#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_২৯
.
এরপর আরও সপ্তাহ দুয়েক চলে গেল।
সরাসরি তাদের কোনো প্রকার যোগাযোগই হলো না।
নির্জন শুধু নুসরাতের মাধ্যমে তরুর খোঁজ-খবর নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। ইশহাক সাহেব আজকাল তাকে অফিসে যেতে জোর দেন। কাজ-কর্ম ধীরে ধীরে বুঝে নিতে বলেন। সেও যায়। শফিক সাহেব তাকে এটা-সেটা বুঝিয়ে দেন।
আজও গিয়েছিল সে। কিন্তু ফিরে এলো বিকেল তিনটার দিকে। নুসরাত একটা মেসেজ দিয়েছে, ‘ভাইয়া ফ্রি হয়ে একটা কল দিবেন। তরুর ব্যাপারে কিছু কথা আছে।’
এই মেসেজ দেখেই সে সোজা বাসায় চলে এসেছে। বাইরেও কথা বলা যেত। তবুও তরুর বিষয়ে কথা হবে। একটু শান্তিমতো বাসায় এসে বলবে। ফ্রিজ থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেয়ে রুমে এসেই কল দিল নুসরাতকে। রিসিভ করলো সে।
– ‘হ্যাঁ নুসরাত, বলুন কি যেন তরুর কথা বলবেন।’
– ‘ভাইয়া, ভোরে মেসেজ দিয়েছিলেন না? তরুর কি খবর, যোগাযোগ হয়েছে কি-না আর। আমি পরে একবার তরুকে কল দিয়েছিলাম৷ কথা হয়েছে।’
– ‘কি কথা হলো বলুন।’
– ‘অনেক কিছুই হয়েছে। বেশ কয়েকদিন আমি কল দেইনি। মানে বুঝেনই তো ফুপুকে দিয়ে তারপর ওর সঙ্গে কথা বলতে হয়। কাজটা একটু বিরক্তিকর না?’
– ‘হ্যাঁ তা ঠিক।’
– ‘ওদের ফ্যামিলি একটা অভিনব সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেয়া উনার নানাবাড়ি এখন। মানুষজনকে বলা হয়েছে ও অসুস্থ তাই বাড়িতে এসেছিল। আবার জামাইর বাড়ি চলে গেছে।’
– ‘মাইগড! তাই না-কি?’
– ‘হ্যাঁ, তরুর জন্য ওদের হাতে একজন পাত্র আছে। আমার আরেক ফুপু দিয়েছেন দেখে। মানে তরুর খালা। ওই পাত্রপক্ষ গতকালই তরুকে দেখে গেছে।’
– ‘হোয়াট! কি বলছেন আপনি? তরু রাজি হয়ে গেল?’
– ‘না, সে পরিবারকে অনেক বুঝিয়েছে। বলেছে পড়ালেখা করতে চায়, বিয়ে করবে না সে। কিন্তু ওই পাত্রই না-কি বলেছে বিয়ের পর পড়তে দেবে। তার বাড়ির কাছেই ভার্সিটি আছে, অনার্স করতে পারবে।’
– ‘আমি বুঝলাম না, তরু এগুলো মানবে কেন? ওর তো কোনো দোষ নেই। দোষ করছে একজন, তার সঙ্গে পরিবার এরকম করছে কেন?’
– ‘তরু এসব বলেছে। ফ্যামিলির কথা বিয়ের পর পড়াশোনাও করতে পারবে। অন্যদিকে ফুপুর কথা হচ্ছে জানাজানি হলে পরিবারের বদনাম হবে। তার আগে বিয়ে দিয়ে দিলে ভালো। এগুলোতে বাঁধা দিলে ওর নিজেরই ক্ষতি। তাছাড়া আরেকটা ব্যাপার।’
– ‘কি?’
– ‘তরু প্রকাশ না করলেও আজ বুঝলাম সে অল্প হলেও আপনার উপর রেগে আছে৷ মানে ওর ধারণা আপনি অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে তার ফ্যামিলির কাছে কালার হয়ে গেছেন।’
নির্জন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ সেটাই, ও আমার প্রতি রেগে আছে প্রথমদিন চ্যাটেই বুঝেছি। কিন্তু ভালোমতো কথা বলারই সুযোগ পাচ্ছি না। প্লিজ আপনি একটু হেল্প করুন। ওদের বাড়িতে কষ্ট করে বেড়াতে যান, ভালো হবে।’
– ‘কিন্তু সেটা কীভাবে ভালো হবে ভাইয়া?’
– ‘সরাসরি তরুর সব জানতে পারবেন। আপনার ফোন দিয়ে সে আমার সঙ্গে চ্যাটও না হয় করতে পারবে। কয়েকদিনের জন্য একটু যান প্লিজ।’
নুসরাত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে আমি যাব। কবে যাব পরে জানাচ্ছি, ঠিক আছে?’
– ‘ওর বিয়ের আলাপ চলছে যেহেতু দুয়েক দিনের ভেতরে গেলে ভালো হয়।’
নুসরাত হেসে ফেললো,
– ‘আচ্ছা আমি জানাচ্ছি আপনাকে।’
– ‘অনেক বিরক্ত করছি তাই না?’
‘এগুলো কিছু না, রাখছি’ বলেই ফোন রেখে দিল নুসরাত। নির্জন অফিসের কাপড়-চোপড় না পালটেই দুইপা বাইরে ঝুলিয়ে রেখে চিত হয়ে শুয়ে রইল বিছানায়।
ঘণ্টা খানেক পর নুসরাত পুনরায় মেসেজ দিয়ে বললো, ‘স্যরি ভাইয়া, আমি ফুপুকে কল দিয়েছিলাম। মানে তরুর আম্মুকে। দিয়ে বললাম তোমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসবো। ফুপু মুখের উপর না করে দিলেন। বললেন এখন এসে তোর ভালো লাগবে না। আমরা ঝামেলায় আছি। কিছুদিন পর আয়।’
নির্জন মেসেজ সিন করে রাগে মোবাইলটা দেয়ালে ছুড়ে মারলো।
*
তরু অন্যদিন এই সময়ে মাঠে বসে বাচ্চাদের খেলা দেখে। আজ আর যায়নি। সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। অবেলায় শুয়ে আছে সে। উঠানের দিকে উত্তপ্ত কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। বেশ বুঝতে পারছে কি হচ্ছে। কেয়া ফুপু চলে এসেছে। নুসরাতের সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর দাদার রুমেও ফোন বেজে উঠে। এখানে শুয়েই ফোনালাপ শুনে বুঝেছে কেয়া ওর মামীকে কামড়ে, মারধর করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। বারান্দায় ধস্তাধস্তি টের পাওয়া যাচ্ছে, রাজিয়া খাতুন বলছেন, ‘আইছিস যখন, বাড়িতেই থাক। তোরে ঘরে চেইন দিয়া বাইন্ধা রাখমু।’
‘না আমি ওই ঘরে যাব না, ছাড়ো, ছাড়ো’ বলে চিল্লাচ্ছে কেয়া। তরু বিছানায় চোখবুজেই রইল। কোনোকিছুই তার ভেতর যেন আলোড়ন, আগ্রহ, প্রতিক্রিয়া জাগাতে পারছে না। দরজা বন্ধের শব্দ এলো, ওই ঘরে এখন কেয়ার অনবরত কান্না শোনা যাচ্ছে। দিনের আলো রুম থেকে ক্রমশই ফুরিয়ে যাচ্ছে। কামরাজুড়ে ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার। নাহেরা বেগম ছোট ছেলেকে কোত্থেকে ধরে নিয়ে এসে বাতি জ্বালিয়ে বললেন, ‘পড়তে বস।’
– ‘হাত-পা ধুয়ে আসি।’
– ‘যা।’
সে চলে গেল। নাহেরা বেগম বিছানায় এসে বসে বললেন, ‘কিরে, তুই এভাবে সারাদিন শুয়ে আছিস কেন?’
তরু মাথা তুলে তাকিয়ে বললো, ‘তাহলে কি করবো?’
– ‘সারাদিন শুয়ে থাকবি না-কি?’
– ‘বলো কি করবো? বলে দাও। সব তো বলেই দিচ্ছ।’
‘ঘ্যাড়ত্যাড়ামি করবি না, শেষে ফুপুর মতো কপাল পুড়বে। যা করছি ভালোর জন্য করছি’ তারপর ফিসফিস করে বললেন, ‘তোর ফুপু যা কাণ্ড করছে তা কয়দিন গোপন থাকবে? বল, তুই বল? তোর বাপের কাছ থেকে জানছি কেয়া কোন হোটেলে গিয়ে তন্ময়ের লগে কোথায় থাকছে সব ভিডিয়ো আছে। পুলিশ ওর জামাইকে দিছে৷ একবার এসব মানুষ জানাজানি হলে কি হবে বুঝেছিস?’
তরু বিছানা থেকে উঠে মায়ের দিকে অবাক হয়ে তাকালো। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে তরু এখনও এই বিষয়টা জানে না। সে শুধু হুস্নার কাছ থেকে জেনেছিল বাসায় ইশহাক সাহেব এসে তন্ময় আর কেয়াকে একসঙ্গে পেয়ে যান। এর বাইরেও কিছু একটা হয়েছে আন্দাজ ছিল, কিন্তু এরকম বিষয় সে বোঝেনি। তারমানে কি? ফুপাকে পুলিশ ভিডিয়ো দিয়েছে, তিনি এগুলো দেখেই হার্ট অ্যাটাক করে কি হসপিটাল যান? এবং এই কারণেই জানান কেয়া যেন হসপিটাল না আসে? এসব জেনেই বুঝি নির্জন সেদিন এতো রেগে গিয়েছিল? নিজের বাপ একজনের অপকর্মের জন্য মরতে বসেছিল জেনে একটা ছেলে রাগবে তাইই তো স্বাভাবিক। তরুর বুকটা হঠাৎ দুমড়ে-মুচড়ে উঠলো। সে এতদিন ভেতরে ভেতরে অল্প হলেও নির্জনের প্রতি কিছুটা রাগ-অভিমান পুষে রেখেছিল। কখনও ভালোভাবে কথা হলে, সুযোগ পেলে উগড়ে দিতো। সেদিন রাতে তাকেও নির্জন দোষারোপ করায় অভিমান করে কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে চলে এসেছিল। ভেতরের সেই সুপ্ত রাগ থেকেই চ্যাটে নির্জনকে বলে ফেলেছিল, ‘আমাদের আর যোগাযোগ রেখে কি হবে? কি দরকার কথা বলে?’
এতকিছুর পরও মানুষটা নিজেই পাগল হয়ে যোগাযোগ করে? তরু চাইলেও তো আরেকটু ওর সঙ্গে যত্ন করে কথা বলতে পারতো। প্রকাশ না করলেও সে কি ভেতরে ভেতরে নির্জনের ওইদিনের রূপ, গালাগাল, তাকে দোষারোপ করা অপছন্দ করেনি? করেছে। গতকালও চিন্তা করেছে নির্জন এত বাড়াবাড়ি না করলেই পারতো। তাকে যদি ভালোই বাসে, তাহলে তার পরিবারের কাছে তো খারাপ না হয়ে বাবাকে দিয়ে ডিভোর্স করিয়ে নিলেই পারতো। এসব চিন্তার জন্য তরুর এখন রীতিমতো লজ্জা হচ্ছে। কেউ না জানুক সে তো জানতো নির্জন তার বাবাকেই পৃথিবী মনে করে। সেই বাবার সঙ্গে এমন অন্যায় জেনেও সে কীভাবে নিজেকে কন্ট্রোল করতো? একটু ধমকের জন্য, নিজের আত্মসম্মানের জন্য সে কিছু না বলেই চলে এসেছিল? মানুষটার দুঃসময়ে তরু কি একটু পাশে থাকতে পারতো না? সেদিন রাতে ধমক খেয়েও পরে ওর রুমে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করতে পারতো না কি হয়েছে? একটু সান্ত্বনা দিয়ে পাশে থাকতে পারতো না? সে কেবলই নিজের লজ্জা, আত্মসম্মান নিয়েই চিন্তিত ছিল। এবং ভেবেছিল নির্জন যোগাযোগ না করলে সে করবে না। এখন হঠাৎ কি যে হলো তরুর। চোখ দু’টা ছল-ছল করে উঠলো। কান্না কোনোভাবেই আঁটকে রাখতে পারছে না৷ নাকটা কেমন যেন জ্বলছে, ঠোঁট দু’টো কাঁপতে শুরু করেছে। তরু দুই হাতে মুখটা ঢেকে ফেললো। নাহেরা বেগম অবাক হয়ে ওর হাতে টেনে সরিয়ে বললেন, ‘আরে কি হয়েছে কাঁদছিস কেন?’
তরু জবাব দিল না। নাহেরা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বুকে টেনে এনে বললেন, ‘হয়েছে, আর আহ্লাদ দেখাতে হবে না। এখন বুঝেছিস তো কেন বিয়ের জন্য মা-বাবা পাগল হয়েছে? আমরা তোর ভালোর জন্যই এমন করেছি।’
তরু সঙ্গে সঙ্গে আবার চোখের পানি মুছে নিয়ে বললো, ‘আমি বিয়ে করবো না আম্মা। ফাইনাল কথা।’
নাহেরা বেগম অবাক হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই শুনলেন ‘ওরে আজ আমি মেরেই ফেলবো’ বলে আরিফুল সাহেব বারান্দা দিয়ে কেয়ার রুমের দিকে যাচ্ছেন। তিনি বাইরে ছিলেন। এখন এসেছেন।
‘মারুক, বেশি বাড়ছে কেয়া’ অস্ফুটে বলে নাহেরা বেগম উঠে রান্নাঘরে চলে গেলেন।
কেয়ার আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। কিছু একটা দিয়ে আরিফুল সাহেব মারছেন। তরু বিছানা থেকে উঠে গেল৷ বারান্দা দিয়ে কেয়ার রুমে গিয়ে দেখে চুলের মুঠি ধরে টেনে ওকে নুইয়ে একটা লাঠি দিয়ে আরিফুল সাহেব পিঠে বেধড়ক মারছেন। হাত বাড়িয়ে লাঠিটা ধরে নিল তরু। আরিফুল সাহেব ধমক দিয়ে বললেন, ‘ছাড়, তুই এখানে কেন এসেছিস?’
– ‘এসেছি ফেরাতে। কারণ, ফুপু অবশ্যই দোষ করেছে। কিন্তু তাকে এদিকে ঠেলে দিয়েছিলে তোমরা। এবং এখনও দাম্ভিকতার সাথে ভুলই করে যাচ্ছ। অন্যকে শাসন করার আগে নিজেদের শুধরাও।’
– ‘চটকনা দিয়ে দাঁত ফেলে দেবো বেয়াদব মেয়ে কোথাকার। কার সামনে কি বলিস হুশ থাকে না? মা-বাপ লাই দিয়ে মাথায় তুলেছে? তোর বাপ আজ আসুক..।’
‘কি হয়েছে, তরু তুই এখানে কেন’ বলে নাহেরা বেগম ছুটে এলেন।
___চলবে…..
লেখা: জবরুল ইসলাম
#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_৩০
.
নির্জন রাত আটটায় বাইরে থেকে ফিরে এসেছে। আছমা চৌধুরী দরজা খুলে দিয়েছেন। সে ভেতরে এলো। ইশহাক সাহেব সিটিংরুমে চা হাতে বসা। অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘এই অবস্থা কি নির্জন? তুমি এখনও অফিসের কাপড় চেঞ্জ করোনি? ফিরেছো তো সেই বিকালে?’
‘এমনিই আব্বা, ভালো লাগছিল না’ বলে সে উপরে চলে এলো। খানিক পর আছমা চৌধুরী এলেন। তার মোবাইল বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘মেঝেতে পড়ে আছে দেখে নিয়ে রাখলাম। গ্লাস ফাটলো কি করে?’
নির্জন হাতে নিয়ে বললো, ‘পড়ে গেছিল আর কিছু না।’
– ‘চা খাবে? দেবো? তোমাদের বাপ-ছেলের তো যখন-তখন চা-কফি চলে।’
– ‘না এখন খাব না, যাও তুমি।’
আছমা চৌধুরী চলে গেলেন। নির্জন একটা সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে জ্বালিয়ে তোয়ালে হাতে বাথরুমে গেল। শাওয়ার ছেড়ে আসন পেতে বসলো সে। পিঠে অনবরত জল পড়ছে। হাতে সিগারেট। টানছে খানিক পর পর। ধীরে ধীরে পানির ছোট ছোট ফোঁটা ছিটকে এসে পড়ে সিগারেট ভিজে যাচ্ছে। নিভে যাওয়ার আগপর্যন্ত টানলো সে। তারপর ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে গোসল করে বের হলো। কাপড়-চোপড় পরে মোবাইল যখন হাতে নিয়েছে তখন নয়টা। ডিসপ্লে ফেটে গেলেও অন আছে। চেক করে দেখলো নুসরাত আরেকটি মেসেজ দিয়েছে, ‘কয়েকদিন পর না হয় যাব, চিন্তা করবেন না।’
নির্জন লাভ রিয়েক্ট দিয়ে রেখে দিল ফোন। সে ভাবছে নিজেই গ্রামে চলে যাবে৷ তরুর সঙ্গে দেখা করবে। পরে যা হয় হবে। বিয়ে কোনোভাবেই হতে দেবে না।
*
আসলাম সাহেব বাইরে ছিলেন। এসে সবকিছু শুনে রেগে গেলেন। এত বেয়াদব হয়েছে মেয়েটি। ডেকে আনলেন দাদার কাছে মাফ চাওয়াতে।
তরু ওর দাদার রুমে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আসলাম সাহেব গিয়ে চেয়ারে বসলেন। আরিফুল এবং রাজিয়া খাতুন বিছানায়।
– ‘তোর দাদার সঙ্গে বেয়াদবি করলি কেন?’
তরু মাথা তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বেয়াদবি আবার কি করলাম?’
– ‘আবার তর্ক করিস? কি বেয়াদবি করেছিস বলতে হবে? মাফ চা গিয়ে। গিয়ে বল দাদা আর কোনোদিন এমন করবো না।’
আরিফুল সাহেব রূঢ় গলায় বললেন, ‘মাফ আমার কাছে চাওয়া লাগবে না। মেয়েকে মাথায় তুলেছো, দু’দিন পরে তোমরাই টের পাবে। ওকে নিয়ে এখান থেকে বের হও।’
আসলাম চৌধুরী তরুর দিকে দাঁত কটমট করে তাকিয়ে বললেন, ‘কি হলো, এখনও দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মাফ চা।’
তরু চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। আসলাম সাহেব গর্জে উঠে ডাকলেন, ‘নাহেরা, এই নাহেরা।’
রান্নাঘর থেকে তরুর মা এসে দরজার সামনে দাঁড়ালেন। স্বামীকে বললেন, ‘আমাকে আবার ডাকাডাকির কি আছে?’
– ‘মেয়ে কেমন হয়েছে দেখবা না? পড়ালেখা করাও আরও। জজ-ব্যারিস্টার বানাও। বাপ-দাদাকে সম্মান দেয় না। এমন বেয়াদব হয়েছে।’
– ‘কিরে তরু। এত দেমাগ কেন তোর? দাদাকে গিয়ে খুশি করলে তোর কি ইজ্জত কমে যাবে?’
তরু কোনো জবাব না দিয়ে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নাহেরা বেগম এবার ধাক্কা দিয়ে বললেন, ‘যা, গিয়ে বল দাদা আর এরকম ভুল হবে না।’
তরু মাথা তুলে তাকিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে বলবো, আগে বলো কি ভুল করেছি।’
– ‘কেন তুই কি ভুল করেছিস জানিস না?’
– ‘না।’
– ‘তুই দাদার লাঠিতে ধরলি কেন? আর পাকনার মতো কি বলেছিস মনে নাই?’
– ‘কি বলেছি?’
– ‘অন্যকে শাসন করার আগে নিজেকে শুধরাও? এটা তুই দাদাকে বলবি? আর আমাদের ভুলে কেয়ার এই অবস্থা মানে কি?’
– ‘এগুলো বলায় আমার ভুল কোথায়? ফুপুর দোষ আছে তা মানি। কিন্তু তার প্রতিটি ভুলের সঙ্গে তোমরা জড়িত তা তো সত্য।’
আসলাম সাহেব ধমক দিয়ে বললেন, ‘বেশি বেড়েছিস তাই না?’
– ‘আমার বাড়তে নিষেধ থাকলে আমাকে মাফ চাইতে বলো না। আমার ব্যাপারে তোমরা আর কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ো না।’
নাহেরা বেগম ওর মাথায় আঙুল দিয়ে গুঁতা দিয়ে বললেন, ‘কি বলছিস এসব হিসাব আছে?’
– ‘আছে, যদি আমাকে মাফ চাওয়াতে চাও। আমার সব কথা শোনা লাগবে। না হলে পথ ছাড়ো। আর আরেকটা কথা। আমি এখন বিয়ে করবো না। বিয়ে না বসলে আমার ভবিষ্যৎ ফুপুর মতো হবে না। বরং বসলে হবে।’
– ‘তোর কথাই কথা না-কি? ছেলে পক্ষ দেখে চলে গেছে। এখন কথা পাকাপাকি হবে।’
– ‘ছেলে পক্ষ দেখার ব্যাপারে আমি রাজি হয়েছি? তোমরা জোর করে কাপড় পরিয়ে দেখিয়ে ছেড়েছো। তোমাদের কথায় আমার জীবন নষ্ট করবো না।’
আরিফুল সাহেব খ্যাক-খ্যাক করে হেসে বললেন, ‘দেখছো মাস্টারনি বানিয়ে কি হইছে? সে জীবন-টীবন সবকিছু বুঝে। আমাদের চুল পাকছে শুধু বয়সে।’
আসলাম চৌধুরী মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মাফ চাইবি কি-না?’
– ‘আমার ভুল আগে দেখিয়ে দিলে চাইব।’
– ‘তুই লাঠিতে ধরেছিস। দাদাকে বলেছিস আগে নিজে ঠিক হতে। এগুলো ভুল না?’
– ‘আমার কাছে ভুল লাগে না।’
– ‘কেন?’
– ‘ইশহাক সাহেবের সঙ্গে ফুপুর বিয়ে দেয়ায় তোমাদেরও ভুল ছিল।’
– ‘ও নিজে রাজি হয়ে বিয়ে বসেছে। আমাদের কেন ভুল থাকবে?’
– ‘সে প্রথমে না করেছিল।’
– ‘পরে রাজি হয়েছে।’
– ‘পরে রাজি হয়েছে কেন? কারণ দাদি আর আম্মা তাকে বুঝিয়েছেন, অনেক বড়লোক, ভালো থাকবি, দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াবি। এসবের কারণে সে ধীরে ধীরে রাজি হয়ে গেছে৷’
আরিফুল সাহেব রূঢ় গলায় বললেন
– ‘সে কি ফিটার খায়? বুঝালো আর রাজি হয়ে গেল?’
– ‘ফুপুর দোষ আছে তা আমি না করিনি। আমি বলেছি তোমরাও দোষী৷ তাছাড়া তখন বুঝিয়ে রাজি না হলে তোমরা জোর করে ঠিকই বিয়ে দিতে। সেটার প্রমাণ, আমাকে জোর করেই বিয়ে দিতে চাচ্ছ। আমার কোনো দোষ নেই, অথচ মোবাইল নিয়ে রেখেছো, পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়েছো। বুঝিয়ে না হলে আমাকে জোরেই বিয়ে দিবে। প্রয়োজনে মারধর শুরু করবে।’
আসলাম সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শুনছো তোমার মেয়ের কথা?’
তরু হেসে বললো, ‘আম্মা কি বলবে? ফুপুকে বুঝানোর জন্য আম্মা পুরো এক রাত ওর সাথে থেকেছিল। তুমিই বলেছিল কেয়াকে বুঝাও। তোমরা এমন অভিভাবক, তাকে বারবার টাকার, বিলাসী জীবনের লোভ দেখিয়েছো। দাদি বলতেন, বুড়া-জোয়ান কিছু না। টাকা হইলে সবই ভালো লাগে। টাকা নাই, সংসারে অভাব-অনটন, তখন সুন্দর আর জোয়ান জামাইও ভালো লাগে ন৷
তোমরা একবারও ভাবোনি ফুপুকে এত কোটিপতির কাছে বিয়ে না দিয়ে মোটামুটি ভালো জায়গায় তো ঠিকই বিয়ে দেয়া যেত। পড়ালেখা করছিল, দেখতেও সুন্দর। আর বিয়ে যেহেতু দিয়েছো, তাহলে জামাই কিছু না টাকাই সব এসব মন-মানসিকতা কেন?
ইভেন যখন ছোট চাচাকে বিদেশ যাওয়ার টাকা দিল৷ তোমাদের কাছে তখন ইশহাক সাহেব ভালো হওয়ার বদলে বলদ হয়েছে। তোমাদের নিজেকে অনেক চালাক মনে হয়েছে। অথচ সে টাকা দিয়েছে স্ত্রীর কথায়। বউকে খুশি রাখতেই দিয়েছে। কখনও তোমরা কেউ ফুপুকে বলেছো তোর জামাই কত ভালো, বয়স হলেও তোকে কত যত্নে রেখেছে৷ তুই বলতেই টাকা দিয়ে বিদেশ পাঠিয়ে দিল ভাইকে? সুন্দরভাবে সংসার কর, ইত্যাদি।
এসব তোমরা বলো নাই। বুড়োর টাকা আছে। আর সে বলদ। তোমরা অনেক চালাক। এরকমই ভাব ছিল তোমাদের।
এইযে এখন ফুপুকে তোমরা আসলে কেন মারো বলো তো? একবারও তোমরা ওর মূল দোষটা নিয়ে কিছু বলতে দেখি না। কার সঙ্গে অন্যায় করেছে তা বুঝিয়ে বলো না। প্রথমদিন নিয়ে এসে শুনলাম নির্জন ভাইকে গালাগাল করছো। একজনের বাপ তোমার অন্যায়ের জন্য মরতে বসবে। সে রেগে গিয়ে কোন পরিস্থিতিতে গায়ে হাত তুলেছে সেটা না ভেবেই ওর দোষ। ওইদিন ফুপুকে জিজ্ঞেস করছো টাকা কোথায়। সে তোমাদের সামনে বলছে বুইড়া গরুর বাচ্চা মিথ্যে বলেছে। তোমরা ওই গালিকে পাত্তাই দাওনি। যেন এটা দোষ না। তোমাদের মারের কারণ, রাগের কারণ ভিন্ন। তোমাদের চিন্তা মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিংবা মেয়ে যদি টাকা এনে থাকে বলছে না কেন। টাকা পেলে তোমাদের কাজে আসবে।
একবারও কি কেউ বুঝিয়ে বলেছো তুই ইশহাক সাহেবকে গালি দিলি কেন? অন্যায় তো তুই করেছিস। এইযে টাকা, সে তোকে চাবি দিয়ে রেখেছিল খরচ করতে। কেন এত বিশ্বাস করতো? না, তোমাদের এসব নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নাই।
পঞ্চাশ বছর বয়সে বিয়ে করেছে। সেটা কি দোষ? দোষ হলে বিয়ে বসার পরও তো তোমাদের মেয়ে ডিভোর্স নিতে পারতো। আমি পাশের রুমে শুয়েও শুনি তোমরা ইশহাক সাহেবকে কলে বলো যে সমঝোতা করতে। কেয়া আর এমন করবে না। তা তোমরা এত বুদ্ধিমান হলে। বিয়ের আগে আম্মাকে দিয়ে বুঝাতে পারলে। এখন কেন ফুপুকে এটা বুঝাও না সে কি অন্যায়টা করেছে? ইশহাক সাহেব তারজন্য অনেক কিছু করেছেন, তাকে ভালোবাসতেন। এরকম বুঝালে সে নিজের ভুল হয়তো বুঝতো, অনুতপ্ত হতো। তোমরা কল না দিয়ে তখন সে স্বামীকে কল দিয়ে মাফ চাইলে কি ভালো হতো না?’
আরিফুল সাহেব হেসে বললেন, ‘দেখছো, তোমাদের মেয়ে এখন এই সংসারের মুরব্বি। তার থেকে বুদ্ধি নিতে হবে। ওর ধারণা কেয়া মাফ চাইলেই মেনে নিবে ইশহাক।’
– ‘তোমরা বারবার সমঝোতার কথা বলায় কি মেনে নিয়েছে? তোমরা কলে যে বলো আর এমন করবে না। এদিকে তোমাদের মেয়ে এখনও গালি দেয় উনাকে। এসবের মানে কি?’
আসলাম সাহেব ধমক দিয়ে বললেন, ‘এজন্যই তো ওকে মারা হয়। ওর খাসিলত ভালো না৷ তাহলে তুই গিয়ে লাঠিতে ধরলি কেন?’
– ‘তোমরা মারছো টাকার জন্য। ওর ভুল কোথায় সেটা নিয়ে মাথা ব্যথা তো নেই। দাদা কলে ইশহাক সাহেবকে বলতে শুনলাম উনি টাকার কথা এখন বানিয়ে বলছেন। আবার এদিকে ফুপুকে টাকার জন্য মারধর করছো। কারণ টাকাটা পেলে ইশহাক সাহেব লাগবে না আর৷ অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে পারবে।
এখন ফুপু ওই বাড়িতে হাত কামড়ে চলে এসেছে। যদি ওর মাথায় সমস্যা এসে থাকে তাহলে মেরে কি লাভ? আমি লাঠি ধরে ভুল কি করলাম? অকারণ মারলে ফেরাবো না?’
আরিফুল সাহেব বললেন,
– ‘ও ভঙ্গি ধরছে, তোর এত দরদ দেখাতে হবে না।’
– ‘ভঙ্গি ধরলে তো সে সুস্থ আছে। তাহলে ওকে বুঝাও, অনুতপ্ত হোক, সে নিজে কল দিয়ে মাফ চাক। এরপর ইশহাক সাহেব মানলে মানবেন না মানলে নেই৷ আর অনুতপ্ত হলে টাকার কথাও স্বীকার করবে। টাকা নিশ্চয় তন্ময়কে দিয়েছে। এই ছেলেকে কেন এমনি এমনি ছেড়ে দিতে হবে? খানপুরের ছেলে, ওর মা এখনও আছে৷ পাড়া-পড়শী আছে। টাকা যদি নিয়ে থাকে, কেন নিল? আর এভাবে একজনের সংসার কেন ভাঙবে? আম্মা বললো ওকে পুলিশ ধরেছিল। সকল তথ্য পুলিশ আর ইশহাক সাহেবের কাছে আছে। এগুলো দিয়েও তো ওকে ধরা যায়।’
আসলাম সাহেব নাহেরাকে বললেন, ‘ওকে সামনে থেকে সরিয়ে নে। বেশি বুঝে। এগুলো দেখিয়ে ওই ছেলেকে ধরলে নিজের ইজ্জত খুব থাকবে তাই না?’
নাহেরা বেগম তখন ইতস্তত করে বললেন, ‘তরুর এই কথা তো ঠিক আছে, অন্তত এই ছেলের মা’র সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করো। আর সে কেয়ার সঙ্গে এতকিছু করলো। তাহলে বিয়েও তো করতে পারে। আমরা তো কিছুই জানি না এখনও।’
আরিফুল সাহেব বললেন, ‘ওই ছেলের কথা তো কেয়াকে জিজ্ঞেস করতে বলছিলাম।’
– ‘ও তো বলতো কথা হইছে। এরপর ওর মাথায় প্রব্লেম চলে এলো।’
তরু শান্ত গলায় বললো, ‘ওর বাড়িতে কেউ গেলেই হয়। গিয়ে ওর মা’কে খুলে বলো।’
আসলাম সাহেব বললেন, ‘এরকম বিয়ে মানবেও না।’
রাজিয়া বেগম প্রতিবাদ করে বললেন, ‘না মানলে নাই, আমার মাইয়ার এত বড় সর্বনাশ করছে। তারে এমনি এমনি ছেড়ে দিবা না-কি?’
আরিফুল সাহেব মাথা নাড়লেন। তরুকে বললেন, ‘ওর বাড়ি চিনস?’
– ‘হ্যাঁ, চিনি, খানপুরের প্রাক্তন একজন স্যারের ছেলে।’
– ‘কাল যাব। এই পোলার জন্যই তো এতকিছু। সে যদি বিয়ে না করে তাহলে এসব কেন করলো? স্যার কেমন শয়তানের বাচ্চা জম্ম দিছে সবাই জানুক।’
আসলাম সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘সে বিয়ে করবে না বলেছে না-কি তোমাকে? আর সবাই জানুক বলে লাফ দিয়ো না আব্বা। ওর মা’কে শুধু জানাও। বিয়ের কথা বলো। দেখো কি বলে। সবাই জানলে নিজেদের ইজ্জতও যাবে। ঘরে আমার বিবাহ যোগ্য মেয়ে আছে।’
আরিফুল সাহেব চুপ করে থেকে খানিক পর বললেন, ‘আচ্ছা আগে যাই। গিয়ে দেখি। তরুকে কাল নিয়ে যাব।’
পরদিন অবশ্য সবাই কেয়াকে তন্ময়ের ব্যাপারে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করলেন। ও একেকবার ঠিকঠাক কথা বললেও, আবার জবাবই দিচ্ছে না। ওর কাছ থেকে তেমন কিছুই জানা গেল না। তরুকে নিয়ে আরিফুল সাহেব বের হলেন দশটায়। এই বিশ্রী ব্যাপারে কথা বলতে একটা বাড়িতে যাবে। তাই বোরখা নিকাব পরে বের হলো তরু। মা’কে বলে নিজের মোবাইলটাও সঙ্গে নিল। তন্ময়ের বাড়িতে এসে তারাও দরজা তালা দেখে হতবাক। তরু ইতস্তত করে বললো, ‘দাদা পাশের ঘরে জিজ্ঞেস করো এরা কোথায়। জানবে নিশ্চয়।’
আরিফুল সাহেব গিয়ে ডাকলেন। তরু পিছু পিছু গেল। সেদিনের মহিলা বের হলো। সঙ্গে আরেকটি মেয়ে। আরিফুল সাহেব বললেন, ‘এই ঘরের মানুষ কোথায় জানেন?’
– ‘বরিশাল চইলা গেছে।’
তরু বললো, ‘কতদিন থেকে নেই? আসবে কবে জানেন?’
– ‘আপনেরা কে কন তো? বড় এক ঝামেলায় পড়ছি। কিছুদিন আগে লাগালাগা তিনদিন একটা মাইয়া আসছিল। আমাকে দিয়া কল দেওয়াইতো তন্ময়ের মাকে। কল না দিলে বইসা থাকতো। নাম্বারও চাইতো। আমি দেই নাই। ওরা না করছিল।’
তরুর বুঝতে অসুবিধা হলো না। কেয়াইই এসেছিল। সে আমতা-আমতা করে বললো, ‘যে মেয়ে এসেছিল আমরা ওরই পরিবারের মানুষ। একটু বলবেন কি বলেছে এসে? কি কথা হয়েছে এদের?’
– ‘তেমন কিছুই কয় নাই। কিন্তু আমরা সবাইই বুঝতে পারছি কি হইছে। তিন নাম্বার দিন তো মেয়েটা আমাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা কইছে তন্ময়ের লগে। শেষ পর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে কইছে তুই টাকা নিয়ে পালিয়েছিস। কোন একটা জায়গার নাম বললো সেইখানে ভিডিয়ো আছে তোরে ধরবো।’
তরু ভ্রু-কুঁচকে বললো, ‘জায়গাটার নাম মনে আছে?’
মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বললো, ‘নবান্ন রেস্ট্রুরেন্টে গেলে সিসি ক্যামেরা চেক করলে এখনও মিলবে টাকা যে দিছি। এসব অনেক কথাই বলেছে।’
তরু নামটা কয়েকবার নিজে নিজে আওড়ানোর পর বললো, ‘নাম শিওর এটা বলেছিল?’
– ‘হ্যাঁ, আমরা সবাইই মনযোগ দিয়ে শুনছিলাম। আসলে ঘটনা কি আমরা সবাইই বুঝতে চাচ্ছিলাম।’
তরু ইতস্তত করে বললো, ‘নাম্বারটা দিতে পারবেন?’
– ‘না তা পারবো না। ওই মেয়ে মনে হয় ফোনে কথা বলে নাম্বার দেখে মনে রেখে পরে কল দিয়েছিল। শেষে ওরা আমাদের সাথেই কল দিয়ে রাগারাগি করেছে।’
আরিফুল সাহেব ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘তাই বলে আপনারাও নাম্বার দিবেন না? এটা কেমন কথা?’
তরু দাদার হাত ধরে বললো, ‘লাগবে না আসো।’
দু’জন বাড়ি থেকে চলে এলো। রাস্তায় এসে আরিফুল সাহেব আফসোসের গলায় বললেন, ‘তাইলে তো কথা সত্য। এক দুই টাকা না, পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে ভাগছে। মাঝখানে ইশহাক ভাবছে কেয়া নিয়ে এসেছে।’
তরু মাথা নাড়লো। সে আসার পথেই নির্জনকে একটা টেক্সটে বাড়ির পরিস্থিতি বলেছে। কল দিতেও না করেছে। এতক্ষণ নির্জন মেসেজ দিয়ে গেছে। তরু রিপ্লাই দেয়নি। এখন সিন করে বুঝতে পারলো নির্জন গ্রামে আসতে চাচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি রিপ্লাই দিল, ‘আপনি গ্রামে আসবেন না। আমি বিয়েটা ভেঙে ডিগ্রিতে আগে ভর্তি হই।’
নির্জন সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই দিল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, কিন্তু মোবাইল কি দিয়ে দিয়েছেন?’
– ‘নিয়েও নিতে পারেন। এখন শোনো, আমি দাদার সঙ্গে তন্ময়ের বাড়িতে এসেছি। হেঁটে হেঁটে মেসেজ দিচ্ছি। দাদা হঠাৎ ধমক দিবে। বেশি কথা বলা যাবে না। তন্ময় পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে ভাগছে। ফুপুর কাছে না ওই টাকা।’
– ‘টাকা কীসের?’
– ‘তুমি জানো না? বুঝেছি ফুপা তোমাকে বলেননি। এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। সমস্যা হলো, তন্ময় টাকা নিয়ে পালিয়েছে। ফুপুর মাথায় সমস্যা এখন। আমরা জানতে পারছি নবান্ন রেস্ট্রুরেন্টে ওকে টাকা দিয়েছিল ফুপু। রেস্তোরাঁটা চিনেছো?’
– ‘হ্যাঁ, চিনেছি। আমাদের বাসার কাছেই।’
– ‘তন্ময় অস্বীকার করছে টাকা নিয়েছে। ওখানে কি রেকর্ড থাকবে না?’
– ‘কবে দিয়েছে তারিখ তো জানি না। তোমার ফুপুকে জিজ্ঞেস করো। আমি না পারলে পুলিশ দিয়ে চেক করিয়ে নিব।’
– ‘ফুপুর মাথায় সমস্যা..।’
‘মোবাইলে কি এত?’ ধমক দিয়ে উঠলেন আরিফুল সাহেব। তরু মেসেজ পাঠিয়েই ডাটা অফ করে, সাইলেন্ট করে রেখে দিল। মোবাইলটা সে আর কোনোভাবেই পরিবারকে দিতে চায় না।
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম