#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_৩৩
.
গ্লাসে জল ঢেলে বাড়িয়ে দিলেন নাহেরা বেগম। দাদার দিকে তাকিয়ে থেকেই এক চুমুকে খেয়ে নিল তরু। দীর্ঘ সময় নির্জনের সঙ্গে আরিফুল সাহেব ফোনে কথা বললেন। কেউই পুরোপুরি কিছু বুঝলো না। ফোন রাখতেই আসলাম সাহেব বললেন, ‘খাওয়া রেখে ওর সাথে আবার এত কথা কীসের?’
– ‘জরুরি কথাই বলেছে। আমাদের এখন সতর্ক হতে হবে। তন্ময়কে ধরেছে ওরা।’
আসলাম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ‘তাই না-কি! কীভাবে?’
– ‘তরুর মোবাইলে না-কি ভিডিয়ো ছাড়বে। কেয়া যে টাকা দিয়েছে সেটার প্রমাণ।’
– ‘তাহলে তো কেয়া ফাঁসবে আব্বা।’
– ‘হ্যাঁ এগুলোই বললো নির্জন। সে বলছে কেয়া যদি বলে তন্ময় তাকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নিয়েছে তাহলে সে বেঁচে যাবে। কারণ তন্ময়ের ফোনে ওর ভিডিয়ো, ছবি পেয়েছিল পুলিশ। আমি তখন বললাম কেয়ার তো এখন মাথার ঠিক নাই। ও এসব বলবে কীভাবে। তখন বললো তাতেও সমস্যা নেই। আমরা যেন বলি কেয়া সুস্থ থাকতে বলেছে, তন্ময় ভালোবাসার নামে তাকে হোটেলে নিয়েছে। এরপর এসব ভিডিয়ো করে ইশহাককে পাঠাবে বলে টাকা নিয়েছে। আর যেহেতু ভিডিয়ো তন্ময়ের মোবাইলে পাওয়া গেছে এবং টাকা নেয়ার ফুটেজও আছে প্রব্লেম হবে না।’
– ‘বুঝেছি, তাতে আমাদের কি এখানে? তন্ময় পুলিশে যাবে, তাদের টাকা তারা পাবে।’
– ‘সেটাই বললো নির্জন, আমাদের ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নিতে বলেছে।’
– ‘কি সিদ্ধান্ত?’
– ‘সে না-কি তন্ময়কে পুলিশে না দিয়ে ভয় দেখালেই হয়ে যাবে। আমরা চাইলে তন্ময়কে ভয় দেখিয়ে আমাদের কাছে দিয়ে দেবে। তখন পঞ্চায়েত নিয়ে কথা বলে কেয়ার সঙ্গে বিয়ে দিতে পারবো।’
– ‘সেটা কীভাবে হবে?’
– ‘পুলিশে দিয়ে কাজ হবে না, গ্রামের পঞ্চায়েতদের কাছে এলে ভালো হবে।’
– ‘কীভাবে?’
– ‘গ্রামে ছেলে-মেয়েকে একসঙ্গে পেলে বিচার হয় না? ধরে বিয়ে পড়িয়ে দেয় না? এখানে তো উলটো সে আমার মেয়ের সংসার ভেঙেছে, তাই না? পঞ্চায়েত কি আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ দেখবে না? প্রমাণ আছে তন্ময় সবকিছু করেছে।’
– ‘বুঝেছি, তরু খেয়ে দেখা তো ভিডিয়োটা।’
খাওয়া শেষে তরু গিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে নির্জন আরেকটি ভিডিয়ো পাঠিয়েছে। তন্ময় জেলে। তার ঠোঁটের কোণে রক্ত। নির্জন তার সামনে গিয়ে বসে বলছে, ‘এখন বল তুই কি করবি। ব্ল্যাকমেইলের জন্য হাজতে থাকতে চাস, না-কি আমার কথা শুনবি?’
– ‘আমি তো তোমাদের টাকা দিয়ে দিয়েছি। তাছাড়া আমি ব্ল্যাকমেইল করিনি।’
– ‘তুই আরেকজনের সংসার ভাঙবি৷ টাকা নিয়ে পালাবি। সব কি তোর ইচ্ছামতো হবে? তুই মেয়েটির যে জীবন নষ্ট করেছিস তার কি হবে? হয় বিয়ে করবি না হয় এখানে জেলে পচে মর। ব্ল্যাকমেইল না শুধু, তোকে আরও অনেক মামলা দিয়ে এখানে ঢুকিয়ে রাখবো।’
তন্ময় চুপ করে রইল। নির্জন ওর কপালে ধাক্কা দিয়ে মাথা তুলে ফিসফিস করে বললো, ‘তোরা ফকিন্নির পুতেদের কনফিডেন্স একটু বেশি। বলদ তুই জানিস তোকে আমি কতকিছু করতে পারি? আমার ফ্যামিলি না হয়ে অন্যকোনো ফ্যামিলি হলে তোদের কি করতো? টাকা থাকলে এদেশে যা ইচ্ছা করা যায় জানিস? পাকনামি করে কত বড়ো কাজ করেছিস এসব ভেবেছিস কখনও? এগুলোকে সাহস বলে না, এগুলো হচ্ছে অজ্ঞতা। কেউ ধর জীব-জন্তুর ব্যাপারে কোনো আইডিয়া নেই তাই জঙ্গলে ঢুকে গেল৷ এটা কি সাহসের কিছু? তুই কি জানিস একজন ইশহাক চৌধুরী চাইলে তোকে কি করতে পারে?’
– ‘আমার সঙ্গেও তো কেয়া অন্যায় করেছে। আমার সাথে প্রেম করে বিয়ে করেছে তোমার আব্বাকে। আমার সঙ্গে কি অন্যায় হয়নি?’
– ‘ওয়েট, ওয়েট, তুই কি ভাবছিস তোকে এখন শাস্তি দেয়া হচ্ছে? মোটেও না। তুই টাকা নিয়েছিস। তাই ধরে আনা হয়েছে। আর কেয়াকে তুই যদি ভালোই বাসিস তাহলে এখন বিয়ে কর। হয়েই তো গেল।’
শফিক সাহেব তখন মোবাইল নিয়ে এসে বললেন, ‘ওর মা কল দিয়েছে নির্জন সাহেব। কথা বলুন।’
নির্জন ফোন এনে কানে লাগিয়ে বললো, ‘বলুন আন্টি কি করবেন। সব তো বুঝেছেন? ভিডিয়ো সহ সবকিছু আছে। একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করছে। সে এখন পাগল। সংসার ভেঙেছে আমার বাবার। টাকা নিয়েও পালিয়েছে। ছেলের মায়া থাকলে বরিশাল থেকে এখন রূপগঞ্জ যান৷ ওদের সঙ্গে সমঝোতা করুন। সেটাই ভালো হবে।’
ওপাশ থেকে মতিয়া বেগম ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। নির্জন ফোন দিল তন্ময়কে। দীর্ঘ সময় কথা হলো তাদের। তন্ময় শেষে রাজি হয়ে গেল। সবকিছুই মানবে, শুধু তাকে যেন এখান থেকে বের করা হয়।
ভিডিয়োটা এ পর্যন্ত। তরু মোবাইল নিয়ে ছুটে গেল খাবার টেবিলে।
– ‘তন্ময়ের ভিডিয়ো পাঠিয়েছেন।’
সবাই আগ্রহ নিয়ে দেখতে চাইলেন। তরু প্রথমে টাকার ফুটেজ দেখিয়ে পরে আজকের ভিডিয়ো দেখায়। আরিফুল সাহেবের চোখ-মুখ ঝলমল করে উঠলো। ভিডিয়ো থেকে চোখ সরিয়ে বললেন, ‘তাহলে তো বাঁচা গেল। কেয়াকে বিয়ে করুক সে৷ নির্জনকে বলি ওকে গ্রামে নিয়ে আসতে অথবা আমরা যাই।’
তরু তখন মোবাইল নামিয়ে বললো, ‘কিন্তু ওর কাছে বিয়ে দেয়া কি ঠিক হবে? সে তো ভালো না। এখন বিয়েটাও বাধ্য হয়ে করবে।’
আসলাম সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘সবকিছুতে কথা বলবি না। ও বিয়ে না করলে কেয়াকে কি ঘরে রাখবো?’
নাহেরা বেগম স্বামীর কথায় একমত হয়ে বললেন, ‘তাছাড়া কেয়াও তন্ময়কে পছন্দ করে।’
– ‘ফুপুর আগে চিকিৎসা দরকার। এরপর বিয়ে দাও।’
আরিফুল সাহেব ক্ষীণ সময় ভেবে বললেন, ‘আচ্ছা তা পরে দেখা যাবে। আগে পঞ্চায়েতের মানুষ ডাকি। তন্ময় আর ওর মাও আসুক। কথা বলে রেখে দিলে হবে।’
আসলাম সাহেব বললাম, ‘তখন যদি তন্ময় আবার পালিয়ে যায়?’
– ‘গেলে তার মা’কে ধরবে পঞ্চায়েত। দরকার হয় লিখিত রাখবে। ওর বাপের বাড়ির ঠিকানাও নির্জনের কাছে আছে।’
আসলাম সাহেব মাথা নেড়ে বললেন, ‘তাহলে নির্জনের সাথে কথা বলো। সে তন্ময় আর ওর অভিভাবকদের নিয়ে আসুক।
আরিফুল সাহেব সম্মত হলেন।
*
পরেরদিন তরু কলেজে গেল না। নির্জন আসবে এই খবরটা তার মনের ভেতর উৎসবের মতো আমেজ তৈরি করেছে।
আরিফুল সাহেব খানপুর খবর নিয়ে জানলেন তন্ময়দের বাড়ি বিক্রি হয়নি।
পাশের বাড়ির ওরা রাখবে বলে শুধু মুখে কথা হয়েছে। ওরা টাকাও দেয়নি, কাগজপত্রও হয়নি। ব্যাপারটা স্বস্তি দিল তাদের।
তন্ময়ের মা আর মামা আগেই চলে এসেছেন। নির্জনের থেকে নাম্বার নিয়ে ওরাই আরিফুল সাহেবের সাথে যোগাযোগ করলো। রূপগঞ্জ কোথায়, কোন রাস্তা দিয়ে তাদের বাড়ি যেতে হয় জেনে এসে পৌঁছে গেল বিকেল চারটার দিকে। তাদের কথাবার্তা পরিষ্কার। তন্ময়ের এরকম কর্মে তার মা এবং মামা সবাই ক্ষুব্ধ। এখন সুন্দরভাবে সমাধান চান। ধীরে ধীরে মুরব্বিরাও এলেন। খবর দিয়ে আনা হলো খানপুর তন্ময়দের পাড়া-পড়শীদেরও।
নির্জন এলো পাঁচটায়। গাড়ি তরুদের বাড়ির উঠানে এলো। তন্ময়কে নিয়ে নামলো সে। ড্রাইভার পুনরায় ঢাকায় ফিরে যেতে হবে বলে পাঠিয়ে দিল সে। কিন্তু তরু তাকে দেখতে পেল না। ততক্ষণে দাদার রুমে আর বারান্দায় বেশ মানুষ চলে এসেছেন। কথাবার্তা শেষ হলো এশার আজানের আগে। তন্ময়ের জন্য কোনো ফাঁকফোকর থাকলো না। নির্জন ভিডিয়ো, হোটেল, বাসার ঘটনা, টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া সব বুঝিয়ে বললো। তন্ময়ও স্বীকার করে নিল সবকিছু। খানপুরের মেম্বারও ছিলেন। সবার সামনে বলেছে কেয়াকে বিয়ে করবে। পাশের বাড়ির লোকদের বলা হলো বাড়ি আপাতত না কিনতে। তাহলে ওরা বাড়ির মায়ায় হলেও পালিয়ে যাবে না। সবকিছু মিলিয়ে সিদ্ধান্ত হলো কেয়ার চিকিৎসার পর সুস্থ হলে ওর মতামত নিয়ে দু’জনের বিয়ে দেয়া হবে। এর ভেতরে ওর পূর্বের বিয়েরও ডিভোর্স প্রয়োজন। নাশতা-টাশতা করে মানুষ চলে যেতে লাগলো। তন্ময় ওর মামা এবং মায়ের সঙ্গে চলে গেল। এলাকার বেশ কিছু মুরব্বি রয়ে গেছেন। নির্জনকে নিতে এলো তাদের বাড়ির কাজের ছেলে রতন। সে সোফা থেকে উঠে আরিফুল সাহেবকে বললো, ‘আমি তাহলে যাই এখন।’
আসলাম সাহেব বললেন, ‘তুমি আমাদের এখানে আজ থাকো।’
– ‘না, আমি বাড়িতেই চলে যাব। এই যে রতন এসেছে নিতে।’
আরিফুল সাহেব বললেন, ‘তাহলে আমাদের সঙ্গে খাবে আজ। বসো।’
– ‘জি না, আব্বা আগেই বাড়িতে বলে রেখেছেন আমি আসছি। তাই সেখানেই সব ব্যবস্থা হয়েছে। আমি যাব এখন।’
তারা আর কিছু বললো না। নির্জন তার ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বের হয়ে বারান্দায় এসে চোরা চোখে চারদিকে তাকিয়েও তরুর দেখা পেল না। বুঝতে পারছে বাড়িতে প্রচুর মানুষ তাই বের হচ্ছে না। সে রতনের পিছু পিছু উঠানে এলো। রতনের বয়স আঠারো-উনিশ হবে। ওরা তাদের বাড়িতেই থাকে। তার চাচারাও কেউ নেই এখানে। থাকবে একা। খাওয়া-দাওয়ার জন্য আলাদা রান্নার ব্যবস্থা করবে। কাজের মেয়ে দেখবে। রতন তাকে বাড়ির পাশ দিয়ে পেছনের দিকে নিয়ে এলো। সে বাড়ির পেছনে এসে বললো, ‘রতন এদিক দিয়ে যেতে হবে না-কি?’
– ‘হ ভাইজান, হাওর দিয়া গেলে আপনাদের বাড়ি কাছে।’
– ‘ও আচ্ছা।’
ওর পিছু পিছু সে বাড়ি থেকে নেমে এলো হাওরে। চাঁদনি রাত। পরিষ্কার সবুজ মাঠ দেখা যাচ্ছে। মাঠের অর্ধেকজুড়ে বাড়ির গাছগাছালির ছায়া পড়ছে। ছায়া পড়ছে তাদের নিজেরও। নির্জনের হুট করে মনটা কেমন করে যেন উঠলো। এতদূর থেকে এসেও সে তরুকে এক নজর দেখতে পেল না। উদাস মনে রতনের পিছু-পিছু হেঁটে মিনিট বিশেক পর বাড়িতে পৌঁছে গেল তারা। বাড়িটি বিশাল। সামনে পুকুর। পুরোনো ধরনের লম্বা দালান ঘর। তাকে একটা রুমে নিয়ে দিল রতন। রুমের দক্ষিণে জানালা। উপরে টিন। নতুন বিছানা চাদর আর বালিশ। বুঝাই যাচ্ছে তার আসা উপলক্ষে ঘর-দোর পরিষ্কার করে রেডি করা হয়েছে। ব্যাগ থেকে তোয়ালে বের করে রতনকে ডাক দিয়ে বললো, ‘আমি গোসল করবো।’
– ‘পুকুরে না-কি চাপাকলে করবেন?’
– ‘পুকুরে।’
‘আইচ্ছা’ বলে টেবিলের ওপরে সাবান দেখিয়ে বললো, ‘এইটা আপনের জন্য আইনা রাখছি।’
– ‘ওকে।’
নির্জন কাপড়-চোপড় নিয়ে গোসলে গেল। রতন বসে রইল সিঁড়িতে। অনেক বছর পর পুকুরে গোসল করে বেশ লাগলো তার। রুমে এসে শরীর মুছে-টুছে থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে মোবাইল হাতে বসলো বিছানায়। রতন তাকে চা এনে দিল। কাপ হাতে নিয়ে বললো, ‘আচ্ছা এখন যাও তুমি।’
রতন চলে গেল। নির্জন চায়ে চুমুক দিয়ে দেখলো তরু রিপ্লাই দিয়েছে। আসার পথে অনেক মেসেজ দিয়েছিল সে। তরু সিন করেনি। এখন অনলাইনে এসেছে।
– ‘স্যরি নির্জন, প্লিজ রাগ করবেন না। আমি এত মানুষের মাঝে কীভাবে গিয়ে দেখা করতাম।’
– ‘ইটস ওকে। কিন্তু দেখা তো হতে হবে তাই না? ঢাকা থেকে এসে দেখা না হলে কিছু হলো?’
– ‘আচ্ছা আমি কাল কলেজে যাব। বের হয়ে মেসেজ দেবো তখন তো দেখা হবে।’
– ‘উহু, এসব দেখায় আমার পোষাবে না। আমি স্পর্শ করতে চাই৷’
– ‘ধ্যাৎ, লজ্জা লাগে না এভাবে বলতে?’
– ‘না।’
– ‘শুনুন, আপনি এত কিছু করতে গেলেন কেন? টাকা নিয়ে পালিয়েছে বলে না নিশ্চয়।’
– ‘টাকার জন্য না তো অবশ্যই। টাকার জন্য হলে গ্রামে নিয়ে আসতাম কেন?’
– ‘তবে কেন এতকিছু করলেন?’
– ‘তোমার জন্য।’
– ‘আমার জন্য মানে?’
– ‘ভেবেছিলাম দেখা হবে। তাছাড়া তুমি নুসরাতের কাছে বলেছিলে তোমাকে ভালোবাসলে তোমার ফ্যামিলির কাছে কালার হলাম কেন। তাই এখন একটু ভালো হওয়ার চেষ্টা। সবই তোমার জন্য ম্যাডাম।’
– ‘ইশ এভাবে বলবেন না৷ কষ্ট হয়। দেখাটাও যে হলো না।’
– ‘তুমি চাইলে কিন্তু করতে পারি এখনও।’
– ‘কীভাবে?’
– ‘তোমাদের বাড়ির পেছনে। চাঁদনি রাত আছে। মাঠে তুমি আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকবে।’
– ‘মাই গড! কি সাহস হয়েছে আপনার।’
– ‘এতকিছু বুঝি না। সবাই ঘুমিয়ে গেলে তুমি বের হতে পারবে কি-না বলো।’
– ‘কেউ দেখে ফেললে কি হবে শুনি?’
– ‘দেখলে আরও ভালো, পঞ্চায়েতকে তুমি বলবে আমার সর্বনাশ করছে। ওর সন্তান এখন আমার পেটে। ওরাও আমাদের বিয়ে পড়িয়ে দেবে। তাতে তো ভালোই হবে।’
– ‘হাঁসাবেন না তো৷ হঠাৎ কেউ হাসতে দেখে ফেলবে।’
– ‘তরু আমি কিন্তু সিরিয়াস।’
– ‘কীসে?’
– ‘তোমাদের বাড়ির পেছনে কয়টায় আসবো বলো।’
– ‘পাগল হয়েছেন আপনি? বিপদে ফেলবেন না-কি আমাকে?’
– ‘কেউ দেখবে না ম্যাডাম।’
– ‘যদি দেখে?’
– ‘দেখলে তোমাকে নিয়ে পালাবো। টুপ করে বিয়ে করে নিব দিনে। আর কাল রাতে তোমাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবো।’
– ‘আপনি বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছেন।’
– ‘ম্যাডাম এত কাহিনি করে এলাম। চোখের দেখাও হলো না।’
– ‘বললাম তো দিনে দেখা হবে।’
– ‘তা তো ডেইলি পথচারীরাও দেখে তোমায়।’
– ‘আপনার মতলব দেখছি ভালো না।’
– ‘চরিত্রও ভালো না। বের হবে কখন বলো।’
– ‘কি আজেবাজে কথা বলছেন! ঘুমান তো। এতদূর থেকে জার্নি করে এসেছেন।’
– ‘আমি কিন্তু আজ রাতেই তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে চাই। সবচেয়ে ভালো হতো পুরো রাত তুমি মাঠে বুকে মাথা রেখে ঘুমালে।’
– ‘মাথাটা গেছে আপনার।’
– ‘কখন আসবো?’
– ‘প্লিজ পাগলামি করবেন না, ঘুমান। নিশ্চয় ক্লান্ত লাগছে।’
– ‘তুমি জানো না? পুরুষ মানুষ ক্লান্ত হলে তার আরও বেশি প্রেম পায়।’
– ‘বাজে বকবেন না। ঘুমিয়ে যান প্লিজ। বারবার বললে আমার রাজি না হয়ে উপায় থাকবে না। এমনিতেই আপনি দেখতে এসে, পারেননি ভেবে কষ্ট হচ্ছে।’
– ‘আজ মানবো না, দেখা করা লাগবে। আমি রাত একটায় এসে মেসেজ দেবো।’
‘আইসেন, হাওরে শেয়াল আছে অনেক। আমি একটু পরেই ঘুমিয়ে যাব। খেতে ডাকছে বাই’ বলে ডাটা অফ করে ফেললো তরু। নির্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলে চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বিছানায় শুয়ে মোবাইল টিপতে শুরু করলো।
তরু রাতের খাবার খেয়ে বাতি নিভিয়ে এসে বিছানায় গা হেলিয়ে দিল। ছোট ভাই-বোন আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তরু ডাটা অন না করে গ্যালারিতে গিয়ে নির্জনের ছবি দেখতে শুরু করলো। সবগুলোই ফেইসবুক থেকে ডাউনলোড করা। অনেকগুলো ছবির মধ্যে একটিতে চোখ আঁটকে গেল। জিমে গিয়ে তুলেছে মনে হচ্ছে। কালো একটি শার্টের বোতাম খোলা। দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে। ঘেমে যাওয়া ফরসা বুক ভীষণ মোহনীয় লাগছে। সিক্স প্যাক না হলেও একেবারে ছিপছিপে পেট। তরু ডাটা অন করলো। সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে চলে এলো নির্জনের কিছু মেসেজ। তরু ছবিটি ওকে পাঠিয়ে বললো, ‘ফেইসবুকে এসব ছবি আপ্লোড করে কাকে দেখানো হয়?’
নির্জন সঙ্গে সঙ্গেই সিন করলো। তারপর এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বললো, ‘কখন আসবো বলো।’
– আপনি এই ছবি ফেইসবুক থেকে ডিলিট করুন তো।’
– ‘উহু, তুমি দেখা করে নিজেই ডিলিট দিয়ো।’
– ‘আপনি তো দেখি দেখা করা ছাড়া আর কিছুই শুনছেন না।’
– ‘না।’
– ‘একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?’
– ‘না।’
– ‘প্লিজ রিস্ক হচ্ছে, আপনি বারবার বলায় আমিও দূর্বল হয়ে যাচ্ছি।’
– ‘হোক রিস্ক আসো।’
– ‘এলে কিন্তু আপনাকে কামড় দেবো আজ।’
– ‘আচ্ছা দিয়ো।’
– ‘ভালো পাগলামি শুরু করেছেন। তাছাড়া এতদূর রাতে একা আসবেন আপনি? ভয় লাগবে না?’
– ‘না।’
– ‘আচ্ছা আপনি আরও এক ঘণ্টা পর এসে মেসেজ দিন। আল্লাহ জানে কপালে কি আছে। ভাবতেই আমার বুক কাঁপছে।’
– ‘কিন্তু তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবো এটা ভাবতেই গা কাঁটা দিচ্ছে।’
– ‘ওকে বাই৷ আমি মোবাইল রেখে শুয়ে থাকি এখন। সবাই ঘুমিয়ে যাক।’
– ‘ওকে।’
তরু মোবাইল রেখে চোখবুজে পড়ে রইল দীর্ঘ এক ঘণ্টা। নানান উথাল-পাতাল ভাবনা মাথায় খেলে গেল। ভয় লাগছে, আবার নির্জনকে কাছে পাবে ভাবলে গায়ে শিহরণও বয়ে যাচ্ছে। ঘণ্টা খানেক পর। প্রায় একটা বাজে। নির্জন মেসেজ দিল, ‘আমি তোমাদের বাড়ির পেছনে চলে এসেছি।’
তরুর বুক ‘ধক’ করে উঠলো। ভয়ে যেন পা কাঁপছে ওর। সে মোবাইলটা হাতে নিয়ে করিডর দিয়ে আস্তে-আস্তে পেছনের দরজার কাছে এলো। তারপর মোবাইলটা মেঝেতে রেখে আলগোছে সিটকানি খুলে পুনরায় মোবাইল হাতে নিয়ে বাইরে আসে। তারপর আস্তে করে দরজা টেনে ভেজিয়ে নেয়। বাইরে দিনের মতো চাঁদের আলো। তরু ‘দুরুদুরু’ বুকে এগিয়ে গেল। বাড়ির আঙিনা পেরিয়ে নেমে গেল মাঠে। দূর থেকেই দেখতে পেল গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে নির্জন। তরু চারপাশে তাকিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল ওর দিকে। কাছে গিয়েই হাঁপানো গলায় শুকনো ঢোক গিলে বললো, ‘আমার ভয় লাগছে অনেক। চলে যাব আমি। এক মিনিটও থাকা যাবে না।’
নির্জন দুই হাত বাড়িয়ে মুখটা ধরে বললো, ‘কথা বলে সময় নষ্ট করো না। মনভরে দেখে নিই তোমাকে।’
তরু ক্ষীণ সময়ের জন্য সবকিছু যেন ভুলে গেল। চোখে চোখ রাখলো নির্জনের। নির্জন ঠোঁট বাড়িয়ে এনে কপালে চুমু খেল ওর। তরুর পুরো শরীর যেন কেঁপে উঠলো। চোখবুজে নিল আবেশে। সঙ্গে সঙ্গে টের পেল নির্জন তাকে নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়েছে। তরুও দুইহাতে শক্ত করে আলিঙ্গন করে মাথা রাখলো তার বুকে। দীর্ঘ সময় দু’জন সবকিছু ভুলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকলো। নির্জন এক হাতে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। গালের ওপর থেকে চুল সরিয়ে হাত রাখে। তারপর ফিসফিস করে বলে, ‘তোমার গালে একটা কামড় দিতে পারি?’
– ‘উহু।’
– ‘চুমু?’
‘পরে, এখন চুপচাপ থাকুন। কথা বলতেও ইচ্ছা করছে না, বুক থেকে মাথা সরাতেও ইচ্ছা করছে না।’ কিন্তু আঁতকে উঠে বুক থেকে মাথা তুলতে হলো তখনই। কেউ সোজা তাদের ওপর বাতির আলো ধরেছে।
___চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম
#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_৩৪
.
বাতিটা কিছুক্ষণ পরেই বন্ধ হয়ে গেল। মাঠের মাঝখানে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে এবার চাঁদের আলোয় চিনতে অসুবিধা হলো না। তরু তাকে ছেড়ে খানিক সরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললো, ‘কে?’
– ‘ভয় পেও না, রতন।’
– ‘আল্লাহ এখন কি হবে?’
‘কিছুই হবে না, তুমি চলে যাও’ কথাটি শুনেই তরু এখান থেকে দৌড়ে হারিয়ে গেল। নির্জন এগিয়ে গেল মাঠের দিকে। রতন লাইট হাতে অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নির্জন কাছে গিয়ে বললো, ‘রতন তুমি এখানে কেন?’
সে লাজুক হেসে বললো, ‘আব্বা পাঠাইছে ভাইজান।’
– ‘এই চাঁদনি রাতে লাইট নিয়ে কেন বের হয়েছো?’
– ‘আমি বাইরের টয়েলেটে গেছিলাম। সেইটায় তো বাতি নাই। লাইট নিয়াই গেছিলাম। বের হতেই আব্বা কইল আপনে রুমে নাই। একা একা কোথায় গেলেন কল দিয়া দেখতে। কল দিলাম কিন্তু আপনে রিসিভ করেন নাই। আব্বা বললো আসলাম ভাইদের বাড়িতে গেল মনে হয়। গিয়া খুঁইজা দেখ। রাত-বিরেতে একলা আসতে অসুবিধা হইব।
তাই লাইট হাতেই চইলা আইছি। এখানে আইসা গাছের ছায়ায় আপনারে চিনতে পারি নাই। ভয় পেয়েই দূর থেকে লাইট মাইরা দিছি। রাগ করছেন না-কি ভাইজান?’
– ‘না চলো যাই। কাউকে এসব বলার দরকার নেই। ঠিক আছে?’
রতন লাজুক হেসে বললো,
– ‘কিযে কন ভাইজান, আমি আবার কারে কইতে যাব?’
নির্জন আসার পথেই রতনের কল আসে। রিসিভ না করে সাইলেন্ট করে নিয়েছিল। রিসিভ করে বলে দিলেই বুঝি ভালো হতো। মোবাইল পকেট থেকে বের করে তরুর মেসেজ পেল, ‘রতন কিছু বলেছে? কি যে লজ্জা লাগছে আমার।’
– ‘ও কি বলবে। কিছু বলেনি। এত ভয় পেও না।’
– ‘কিযে ভাবছে আল্লাহ জানে। রতন আমার সঙ্গে মক্তবে পড়েছে।’
– ‘তাই না-কি।’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘থাক এসব ব্যাপার না। আমার বউকে আমি জড়িয়ে ধরছি তাতে কার কি?’
– ‘হইছে, এসব বলে বলেই বের করে নিয়েছেন।’
– ‘এত অস্থির হইয়ো না তো তরু, ঘুমাও। শুভ রাত্রি।’
নির্জন মোবাইল আবার পকেটে রাখতে রাখতে বললো, ‘তুমি কি এখনও পড়ালেখা করো?’
– ‘না।’
– ‘তরুর সঙ্গে পরিচয় আছে? রাস্তা-ঘাটে দেখা হয়?’
– ‘হয় ভাইজান।’
– ‘এখন থেকে দেখা হলে কিছু বইলো না, লজ্জা পাবে। তাকিয়ে হাসবেও না।’
– ‘জি আচ্ছা।’
– ‘বিয়ের পর বইলো, তখন তো তোমার ভাবি হবে।’
রতন লাজুক হেসে লাইটের সুইচ টিপে দিল। নির্জন ধমক দিয়ে বললো, ‘দিনের মতো আলো থাকতে বাতি জ্বালাচ্ছ কেন?’
বাতি বন্ধ করে রতন বললো,
– ‘মনের ভুলে টিপা পইড়া গেছে ভাইজান।’
– ‘আচ্ছা যাইহোক, কাল তো তোমার কোনো কাজ নেই মনে হয়? আমাকে আটটার আগে ডেকে তুলতে পারবে না?’
– ‘পারবো।’
– ‘ডেকে দিয়ো, দু’জন বের হব।’
– ‘জি আইচ্ছা।’
*
পরদিন ঠিক আটটায় রতন তাকে ডেকে তুলে দিল। নির্জন বিছানা থেকে উঠে জানালা খুলে দেখে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। সূর্যের আলো মলিন। ব্রাশে পেস্ট নিয়ে সে দরজা খুলে বাইরে এসে দেখে রতন হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে লুঙ্গি আর হলুদ একটা গেঞ্জি। নির্জন দাঁত ব্রাশ করতে করতে পুকুরে এলো। পিছু পিছু এলো রতন। নির্জন সিঁড়িতে নেমে হাঁটু ভর দিয়ে বসে কুলি করে বললো, ‘কাপড় পালটে নাও রতন। নাশতা করো দু’জন বের হব।’
– ‘কোথায় যাইবেন ভাইজান? কাপড় পালটান লাগবো কেন?’
– ‘খানপুর যাব। লুঙ্গি পরে যাবে?’
– ‘হ লুঙ্গি পরেই যাই তো।’
– ‘তাহলে থাক, পালটাতে হবে না।’
নির্জন নাশতা করে, কাপড় পালটে। রতনকে নিয়ে বের হলো সাড়ে আটটায়। দ্রুত হেঁটে রূপগঞ্জ একটি চায়ের দোকানে গিয়ে বসলো তারা। তরুকে বের হওয়ার আগেই মেসেজ দিয়েছে, সেও বের হয়ে গেছে। হয়তো একটু পরেই চলে আসবে তরু। এখানে বসেই অপেক্ষা করবে সে। দু’কাপ চা দিতে বললো নির্জন। মিনিট খানেকের ভেতরেই চা দিল দোকানি। চা হাতে নিয়ে চুমুক দিতেই দূরে দেখতে পেল তরুকে। সাদা একটি লং ড্রেস পরনে, মাথায় কালো স্কার্ফ। সঙ্গে ওর দাদি। নির্জন চায়ের কাপ রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। তাকে চোখ দিয়ে ইশারায় তরু শাসাচ্ছে। যেন সামনে না আসে। নির্জন সেসব তোয়াক্কা না করে রাজিয়া খাতুনকে সালাম দিয়ে বললো, ‘কোথায় যাচ্ছেন? তরুর কলেজে না-কি?’
– ‘হ্যাঁ, ওর লগে মাঝে মাঝে আমি যাই।’
– ‘এভাবে তো কষ্ট হয়ে যায় আপনার। গ্রামের কলেজ তরু তো একাই যেতে পারে।’
– ‘যুগটা তো ভালা নাই, জোয়ান মাইয়া একা যাওয়ার থাইকা কেউ থাকলে ভালো।’
– ‘আচ্ছা যান, আমি এমনিই সকালে এদিকে বের হয়েছিলাম।’
– ‘আমাদের বাড়িতে যাইও। কাল তো ঝামেলার মইধ্যে গিয়া চইলা গেছিলা।’
‘আপনি যেহেতু বলছেন আজ যাব একবার।’ বলে সে তরুর মুখের দিকে তাকায়। তরু ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে দাদিকে বললো, ‘চলো যাই এখন, ক্লাসের টাইম হয়ে যাচ্ছে।’
তারা বিদায় নিয়ে চলে গেল। খানিকদূরে গিয়ে তরু মেসেজ দিয়ে বললো, ‘যাওয়ার পথে দেখার জন্য আবার রাস্তায় বসে থাকবেন না। বাড়াবাড়ি ভালো না।’
– ‘একদিনেই বাড়াবাড়ি হয়ে গেল?’
– ‘বিকেলে আবার দাদি দেখলে কি বলবে? আর শুনুন, রাতে এতটা খেয়াল করিনি। আপনার চেহারা-ছবির কি হাল করেছেন বলুন তো? চোখের নিচে কালি পড়ে যাচ্ছে। কালোও হয়েছেন কিছুটা।’
– ‘এগুলো তো তোমার জন্য।’
– ‘হয়েছে, এখন বাসায় যান। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবেন না। আর এখন বাই৷ হেঁটে হেঁটে চ্যাট করতে পারবো না।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলে নির্জন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রতনকে নিয়ে বাড়িতে চলে এলো। দুপুরের পরই ইচ্ছা করছিল আবার দোকানের সামনে চলে যেতে। নিজেকে কোনোভাবে সামলে রাখলো সে। কিন্তু সন্ধ্যা হতেই তরুকে মেসেজ দিয়ে বললো, ‘তোমাদের বাড়িতে আসছি।’
মিনিট কয়েক পরেই তরু রিপ্লাই দিল, ‘কেন?’
– ‘তোমার দাদি না যেতে বললেন।’
– ‘তাই বলে চলে আসবে?’
– ‘হ্যাঁ, তাছাড়া আমি কাল চলে যাব। তার আগে বিদায় নিতে যেতে পারি না? তোমাদের কাজেই তো এসেছিলাম।’
– ‘বুঝেছি, আসুন।’
– ‘কিন্তু আমি কেন যাচ্ছি জানা আছে তো? তুমি সামনে আসবে আগেই বলে দিলাম।’
– ‘আচ্ছা দেখি, একাই আসুন।’
‘ওকে’ বলেই মোবাইল রেখে নির্জন একটু পারফিউম দিয়ে, চুল-টুল ঠিক করে একাই বের হয়ে গেল। হাওর, মাঠ পেরিয়ে তরুদের বাড়ির দরজায় এসে নক দিল সে। খুলে দিলেন এসে নাহেরা বেগম।
– ‘আরে নির্জন তুমি, আসো, ভেতরে আসো।’
সে সালাম দিয়ে ভেতরে এসে ইতস্তত করে বললো, ‘কাল চলে যাব, তাই ভাবলাম দেখা করে যাই।’
‘ভালো করেছো, আসো’ বলে আরিফুল সাহেবের রুমে তাকে বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে বসালেন। সে সোফায় বসে আরিফুল সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে থেমে গেল৷ আসলে এবাড়ির লোকদের সে কি ডাকবে ভেবে পায় না। বারবার আঁটকে যায়। তবুও ইতস্তত করে বললো, ‘নানা বাড়িতে নেই না-কি?’
– ‘না, তরুর বাবাও নেই। ওরা সন্ধ্যায় একটু বাইরে যায়।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘কাল চলে যাবে না-কি বললে?’
– ‘জি কালই চলে যাব।’
– ‘বাড়িতে কেউ নেই, একা একা থাকতেও তো ভালো লাগছে না মনে হয়।’
‘জি ঠিকই বলেছেন। তা তরুর পড়ালেখা কেমন চলছে? ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে গেছে শুনলাম। কোচিং এর স্যারেরা বলেন ও পড়ায় ভালো ছিল। চেষ্টা করলে ভালো ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে যেত’ শেষের কথাগুলো লক্ষ্যহীন মিথ্যে বললো সে। নাহেরা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ওকে ডেকে দিচ্ছি, গল্প করো তোমরা। চা-নাশতা কিছু দেই তোমাকে।’
– ‘এগুলো লাগবে না মামী।’
‘কিযে বলো তুমি’ বলে নাহেরা বেগম চলে গেলেন। একা বসে থাকবে ভেবে তরুকে ডেকে পাঠালেন তিনি। তরু ওড়না মাথায় দিয়ে এসে রুমে ঢুকলো। কেউ নেই আশেপাশে। তবুও কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে তরুর। সে গিয়ে বিছানায় বসলো। নির্জন অপলক তাকিয়ে রইল। সাদা ড্রেসটাই এখনও পরনে। ওড়না আলগা করে মাথায়। তবুও চুল উঁকি দিয়ে তার সৌন্দর্য প্রকাশ করতে এতটুকু ছাড় দিচ্ছে না। তরু বারবার চুলগুলো কানে গুঁজে রাখছে। নির্জন গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বললো, ‘তুমি এমনভাবে বিব্রতবোধ করছো, যেন আমি বর, আমার পাশে সোফায় আমার মুরব্বিরা বসা। তুমি এসে ঢুকতেই সবাই ‘হা’ করে তাকিয়ে কনেকে দেখছি।’
তরু মুখে হাত দিয়ে হেসে দরজার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললো, ‘সত্যিই কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছে সবাই দেখছে আমাদের।’
নির্জন পকেট থেকে একটি লাল ছোট্ট বক্স বের করলো। তারপর ফিসফিস করে বললো, ‘এদিকে দেখো।’
তরু ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে বললো, ‘এটা কি?’
‘শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরেই এটা আমি কিনেছিলেন। ভাবলাম তোমার আঙুল এত সুন্দর, ফুল দিয়ে প্রপোজ করে মানুষ। আমি না হয় আংটি দিয়ে করবো। সেই সুযোগ আর হয়নি। এরপর কাল রাতে…।’
তরু ঠোঁটে আঙুল রেখে বললো, ‘আস্তে বলুন।’
‘আচ্ছা আস্তেই বলছি, এটা কাল রাতেও পকেটে করে এনেছিলাম। কিন্তু রতইন্নার কারণে দেয়া হয়নি।’
– ‘এটা দিতেও হবে না। আপনার জিনিস আপনার কাছেই রাখুন।’
– ‘কেন? দিলে সমস্যা কি? তুমি লুকিয়ে রাখবে। পরে থাকতে হবে এমন কোনো কথা তো নেই।’
– ‘আজাইরা কাজ করবেন না তো। এমনিতেই ভয় লাগছে।’
– ‘লাগুক ভয়, এটা আজ আঙুলে পরিয়েই যাব। তুমি লুকিয়ে রেখে দিয়ো। আর একদিন পরে শুধু আঙুলের ছবি দেবে। যে হাতের নখ লম্বা সেই হাতে…।’
‘চুপ, আস্তে কথা বলুন। একেবারে নিশ্চিন্তে কথা বলছেন।’
‘তাহলে কথা বলাচ্ছ কেন? নিঃশব্দে পরিয়ে দেই’ বলে নির্জন দরজার দিকে তাকিয়ে কেউ নেই দেখে এগিয়ে কাছে গেল। তরু হাত আর চোখ দিয়ে ইশারা করে গিয়ে বসতে নিষেধ করছে। নির্জন পিছু ফিরে চারদিকে তাকিয়ে বললো, ‘আশেপাশে কেউ নেই তো।’
– ‘আসতে কতক্ষণ! যান, গিয়ে সোফায় বসুন।’
নির্জন এসব তোয়াক্কা না করে একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বক্স খুলে আংটি বের করে বললো, ‘হাত দাও।’
– ‘প্লিজ নির্জন কেউ আসবে।’
নির্জন ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ভয়ে তোমার থুতনি ঘেমে গেছে, কিযে মিষ্টি লাগছে।’
– ‘নির্জন গিয়ে বসুন, প্লিজ।’
– ‘আঙুলে আংটি পরিয়ে দিতে কতক্ষণ লাগবে শুনি?’
তরু শুকনো ঢোক গিলে পুনরায় দরজার দিকে তাকিয়ে ডান হাত বের করে দিল। নির্জন ফিসফিস করে বললো, ‘যে হাতের নখ লম্বা।’
তরু বাঁ হাত বাড়িয়ে দিল। নির্জন বুঁদ হয়ে তাকিয়ে রইল ওর হাতের দিকে৷ কি সুন্দর করে হাত বাড়িয়ে ধরেছে তরু। সে আংটি না পরিয়ে একবার কোমলভাবে নিজের হাতের মুঠোয় নিল তরুর হাত। তরুও খানিক সময়ের জন্য মিষ্টি এক অনূভুতিতে ভয়-ডর ভুলে গেল। সে পিটপিট করে চোখ তুলে নির্জনের চোখে চোখ রাখলো। সবকিছু ভীষণ ভালো লাগছে তরুর। মানুষটিকে একান্ত নিজের করে পেয়ে গেলেই হতো। এত বাঁধা, ভয়, শঙ্কা নিতে পারছে না আর। নির্জন দরজার দিকে তাকিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বললো, ‘হাতে একটা চুমু খেয়ে নিই?’
তরুর ভয় লাগছে। তবুও নির্জনকে ফিরিয়ে দেয়ার মতো ক্ষমতা আর অবশিষ্ট নেই ওর। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে দিল। নির্জন ওর হাত তুলে এনে ঠোঁট দিয়ে আলতো করে স্পর্শ করলো। তরুর পুরো শরীরে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গেল। তার আর তাড়া দেবার, তাড়িয়ে দেবার ক্ষমতাই যেন নেই। চোখ নামিয়ে কপাল ঠেকিয়ে নিল নিজের হাতেই। নির্জন আস্তে-আস্তে ওর মাঝের আঙুলে সোনার আংটি পরিয়ে দিয়ে কানের কাছে ঠোঁট এনে ফিসফিস করে বললো, ‘প্রচণ্ড ভালোবাসি তরু, আই লাভ ইউ সো মাচ। প্লিজ, এত ভয় পেও না। আমরা আলাদা হব না। তুমি আমার প্রেমিকা নও, তুমি আমার বউ। তুমি আমার জন্য বিয়ে ভেঙে দিয়েছো, এখন আমি তোমাকে নিজের করে নেয়ার জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারি। তুমি যতদিন আমাকে চাইবে, তোমাকে হারানোর বিন্দুমাত্র ভয় নেই আমার। শুধু তুমি চাইলেই আমার থেকে কেউ তোমাকে কেড়ে নিতে পারবে না। আর হ্যাঁ, তুমি ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছো ঠিক আছে। সবকিছু ঠিক হয়ে গেলে। যদি ঢাকা যাও, অনার্সে আবেদন করে চান্স পেলে ডিগ্রি বাতিল করে নিবে। যতদূর জেনেছি এরকম হয়। তোমার পড়ালেখা, লেখালেখি সবই হবে। শুধু সাহস নিয়ে সব সময় আমার…।’
হঠাৎ থেমে গেল নির্জন। ছেড়ে দিল তরুর হাত।
___চলবে…..
লেখা: জবরুল ইসলাম