ এনে দিতে গেলেন। নির্জন এসে বসার পর কোনো ভূমিকা না করে বললো, ‘তুমি অস্থির না হলে আমি বলি। তোমার কাছে বিষয়টা অপ্রত্যাশিত। মেনে নেয়াও কষ্টকর। তাই বলতেও দ্বিধায় ছিলাম..।’

তাকে থামিয়ে ইশহাক সাহেব বললেন,

– ‘বলো।’

– ‘আরিফুল সাহেব তোমাকে যা বলেছেন সবই সত্য। তরুই আমাকে নাম্বার দিয়ে বলেছে বিয়ে ভেঙে দিতে৷ কারণ আমরা একে অন্যকে বিয়ে করতে চাই। তোমাদের ডিভোর্সের আগে থেকেই আমাদের সম্পর্ক।’

ইশহাক সাহেব মুচকি হেসে বললেন, ‘তো এটা কি জটিল কোনো কথা? তোমার কেন মনে হয় এটা শুনেই আমি হার্ট আট্যাক করবো? আমি এই বয়সে যদি প্রেমে পড়ে বিয়ে করতে পারি। তুমি পড়তে পারো না?’

নির্জন বিস্মিত হয়ে বাবার দিকে তাকায়। আছমা চৌধুরী চা নিয়ে এসে বললেন, ‘চা নে।’

নির্জন বিস্ময় থেকে বের হয়ে চায়ের কাপ হাতে নিল। ইশহাক সাহেব এবার বললেন, ‘কিন্তু ওর দাদা বললেন তরু বলেছে তোমার সঙ্গে ওর কোনো সম্পর্ক নেই।’

– ‘ওর মোবাইল নিয়ে নিবে এই ভয়ে বলেছে। বিয়ের প্রস্তাব দিলে দরকারের সময় স্বীকার করবে।’

– ‘তাই না-কি?’

– ‘হ্যাঁ, আগামী শুক্রবারে ওর বিয়ের ফাইনাল কথা বলতে আসবে। এর আগেই প্রস্তাব দেয়া লাগবে।’

– ‘আচ্ছা আমি আগে না হয় আরিফুল সাহেবকে ঘটনাটা খুলে বলি।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

ইশহাক সাহেব কল দিলেন। রিসিভ হতেই তিনি সালাম বিয়ে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।’

– ‘বলো।’

– ‘আসলে ব্যাপারটা একটু জটিল। আমরা সহজভাবে নিলেই সহজ। তরুর বরপক্ষকে নির্জন এভাবে বলা ঠিক হয়নি। কিন্তু সে তরুকে পছন্দ করে, বিয়ে করতে চায়। আপনারা অনুমতি দিলে আমি রূপগঞ্জ আসবো। সামনাসামনি এ বিষয়ে কথা বলবো।’

‘কি বলো এসব, ইশহাক? এগুলো সম্ভব না। তরুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। নিজের ছেলেকে শাসন না করে তুমি বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছ।’ বলেই তিনি কল কেটে দিলেন। ইশহাক সাহেব মুচকি হেসে বললেন, ‘উনি কল কেটে দিয়েছেন, চিন্তার কিছু নেই। উনার কাছ থেকে তরুর মা-বাপ জেনে কি বলে দেখো। তরুকে মেসেজ দাও।’

– ‘হ্যাঁ, দিচ্ছি।’

নির্জন তরুকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিল, ‘তরু, আব্বু তোমার দাদার সঙ্গে আমাদের ব্যাপারে কথা বলেছেন। কিন্তু উনি কল কেটে দিলেন। তোমার আব্বা-আম্মা শুনে কি বলেন একটু জানাবে।’

তরুকে অফলাইন দেখায়। সে বাবাকে বললো ‘ও অনলাইনে নেই এলে দেখা যাক কি বলে।’

ইশহাক সাহেব বললেন, ‘দেখো কি বলে। তরুকে বলো পরিবারকে রাজি করাতে। আমাদের দিক থেকে তো কোনো প্রব্লেম নেই।’

– ‘আচ্ছা আমি তোমাকে জানাবো। আর আজ অফিসে যাচ্ছি না।’

‘ওকে’ বলে ইশহাক সাহেব নাশতা শেষে উঠে চলে গেলেন।

তরু রিপ্লাই দিল দুপুরে। নির্জন তখন গোসল করে বের হয়েছে। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে তরুর মেসেজ, ‘হ্যাঁ, দাদা জানিয়েছেন। ওরা কেউই ভালোভাবে নেয়নি। আফতাব স্যার প্রস্তাব দিয়ে ঝামেলা করেছে। ওকেই তাদের সবকিছু মিলিয়ে পছন্দ হয়ে গেছে। এখন আমি ভাবছি সরাসরি বলে দেবো তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবো না। পরে মোবাইল নিলে নিক।’

নির্জন রিপ্লাই দিল, ‘আচ্ছা বলে দাও।’

অফলাইন দেখায় তরুকে। নির্জন তার বাবাকে মেসেজ দিয়ে জানায় ওরাও রাজি না।
ইশহাক সাহেব অফিসেই বসে ফাইলপত্র দেখছিলেন। মেসেজটি দেখে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। পুরোদিন গেল এসব নিয়ে ভেবে। রাত আটটায় বাসায় ফিরেই নির্জনকে ডেকে আনলেন সিটিংরুমে। হুস্না এনে চা দিল। ইশহাক সাহেব বললেন, ‘তরু আর কিছু জানিয়েছে?’

– ‘না।’

– ‘তাহলে মোবাইল নিয়ে নিল না-কি?’

– ‘হতে পারে।’

– ‘মেয়ে যেহেতু রাজি, তুমি পালিয়েও আনতে পারো। আমার কোনো অসুবিধা নেই।’

নির্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘ও পালিয়ে আসবে না। প্রস্তাব দিতে সে নিজেই বলেছে।’

ইশহাক সাহেব খানিকক্ষণ চুপ থেকে ফোন ঘেটে তরুর মায়ের নাম্বার বের করলেন। ডায়রেক্ট কল দিলেন উনাকে। দুইবার রিং হতেই রিসিভ করলেন। ইশহাক সাহেব সালাম দিয়ে বললেন, ‘কেমন আছেন?’

– ‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি?’

– ‘হ্যাঁ, ভালো আছি। আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল, ফ্রি আছেন?’

– ‘বলুন।’

– ‘আপনার মেয়ে নির্জনের ব্যাপারে কিছু বলেছে?’

– ‘তা জেনে কি হবে ভাই৷ এগুলো তো সম্ভব না।’

– ‘কেন সম্ভব না?’

– ‘এসব পুরনো আলাপ করে কি হবে বলুন। জানেনই তো একটা ঝামেলা হয়েছে। তাছাড়া ভালো পাত্র পেয়েছি।’

– ‘শুনুন, পুরনো যে ঘটনা ঘটেছে। সেটার জন্য কি আপনারা বাদ দেয়ার কথা না-কি আমি? একটু ভেবে বলুন। পুরনো ঘটনায় নির্জনের বাপ কি বাজে কিছু করেছে? যার জন্য নির্জনও খারাপ হতে পারে ভাবছেন? উলটো আমি ভাবতে পারতাম কেয়া এরকম কাজ করেছে, তাহলে ওর ভাইঝিও এমন হতে পারে।’

– ‘না আমি সেটা বলছি না। তবুও তো একটা ঝামেলা..।’

– ‘শুনুন, আপনি মা। আশাকরি মেয়ের জন্য ভালোই চাইবেন। আপনার মেয়ে কি দোষ করছে যে সে তার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে না? নির্জনই বা কি দোষ করছে?’

– ‘এগুলো বাদ দিন ভাই৷ পাত্র আমরা সবাই মিলে-মিশে ঠিক করে নিয়েছি।’

– ‘কিন্ত যাকে বিয়ে দিবেন সে রাজি না। সেটা গুরুত্বপূর্ণ না বলুন? আপনি তো মা। একটি সন্তানের জন্য মা সব করতে পারে। অথচ সে পুরো জীবন যার সঙ্গে কাটাতে চায়। তার সঙ্গে বিয়ে না দিয়ে নিজেদের পছন্দমতো দেবেন? সে সুখী হবে? তরুও যদি তখন কেয়ার মতো করে? যদি জোর করে বিয়ে দেয়ার পর ওইখান থেকে নির্জনের সঙ্গে পালিয়ে আসে?’

– ‘আমার মেয়ে এমন করবে না। রাখছি এখন।’

– ‘শুনুন, তরু কিন্তু আপনাদের জানিয়েছে নির্জনকে পছন্দ করে। বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা?’

– ‘কি বুঝবো? মেয়েকে পড়তে দিয়েছিলাম, প্রেম করতে না।’

– ‘প্রেম যেহেতু করেই ফেলেছে বিয়ে দিলেই তো হয়ে যায়। তাছাড়া ভাবুন। মেয়ে কিন্তু এখনই পালিয়ে আসতে পারতো। আপনাদের ইজ্জতের কথা ভেবে আসেনি, তাই না? একটু ভেবে দেখবেন।’

– ‘ভালো থাকুন রাখছি।’

ফোন রেখে দিলেন নাহেরা বেগম। ইশহাক সাহেব ফোন নামিয়ে নির্জনকে বললেন, ‘ওর মাও তো রাজি না।’

নির্জন চুপ করে রইল।

___চলবে___
লেখা: জবরুল ইসলাম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে