প্রণয়ে প্রলয়ের সুর পর্ব-২৭+২৮

0
808

#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_২৭
.
নির্জন কথাটি শুনেই প্রথমে ভেবেছে কল কেটে দেবে। কিন্তু তার আগেই আসলাম সাহেব গমগমে গলায় বললেন, ‘কে বলছেন?’

সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে কিছু একটা ভেবে বললো,

– ‘আমি নির্জন, তরুর সঙ্গে একটু কথা ছিল। মামা বলছেন না-কি?’

আসলাম সাহেব রূঢ় গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ, কিন্তু ওর সঙ্গে কি কথা তোমার?’

– ‘ওর কোচিং এর স্যারেরা তো আমার পরিচিত। রাস্তায় একজনের সাথে দেখা হওয়ায় বললেন তরু দুইদিন থেকে ক্লাসে আসছে না কেন? তাই এখন হঠাৎ মনে পড়ায় ভাবলাম ওকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করি কোচিং করবে কি-না। একটা ঝামেলা হয়েছে ঠিক আছে। তাই বলে ওর তো পড়ালেখায় ক্ষতি হতে দেয়া যায় না। সে এসে আমাদের এখানে থেকেই কোচিং করুক না, সমস্যা কি।’

– ‘না, সে কোচিং করবে না, রাখছি।’

কল কেটে গেল। নির্জন মোবাইল পাশে রেখে কপালে হাত ঠেকিয়ে দীর্ঘ সময় চুপ করে রইল। কলটা না দিলেই বুঝি ভালো হতো? তারজন্য এখন তরু কত ঝামেলা পোহাতে হবে কে জানে। মেয়েটা ফুপুর কারণে এমনিতেই বিপদে পড়েছে। পড়ায় ক্ষতি হলো। এখন দৈনন্দিন জীবন যাত্রায়ও প্রভাব পড়বে। নির্জনের বুকটা যেন তরুর জন্য কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সবই যেন তার দোষ। সে নিজেই কেয়ার সঙ্গে তরুকে এ বাড়ি থেকে বিদায় করে দিয়েছে। বুকে চাপা এক কষ্ট হচ্ছে তার। সেই কষ্ট নিয়ে ছটফট করে পুরো রাত একরকম নির্ঘুম কাটিয়ে দিল সে। পরেরদিন ঘুম থেকে উঠেই কোনো মেসেজ না দেখে ভয় করতে শুরু করলো তার। ওর বাবা কি তাহলে মোবাইল নিয়ে নিল? না হয় একটা হলেও তো মেসেজ দিতে পারতো তরু। না-কি সে নিজেই যোগাযোগ করতে চাচ্ছে না? নির্জন ‘শুভ সকাল’ লিখে মেসেজ দিয়ে পরীক্ষা করে হতাশ হলো, অফলাইন দেখাচ্ছে ওকে। কি করবে এখন নির্জন?

*
বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। কেয়া আজকাল অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করেছে। রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাউকে কিছু না বলে কোথায় যেন চলে যায়। গতকাল ভোরে গিয়ে দুপুরে রোদের মধ্যে ফিরেছে। ওর মা রাজিয়া খাতুন বললেন, ‘তুই সকালে উইঠা কই গেছিলি? সবাই খুঁজতাছে।’

সে ওড়না মাথা থেকে হাতের মুঠোয় এনে ‘আমি খুঁজতেছি আরেকজনকে, তোমরা খুঁজতেছো আমারে, ভালোই তো’ বলে হেসে বারান্দা দিয়ে হেঁটে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। এরপর সারাদিন আর খুলেনি। রাতের খাবারের সময় নাহেরা বেগম একরকম ডাকতে ডাকতে পাগল হওয়ার পর খুলেছে। তিনি ভেতরে গিয়ে বাতি জ্বালিয়ে বললেন, ‘তুই শুরু করেছিস কি কেয়া? সকাল থেকে এভাবে দরজা বন্ধ করে আছিস কেন?’

তখনই আচমকা বিছানা থেকে উঠে এসে নাহেরাকে জড়িয়ে ধরে ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদতে শুরু করলো। নাহেরা বেগম সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘আর কান্নাকাটি করে লাভ নেই। ওই ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘খাবার খা এসে।’

কেয়া চুপচাপ গেল খাবার খেতে। ওকে দেখেই আসলাম সাহেব টেবিল থেকে উঠে ‘পরে খাব’ বলে রুমে চলে গেলেন।
কেয়া চুপচাপ খেয়ে এসে ঘুমিয়ে গেল।
ভোরে কেয়ার মা রাজিয়া খাতুন প্রায়ই ঘর-দোর ঝাড়ু দেন। আজও ঘুম থেকে উঠে ঝাড়ু হাতে বারান্দায় গিয়ে দেখেন কেয়া পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে বসে একা একা গান গাচ্ছে,

‘আমায় ভাসাইলি রে, আমায় ডুবাইলি রে
অকুল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে।।

কুল নাই সীমা নাই অথৈ দরিয়ার পানি
দিবসে নিশিথে ডাকে দিয়া হাতছানি রে
অকুল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে…।’

রাজিয়া খাতুন উঠান পেরিয়ে পুকুর ঘাটে গিয়ে কেয়ার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘তুই এই সাত-সকালে এইখানে আইসা বইসা রইছিস কেন?’

কেয়া পিছু ফিরে তাকিয়ে এক ঝটকায় মায়ের হাত সরিয়ে বললো, ‘তুমি যে হাত দিয়ে ঝাড়ু নেড়েছো সেই হাতে আমাকে ধরলা কেন?’

– ‘তাতে কি হইছে? আর এইখানে কি করিস?’

– ‘কি করছি দেখো না? পাগলের মতো এক কথা কয়বার জিজ্ঞেস করো? গান গাইতেছি। সাত-সকালে গান গাইলে কি সমস্যা? সমস্যা হলে বলো। আমার সবকিছুতেই তো আবার তোমাদের সমস্যা।’

– ‘ঝাড়ু দেখতাছিস হাতে? তোরে কি বলছি আর তুই কি জবাব দিতেছিস?’

– ‘হ্যাঁ ঝাড়ুর বাড়িই তো দিবা, আমি তো ফেলনা। এ বাড়িতে সামান্য গান গাইলেও আমার দোষ হয়ে যায়।’

– ‘ভূত-পেত্নী আছর করছেনি তোরে? আমি বলতেছি এক কথা, তুই আরও বলতাছিস তিন কথা৷ গান গাইতে তোরে না করছে কে?’

‘না করলে এত চিল্লাচিল্লি কেন করো। আমি আমার গান গাইব কার বাপের কি?’ বলে সে এবার জোরে জোরে গাইতে শুরু করলো, ‘আমায় ভাসাইলিরে, আমায় ডুবাইলিরে..।’

আরিফুল সাহেব বারান্দায় এসে বললেন, ‘কি হইছে এখানে।’

রাজিয়া খাতুন শ্লেষের গলায় বললেন, ‘তোমার মাইয়ার এইবার মাথা গেছে। দেখো সাত-সকালে চিল্লাইয়া গান গাইতেছে।’

কেয়া গান বন্ধ করে ফিরে তাকিয়ে বললো, ‘আমার মাথা খারাপ বলছো? তোমার বাপ-দাদা চৌদ্দ গোষ্ঠীর মাথা খারাপ।’

আরিফুর সাহেব ওর এই অবস্থা দেখে বিরক্তিতে উঠানে একদলা থু-থু ফেলে বললেন,

– ‘ইজ্জত মারার আরও বাকি রইছে তো ওর। একেবারে খায়েশ মিটিয়ে মারুক।’

নাহেরা বেগমও কথাবার্তা শুনে বারান্দায় এলেন। এসে দেখলেন কেয়া পুকুর পাড় দিয়ে ওড়না হাতের মুঠোয় নিয়ে গান গেয়ে যাচ্ছে, ‘আমায় ভাসাইলিরে, আমায় ডুবাইলিরে…।’

– ‘আব্বা ওকে গিয়ে নিয়ে আসো। ওর মাথায় গন্ডগোল হইছে মনে হয়। রাস্তায় মানুষ এসব পাগলামি দেখলে কি বলবে?’

আচমকা রাগে আরিফুল সাহেব দৌড়ে উঠান দিয়ে যেতে যেতে কেয়াকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করে ফিরে আসার জন্য ডাকলেন। কেয়া গান বন্ধ করে পিছু ফিরে তাকিয়ে হেসে বললো, ‘এই বুড়া ব্যাটা আবার চ্যাতছে কেন। আমি আমার গান গাইতেছি তাতে কার বাপের কি?’

আরিফুল সাহেব ততক্ষণে ওর কাছে চলে গেলেন। গিয়ে চুলের মুঠি ধরে পিঠে বেশ কয়েকটি কিল-ঘুষি দিয়ে টেনে বাড়ির দিকে নিয়ে আসতে লাগলেন। রাজিয়া খাতুন ছুটে গেলেন মেয়েকে রক্ষা করতে। স্বামীর হাত ধরে টেনে বললেন, ‘ওর চুলের মুঠি ছাইড়া দেও আসলামের বাপ। মানুষ দেখলে কি কইবো।’
‘তুই সর’ বলে তিনি ধাক্কা দিলেন। রাজিয়া খাতুন টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলেন পুকুরে। নাহেরা মাথায় কাপড় দিয়ে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আব্বা ছাড়ো, ওকে ঘরে নিয়ে তালা মেরে রেখে দেবো, ছাড়ো দয় করে, চিল্লাচিল্লি শুনে মানুষ এসে তামাশা দেখবে।’,

আরিফুল সাহেব ছাড়লেন। তরু আর আসলাম সাহেবও ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় বের হয়ে এলেন। কেয়াকে নাহেরা বেগম হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। তাকে অবাক করে দিয়ে কেয়া খিলখিল করে হেসে বললো, ‘তরুর মা দেখলি বুড়ার অবস্থাটা? বেইজ্জত ব্যাটা এটা কি করলো? আমারে মারছে তো মারছে। আম্মারে পানিতে ফেলে দিছে..।’

– ‘তুই হাসছিস কেয়া? তোর তো দেখি মাথা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে।’

– ‘মাথা নষ্ট না, দুঃখে হাসি।’

– ‘দুঃখে হাসছিস?’

‘হ্যাঁ’ বলে আবার খিলখিল করে হাসলো। আসলাম সাহেব বারান্দা থেকে এসব দেখে বললেন, ‘ওরে গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছা করছে নাহেরা। দরজা বন্ধ করে নিয়ে রাখ। না হলে কখন কি করি ঠিক নাই।’

কেয়া দরজার কাছ থেকে তাকিয়ে বললো, ‘তরুর মা, তোর জামাইও বুড়ার মতো চ্যাতছে।’

নাহেরা ধাক্কা দিয়ে ওকে ভেতরে ঢুকিয়ে বললো, ‘চুপ কর তো কেয়া। মুখটা বন্ধ রাখ।’

কেয়া খিলখিল করে হেসে বললো, ‘তোর জামাইর ঢং দেখতেছিস কয়েকদিন থেকে? আমি খেতে গেলে উঠে চলে যায়। আমাকে শরমের কি আছে তরুর মা?’

নাহেরা বেগম কোনো জবাব না দিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে এলেন। তরু বারান্দায় ছিল। আসলাম সাহেব ওর দিকেও দাঁত কটমট করে তাকালেন। সে সামনে থেকে আস্তে-আস্তে হেঁটে ঘরে চলে এলো। তরুর দিনকাল ভীষণ খারাপ যাচ্ছে। কেউই বুঝতে পারছে না বিনা-দোষে সে কত কষ্ট পাচ্ছে। পড়ালেখারও ক্ষতি হলো। সেদিন রাতে ওর বাবা মোবাইলটাও নিয়ে চলে গেলেন। ভাগ্যিস লক থাকায় কেউ মেসেজ চেক করতে পারছে না৷ করলে নির্জনের সঙ্গে সম্পর্কের সবই জেনে যেত। তরু মাকে গতকাল বলেছে খানপুর ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে ভর্তি হতে চায় সে৷ তিনি বলেছেন, ‘আচ্ছা তোর বাবার সঙ্গে কথা বলবো।’

এখন সেই অপেক্ষায়ই দিন যাচ্ছে তরুর। আজকাল পুরোটা দিন বিষণ্ণ মনে, একা একা কেটে যায়। ভীষণ মনে পড়ে নির্জনকে। মোবাইলও নেই যে একবার ছবি দেখবে মানুষটার। বিকেলের দিকে বাড়ির পেছনের দিকে মাঠ আছে। বাচ্চারা খেলে। তরু গিয়ে বসে থাকে। এই একবারই বাড়ি থেকে বের হয়। না হয় পুরোদিন বাড়িতে। আশেপাশে কারও বাড়িতে গেলেও সমস্যা। সবাই কেয়ার ব্যাপারে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে। সব মিলিয়ে সে ভালোই যন্ত্রণায় পড়েছে। তরু আবার এসে বিছানায় শুয়ে গেল৷ এত আগে ঘুম থেকে উঠেই বা কি করবে? সে বালিশে মাথা পেতে পাশ ফিরে চোখবুজে শুয়ে গেল। ক’দিন থেকে অদ্ভুত একটা খেলা খেলে তরু। চোখ বন্ধ করে নির্জনের মুখ কল্পনা করে। এরপর এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে শ্রীমঙ্গল চলে যায়। সেই সন্ধ্যা। চা নিয়ে গিয়ে সে জানালা দিয়ে তাকিয়েছে৷ নির্জন বাথরুম থেকে গোসল করে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে খালি গায়ে বের হয়েছে। ফরসা, উজ্জ্বল লোমশ বুক। পাতলা কিছু লোম বুক থেকে পেট দিয়ে নেমেছে৷ মেদহীন পেট। সে কল্পনায় দরজা খুলে ছুটে গিয়ে নির্জনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখে৷ তরুর তখন সবকিছু কেমন বাস্তব মনে হয়। নির্জনের শরীরের ঘ্রাণ পায়। ওর শরীরের উষ্ণতা টের পায়। এভাবে কখনও ভোর গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে গোধূলিলগ্ন চলে আসে। উঠে তখন চলে যায় বাচ্চাদের খেলা দেখতে।

*
এখন সন্ধ্যা। নির্জন বাড়ির ছাদের রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আঙুলের ফাঁকে জলন্ত নিকোটিন। টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো আকাশের দিকে। বেশ কিছুদিন কেটে গেল তরুর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই তার। মাঝে মাঝে ভাবে রূপগঞ্জ চলে যাবে। কিন্তু তাতে তরুর জন্য যদি আরও ঝামেলার হয় ব্যাপারটা? তাই বারবার নিজেকে সামলে নিচ্ছে।

‘কিরে এখানে কি করছিস?’

নির্জন চমকে উঠে তাকিয়ে দেখে আছমা চৌধুরী। সিগারেটটা ফেলে দিল হাত থেকে৷

– ‘না কিছু না।’

‘চা খেতে আয়’ বলে তিনি চলে গেলেন। আজ দুপুরে একটা ঘটনা ঘটেছে। খেতে বসেছে টেবিলে। আছমা চৌধুরী দাঁড়িয়ে খাবার দিচ্ছেন তার প্লেটে। তখন টেবিলে থাকা নির্জনের ফোনে সিমের অফারের একটি মেসেজ এলে বাতি জ্বলে উঠলো। ডিসপ্লেতে ভেসে উঠলো একটি ছবি। চা-বাগানে এক ফাঁকে দু’জন সেলফি তুলেছিল। তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে তরু। আছমা চৌধুরী ওয়াল পেপারের সেই ছবিটি দেখে ফেললেন। প্রথমে চিনতে না পেরে বললেন, ‘তোর সঙ্গে কাকে যায়?’

সে হাত বাড়িয়ে ফোন লক করে বলে দিল, ‘তরু, চা-বাগানে তুলেছিলাম।’

তিনি আর কিছু না বলে চুপ হয়ে গেলেন। তখনই খেতে খেতে তার মাথায় নুসরাতের ব্যাপারটা এলো। ওর সঙ্গে কোনোভাবে যোগাযোগ করতে পারলে তরুর খোঁজ-খবর পাবে হয়তো। ভাবনাটা সারাক্ষণ মাথায় ঘুরছিল। একটু আগে তরুর আইডির পোস্টগুলোর লাইক, কমেন্ট ঘাটতে ঘাটতে নুসরাতকে বের করলো। বের করে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিয়ে রেখেছে। বারবার চেক করছে ও গ্রহণ করে কি-না। এখনও করেনি। অস্থিরতায় সময় কাটছে তার। ফুপুর কথায় নিচে গেল চা খেতে। অন্যমনষ্ক অবস্থায় পানির মতো টেনে চা খেয়ে নিল। অবাক হয়ে শুধু আছমা চৌধুরী তার কাণ্ড দেখলেন। নির্জন সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে রুমে চলে এলো। বার দুয়েক চেক করলো নুসরাত ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট গ্রহণ করেছে কি-না। ফলাফল প্রতিবারই হতাশ করলো। এবার একটা মেসেজও দিয়ে রাখলো, ‘হাই, আমি নির্জন, ওইযে তরুর সঙ্গে বিয়েতে গিয়েছিলাম। অনলাইনে এলে প্লিজ রিপ্লাই দিবেন। একটু কথা আছে।’
তারপর রুমে পায়চারি করে অস্থিরতায় কাটতে লাগলো সময়। নুসরাত তার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট গ্রহণ করে মেসেজ দিল দশটায়। চমকে উঠে তাড়াতাড়ি সিন করলো নির্জন। সে দ্রুত টাইপ করলো, ‘নুসরাত, আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। কল দিতে পারি?’

নুসরাত নিজেই কল দিয়ে দিল। রিসিভ করলো সে। দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে তার। নুসরাত হাস্যজ্বল গলায় বললো, ‘কি হয়েছে ভাইয়া? কোনো সমস্যা?’

সে ইতস্তত করে বললো, ‘নুসরাত, আপনি হয়তো সবকিছু জানেন না। তবুও আপনাকে আমার বলতে হবে।’

– ‘হ্যাঁ বলুন, এত অস্থির হচ্ছেন কেন।’

– ‘আসলে তরু গ্রামে চলে গেছে। কেন গেছে জানেন?’

– ‘না।’

– ‘সবকিছু বলবো কীভাবে বুঝতে পারছি না। ওদের পারিবারিক ব্যাপার।’

– ‘যতটুকু বলা যায় বলুন। না হলে বুঝবো কি করে?’

– ‘তরুর ফুপুর আমার বাবার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এখানে ওর ফুপুর কিছু খারাপ বিষয় সামনে আসে। আমরা প্রমাণ সহ পাই। আমিই বেশি রিয়েক্ট করি। এরপর তরুর বাবা-দাদা এসে উনাকে নিয়ে চলে যান। এখন বুঝতেই তো পারছেন ওদের ফ্যামিলির সঙ্গে আমাদের ঝামেলা হয়ে গেছে। এই অবস্থায় তরুর সঙ্গে আমি যোগাযোগ করতেই পারছি না। ওর মোবাইলও মনে হয় কেড়ে নিয়েছে ওরা।’

– ‘মাইগড! এত কিছু হয়ে গেল।’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘কিন্তু তরুর ফোন কেন নিবে ওরা। যদি ওর ফুপুর ঝামেলা হয়।’

– ‘হয়তো ওর ফুপুর যে বিশ্রী ব্যাপার। এটার জন্য ওরা কড়া হয়ে গেছে। মেয়েদের ব্যাপারে অতিরিক্ত সতর্ক হয়েছে।’

– ‘ও আচ্ছা, এখন আপনি যোগাযোগ করতে পারছেন না?’

– ‘না, এবং তরু হয়তো কিছু ভুলও বুঝেছে। আমি ঠিক জানি না। কথা হলে বুঝতে পারতাম।’

– ‘বুঝেছি, মানে ওর ফুপুর ব্যাপারে আপনিই হয়তো জেনে, রিয়েক্ট করে, ছাড়াছাড়ির ব্যাপারে কাজ করেছেন।’

– ‘অনেকটা এরকমই। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না। খুবই বিশ্রী ব্যাপার এটা। এরকম হলে কেউই রাখতে চাইবে না। আমার বাবাও চাননি। কিন্তু এখন ইফেক্ট পড়েছে আমাদের দু’জনের ওপর।’

– ‘তা তো পড়ারই কথা। কিন্তু আমি এখন কি করবো বলুন?’

– ‘আপনি তো ওর বাড়িতে একটু খোঁজ-খবর নিতে পারবেন তাই না? ও কি করছে, কেমন আছে এগুলো জানতে ইচ্ছা করছে। প্লিজ এটুকু করুন।’

– ‘এভাবে বলতে হবে না ভাইয়া। আমি তা পারবো ব্যাপার না।’

নির্জন বুকের ভেতর এক অদ্ভুত প্রশান্তি টের পেল। নুসরাতকে খানিকক্ষণের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে আপন মানুষ মনে হলো তার। সে ইতস্তত করে বললো, ‘আপনি তো ওর আম্মুর সাথে কথা বলে ওর কাছে দিতে বলতে পারবেন তাই না?’

– ‘হ্যাঁ, পারবো। বলবো ওর ফোনে পাইনি তাই দিয়েছি। এগুলো ব্যাপার না।’

– ‘তাহলে প্লিজ ওকে বলবেন আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আপনার মাধ্যমে খবর নেব। কিছু বলার থাকলে আপনাকে বলতে পারবে।’

– ‘আচ্ছা চিন্তা করবেন না। আমি বলবো।’

– ‘আপনার নাম্বারটাও দিবেন আমাকে। যদি অনলাইনে না পাই বা কোনো প্রব্লেম হয়। ডায়রেক্ট কল দিতে পারবো।’

নুসরাত মুচকি হেসে বললো, ‘কি প্রব্লেম হবে? হঠাৎ আইডি নষ্ট হয়ে যেতে পারে, এমন হলে আমাকে কোথায় পাবেন সেই ভয়? ভয়ের কি? তখন আমাদের বাড়িতে চলে আসবেন।’

নির্জন ভীষণ লজ্জা পেল। সে অতিরিক্ত ভাবছে, ভয় পাচ্ছে। নুসরাত পুনরায় বললো, ‘আমি নাম্বার দিচ্ছি।’

– ‘আচ্ছা আপনি প্লিজ এখন একটু ওর বাড়িতে কল দিন।’

– ‘ওকে দিচ্ছি, দিয়ে আমি জানাবো আপনাকে।’

– ‘ওকে রাখছি, আর ধন্যবাদ।’

ফোন রেখে দিল নুসরাত। নির্জনের গা কাঁটা দিচ্ছে বারবার। সে সিগারেট একটা ধরিয়ে আবার রুমে পায়চারি করতে শুরু করলো। বারবার মনে হচ্ছে এখনই নুসরাত কল দিবে, এই বুঝি বেজে উঠলো ফোনটা, সে গিয়ে রিসিভ করতেই নুসরাত বলবে, ‘তরুর সঙ্গে কথা হয়েছে। সে এমনিতে ভালোই আছে। শুধু আপনার জন্যই ওর সারাদিন একটু মন খারাপ থাকে ।’
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_২৮
.
রাতে ছোট ভাই-বোনকে পড়াতে নিয়ে বসেছে তরু। কিন্তু পাশের রুমের দরজার বিরক্তিকর শব্দে বারবার থেমে যাচ্ছে তারা। কেয়া দরজা খুলে দেয়ার জন্য অনবরত চাপড় ও অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে।
এমন সময় নাহেরা বেগম ফোন হাতে নিয়ে এসে তরুকে বললেন, ‘এই নে, তোর মোবাইলে না পেয়ে নুসরাত কল দিয়েছিল। কেয়ার কথা কিছু বলবি না।’

তরু ফোন হাতে নিয়ে বললো, ‘এখানে থেকে কল দিলে তো সে ফুপুর গালাগালি শুনবে।’

– ‘তাহলে উঠানে যা।’

তরু ফোন নিয়ে ঘাট পাড়ের সিঁড়িতে এসে বসলো। আশেপাশে কেউ নেই দেখে নুসরাতকে কল না দিয়ে তাড়াতাড়ি মিসডকল দিল নির্জনকে। সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাক করলো সে। তরু আশেপাশে তাকিয়ে ‘দুরুদুরু’ বুকে রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে সালাম দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে নির্জন বললো, ‘কে বলছেন? মিসডকল পেলাম।’

তরু শুকনো ঢোক গিলে পুনরায় উঠানের দিকে সতর্ক চোখে তাকিয়ে নিয়ে ভায়ার্ত গলায় বললো, ‘আমি তরু।’

– ‘তরু তুমি! ঠিক আছো তো তুমি? কীভাবে মানে বলতে চাইছি তোমার মোবাইল কোথায়? এটা কার ফোন?’

– ‘এত কথা বলতে পারবো না নির্জন। আব্বা আমার ফোন নিয়ে নিয়েছে। এখন আম্মার ফোন থেকে কল দিয়েছি। আপনি কেমন আছেন বলুন?’

– ‘আমি ভালো আছি তরু, তুমি খুব অসুবিধায় পড়ে গেছো তাই না..।’

তাকে থামিয়ে দিয়ে তরু বললো,

‘শুনুন, কেউ এসে যাবে। ফুপুর এই ঘটনার পর ওরা আমাকে নিয়েও ভয় পায়। আচ্ছা রাখছি এখন। প্লিজ নিজের খেয়াল রাখবেন।’

– ‘এখনই রেখে দেবে তরু? আরেকটু থেকো..।’

‘হ্যাঁ রাখতে হবে’ বলে সে আবার উঠানের দিকে তাকিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বললো, ‘আর শুনুন, আপনার কথা আজকাল ভীষণ মনে পড়ে। রাখছি। প্লিজ ভালো থাকবেন, নিজের খেয়াল রাখবেন’ বলেই কেটে দিল সে। প্রচণ্ড ভয় লাগছিল, এখন রীতিমতো হাঁপাচ্ছে তরু। সিঁড়ি থেকে উঠে উঠানে গিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে কল দিল নুসরাতকে।

– ‘হ্যালো, তরু?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘কিরে এতক্ষণ লাগে কল দিতে। অপেক্ষা করছিলাম। তোর ফোন কোথায়?’

তরু ইতস্তত করে কিছু একটা ভেবে বললো,

– ‘নষ্ট হয়ে গেছে। কি করছিস তুই? বাড়ির সবাই ভালো?’

– ‘হ্যাঁ, ভালো আছে। আচ্ছা শোন, তোর ফোন যদি নষ্ট হয়ে থাকে। তাহলে এটা দিয়ে নির্জন ভাইকে কল দিতে পারিস না?’

তরু অবাক হয়ে গেল। ও হঠাৎ এই কথা বলছে কেন। নির্জন ওকে? বুঝে ফেললো তরু। মুচকি হাসলো নির্জনের পাগলামি টের পেয়ে। সে লাজুক গলায় বললো,

– ‘উনাকে কল দেইনি তুই জানলি কি করে? আর আমি উনাকে কল দিতে যাব কেন?’

– ‘এহ ভাব নিচ্ছিস আমার সঙ্গে? নাটকবাজ একটা। ক্রাশ খেয়েছিলাম আমি আর পটিয়েছিস তুই৷ এখন শোন, আমাকে উনিই ফেইসবুকে বের করে সব বলেছেন।’

– ‘বলিস কি? কি বললেন?’

– ‘তোর কোনো খবর না পেয়ে পুরাই পাগল হয়ে আছেন উনি। আমাকে বললেন একটু খোঁজ-খবর নিয়ে জানাতে।’

তরু আগের কলের ব্যাপারটা চেপে গিয়ে বললো, ‘আচ্ছা শোন, উনি তো ফুপুর ব্যাপারটা মনে হয় বলেছেন।’

– ‘খোলাসা করে বলেননি। বললেন এখন তোর ফুপুর সঙ্গে তুই গ্রামে। যোগাযোগ করতে পারছিস না। হয়তো ফোন নিয়ে নিছে ফ্যামিলি।’

– ‘হ্যাঁ, সেটাই। ওরা ফোন নিয়ে নিছে। বলিস আমি ভালো আছি।’

– ‘আচ্ছা তা বলবো। কিন্তু ফোন কবে দিবে তোকে। না দিলি এভাবে কতদিন?’

– ‘জানি না কতদিন। কিছুই বুঝতে পারছি না।’

– ‘তুই ঢাকা থেকে চলে এলি। পড়ালেখা ছেড়ে দিবি না-কি?’

– ‘দাদা পরশুদিন আব্বাকে কি বলছে জানিস? মাইয়া মানুষ এত পড়িয়ে কি হবে? ওকে বিয়ে দিয়ে দাও। আব্বাও তাই বলছে, ইন্টার পাস, আর পড়ালেখার কি দরকার? ভালো পাত্র পেলে বিয়ে দিয়ে দেবে।’

– ‘ওমা বলিস কি? তুই কি বললি?’

– ‘আম্মাকে বলেছি খানপুর ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে যাব।’

‘কিরে এতক্ষণ তোদের কীসের কথা?’

তরু বারান্দার দিকে তাকালো। নাহেরা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। তরু সঙ্গে সঙ্গে নুসরাতকে বললো,

– ‘এই আম্মা ডাকছে। এখন রাখলাম। আর তুই মাঝে মাঝে এভাবে কল দিস।’

তরু ফোন রেখে ঘরে চলে গেল। বারান্দায় এসে শুনলো আসলাম এবং আরিফুল সাহেব কেয়ার রুমে ওই টাকাটার কথা নিয়েই ধমকা-ধমকি করছেন। তারা আসার একদিন পরেই ইশহাক সাহেব জানিয়েছেন উনার প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা পাচ্ছেন না। এটার চাবি শুধু কেয়ার কাছেই ছিল। এখান থেকে কেয়াকে খরচ করার পূর্ণ স্বাধীনতা তিনি দিয়ে রেখেছিলেন। তাই বলে হসপিটাল যেতেই এত টাকা কোথায় খরচ করলো? নিশ্চয় যাওয়ার সময় নিয়ে চলে গেছে।

তা নিয়েই দুয়েকদিন পর পর আরিফুল সাহেন কেয়াকে মারধর করতে শুরু করেন। নাহেরা বেগমও কেয়ার রুমে গিয়ে ঢুকলেন। নিঃশব্দে দরজার কাছে গেল তরু। কান পেতে রইল। আসলাম সাহেব বললেন, ‘নাহেরা, তুই বুঝা, না হলে ওরে কাঁচা খেয়ে ফেলবো। টাকা যদি এনে থাকে স্বীকার করুক।’

নাহেরা বেগম কেয়ার পাশে বসে বললেন, ‘এতদিন থেকে এত মার খাইতেছিস, তবুও বলিস না কেন? এত টাকা তুই কি করলি?’

কেয়া চেঁচিয়ে উঠে বললো, ‘কয়বার বলবো আমি জানি না? ওই বুড়া মিথ্যে বলছে। বানিয়ে বলছে। আমি যখন আসছি আমার কাছে টাকা পাইছো তোমরা?’

আসলাম সাহেব বললেন, ‘এটা আমরা তোর জামাইকেও বলেছি। তার এক কথা। টাকা তুই সরিয়েছিস। এই অবস্থায় কীভাবে বলি যে আবার কেয়াকে ফিরিয়ে নাও? বলার মুখ থাকে?’

আরিফুল সাহেব বললেন, ‘তাছাড়া সত্যিই এত টাকা ওর কাছে থাকলে স্বীকার করুক। তাহলে টাকা দিয়েও না হয় অন্য জায়গায় বিয়ে দেয়া যেত।’

নাহেরা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘কেয়া, বোন আমার। তুই মুখ খুলবি তো না-কি?’

কেয়া চুপ করে রইল। আরিফুল সাহেব গালে ‘ঠাস’ করে চড দিয়ে গলা টিপে ধরে বললেন, ‘সত্য করে বল, না হলে গলা টিপে মেরে ফেলবো।’

কেয়া হঠাৎ গা ছেড়ে চোখবুজে সামনের দিকে পড়ে যাচ্ছে দেখে অবাক হয়ে বললেন, ‘আরে কি হলো?’

নাহেরা হাত বাড়িয়ে ওকে ঠেলে ধরে রাখলো। রাজিয়া খাতুন তখন দরজার সামনে এলেন। আসলাম সাহেব বললেন, ‘আম্মা তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে আসো।’

‘কি হইছে আমার মাইয়ার?’

– ‘আগে পানি নিয়ে আসো।’

রাজিয়া খাতুন বারান্দার দিকে তাকিয়ে তরুকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘দাঁড়িয়ে তামাশা দেখিস না-কি পানি নিয়ে আয়।’

তরু দ্রুত ছুটে গিয়ে পানি নিয়ে এসে বাড়িয়ে দিল। রাজিয়া খাতুন কেয়ার মাথায় মুঠো ভরে পানি দিতে দিতে আরিফুল সাহেবকে বললেন, ‘আমার মাইয়ার কিছু হইলে তোমার দোষ। তুমি মারছো।’

– ‘তোর মেয়ে ভঙ্গি ধরছে। পিঠে মাইর পড়লে নাটক বের হয়ে যাবে।

*

নির্জন কল রাখার পর থেকে রুমে পায়চারি করছে। তরু কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই তার কলটা কেটে দিল। এখন কি করবে সে? কীভাবে যোগাযোগ করবে, কিছু একটা তো তরু বলে রাখতে পারতো।
বিছানায় বসে আরেকটি সিগারেট ধরালো নির্জন। আগে কখনও এই বদ অভ্যাসটা ছিল না তার। কয়েকদিন থেকে সিগারেট না খেলে যেন অস্থিরতাই দূর হচ্ছে না। সিগারেট ধরিয়ে টান দিতেই মোবাইলটা বেজে উঠলো। নুসরাতের কল। তাড়াতাড়ি রিসিভ করলো সে। নুসরাত ওপাশ থেকে বললো,

– ‘ভাইয়া ওর সঙ্গে কথা হয়েছে।’

– ‘হ্যাঁ হয়েছে, কিন্তু আমাকে তেমন কিছু বলার সুযোগই দেয়নি।’

– ‘বুঝিনি, আপনার কথা হয়েছে মানে? আমি আমার কথা বলছিলাম।’

– ‘আমার সঙ্গেও হয়েছে, ওর আম্মার ফোন থেকে কল দিয়েছিল।’

‘ওমা কুত্তিটা..। তারপর ফিক করে হেসে বললো, ‘ওহ স্যরি ভাইয়া স্যরি মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।’

‘ব্যাপার না বলুন। আমি তো ভেবেছিলাম আপনার কল পেয়েই তরু আমাকে কল দিয়েছে।’

– ‘না, বাইরে এসে সুযোগ পেয়ে মনে হয় আমাকে না দিয়ে আপনাকে দিয়েছে। যাইহোক, ওর ফোন ফ্যামিলি নিয়েছে তা তো বলেছে নিশ্চয়।’

– ‘হ্যাঁ তা বলেছে, কিন্তু ওর পড়ালেখার কি হলো। কীভাবে এরপর যোগাযোগ করবো কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারিনি।’

– ‘ওর ফ্যামিলি আর পড়ালেখা করাতে চাচ্ছে না ভাইয়া। কিন্তু তরু ওর আম্মুকে বলেছে ডিগ্রিতে ভর্তি হবে। ওরা তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ভালো পাত্র পেলেই বিয়ে দিয়ে দেবে।’

– ‘কি বলেন! এত কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দেবে?’

– ‘কম বয়স বলতে ইন্টার পাস মেয়ের অহরহ বিয়ে হয় ভাইয়া। তাছাড়া ওর ফুপুর ব্যাপারটার প্রভাব।’

নির্জন কি বলবে। কি করবে বুঝতে পারছে না। সে ইতস্তত করে বললো, ‘আমার সঙ্গে আর কবে যোগাযোগ করবে বলেছে? আমি তো কল দিতে পারবো না।’

– ‘তা বলেনি কিছু। আমি কল দেয়ায় ফুপু ওকে মোবাইল নিয়ে দিয়েছেন। তাই হয়তো কল দিল আপনাকে। সব সময় তো এরকম সুযোগ পাবে না। আচ্ছা এখন রাখছি ভাইয়া, আমার পড়তে বসতে হবে।’

– ‘ও হ্যাঁ, ওকে রাখছি। ধন্যবাদ আপনাকে।’

নুসরাত মিষ্টি হেসে বললো, ‘ধন্যবাদ দেয়ার মতো কিছু করিনি। রাখছি।’

ফোন রেখে নির্জন চিত হয়ে বিছানায় শুয়ে রইল। এখন কি করবে সে। কি হচ্ছে এগুলো? বিয়ের প্রস্তাব দেবে? তার বাবাকে লড়াই-সংগ্রাম করে রাজি করালেও, তরুর ফ্যামিলিকে প্রস্তাব দিলে রাজি হবে না। তাছাড়া এই ঝামেলার পর সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিয়ে কীভাবে সম্ভব? অন্তত বছর খানেক গেলেও না হয় ঘা খানিকটা শুকানোর সময় পেত। এখন তো ক্ষতটা কাঁচা।

আরও বেশ কয়েকদিন এভাবে কেটে গেল। মাঝে একদিন আবার নুসরাতের মাধ্যমে শুধু খবর নিল কেমন আছে তরু। মোবাইল কবে দেবে। ডিগ্রিতে ভর্তির ব্যাপারে ফ্যামিলি রাজি হয়েছে কি-না। উত্তর কিছুই পালটায়নি। শুধু জানতে পারলো কেয়ার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ওকে ঘরে বন্দি করে রাখা হচ্ছে। এসব নিয়ে পুরো পরিবার পেরেশানিতে আছে। আশেপাশের মানুষও কানাঘুঁষা শুরু করেছে। সবকিছু মিলিয়ে তরুকে নিয়ে কেউ নতুন করে কিছু ভাবতে পারছে না।

আজ সকালে ইশহাক সাহেবই তাকে ডেকে তুললেন। সে দরজা খুলতেই বললেন, ‘তোমার এই অবস্থা কি নির্জন? আর এত বেলা অবধি ঘুমাও কারণ কি?’

– ‘কিছু না আব্বু। তুমি অফিসে যাওনি আজ?’

– ‘আজ তো শুক্রবার, অফিসে কেন যাব?’

– ‘ও হ্যাঁ, খেয়াল ছিল না।’

– ‘ফ্রেশ হয়ে নিচে আসো, নাশতা করবে।’

নির্জন ফ্রেশ হয়ে নিচে গেল। আছমা চৌধুরীও বসে আছেন। হুস্না এনে নাশতা দিল তাদের। ইশহাক সাহেব নাশতা খেতে খেতে বললেন, ‘বলো, তোমার চেহারা ছবির এই অবস্থা কেন?’

– ‘কিছু না আব্বু।’

– ‘তুমি কি আমাকে নিয়ে চিন্তিত? যা হয়েছে সেগুলো বাদ। আমি তো দিব্যি অফিসে যাচ্ছি। সুস্থ আছি। আর হ্যাঁ, তোমাদের বলা হয়নি। আমি লয়ার একজনের সঙ্গে কথা বলে, ডিভোর্স নোটিশও রেডি করে নিয়েছি।’

আছমা চৌধুরী বললেন, ‘ওরা আর যোগাযোগ করেছে?’

– ‘হ্যাঁ, কেয়ার বাপ-ভাই কল দিয়ে সমঝোতা করতে চাইছে। এলাকার অনেক মানুষ দিয়েও সুপারিশ করিয়েছে।’

– ‘কত নির্লজ্জ ভাবো। তুমি দেইখো আবার ওদের কথায় গলে যেও না।’

ইশহাক সাহেব কথাটি শুনে হাসলেন। কেয়াকে তিনি আবার মেনে নিবেন তা কি হয়? হসপিটাল থেকে এসে কয়েক লক্ষ টাকাও পাননি। এগুলো নিশ্চয় কেয়াইই সরিয়েছে? সুযোগ পেলে আরও টাকা নিয়ে পালিয়ে যেত। নির্জন আঁটকে রাখার জন্য হয়তো পারেনি। টাকার ব্যাপারটা তিনি বোন বা ছেলেকে কিছু না বললেও আরিফুল সাহেবকে জানিয়েছেন। ওরা বিশ্বাস করে না। উলটো বলে এখন বানিয়ে বলছেন তিনি। শুধু হাসি পেয়েছে। ঘেন্না লেগেছে। পরে বলেছেন, ‘আমার টাকা লাগবে না, আপনারা আর কখনও আমাকে কল দিয়ে বিরক্ত করবেন না। আপনার মেয়েকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা অসম্ভব, এমন পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক আর কল্পনাও করতে পারি না।’

‘আব্বু, আমি কিছুদিন গ্রাম থেকে ঘুরে আসি?’
ছেলের কথায় ভাবনা থেকে বের হয়ে এলেন ইশহাক সাহেব। তিনি চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘কি বললে গ্রামে যাবে?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তোমার যা অবস্থা কোথাও বেড়াতে গেলে অবশ্য ভালো। কিন্তু তুমি তো গ্রামে কখনও যেতে চাও না, এখন হঠাৎ কেন?’

আছমা চৌধুরী বললেন, ‘বেড়াতে হলে অন্য কোথাও যা নির্জন। এখন গ্রামে গেলে ওই গরুর পালেরা তোর পিছু নিবে।’

ইশহাক সাহেব সহমত জানিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, একদম ঠিক। তাছাড়া রূপগঞ্জের সবাই ধীরে ধীরে ব্যাপারটা জেনে গেছে। তোমাকে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করে বিরক্ত করে ফেলবে৷ কি দরকার এখন এসব ঝামেলার? বেড়াতে হলে দেশের বাইরে যাও। অথবা কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন এসবে যাও।’

নির্জন আর কোনো কথা বললো না। নাশতা শেষ করে চুপচাপ রুমে চলে এলো। জানালার পর্দা সরাতেই ভোরের আলো এসে তার চোখে-মুখে পড়ায় বিছানায় গিয়ে বসলো। তরুর একটা কথা সংগীতের মতো কানে বাজে তার, ‘আজকাল আপনার কথা ভীষণ মনে পড়ে।’

আর সহ্য হচ্ছে না নির্জনের। তরুর সঙ্গে কথা না বলে এভাবে পাগল হয়ে যাবে। মোবাইল হাতে নিল। আনমনে কল দিয়ে বসলো নুসরাতকে। সে রিসিভ করেই বললো, ‘শুভ সকাল ভাইয়া।’

– ‘শুভ সকাল। কেমন আছেন আপনি?’

– ‘ভালো, আপনি কেমন আছেন?’

নির্জন ইতস্তত করে অসহায়ের মতো বললো, ‘কোনোভাবেই কি ওর সঙ্গে কথা বা দেখা করা যাবে না?’

– ‘না, বেশি বাড়াবাড়ি করলে তরুর আরও বিপদ বাড়বে। ও চেষ্টায় আছে পড়ালেখার ব্যাপারে রাজি করাতে। ওর এই আশাও শেষে পূরণ হবে না।’

নির্জন চোখবন্ধ করে কপালে হাত রেখে খানিকক্ষণ ভেবে বললো, ‘আমি রূপগঞ্জ যেতে চাচ্ছিলাম। ওখানে আমার গ্রামের বাড়িই আছে।’

– ‘কিন্তু তাতে লাভ কি? ওর সঙ্গে দেখা করবেন কীভাবে? ফোনেই তো কথা বলতে পারছেন না।’

সে ইতস্তত করে বললো, ‘আপনি ওদের বাড়িতে বেড়াতে যান না? গেলে ভালো হতো। আমিও যেতাম। আর আপনার ফোনে যোগাযোগ করে ওকে রাতে বের হতে বলতাম।’

– ‘ভাইয়া আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে? কি বলেন এসব? তরুকে এভাবে আরও বিপদে ফেলবেন। এখন রাখছি ভাইয়া, আমি বাইরে যাব।’

– ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে, রাখছি।’

নির্জন ফোন রেখে কপালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে রইল।

___চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে