প্রণয়ে প্রলয়ের সুর পর্ব-৩৫+৩৬

0
803

#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_৩৫
.
দরজার আর্তনাদ দু’জনই স্পষ্ট শুনতে পেল। কেউ ভেজানো পাল্লা ঠেলে ভেতরে এসেছে। তরু ফিসফিস করে বললো, ‘তাড়াতাড়ি সোফায় গিয়ে বসুন।’
নির্জন আস্তে-আস্তে সোফায় এসে বসে গেল। খানিক পরেই আরিফুল সাহেব রুমে ঢুকে বিছানায় তরু আর বাঁ পাশে সোফায় নির্জনকে দেখতে পেলেন। সালাম দিল সে।

– ‘ও নির্জন আসছো, গতকাল ঝামেলার মধ্যে এসে চলে গেলে।’

– ‘হ্যাঁ, তাই আজ এলাম। কাল তো আবার ঢাকায় চলে যাব।’

তরুর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘চা নাশতা কিছু দাও তাকে।’

তরু বিছানা থেকে উঠে গেল। আরিফুল সাহেব অন্যদিকে ফিরে পাঞ্জাবি খুলে আলনায় মেলে রাখছেন। নির্জন তরুর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘চা-নাশতা কিছু লাগবে না, তুমি বসো তরু।’

তরু মুখে কিছু না বলে দাঁত কটমট করে চোখ দিয়ে শাসিয়ে বের হয়ে চলে গেল। দীর্ঘ সময় পর ফিরে এলো চায়ের ট্রে হাতে। দরজার কাছে এসে কিছু কথা শুনতে পেল। নির্জন চেক বের করে বললো, ‘আব্বু আমাকে চেক সাইন করেই দিয়েছেন। প্রথমে বলেছিলেন ওই টাকাটাই নিয়ে আসতে। পরে বললেন নগদ টাকা নিয়ে গেলে বাজে দেখায় তাই চেক দিয়ে দিলেন।’

আরিফুল সাহেব কিছু বলার আগেই তরু ভেতরে গেল। বুঝতে পারছে চু*রির টাকা নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। টি-টেবিলে ট্রে রেখে দু’জনকে চা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নির্জন চেক হাতে ইতস্তত করে আরিফুল সাহেবকে বললো, ‘নিন, নিলে খুশি হবেন আব্বু।’

‘দাদা কীসের চেক, আর ঘরে কারও সঙ্গে আলোচনা না করে আশাকরি নিবে না।’ তরু দাদার দিকে তাকিয়ে কথাটি বললো।

তিনি স্মিত হেসে বললেন, ‘ওই তন্ময়ের থেকে উদ্ধার করা টাকা, ওটা তারা কেয়াকেই দিয়ে দিতে চাচ্ছে৷ তোর বাপও বাড়িতে নেই। কি করবো ভাবতেছি।’

– ‘ভাবাভাবির কিছু তো নেই। ওই টাকা তো গ্রহণ করার কোনো যুক্তি নেই। এটা ওদের টাকা৷ বরং ফুপু টাকা সরিয়ে অন্যায় করেছিল।’

নির্জন তরুর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ডিভোর্স হলেও তো টাকা পায় স্ত্রী তাই না?’

– ‘সেরকম ডিভোর্স এটা না।’

– ‘উনার চিকিৎসাও দরকার। তাই আব্বু দিয়েছেন।’

– ‘স্ত্রী হিসাবে দিয়েছেন কি? স্ত্রী হিসাবে দিলে গ্রহণ করা যায়। না হলে কেন এই টাকা নিব আমরা?’

আরিফুল সাহেব রূঢ় গলায় বললেন, ‘তরু তুই এত কথা বলছিস কেন? যা, ভাই-বোনকে নিয়ে পড়তে বস।’

তরু ইতস্তত করে চলে গেল। নির্জন চেক বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘তরু বলেন বা আমি। এই বয়সে আমরা অনেক বেশি সৎ, আত্মসম্মান, যুক্তি এসব নিয়েই থাকি। আপনি নিশ্চয় বুঝেন দুনিয়া এত ভেবেচিন্তে চলে না। এত ভাবলে শিক্ষিত, সম্মানি মানুষ ঘুস নিত না৷ কত অন্যায় কাজ করে মানুষ টাকার জন্য। এটা তো সেরকম কিছু না। আব্বু উনাকে দিয়েছেন। আপনাদেরও লজ্জা পাবার কিছু নেই। তাছাড়া কেউ জানবেও না।’

আরিফুল সাহেব বিভ্রান্ত হয়ে বললেন, ‘বুঝতে পারছি না নেয়াটা ঠিক হবে কি-না।’

– ‘টাকাটা নিন, আপনার মেয়ের কাজে আসবে। তন্ময়ও কিন্তু বেকার। চাইলে এই টাকা দিয়ে তাকেও কোনো ব্যবসায় লাগাতে পারবেন। আপনি দরকার হয় ঘরে কাউকে বইলেন না। উনাকে চিকিৎসা করান। একেবারে কম বয়স, পুরো ভবিষ্যৎ পড়ে আছে।’

আরিফুল সাহেব গাঁইগুঁই করতে শুরু করলেন। নির্জন তাড়া দিয়ে বললো, ‘নিন তো, টাকার আশা তো আব্বু ছেড়েই দিয়েছিলেন। যখন আমার থেকে জেনেছেন তন্ময় নিয়ে পালিয়েছে, তখনই বললেন ধরতে। নিন।’

আরিফুল সাহেব হাত বাড়িয়ে চেক নিলেন। নির্জন এরপর চায়ে চুমুক দিয়ে ভাবছে কেয়াকে দেখে যাবে কি-না। আবার মনে হলো মাথার ঠিক নেই। যদি তাকে দেখে গালাগাল করে অকারণ একটি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়বে। সে চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘তাহলে যাই এখন, কাল চলে যাব ঢাকায়।’

– ‘বসো, আমাদের সাথে রাতের খাবার খাও।’

– ‘জি না, এখন উঠবো।’

– ‘আচ্ছা চলো।’

আরিফুল সাহেব তাকে মাঠ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলেন।

*

নির্জন ঢাকায় চলে গেল। এরপর কেটে গেল দীর্ঘ একমাস। এতদিন নির্জন আর তরুর কেবল মুঠোফোনেই আলাপ হয়েছে। সরাসরি দেখা হয়নি।
আজ শুক্রবার, অফিস নেই। নির্জন এখন নিয়মিত অফিসে যায়। আছমা চৌধুরী তাকে সকাল নয়টায় ডেকে তুলে ফ্রেশ হয়ে নাশতার টেবিলে যেতে ডাকলেন। সে নাশতার টেবিলে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। বাবাকে চিন্তিত দেখে বললো, ‘আব্বু কোনো সমস্যা?’

আছমা চৌধুরী বললেন, ‘কেয়া কল দিয়েছিল।’

– ‘তাই না-কি? কাকে?’

– ‘তোর বাবাকে।’

নির্জন খানিকটা বুঝতে পারলো। তরু কয়েকদিন আগে বলেছে। কেয়া এখন পুরোপুরি সুস্থ-স্বাভাবিক। কিন্তু পূর্বের সবকিছু নিয়ে বেশ চিন্তিত সে। নির্জন আছমা চৌধুরীকে বললো, ‘কেন?’

– ‘দিয়ে বলেছে ভাইয়ের সাথে দেখা করতে চায়। উনি রূপগঞ্জ গেলে ভালো হয়।’

– ‘তাই না-কি, তা আব্বু কি বললে?’

ইশহাক সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘বলেছি যেতে পারবো না। তারপর বললো তাহলে সে একদিন আসতে চায়। তাও নিষেধ করলাম।’

– ‘তাহলে তো হলোই।’

আছমা চৌধুরী বললেন, ‘কিন্তু সে পরে আমাকেও কল দিয়েছে। একবার সবার সাথে সে দেখা করতে চায়। ভাইকে যেন বুঝাই।’

– ‘তাহলে আসুক একদিন। দেখো কি বলে।’

– ‘হ্যাঁ, সেটাই বলেছি। দেখি কেন আসতে চাচ্ছে।’

ইশহাক সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘কিন্তু কোনো লাভ নেই। নিজের ইজ্জত নিয়ে বাড়িতে থাকতে পারতো। যাইহোক তোমরা চাইলে আসতে বলতে পারো।’

আছমা চৌধুরী বললেন, ‘আমি নিজেও চাই না ওই মেয়েকে আর গ্রহণ করো। তারপরও নিজ থেকে আসতে চাচ্ছে। আমার সাথেও সুন্দর করে কথা বললো। এজন্য বলছি আসুক না।’

– ‘তুমি কীভাবে ওকে প্রশ্রয় দিচ্ছ সেটাই ভাবছি। দুই চোখে তো দেখতে পারতে না।’

– ‘তা ঠিক, কিন্তু কলে কথা শুনে একটু নরম হয়েছি আরকি।’

– ‘আচ্ছা বলে দাও আসতে। কিন্তু চেয়ারম্যান অফিসে নোটিশ গিয়েছে তার তিনমাস হতে এখনও বাকি। সে নিশ্চয় ফিরতে চাইবে। এজন্য না করেছি।’

আছমা চৌধুরী ইতস্তত করে বললেন, ‘তাহলে তো আরেক ঝামেলা।’

নির্জন চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, ‘থাক, এলে আব্বুর জন্য একটা এক্সট্রা ঝামেলা হবে। ফুপু কল দিয়ে বলো আসা লাগবে না। ফোনে কথা বলুক। দরকার হয় সবার সঙ্গে গ্রুপ কলে কথা বলুক।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমি বলে দিব।’

– ‘এখন বলে দাও, ছুটির দিন আছে।’

আছমা চৌধুরী চেয়ারে বসে কল দিলেন। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই জানিয়ে দিলেন এখানে আসতে হবে না। কলে কথা বলতে পারো। তারপর ফোন রেখে দিল কেয়া। সঙ্গে সঙ্গেই টেবিলে থাকা ইশহাক সাহেবের ফোনটি বেজে উঠলো, তাকিয়ে দেখলেন কেয়ার নাম্বার। তিনি টেবিলে রেখেই রিসিভ করে লাউডস্পিকারে দিলেন। ওপাশ থেকে কেয়া সালাম দিল। ইশহাক সাহেব জবাব দিয়ে বললেন, ‘আমি নাশতার টেবিলে, ফোন লাইডে আছে। এখানে আমার ছেলে আর বোনও আছে। তোমার কি বলার বলো।’

ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস ভেসে এলো। ক্ষীণ সময় পর কেয়া ইতস্তত করে বললো, ‘আমি তো তোমার কাছে কল দিয়েছি, ব্যক্তিগত কথাই বলবো। লাইডে না দিলে হয় না?’

– ‘তোমার সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো কথা আর নেই। আনুষ্ঠানিকভাবেই বলো।’

আরও খানিকক্ষণ চুপ থেকে কেয়া বললো, ‘সবাইই শুনছেন তাই না?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তাহলে সবার উদ্দেশ্যেই বলি, নির্জন আর আপু শুনছেন?’

আছমা চৌধুরী বললেন, ‘হ্যাঁ বলো।’

– ‘আমি আসলে এই কল যে দিয়েছি সেটাও নির্লজ্জের মতো লাগছে তাই না? যাইহোক, আমি আসলে আপনাদের সবার সাথে অন্যায় করেছি। অন্যায়টা যখন করেছি তখন যে বুঝিনি তা না, বুঝেছি। এজন্য সারাক্ষণ অস্থিরতায় থাকতাম। রিয়েক্ট করতাম। যাইহোক, সেসব বাদ দেই। আমি আপনাদের সকলের কাছে ক্ষমা চাইতেই কল দিয়েছি।’

আছমা চৌধুরী বললেন, ‘আমরাও মনে থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছি। তোমার পুরো ভবিষ্যৎ পড়ে আছে৷ দোয়া করি ভালো হোক। শুনেছিলাম তুমি সুস্থ হলে তন্ময়ের সাথে বিয়ে হবে। সেটা কি কিছু ঠিকঠাক হয়েছে?’

কেয়া দীর্ঘ সময় চুপ থেকে বললো, ‘না করে দিয়েছি, ওকে আমি বিয়ে করবো না।’

– ‘তা কেন?’

– ‘এমনিই, আচ্ছা আপু রাখছি। আপনার ভাইয়ের সাথে কথা বলার ছিল। সেই সুযোগ পেলাম না।’

আছমা চৌধুরী ইশহাক সাহেবের দিকে তাকালেন। তিনি কোনো কথা না বলে কেটে দিলেন কল। তার মোবাইল নিয়ে নাশতার টেবিল থেকে রুমে এলেন। এসে দীর্ঘ সময় পায়চারি করে বিছানায় বসে কল দিলেন কেয়াকে। সঙ্গে সঙ্গে কেয়া রিসিভ করলো, ইশহাক সাহেব তাড়া দিয়ে বললেন, ‘বলো কি বলতে চাও।’

– ‘আমার সঙ্গে এখন কথাই বলতে চাচ্ছ না। এত ঘৃণা। তাহলে শাস্তি না দিয়ে চুরির টাকা উলটো ফিরিয়ে দিয়েছো কেন?’

– ‘এমনিই দিয়েছি।’

– ‘এমনিই না, তুমি এখনও আমাকে ভালোবাসো।’

– ‘টাকা দিয়েছি তন্ময়ের জন্য। দু’জন মিলেই তো চুরি করেছিলে। হয়তো ব্যবসা-ট্যাবসা কিছু করবে। তাই দিলাম। ওকে বিয়ে করো। টাকা কোনো কাজে লাগাও।’

– ‘ওকে আমি বিয়ে করবো না।’

– ‘কেন?’

– ‘যে ছেলে আমাকে রেখে টাকা নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল তাকে বিয়ে করবো? আমি অনেক ভুল করেছি ইশহাক। তোমার সঙ্গে অন্যায় করেছি। আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও। আমি তোমার স্ত্রীর পরিচয় নিয়েই সারাজীবন কাটাতে চাই। তোমাকে রেখে তন্ময়ের মতো বাটপারকে ভালোবাসা আমার ভুল ছিল।’

– ‘কেয়া যা ভেঙে গেছে, তা জোড়া লাগানো সহজ না। তুমি এসব বিষয় নিয়ে আর কল না দিলে খুশি হব। তন্ময়কে না করলে অন্যকোনো ভালো ছেলে দেখে বিয়ে করে নিয়ো।’

– ‘না, তুমি আমাকে গ্রহণ না করলে আমি সারাজীবন একা থাকবো। আমি এতকিছু করার পরও যে মানুষটা চিকিৎসার জন্য টাকা দেয়। আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে। কাউকে আমার নামে বদনাম বলেনি। এমন একটা মানুষকে রেখে আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না।’

কেয়ার শেষের কথাগুলো কান্নার মতো শুনালো। ইশহাক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘সম্ভব না, ফিল্মের ডায়লগ আমাকে দেবে না। তোমাকে আর আমি ফিরিয়ে আনবো না এটাই ফাইনাল। এখন রাখছি।’

– ‘শেষ কথা শোনো, তুমি আমাকে ফিরিয়ে নেয়ার আগপর্যন্ত আমি অপেক্ষায় থাকবো। বিয়ে বসবো না।’

‘কিছুদিন পর অটোমেটিক আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। নব্বুই দিন হতে আর বেশি বাকি নেই, রাখলাম’ বলে ইশহাক সাহেব কল কেটে দিলেন।

*

কেয়া ফোন রেখে দিল। পাশেই বসা ছিলেন নাহেরা বেগম। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে চলে গেলেন আরিফুল সাহেবের রুমে। তাকে দেখেই আসলাম সাহেব বললেন, ‘মেনেছে?’

– ‘না, কেঁদে-কুটেও বললো তবুও সে ফিরিয়ে নিবে না।’

আরিফুল সাহেব রূঢ় গলায় বললেন, ‘মানবে না জানি, তরু আবার এখন ওর মাথা নষ্ট করছে। সুস্থ হয়েছে, ব্যস তন্ময়ের কাছে কাজি ডেকে বিয়ে পড়িয়ে দেবো। তা না, নতুন নাটক শুরু হয়েছে।’

আসলাম সাহেব বললেন, ‘ওর নাটকে থাকলে হবে না। তন্ময়কেই বিয়ে করুক। ওর জন্য এতকিছু করলো, এখন কি হয়েছে।’

নাহেরা বেগম বললেন, ‘তন্ময়কে না-কি বিয়ে করবেই না আর।’

– ‘তাহলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাক। আর তরুকে বলবি চুপ থাকতে। ওর কারণে কেয়া আরও প্রশ্রয় পেয়েছে। এখন কি হলো? কান্নাকাটি করার পরও তো মানলো না।’

আরিফুল সাহেব বললেন, ‘মাফ চাওয়ার পরও মানলো না ওদের সাথে আর যোগাযোগই রাখার দরকার নেই। কেয়ার বিয়ে তন্ময়ের সাথেই হবে।’

– ‘কিন্তু ও তো কোনোভাবেই রাজি না তন্ময়কে বিয়ে করতে।’

রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘রাজি না হইলে ওই পোলার লগে নষ্টামি করছিল কেন? ওর রাজির চিন্তা করলে কি হইব?’

আসলাম সাহেব স্ত্রীকে বললেন, ‘বুঝাও ওকে। ওর যা মন চায় তা হলে হবে না।’

নাহেরা বেগম রান্নাঘরে চলে গেলেন। তরু রুম থেকে সবকিছু শুনে কেয়ার কাছে গিয়ে বসলো।

– ‘এখন কি করতে চাচ্ছ ফুপু?’

কেয়া থমথমে মুখে বসে আছে। তার সাময়িক মানসিক সমস্যা দূর হয়েছে। তবুও এখনও মাঝে-মধ্যে মাথা ঠিক থাকে না। তরু তাড়া দিয়ে বললো, ‘ভেবে-চিন্তে দেখো। ইশহাক সাহেব মানবেন না আর।’

কেয়া ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তন্ময়কে আমি বিয়ে করবো না তরু।’

– ‘তাহলে?’

– ‘দরকার হয় একা থাকবো।’

– ‘ওরা তোমাকে বাড়িতে শান্তিতে থাকতে দেবে?’

কেয়া তরুর হাত ধরে বললো, ‘কোনো জব-টব পেলে হত। কিন্তু ঢাকায় কাকে বলবো?’

– ‘কি বলো এসব?’

– ‘তরু আমার এই মুহুূর্তে বিয়ে করতে মন চাইছে না। আমার সময় দরকার। এদিকে বাড়িতে নানান কথা শুনে মাথা ঠিক থাকছে না।’

নাহেরা বেগম দরজার কাছে এসে তরুর দিকে দাঁত কটমট করে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই এখান থেকে যা তো।’

তরু উঠে চলে গেল। নিজের রুমে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে নির্জনের মেসেজ।

– ‘শুভ সকাল। কি করছো? তোমার ফুপু না-কি তন্ময়কে বিয়ে করতে চান না আর।’

তরু রিপ্লাই দিল, ‘হ্যাঁ, চায় না।’

– ‘এখন কি করবে?’

তরু কি বলবে ভাবছে। সে কখনওই ফুপুর পক্ষ নিয়ে কিছু বলতে চায় না। শুধু বললো, ‘সে তো এখন অনুতপ্ত। ফুপা ফিরিয়ে না নিলে আপাতত বিয়ে করতে চায় না। এদিকে ঘর থেকে চাপ দিচ্ছে তন্ময়কে বিয়ে করতে।’

– ‘আব্বু ফিরিয়ে আনবে কীভাবে? তা কি সম্ভব? যাইহোক এসব বাদ দাও। কথা হলো তন্ময়কে বিয়ে না করলে অন্য কাউকে করুক।’

– ‘তারজন্য তো সময় দরকার। তা পাচ্ছে না তো। মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছে সবাই। একটু আগে বললো কোনো জব পেলে বাড়ি থেকে চলে যেত।’

– ‘তাতে কি লাভ? বিয়ে করবে না?’

– ‘তা হয়তো করবে, তন্ময়কেও করতে পারে। এরজন্য বাড়ি থেকে সরলে ভালোই হতো। মাস ছয়েক যাক। ভাবুক। অন্য ছেলেকেও তখন বিয়ে করতে পারে।’

– ‘ও বুঝেছি, তা ঠিক।’

– ‘কোনো জব দিতে পারবেন ওকে?’

– ‘কি বলো! তোমার পরিবার শুনলে কি বলবে?’

– ‘ওরা জানবে না তো কে জব দিয়েছে। ফুপু জাস্ট ঠিকানায় চলে যাবে।’

– ‘পালিয়ে?’

– ‘না, জব পেলে বুঝিয়ে বলে যেতে পারবে। সমস্যা হবে না।’

– ‘আচ্ছা দেখবো আমি।’

– ‘ধন্যবাদ। কিন্তু নির্জন, আমাদের ব্যাপারটা আবার জটিল হয়ে গেল মনে হচ্ছে।’

– ‘হ্যাঁ, তাইতো লাগছে। আব্বু পুনরায় না মানায় তোমার পরিবার নিশ্চয় নাখোশ।’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘যাইহোক, চিন্তা করো না। আমি আবার গ্রামে যাব। দু’জন রাতে মাঠে দেখা করবো। রতনকে কল দিয়ে বলবো এবার একা এসে লাইট না মেরে পঞ্চায়েত নিয়ে আয়।’

তরু ফিক করে হেসে বললো, ‘ওরা এসে আগে আপনাকে মাইর দেবে। তারপর না বিয়ে? যাইহোক, পরে কথা হবে। বাড়িতে সবার আজ মাথা গরম।’

__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_৩৬
.
সপ্তাহ খানেক পর একদিন সন্ধ্যায় তরু পড়তে বসেছে। তখনই মেসেজ পেল সে। নির্জন কেয়ার জন্য একটি জবের ব্যবস্থা করেছে। কথায় কথায় ডিটেইলস জেনে নিল তরু। তারপর ফুপুকে সংবাদ দিতে রান্নাঘরে গেল। কেয়া এখন ঘরের কাজে নাহেরা বেগমকে সহযোগিতা করে। তবুও পারিপার্শ্বিক চাপে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। তরু গিয়ে ডেকে বারান্দায় আনলো তাকে। জবের ব্যাপারে সবকিছু খুলে বললো। শুনে কেয়া যেন শুকনো গলায় ঠান্ডা জল পেল। বাড়ির সবাইকে বললো একজন বান্ধবী জবটি দেখে দিয়েছে। কিন্তু কেউই প্রথমে রাজি হয়নি। তবুও সে একমতো বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দুইদিনের ভেতরেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেল ঢাকায়। নতুনভাবে শুরু করলো জীবন। জব দিলেও নির্জন একদিনও কেয়ার সঙ্গে দেখা কিংবা যোগাযোগ করলো না।

এদিকে মাসের পর মাস চলে গেল কেয়াকে আর বাড়িতে আনা গেল না। একদিন তন্ময়ের মা এসে আরিফুল সাহেবকে জানালেন কেয়া তো স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে বিয়ে করবে না৷ এখন তো আর কিছু করার নেই। তিনি ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে দিতে চান। তারা শেষবার কেয়ার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলেন। নাহেরা, রাজিয়া খাতুন সহ সবাই ফোনে কথা বললেন। কিন্তু কেয়া তন্ময়কে বিয়ে করতে রাজি হলো না। তাই বাধ্য হয়ে মুক্তি দিতে হলো তন্ময়কে।

*
পরিবারের একটি মেয়ে চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে গেল। এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ওর। ঢাকা শহরে একা থাকে। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা তরুর পরিবারকে দিনকে দিন আরও বেশি রক্ষণশীল করে তুলেছে। তরুকে বিয়ে দিলেই যেন শান্তি। সবার গলায় কাঁটার মতো যেন বিঁধে আছে ও। এই অবস্থায় খানপুর কলেজে একজন নতুন ইংলিশ স্যার এলেন। নাম আফতাব আলম। অবিবাহিত ইয়াং শিক্ষক। ভদ্রলোকের পরিবার বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছে। এই মাহেন্দ্রক্ষণে কলেজে তরুকে দেখতে পান তিনি। দেখে ভীষণ ভালো লেগে যায়। তরুর ঠিকানা যোগাড় করে মা-বাবাকে দিয়ে বিয়ের আলাপ দেন।
প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন সবাই। তরুর কোনো যুক্তিই টিকে না। পড়ালেখা করতে চায়, বিয়ে করবে না বললে, পরিবার বললো ছেলে নিজেই শিক্ষক। সে পড়ালেখা করাবে। আরিফুল এবং আসলাম সাহেব ছেলের বাড়ি গিয়েও দেখে পছন্দ করলেন। অবস্থা বেশ ভালো। ছিমছাম পরিবার। সবাই উচ্চশিক্ষিত। টাকা-পয়সার কোনো অভাব নেই। পরিবারের সবাই বসে সিদ্ধান্ত একটা নিয়ে নিলেন। আজ এক শুক্রবার, আগামী শুক্রবারে আফতাব আলমের পরিবার আসুক। সেদিনই বিয়ের কথাবার্তা ফাইনাল করে যাক। সবকিছু মিলিয়ে তরু পুনরায় বিপদে পড়ে গেল। দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম। এই বিয়ে সে এখন কীভাবে ফিরিয়ে দেবে? ছেলে দেখতে-শুনতে ভালো, শিক্ষিত। নির্জনের মতো বড়লোকের ছেলে না হলেও যথেষ্ট আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবার। মা-বাবা সবাই মহানন্দে আছেন। তরু পুরোদিন এটা-ওটা বলে কারও কাছে নিজের কথা বসাতে পারলো না। এমন একটি প্রস্তাব তারা ফিরিয়ে দেয়ার মতো বোকা না।

রাতের খাবার খেয়ে এসে ঘুমানোর আগে মোবাইল হাতে নিল তরু। ঠান্ডা মাথায় নির্জনের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আজকাল রোজ রাতেই তাদের দীর্ঘ চ্যাট হয়। তরু আপনি থেকে তুমিতেও পুরোপুরি চলে এসেছে এখন। ডাটা অন করতেই নির্জনের বেশ কয়েকটি মেসেজ এলো। সেগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে সে বললো, ‘নির্জন, ফ্রি আছো এখন? খাওয়া-দাওয়া করেছো?’

সিন হলো না। তরু রোজকার মতো কল দিল। দুইবার রিং হতেই নির্জন কেটে দিয়ে আগের মেসেজের রিপ্লাই দিল, ‘তোমার জন্য তো সব সময়ই ফ্রি ম্যাডাম। আর খাওয়া-দাওয়াও শেষ। এখন প্রেমের সময়।’

– ‘শুনুন, কিছু জরুরি কথা বলবো।’

– ‘বলো।’

– ‘তোমাকে আসলে একটা বিষয় বলিনি। ভেবেছিলাম হয়তো এমনিই ভেঙে যেতে পারে। তোমাকে বললে অকারণ চিন্তা করে খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে দেবে।’

– ‘আরে কি হয়েছে বলো। কোনো সমস্যা?’

– ‘আমাদের কলেজের এক স্যার। ক্লাসে গেলে আমার দিকে “হা” করে তাকিয়ে থাকতো। সে কয়েকদিন আগে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমি তোমাকে না বলে চেষ্টা করছিলাম ভেঙে দিতে। কিন্তু সম্ভব হয়নি। ওরা সবাই পাগল হয়ে গেছে। এবার আর বিয়ে ভেঙে দেয়া সম্ভব না।’

– ‘আশ্চর্য, ভেঙে দেয়া সম্ভব না মানে?’

– ‘মানে বুঝা যায় তো না-কি? এবার যে আগের মতো বিয়ে ভেঙে দেয়া যাবে না তা আমি বুঝতেই পারছি।’

– ‘তুমি এত অবলীলায় এগুলো কীভাবে বলছো তরু? ভেঙে না দিতে পারলে আমি এখনই আসি। তোমাকে পালিয়ে নিয়ে আসবো। কি বলো এসব! ভেঙে দেবে না বলে বিয়ে বসে যাবে না-কি?’

– ‘এই ঠান্ডা হও তো আগে। আমি কি বিয়ে বসতে বলেছি? আগের মতো ভেঙে দেয়া যাবে না। তোমাকেই সামনে আসতে হবে। কিছু করার নেই। এখন বলো কি করবো? আমি কি ঘরে বলে দেবো তোমাকে পছন্দ করি?’

– ‘পারবে বলতে?’

– ‘সেটাই তো, বলতেও তো লজ্জা লাগে, ভয় লাগে।’

– ‘তুমি আমাকে রেখে এত প্রেশার নাও কেন বলো তো? তোমার কিচ্ছু বলা লাগবে না। আমি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দেই।’

– ‘তোমার পরিবার রাজি হবে?’

– ‘আব্বু বা ফুপুকে বুঝিয়ে বলে দেখি।’

– ‘কিন্তু এক সপ্তাহ সময়। ওরা শুক্রবারে এসে বিয়ের কথা ফাইনাল করবে। বুঝতেই পারছো একবার ফাইনাল হলে ভেঙে দেয়া কঠিন।’

– ‘হ্যাঁ, সময়ও তো কম। দেখি ফুপুর সাথে কথা বলে।’

– ‘নির্জন শোনো, আঙ্কেলের হার্টে প্রব্লেম। তাই একবার না করলে জোড়াজুড়িও করা যাবে না। আপাতত একটি কাজ করো। আমি স্যারের নাম্বার দেই। তুমি উনাকে কল দিয়ে আমাদের কথা বলে দাও। আমার তো স্যার। কেমন লজ্জা লাগবে সরাসরি বলতে। তাছাড়া বিশ্বাসও না করতে পারে।’

– ‘কিন্তু তোমার স্যার যদি আমাকেও বিশ্বাস না করে?’

– ‘তাহলে কি করবো বলো তো?’

– ‘আচ্ছা কথা বলে দেখি নাম্বার দাও।’

তরুকে ওর মা নাম্বার দিয়েছিলেন আফতাব আলমের সঙ্গে কথা বলতে। সে কথা বলেনি। নির্জনকে নাম্বার পাঠিয়ে দিয়ে বললো, ‘এখনই কল দিয়ে কথা বলো। অচেনা নাম্বার দেখে সে আমার নাম্বার ভেবে রিসিভ করবে।’

– ‘ওকে জানাচ্ছি কথা বলে।’

নির্জন কল দিল। প্রথম রিং হতেই রিসিভ করলো আফতাব আলম। নির্জন সালাম দিয়ে বললো, ‘আপনি কি খানপুর কলেজের স্যার?’

ওপাশ থেকে গম্ভীর গলায় বললো, ‘হ্যাঁ, আপনি কে বলছেন?’

– ‘আমি আপনার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা বলতে কল দিয়েছি। আসলে আপনি তরুকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন তাই না?’

– ‘তা জেনে আপনার কি?’

– ‘তরু আপনার নাম্বার আমাকে দিয়েছে। আমরা একে অন্যকে ভালোবাসি।’

– ‘তাই না-কি? তা এখন আমি কি করবো?’

– ‘বিয়েটা না করলে খুশি হব। তরু আপনাকে স্যার হিসাবে সম্মান করে। তাই নিজে বলতে পারছে না। আমাকে দিয়ে বলিয়েছে।’

– ‘আপনাকে আমি বিশ্বাস করবো কেন?’

– ‘কারণ তরু আমাকে নাম্বার না দিলে পেলাম কোথায়? আপনার বিশ্বাস না হলে আরও অনেক উপায় আছে করানোর। বিশ্বাস হলে কি বিয়ে ভেঙে দেবেন?’

‘ফোন রাখেন তো। বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি। দুই পরিবার মিলে-মিশে বিয়ে হবে। আপনি প্রেম-পিরিতের আলাপ করছেন কল দিয়ে’ বলেই কেটে দিল আফতাব আলম।

নির্জন হতাশ হয়ে তরুকে পুরো বিষয় জানালো। তারপর দু’জন কথা বলে সিদ্ধান্ত নিল, নির্জন বিয়ের প্রস্তাব দেবে। কিন্তু ঝামেলাটা লেগে গেল তার আগেই। আফতাব আলম সোজা কল দিয়ে দিয়েছে আসলাম সাহেবকে। বিস্তারিত খুলে বলেছে। এসব বিয়ের আগের সম্পর্ক নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই। তবে মেয়েকে আগেই একটু বুঝান, ওই ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে এখনই বাদ দিতে বলুন।
আসলাম সাহেব সবকিছু শুনে নাম্বারটি চাইলেন। আফতাব আলম নাম্বার দিল। তিনি ঘাটাঘাটি করে পেয়ে গেলেন এটা নির্জনের নাম্বার। রেগে আগুন হয়ে গেল তাদের পুরো পরিবার। সে কেন তরুর বিয়ে ভেঙে দিতে এমন কাজ করবে? আরিফুল সাহেব বললেন ইশহাককে জানাই। তারা না খুব ভালো মানুষ। এখন জিজ্ঞেস করি অন্যের মেয়ের বিয়ে ভেঙে দেয়ার জন্য মিথ্যেচার করা কেমন ভালো মানুষের কাজ।
__চলবে…..
লেখা: জবরুল ইসলাম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে