প্রণয়ে প্রলয়ের সুর পর্ব-৩১+৩২

0
762

#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_৩১
.
তরু কিছুটা রেহাই পেয়েছে।
বাড়ির সবাই এখন তন্ময়কে নিয়ে ব্যস্ত। পাঁচ লক্ষ টাকা নিয়ে পালিয়েছে। ওর কারণেই কেয়ার সংসার ভেঙেছে। আরিফুল, আসলাম সাহেব সবাইই ক্ষুব্ধ।
ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের সঙ্গে তারা দেখা করছেন। পঞ্চায়েতের প্রবীণদের বাড়িতে ছোটাছুটি করছেন। তন্ময়ের মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন। বেশ ব্যস্ত সবাই।

তাদেরকে সেদিকে ঠেলে দিয়েছেও তরু। সেদিন তন্ময়দের বাড়ি থেকে আসার পর সন্ধ্যায় সবাই বসেছিলেন। তরু মায়ের চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আরিফুল সাহেব বললেন, ‘ওই হা*রামির বাচ্চাকে ছাড়বো না। এত টাকা নিয়ে পালিয়েছে, আবার আমার মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে।’

আসলাম সাহেব বললেন, ‘তরুর বিয়েটা আগে হয়ে যাক, পরে যা হয় হবে।’

তরু চুপ থাকলো না। সে কথা বললো। নির্জনের জন্য সে এখন সবই করতে পারবে। প্রথমে মানুষটাকে নিয়ে তার মনে যে কালো মেঘ জমেছিল সেটা কেটে গেছে। তাছাড়া এতকিছুর পরও বাবা-মা কেউই কোনোদিন মানবে কি-না সন্দেহ ছিল। তরুর ধারণা ছিল শুধু তন্ময়ের সঙ্গে বাসায় ধরা পড়ার কথা শুনে নির্জন এত রেগেছিল। এটা তার বাবাই শেষ করেছেন। চাইলে ডিভোর্সের মাধ্যমে, আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধান হবে৷ সে কেন এত বাড়াবাড়ি করতে গেল? গায়ে হাত তোলার, গালাগাল করার সে কে? যেখানে তার বাবা বিষয়টা জানেন, যা করার তিনিই করবেন। এসবের পর তরু যতই পক্ষে কথা বলুক তার পরিবার মানবে না বলে হীনমন্যতা ছিল। সেসব ভুল, দ্বিধা কেটে গেছে তরুর, সবকিছু বুঝতে পেরেছে। বাসার ঘটনার পরে নতুন ঘটনা ঘটেছে, ফুপুর হোটেলে গিয়ে বাজে বিষয়গুলো দেখে মানুষটার বাবা মরতে বসেছিলেন। ফুপুকে ভালোর জন্যই সে বন্দি করে রাখতে চেয়েছিল। গায়েও নিশ্চয় হাত তুলেছে শক্ত কোনো কারণে। সে তখন সামনে ছিল না। ওই পরিস্থিতি সে এখনও জানে না। নির্জনের সঙ্গে কথা বলে তরু একদিন সবকিছু বুঝিয়ে বলবে সবাইকে। এরপর কেউ না বুঝলে নেই। অন্তত এখন নির্জন তার কাছে অপরাধী নয়। এটাই তরুর শক্তি। তার ভালোবাসার মানুষটা কোনো অন্যায় করেনি, এখন ওর জন্য তরু সবই করতে পারে। আসলাম সাহেবের কথাটি শুনেই সে বললো, ‘কিন্তু আব্বা, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যাবে না?’

– ‘কি দেরি হয়ে যাবে?’

– ‘আমার বিয়ের পর বলছো তন্ময়কে দেখা যাবে। ততদিনে তো দেরি হয়ে যাবে। সে যদি দেশের বাইরে চলে যায়?’

– ‘দেশের বাইরে মানে? চুরি করে টাকা নিয়েছে বেড়াতে?’

– ‘না তা না, হতে পারে সে মিডলইস্ট কাজের জন্য চলে গেল। সৌদি, দুবাই যেকোনো দেশে। অথবা টাকা অন্যকিছুতে খরচ করে ফেললো। এজন্য গরম গরম ওকে ধরা ভালো।’

রাজিয়া বেগম বললেন, ‘ওই পোলাকে ছাড়বা না, সে আমার মাইয়ার জীবন নষ্ট করছে, বিয়া করা লাগবো ওর।’

আরিফুল সাহেব বললেন, ‘তুই আছিস তোর মেয়ে নিয়ে আসলাম। কেয়ার কথা তো ভাবতে হবে। ওকে এভাবে ফেলে রাখলে হবে না-কি? ওই ছেলে বিয়ে করুক, না হলে টাকা দিক। এরপর ইশহাক ওকে মানবে, অথবা অন্য জায়গায় ওকে বিয়ে দেবো। কেয়ার তো ব্যবস্থা একটা করা লাগবে।’

তরু বিয়ের ব্যাপারটায় একমত নয়। তন্ময় যদি এভাবে ফুপুকে ফেলে চলে যায়। তার কাছে কেন মেয়ে বিয়ে দিতে হবে? এ ব্যাপারে তরু তবুও সেদিন কিছু বলতে যায় না। সবাই এরপর তন্ময়কে নিয়ে ব্যস্ত৷ তরু ব্যাপারটায় হাফ ছেড়ে বেঁচেছে।

আজ সে সন্ধ্যার আগেই রোজকার মতো বাড়ির পেছনে বাচ্চাদের খেলা দেখে ঘরে ফিরে এলো। নাহেরা বেগম চুলোয় ভাতের সঙ্গে চা বসিয়েছেন। তরু রান্নাঘরের চেয়ারে এসে বসলো। তিনি দেখে বললেন, ‘আমি এদিকে খেটেখুটে মরি। তুই সারাদিন শুয়ে-বসে কাটিয়ে বিকালে বাইরে গিয়ে হাওয়া লাগিয়ে আসিস। মা’কে যে কাজে একটু হেল্প করবি তা না।’

তরু সুযোগ পেয়েছে। সে নির্লিপ্ত চেহারায় খোঁচা দিয়ে বললো, ‘খেটেখুটে তো তুমিই মরবে, তুমি তো নায়িকা সাবানা।’

নাহেরা বেগম চুলো থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে ভ্রু-কুঁচকে বললেন, ‘কি বললি?’

– ‘যা বলেছি সত্যই তো বলেছি। তুমি তো খুবই ত্যাগী নারী। শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদির জন্য কত ত্যাগ। মানুষ নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য কতকি করে। জা, শাশুড়ি, ননদির সঙ্গে ঝগড়া করে। কিন্তু তুমি তো মহান নারী। নিজের মেয়ের জীবন নিজেই স্বামী সংসারের জন্য কো*রবান করে দিচ্ছ।’

– ‘কি আবোল-তাবোল কথা বলছিস?’

– ‘ঠিকই বলেছি, তোমার মেয়ে কি কোনো দোষ করছে? অন্যের মেয়ের জন্য তুমি নিজের মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ করতে রাজি হয়ে গেলে। মোবাইল কেড়ে নিয়ে রাখলে। এগুলো কি?’

– ‘তোর মোবাইল তো পেয়েছিস। বেশি বকবক না করে বিদায় হ।’

– ‘মোবাইল দিয়েছো তো তন্ময়দের বাড়ি যাওয়ার সময়। আবার যখন স্বামী বা শ্বশুর বলবেন। আলগোছে নিয়ে নিবে। মেয়ে তো কিছু না। তোমার শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী, সংসার সব। এদিকে বিনাদোষে আমার কত ক্ষতি হলো। কোচিং ছেড়ে এলাম। এখন পড়ালেখাই অনিশ্চিত। অন্য কারও মা হলে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিতো, তোদের মেয়ে নষ্টামি করছে, আমার মেয়ে পেছনে লেগেছিস কেন? কিন্তু আমার মা তো সাবানা…।’

– ‘চুপ করবি না-কি মাইর খাবি। বেশি পেকে গেছিস তাই না? যা এখান থেকে।’

তরু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুখভার করে উঠে চলে গেল। ছোট ভাই-বোনকে নিয়ে সন্ধ্যায় পড়াতে বসলো। দশটার দিকে খাওয়ার টেবিলে বসলেন সবাই। নাহেরা বেগম স্বামীর প্লেটে খাবার দিতে দিতে বললেন, ‘তরু কি বাড়িতে বসে আন্ডা পারবে?’

– ‘কেন, কি হয়েছে?’

– ‘তাকে ভর্তি করে দাও।’

– ‘ওকে নিয়ে যাওয়া-আসা কে করবে?’

– ‘যে যখন পারি নিয়ে যাব, আসবো৷ কিন্তু যেতেই হবে সব সময় এমন তো না। একজন দূর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলছে বলে সবাই এমন হবে না-কি?’

আসলাম সাহেব চুপ করে গেলেন। কিছু বললেন না। তরু চুপচাপ খেয়ে উঠে রুমে চলে এলো। মোবাইল সে অফ করে ব্যাগে রেখে দিয়েছিল। বের করে আনলো। অন করে ডাটা চালু করতেই নির্জনের একটি মেসেজ এলো, ‘আমি নবান্ন রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলাম। ওদের নিয়ম নেই রেকর্ড দেখানো। তাই ভাবছি ভিন্ন ব্যবস্থা করবো।
আর ফুটেজ দেখতে হলে জানা দরকার ওরা কখন, কোন তারিখে গিয়েছিল রেস্তোরাঁয়৷ অবশ্য অনেক ভেবে বের করেছি কবে যেতে পারেন তোমার ফুপু। আব্বা হসপিটাল যাওয়ার পর উনি একদিন বিকেলে বাইরে থেকে বাসায় ফিরেন। আমি খাওয়ার টেবিলে ছিলাম। উনাকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম কোথায় গিয়েছেন। বললেন একটা কাজে বাইরে। সুতরাং সময়টা বিকেল তিনটা। ওদের দেখা দুইটার দিকেই হয়েছে। সেদিনই টাকা দিয়েছেন বলে আমার ধারণা। ম্যানেজার শফিকের সঙ্গেও কথা বলে জেনেছি এর আগেরদিনই তন্ময় পুলিশের থেকে ছাড়া পেয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে আমি নিশ্চিত ওইদিন বিকেলে তাদের দেখা হয়েছে। এবার সিস্টেম করে চেক করে নিব ফুটেজ। চিন্তার কিছু নেই। তন্ময়কেও ধরার ব্যবস্থা করবো। তোমার কি অবস্থা বলো। অনলাইনে এলে রিপ্লাই দিয়ো। আমি আর কল-টল দেবো না ঠিক করেছি। মোবাইল তোমার হাতে থাকলেই শান্তি। আমাকে অনলাইনে এলে আপডেট জানাইও। তোমার শুনেছি বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে। কি যে টেনশনে আছি বুঝাতে পারবো না। বিয়েটা ভেঙে দিয়েছো কি-না জানাবে। আর আরেকটা কথা। নুসরাতের থেকে বুঝলাম, তুমি আমার উপর রেগে আছো।
কেন রেগে আছো বলো তো? তোমার ফুপুর জন্য? এটার জন্য আমি মাফ চেয়েছি। নিজেও খুবই অনুতপ্ত। আসলে যখন শফিক সাহেব বললেন, তন্ময় আর তোমার ফুপু হোটেলে যা যা করেছে সবকিছুর ভিডিয়ো তন্ময়ের ফোন থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে। সেই ভিডিয়ো দেখে আব্বু হার্ট আট্যাক করেছেন। এরপর আমার আর হুশ ছিল না। ভালোর জন্যই উনার থেকে ফোন এনে বন্দি করতে চেয়েছি। কিন্তু উনার রাগারাগির কারণে নিজেও খারাপ আচরণ করে ফেলি। বিশ্বাস করো, পরেরবার রাতে আমি উনাকে খাওয়াতে গিয়েছিলাম। ভালোভাবে বলেছি খেয়ে নিন। নিজেকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। ডিভোর্স হলে তন্ময়কে বিয়ে করে নিয়েন। এখন খান। উনি তখন আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে আমার মা’কে তুলে গালি দিয়েছিলেন। আর আমিও বোকার মতো কাজটা করে বসলাম। এরপর কসম তরু, আমার রাতে ঘুম হয়নি। নিজেকে এত জঘন্য মনে হয়েছিল বুঝাতে পারবো না। তুমি এখন এসবের কারণে ভুল বুঝলে আমি কি করবো বলো। আর তোমাকে রেগে গিয়ে কি যেন বলেছিলাম মনে নাই। তুমিও মনে রেখো না, ভুলে যেও। সবকিছুর জন্য সত্যিই স্যরি। আমি অনুতপ্ত। তুমি বিয়েটা শুধু কোনোভাবে ভেঙে দাও। এরপর আমি তোমার কাছে, তোমার ফুপুর কাছেও মাফ চেয়ে নিব। কিন্তু একবার বিয়ে হয়ে গেল কি করার থাকবে আমার?
অনলাইলে এলে প্লিজ রিপ্লাই দিয়ো। অপেক্ষায় রইলাম।’

মেসেজ পড়ে তরু মুচকি হেসে সতর্ক চোখে দরজায় দিকে তাকিয়ে কেউ নেই দেখে টাইপ করলো, ‘আপনি এত রাগী কেন? জানেন সেদিন আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম? কিন্তু আজকের মেসেজ পড়ে মনে হচ্ছে কোনো রাগ নেই, বাচ্চা একটা ছেলে কথা বলছে। যাইহোক, নুসরাত আপনাকে এগুলো বলে দিয়েছে তাহলে। আসলে পুরো ঘটনা তখন জানতাম না। আমি হুস্নার থেকে জেনেছি ফুপা তন্ময় আর ফুপুকে একসঙ্গে পেয়ে যান। আর সেদিন আমি ফুপুকেও দেখে বুঝেছি ফুপা মারধর করেছেন। এরপর উনি হয়তো মেনে নিয়েছেন কিংবা ভিন্ন কিছু ভেবেছেন। তো আমার কথা আপনি মাঝখান থেকে কেন বন্দি করবেন? আবার রাতে গিয়ে মারবেন? এই কারণে ভেতরে ভেতরে একটু রাগ ছিল। পরে জানলাম ফুপুর কারণেই ফুপা হসপিটাল গিয়েছিলেন। এখন আপনার প্রতি সেসব রাগ নেই জনাব।’

তরু মেসেজ দিয়ে দেখলো সিন হয়নি। সে কিছু একটা ভেবে কল দিল হোয়াটসঅ্যাপে। কয়েকবার রিং হতেই ধরলো নির্জন। সঙ্গে সঙ্গে সে কল কেটে টাইপ করলো, ‘কথা বলতে না, কল দিয়ে চ্যাটে ডাকলাম।’

নির্জন খানিক পর উপরের মেসেজের রিপ্লাই দিল, ‘তুমি তাহলে ভুল বুঝেই আমাকে না বলে চলে গিয়েছিলে?’

তরু মুচকি হেসে রিপ্লাই দিল, ‘ভুল বুঝলেও আমি আপনার মেসেজের রিপ্লাই দিয়েছিলাম। কল দিয়েও কথা বলেছিলাম। তাছাড়া আপনাকে দাদা প্রথমদিন দোষারোপ করায় আমি আপনার পক্ষ নিয়েই কথা বলেছি।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে, বিয়ের বিষয়টা বলো। কি হয়েছে?’

– ‘আপাতত বন্ধ। আমি ডিগ্রিতেও ভর্তি হওয়ার চেষ্টায় আছি।’

– ‘আমি তাহলে গ্রামে আসি। দেখা করি।’

– ‘একদম বাচ্চামু না। চ্যাটেও কথা কম। শেষে মোবাইলও যাবে, পড়াও বন্ধ হবে।’

– ‘তাহলে আমাদের দেখা হবে না? এভাবে চ্যাটে কতদিন?’

– ‘কতদিন দেখা যাক। আর দেখা করতেই হবে এমন না।’

– ‘আমার তো দেখা লাগবে, আমাদের সম্পর্ক তো একই বাসায় থেকে হয়েছে। এখন হুট করে ঠিক মতো দেখতেও পাচ্ছি না। আর গ্রামে আমার বাড়িতে আমি গেলে কার কি সমস্যা?’

তরু মুচকি হেসে বললো, ‘আচ্ছা আমি আগে ভর্তি হই। ডেইলি একটা ছবি দেবো। এরপর আপনিও গ্রামে এলে আসবেন। এখন অস্থির হবেন না প্লিজ।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে, এসব ঝামেলার মূল তন্ময়। সব শোধ নিব তন্ময়কে হাতের কাছে পেলে। সে খুব ভাব নিয়ে আমাকে ভাগনা বলতো।’

তরু হাসির রিয়েক্ট দিয়ে বললো, ‘প্লিজ আর কোনো বাড়াবাড়ি করবেন না। আচ্ছা, হুস্না কেমন আছে?’

– ‘তুমি যাওয়ার পর মনমরা ছিল। ফুপু বললেন শুধু তরু তরু করে।’

– ‘আচ্ছা আপনার অবস্থা কি? প্লিজ নিজের খেয়াল নিবেন।’

– ‘না, বিদ্রোহ করেছি। নিজের খেয়াল নেব না। তোমাকে নিতে হবে এসে।’

তরু ফিক করে হেসে ফেললো। তখনই দরজার কাছে এসে নাহেরা বেগম বললেন, ‘তুই মোবাইলের দিকে তাকিয়ে হাসছিস কেন?’

___চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_৩২
.
বালিশ কোলে নিয়ে কনুই ঠেকিয়ে আসন পেতে বসা ছিল তরু। মায়ের কথাটি শুনে বুকটা কেমন ‘ধক’ করে উঠলো। এখন কি করবে সে? কি বলবে মা’কে? দ্রুত ভাবছে। নাহেরা বেগম অনুসন্ধানী চোখে তাকিয়ে এগিয়ে আসছেন। উদ্ধার করলো একটি কল। সাইলেন্ট থাকায় রিং হলো না। কিন্তু মোবাইল স্ক্রিনে চোখ যেতেই তরুর মুখটা ঝলমল করে উঠলো। নুসরাত হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়েছে। তরু মায়ের দিকে মোবাইল ধরে বললো, ‘তোমার ভাইঝির সঙ্গে চ্যাট করলে না হেসে পারা যায়? এই দেখো কলও দিয়ে বসেছে’ বলে রিসিভ করেই ভলিউম একেবারে কমিয়ে কোনো সৌজন্যতায় না গিয়ে বললো,

– ‘কল দিয়ে বেঁচে গেছিস, নুসরাত। চ্যাটে তোর কথা শুনে হাসছিলাম। তখন আম্মু এসে দেখে বলছে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে হাসছিস কেন। তুই কল না দিলে নিশ্চিত মেসেজ দেখতে চাইতো, আমিও দেখিয়ে দিতাম। তোর ফুপুও বুঝতেন তুই কেমন পেকেছিস…।’

ওপাশ থেকে অবাক গলায় নুসরাত বলে যাচ্ছে, ‘কিরে কু*ত্তি? চ্যাট করলাম কখন? আমি তোকে হঠাৎ অনলাইনে দেখে কল দিলাম। এসব আবোল-তাবোল কি বলছিস?’

তরু মায়ের দিকে তাকিয়ে মিটমিটে হেসে বললো, ‘না, দেখিয়ে দেই নুসরাত। আম্মু দেখতে চাচ্ছে। দেখালে কি আর হবে?’

নুসরাত ওপাশ থেকে বললো, ‘কু*ত্তি বুঝেছি, তুই কোন জামাইর লগে চ্যাটে ধরা পড়ে এখন আমাকে ফুপুর কাছে কালার করছিস।’

– ‘হ্যাঁ, আম্মু আমার সামনেই বসা। সব শুনছে। তাতে কি? সবাই জানে তুই কেমন।’

– ‘কিরে বাল, নাটক বন্ধ কর। এখন কল রেখে দেবো না-কি?’

– ‘তোর ইচ্ছা।’

নুসরাত কল কেটে দেয়। তরু মুচকি হেসে মায়ের দিকে তাকিয়ে ‘রাগ করে কেটে দিছে’ বলে কান থেকে ফোন নামিয়ে দেখে নির্জন অনবরত মেসেজ দিয়েই যাচ্ছে। ওর নামে চেপে ধরে পলকে হাইড করে নেয় তরু। নাহেরা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘রাগ তো করবেই, সেই কখন থেকে ইয়ার্কি করে যাচ্ছিস।’

– ‘ভাইঝির জন্য দেখছি দরদ একেবারে উথলে উঠছে।’

– ‘নুসরাত আমাদের ওখানে আসতে চাইছিল। বলেছি পরে একদিন আসতে। এখন এসে এসব রং-তামাশা দেখে যাবে না-কি।’

– ‘ভালো করেছো।’

– ‘শোন, যা বলতে এসেছিলাম। তোর বাবা রাজি হয়েছে। কাল গিয়ে ভর্তি হয়ে যা। দেখিস, এদিক-সেদিক কিছু করলেই সব দোষ আমার হবে এখন।’

– ‘অবশ্যই এদিক-সেদিক কিছু করবো।
কলেজে যাওয়ার পথে কোনো রূপকথার রাজপুত্র পেয়ে গেলে তার ঘোড়ার পেছনে উঠে পালিয়ে যাব। তোমাদের এখান থেকে বিদায় হওয়া ভালো। নিজের মেয়েকেই তোমরা বিশ্বাস করো না।’

‘মাইর খাওয়ার জন্য বেশি কথা বলিস তাই না? বেশি পেকে গেছিস’ বলে নাহেরা বেগম উঠে চলে গেলেন।

তরু চোখবন্ধ করে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে ছাড়লো। বুকটা এখনও ধড়ফড় করছে। নির্জন এদিকে অনবরত মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে।

তরু এবার তাড়াতাড়ি গিয়ে রিপ্লাই দিল, ‘আপনি কি বলুন তো? আমাকে পাগল করে ছাড়বেন। চ্যাটে কথা বলার সময় দিন-দুনিয়া ভুলে গিয়েছিলাম। আম্মু হঠাৎ এসে হাজির। আর আমি তখন আপনার মেসেজ দেখে হাসছি। এখনই মোবাইল নিয়ে যেত। শুধু নুসরাতের কলের জন্য বেঁচে গেলাম। শুনুন, আমাকে কাল ভর্তি হতে বলেছে। কোনো বাড়াবাড়ি না। ডাটা অফ করলাম। ঘুমান।’

নির্জন সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই দিল, ‘যাক এই যাত্রায় বেঁচে গেলাম তাহলে।’

– ‘আপনি না, আমি বেঁচেছি। আপনার ফোন কেউ কেড়ে নেয়নি। এখন বাই।’

– ‘আরেকটু থাকো, শোনো, তোমার বাঁচা কি আমার বাঁচা না? আমরা দু’জন কি আলাদা?’

– ‘ হ্যাঁ, অবশ্যই আলাদা। আর আপনি কে হোন আমার? কিছুই না।’

– ‘কিছুই না?’

– ‘না।’

– ‘প্রচণ্ড ভালোবাসি ম্যাডাম। আমি তোমার কিছু না হলেও, তুমি আমার সব।’

‘শুনুন, আপনার কোনো অধিকারই নেই আমাকে এসব বলার। প্রপোজও করেননি আমাকে। এখন বাই। হঠাৎ কেউ চলে আসবে’ বলেই তরু ডাটা অফ করে দেয়। মোবাইল বালিশের পাশে রেখে পাশ ফিরে শুয়ে থাকে চুপচাপ। বারবার মনে হচ্ছে নির্জন মেসেজ দিচ্ছে। ডাটা অন করলেই পাবে। আরেকটু কথা বলে নিলে কি হবে? আম্মা-আব্বা কেউই আসবে না এখন। তবুও তরু নিজেকে সামলে রাখে। দীর্ঘ সময় এভাবে কেটে গেল। ভাই-বোন এসে বিছানায় শুয়ে পড়েছে৷ তরু উঠে গিয়ে বাতি বন্ধ করার সময় দরজা ভেজিয়ে নেয়। সব সময়ই এভাবে খোলা থাকে। এখন হঠাৎ একেবারে বন্ধ করলে মুশকিল। বিছানায় এসে শুয়ে পড়ার পর মনে হলো ডাটা অন করে শুধু মেসেজ দেখে নিয়েই অফ করে নিবে। মোবাইল হাতে নিয়ে তাই করলো। মেসেজ এলো সঙ্গে সঙ্গে, ‘তুমি তো সবদিকেই কথা বলো তরু। নিজেই প্রপোজ করতে মানা করেছিলে। এখন নিজেই আবার প্রপোজ করিনি বলে আমার কোনো অধিকার নেই বলছো। এখন আমি কোন পথে যাব বলো তো? কালই তাহলে গ্রামে আসি। আমি তোমার কলেজে গিয়ে সবার সামনে প্রপোজ করবো। কলেজে না পেলে বাড়িতে গিয়ে প্রপোজ করবো। পরে যা হয় হবে।’

তরু মুচকি হেসে রিপ্লাই দিলো, ‘এত সাহস? সত্যিই পারবেন?’

মেসেজ সিন হলো সঙ্গে সঙ্গেই। নির্জন রিপ্লাই দিল, ‘সাহসের কি দেখেছো? আমার কাছে বিয়ে না দিলে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে আসবো।’

– ‘আমি যাব না।’

– ‘জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে আসবো। ফিল্মে দেখো না ভিলেন কি করে?’

– ‘আপনি ভিলেন?’

– ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য না হয় হলাম।’

– ‘তা জোর করে নেয়ার পর আমার বাপ-দাদা যখন পুলিশ নিয়ে আপনার বাসায় যাবে?’

– ‘তখন আর কি হবে? তুমি বাঁচিয়ে নিবে। পুলিশকে বলবে স্বেচ্ছায় এসেছি আমি।’

– ‘জোর করে নিলে আমি কেন বলতে যাব?’

– ‘পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যাবে তুমি বাঁচাবে না?’

– ‘না।’

– ‘ভালোবাসো না?’

– ‘না।’

– ‘একটুও না?’

– ‘না।’

– ‘কার জন্য এত কষ্ট পাচ্ছি। তুমি তো দেখছি হৃদয়হীন নারী। পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যাবে সে চুপ থাকবে।’

– ‘শুনুন।’

– ‘বলো।’

– ‘প্রচণ্ড ভালোবাসি। এখন বাই। আপনি প্লিজ মিস করবেন না। আপনি মিস করলে আমার ঘুম আসছে না।’

– ‘তাহলে তো তোমাকে কাছে পাওয়ার আগপর্যন্ত নির্ঘুম রাত কাটাতে হবে তোমার। কারণ আমি প্রতিটি মুহুূর্তে তোমাকে মিস করছি, করবো।’

– ‘এভাবে কথা বলবেন না তো। ঘুমাতে দিন।’

– ‘আমি কাউকে কাতুকুতু দিয়ে জাগিয়ে রাখছি না।’

– ‘আপনি অবশ্যই কাতুকুতু দিচ্ছেন।’

– ‘অপবাদ দেয়া হচ্ছে। আমি জিন-ভূত না যে ঢাকা থেকে গিয়ে তোমার রুমে ঢুকে কাতুকুতু দিচ্ছি।’

– ‘কিন্তু কাতুকুতু যেভাবেই হোক আমার হৃদয়ে ঠিকই দিচ্ছেন। ফোন রেখে ঘুমাতে পারছি না। ইচ্ছা করছে অনন্তকাল চ্যাট করেই কাটিয়ে দেই।’

– ‘এভাবে কথা বলো না তো তরু। অসহ্য লাগে। শেষে মাঝরাতে বাসা থেকে বের হয়ে রূপগঞ্জ চলে যাব।’

তরু ফিক করে হেসে বললো, ‘আচ্ছা এখন প্লিজ রাখি। ঘুমান।’

– ‘এত তাড়াহুড়ো কেন? রাতেও কি ওরা ঘুম থেকে উঠে চেক করতে আসবে?’

– ‘যদি হঠাৎ আসে তখন? ঘুমান তো। আমারও মোবাইল রাখতে ইচ্ছা করছে না।’

– ‘আচ্ছা ঘুমাও, শুভ রাত্রি।’

ঘুমিয়ে গেল দু’জনই। তরুর ঘুম ভাঙলো ঘণ্টা খানেকের ভেতরেই। কেয়া মাঝরাতে গুন-গুন করতে করতে গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করেছে,
‘আমায় ভাসাইলিরে
আমায় ডুবাইলিরে
অকুল দরীয়ায় বুঝি কুল নাইরে…।’

আরিফুল নিজের রুম থেকে হাঁক দিয়ে বললেন, ‘গান বন্ধ করবি নাকি এসে গলায় পা দিয়ে ধরবো?’

কেয়া নিজের রুম থেকে বললো, ‘এই বাড়িতে দেখতেছি আমার গান গাওয়াও নিষেধ। তাইলে আল্লাহ আমারে বোবা বানাইয়া দিতা..।’

নাহেরা বেগম আরেক রুম থেকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘কেয়া মাঝরাতে কীসের গান? দিনে গাইবি যা পারিস। এখন চুপ থাক। সবাই ঘুমাচ্ছে।’

– ‘আমার আবার রাত-দিন কি? সব সময় অন্ধকার। কখন ঘুমাই, কখন উঠি তার নাই ঠিক..।’

আরিফুল সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তোরে কবরে রাইখা আসতে পারলে সবাই শান্তি পেয়ে যেতাম। চুপ থাক। আমি উঠলে এখন বড়ো অসুবিধা হবে বলে দিলাম।’

কেয়া আরও খানিকক্ষণ তর্ক-বিতর্কের পর গুন-গুন করে বন্ধ হয়ে গেল।

*
পরদিন তরু কলেজে গিয়ে ভর্তি হয়ে এলো। ক্লাসমেট বেশিরভাগই ইন্টার দিয়ে এখানেই ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে গেছে। দেখা হলো তাদের সঙ্গে। বেশ ভালো লাগলো তরুর। মন্দের ভালো মনে হচ্ছে। শহরে গিয়ে ভালো ভার্সিটিতে ভর্তি হলে এদের পেত না আজ। ধীরে ধীরে পড়ালেখা শুরু হলো। নির্জনের সঙ্গে লুকোচুরি প্রেম। তিনদিন পর নির্জন তাকে জানায় হোটেল থেকে ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কেয়া একটি পলিথিনের ব্যাগ বের করে তন্ময়কে টাকা দিয়েছে। আরও বেশ কয়েকদিন এভাবে চলে যাওয়ার পর একদিন দুপুরে নির্জন তাকে মেসেজ দিয়ে না পেয়ে ডায়রেক্ট কল দিয়ে দিল, এভাবে কল দেয় না বলে আজকাল সাইলেন্ট করার কথাও খেয়াল থাকে না। আজ হঠাৎ দিয়ে বসেছে। কল কেটে দিয়ে বাইরে গিয়ে ব্যাক করলো সে, নির্জন তাড়া দিয়ে বললো,

– ‘তরু তন্ময়ের কোনো মোবাইল নাম্বার থাকলে দাও। ওর নাম্বার পেলে ঠিকানা পেয়ে যেতাম।’

কেউ দেখে ফেলে কি-না সেই ভয়ে তরু হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পেছনে চলে এসেছে। চারপাশে তাকিয়ে বললো, ‘ওর নাম্বার নেই। যেটা ছিল সেটা অফ।’

– ‘তুমি না বললে কোন এক নাম্বারে তোমার ফুপু যোগাযোগ করেছেন।’

– ‘হ্যাঁ, সেটা আমি বের করে দিতে হবে।’

– ‘আচ্ছা তুমি তাড়াতাড়ি দাও আমাকে।’

তরু সোজা ফোন রেখে মা’কে গিয়ে বললো, ‘ফুপুর মোবাইল তোমার কাছে না?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘দাও তাড়াতাড়ি।’

– ‘কেন?’

– ‘দাও তো আগে দরকার আছে।’

নাহেরা বেগম ওর তাড়া দেখে মোবাইল এনে দিলেন। তরু কেয়ার ফোনের কললিস্ট চেক করে দুইটা নাম্বারই পেল। তন্ময় আর আরেকটি সেভ করা নেই। সেটি নিজের ফোনে নিয়ে কল দিল, রিসিভ হতেই তরু চালাকি করে বললো, ‘বরিশাল না এটা?’

ওপাশ থেকে মহিলা একজন বললেন, ‘হ্যাঁ।’

– ‘আপনাদের বাড়ি খানপুর?’

– ‘হ্যাঁ, কে আপনে?’

তরু কল কেটে দিল। তারপর নাম্বারটি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিল নির্জনকে।
নাহেরা বেগম এতক্ষণ দাঁড়িয়েই ছিলেন। অবাক হয়ে বললেন, ‘তুই কার সঙ্গে এতক্ষণ কথা বললি?’

– ‘তন্ময়ের মায়ের সঙ্গে।’

– ‘বলিশ কি? তোর দাদা আর বাপ না যোগাযোগ করতে পারছে না। নাম্বার কোথায় পেলি?’

– ‘ফুপুর ফোনেই।’

– ‘বলিস কি? তাহলে নাম্বার দিতি ওদের।’

– ‘তাদের দিয়ে কি হবে? আচ্ছা ফুপু যে তন্ময়কে টাকা দিয়েছে দেখবে?’

– ‘কই?’

– ‘থাক, এখন দেখা লাগবে না। সময় আসুক দেখবে।’

*

আজ শুক্রবার। জুম্মার নামাজ পড়ে সবাই খেতে বসেছেন। তরুও সবার সাথে খাবার টেবিলে। তখনই আরিফুল সাহেবের ফোন বেজে উঠলো। পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোন বের করে নাম্বার না চেনায় রিসিভ করে বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যালো, কে বলছেন?’

ওপাশ থেকে সালাম দিয়ে গম্ভীর গলায় বললো, ‘আমি নির্জন, আপনার সাথে একটু জরুরি কথা আছে।’

তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘নির্জন?’

দাদার মুখে নামটি শুনে তরু বিষম খেল।

___চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে