#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_২৫
.
নির্জন হুস্নার কল কেটে দিল। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে দারোয়ানের নাম্বার বের করে কল দিল, সিকান্দার রিসিভ করে বললো, ‘ভাই সাহেব কল দিয়া ভালাই করছেন। ম্যাডাম বাইর হইয়া যাইতে চাইতেছে। কোনোভাবে আঁটকে রাখতে পারতেছি না।’
নির্জন মোবাইল কান থেকে সরিয়ে আসলাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘উনি রুমে থাকতে আপনারাই তো বলে এসেছিলেন। এখন বের হয়ে গেছে। বাইরে দারোয়ান আঁটকে রাখতে চেষ্টা করলে সিনক্রিয়েট করবে। আশেপাশের বাসার মানুষ দেখবে। কি করবো এখন বলুন।’
আসলাম এবং আরিফুল সাহেব দৃষ্টি বিনিময় করলেন। তারপর আসলাম সাহেব বললেন, ‘ওর সাথে কলে লাগিয়ে দাও আমাকে।’
নির্জন দারোয়ানকে বললো, ‘তোমার ম্যাডামকে মোবাইল দিয়ে বলো উনার ভাই কথা বলবে।’
সিকান্দার মোবাইল দিল কেয়াকে। আসলাম সাহেব দীর্ঘ সময় কথা বলে বুঝিয়ে বাসায় যেতে বললেন। ফোন রাখার পর নির্জন মুখ খুললো।
– ‘আপনারা দু’জনই আমার বাবার মুরব্বি। আমি তো সম্মান না করার প্রশ্নই আসে না৷ শুরু থেকে চাচ্ছি পরিবেশ শান্ত রেখে কথা বলার। কারণ যে বিষয় নিয়ে ঝামেলা সেটা খুবই সিরিয়াস ইস্যু। কিন্তু আপনারা এসেই রাগারাগি করছেন।
আচ্ছা এখন আপনারাই বলুন, উনি তো পাগল না। তাহলে বাসা থেকে এভাবে বের হলেন কেন? যেখানে আপনারা বলেই এসেছেন বাসায় থাকতে..।’
আরিফুল সাহেব কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। আঁটকে দিল নির্জন, ‘আমার পুরো কথা শুনুন। সকল উত্তর পেয়ে যাবেন। আমার বাবা হার্ট অ্যাটাক করে হসপিটাল। এই অবস্থায় আমি কীভাবে তাকে সবকিছু শুনিয়ে কাজ করবো? ইভেন এখন যে উত্তপ্ত কথাবার্তা হচ্ছে সেটাও আব্বার সামনে হোক চাইনি।
যাইহোক সংক্ষেপে বলি, আমি উনাকে বন্দি করেছিলাম এভাবে পালিয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায়। তাছাড়া চাইনি হসপিটাল এসে আব্বুর মুখোমুখি হোক। ঝামেলা বাঁধুক। ফোনও এই কারণে নিয়েছি। আমি গায়ে হাত তুলে ভুল করলে ক্ষমা চাইব। কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে তুলেছি সেটাও তো জানতে হবে।’
আসলাম সাহেব রূঢ় গলায় বললেন,
– ‘কোন পরিস্থিতি?’
ইশহাক সাহেব নির্জনের দিকে হাত তুলে চুপ থাকতে ইশারা করে আসলাম সাহেবকে বললেন, ‘সেটা পরে শুনবেন, আপনাদের কেন ডেকেছি শুনুন। এসেছেন আগে চুপচাপ বিস্তারিত শুনে এরপর কথা বলবেন।’
দু’জন সম্মতি জানিয়ে বললো, ‘আচ্ছা বলুন।’
– ‘কেয়াকে আমি ডিভোর্স দেবো।’
আসলাম সাহেব ভ্রু-কুঁচকে বললো,
– ‘কেন?’
– ‘চেয়েছিলাম ছেলে, বোনের থেকে লুকিয়ে রাখবো। মানুষকে কম জানাবো৷ কিন্তু আপনারা সেরকম মানুষ না। সোজাসুজি আলাপই ভালো। আপনাদের মেয়ে পরকীয়া করে। হাতেনাতে ধরেছি আমি।’
আরিফুল সাহেব বিস্মিত হয়ে গেলেন। আসলাম অবিশ্বাসের গলায় বললেন, ‘যা ইচ্ছা বললেই হলো নাকি। মিথ্যে অপবাদ দিয়ে ডিভোর্স দিতে চান?’
– ‘কাজের মেয়ে সাক্ষী আছে।’
– ‘ওকে তো টাকা খাইয়ে মিথ্যে বলাবেন।’
ইশহাক সাহেব খানিকক্ষণ দাঁত কটমট করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর নির্জন এবং আছমা চৌধুরীকে বাইরে যেতে ইশারা করলেন। ওরা বাইরে চলে গেল। তিনি আসলাম চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বোনের ভিডিয়ো দেখার পর বিশ্বাস করবেন মনে হচ্ছে। হোয়াটসঅ্যাপে দেই ভিডিয়ো? বাপ-ছেলে মিলে সেটা দেখুন। ভালো ব্যবহার পছন্দ না? আপনাদের মেয়ে বিয়ের পর থেকে আমাদের কি পরিমাণ যন্ত্রণায় রেখেছে, জানাইনি। সব সময় ভেবেছি ঠিক হয়ে যাবে। পরে বুঝলাম ঠিক হবার নয়, সে জটিল অসুখে আক্রান্ত। সেটার নাম পরকীয়া।’
আরিফুল সাহেব আমতা-আমতা করে বললেন, ‘কিন্তু কার সঙ্গে এমন করলো কিছুই তো বুঝতেছি না।’
– ‘খান পুরের একটি ছেলে। তন্ময় নাম। প্রাক্তন একজন শিক্ষকের ছেলে।’
– ‘চিনলাম না তো।’
– ‘তা চেনানোর আপাতত আমার প্রয়োজন নেই। বিশ্বাস করানোর জন্য ভিডিয়ো আছে। পুলিশ নিজে দিয়েছে ভিডিয়ো। বিচার আদালত বসান। যান। তার আগে এখান থেকে সোজা আমার বাসায় যান। গিয়ে আপনাদের মেয়েকে নিয়ে বাড়ি যান। ডিভোর্সের পেপার পেয়ে যাবেন।’
আসলাম সাহেব আমতা-আমতা করে বললেন, ‘আমরা তো একটা সমঝোতায় আসতে পারি। ভুল হয়তো একবার করেই ফেলছে তাই বলে..।’
ইশহাক সাহেব তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন, ‘আমার বিছানায় আরেক ছেলে নিয়ে শুইয়ে গেছে। হোটেলে চলে গেছে আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে। এই মেয়ে নিয়ে আমি আবার সংসার করবো? আর নিজেই শুনলেন ছেলে গায়ে হাত তুলেছে। কি বুঝলেন? এখন এই মেয়েকে রাখতে চাইলে আমাকে মানবে? কথা কম বলুন। মেয়েকে নিয়ে বিদায় হোন। ওকে আমি আর রাখবো না। আমি হসপিটাল থেকে ও বিদায় না হওয়া অবধি যাচ্ছি না।’
আরিফুল সাহেব ইতস্তত করে বললেন, ‘আচ্ছা ওকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি বাবা৷ এখনই ডিভোর্সের কথা না ভেবে সময় নাও।’
– ‘আমার কোনো সময় নিতে হবে না। ডিভোর্স বলেছি ডিভোর্স৷ আর যত কথা বাড়াবেন আমারও লজ্জা, আপনাদেরও লজ্জা৷ চুপচাপ চলে যান। আর আপনাদের মেয়ে জানে না আমার কাছে ভিডিয়ো আছে। চিল্লাচিল্লি করলে জানিয়ে দিয়েন হোটেলে গিয়ে কি করেছে সব আছে। লাগলে হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে দেবো।’
দু’জন শুরুতে যেরকম গরম হয়েছিল। সেরকমই হুট করে ঠান্ডা হয়ে গেল। ইশহাক সাহেব বাইরে এসে নির্জন এবং আছমা চৌধুরীকে ডেকে বললেন, ‘তাদের বাসায় নিয়ে যাও। কেয়াকে ওদের সঙ্গে বিদায় করো। এরপর আমি বাসায় যাব।’
তাদের নিয়ে বাসায় গিয়ে নির্জন সিটিংরুমে বসে থেকে বললো, ‘যান, আপনাদের মেয়ের রুমে যান।’
ওরা দু’জন চলে গেল। আছমা চৌধুরী এবং নির্জন বসে রইল সোফায়। খানিকক্ষণ পর কেয়ার রুম থেকে ওর আর্তনাদ শোনা গেল। নির্জন হুস্নাকে ডেকে বললো কেয়ার মোবাইল নিয়ে আসতে। সে মোবাইল নিয়ে এলো। দীর্ঘ সময় পর ওরা কেয়াকে নিয়ে নিচে এলো। কেয়ার তখন চুল এলোমেলো। গাল দু’টো লাল হয়ে আছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। বুকে ওড়না নিই। বুঝাই যাচ্ছে ওপরে ওদের কথাবার্তা হয়েছে। সেসব থেকে কেয়াও বুঝে গেছে সবকিছু সবার কাছে দিনের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। তাই ওর মুখে কোনো শব্দ নেই।
আরিফুল সাহেব সামনের দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমরা যাচ্ছি।’
নির্জন ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘আমি রাগের মাথায় অনেক ভুল করেছি হয়তো, তারজন্য আপনাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।’
আসলাম সাহেব মোবাইল হাতে নিলেন। কিন্তু কেউ কোনো কথা বললো না। কেয়াকে নিয়ে তারা বাসা থেকে বের হয়ে চলে গেলেন। আছমা চৌধুরীকে ভীষণ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। তিনি নির্জনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আল্লাহ এতদিনে ঘাড় থেকে এক শয়তান্নীকে নামিয়ে দিল।’
নির্জন কোনো সাড়া দিল না। তাকে কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। বিষণ্ণ দেখালো হুস্নাকেও। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘কিরে তোরা এমন কালো মুখ করে আছিস কেন?’
‘উদযাপন করার মতো কিছু হয়নি ফুপু। দোষ করেছে, তাকে রেখে হতো না। তাই বিদায় করেছি, শেষ।’ বলে নির্জন ওপরে চলে গেল।
সন্ধ্যার আগেই হসপিটাল থেকে চলে এলেন ইশহাক সাহেব।
*
মায়ের ডাকে রাত নয়টার দিকে দরজা খুলে দিল তরু। কাঁধে ওড়না ঝুলে আছে। মুখ ঈষৎ ফোলা ফোলা। তিনি ওর অবস্থা দেখে বেশি আর ঘাটাতে গেলেন না। নরম গলায় বললেন, ‘খেতে আয়, একফোঁটা জলও মুখে দিলি না, এসে দরজা বন্ধ করে বসে আছিস।’
তরু গতরাত খায়নি। আজ পুরো দিন গেছে না খেয়ে। পেটে প্রচণ্ড ক্ষিধে। সে মাথা নেড়ে মায়ের সঙ্গে খাবার টেবিলে গেল। সেখানে দাদিও আছেন। তিনি খেতে খেতে বললেন, ‘কি হইছে রে তরু? তুই চলে আইলি কেন?’
সে চেয়ার টেনে বসে বললো, ‘ভালো লাগে নাই তাই।’
– ‘তোর বাপ, দাদা গেল এখনও আইতেছে না কেন।’
– ‘আসলেই জেনে নিয়ো।’
– ‘তোর কি হইছে, এমন কইরা কথা কইতাছিস কেন?’
নাহেরা বেগম তরুর প্লেটে বাদ দিয়ে বললেন, ‘আম্মা বাদ দাও, ওর ঘ্যাড় ত্যাড়া জানোই তো। এখন কিছু বলবে না। খেয়ে নিক।’
– ‘তাইলে ওদের টেলিফোন করো আইতেছে না কেন।’
তরু দাদির দিকে তাকিয়ে রূঢ় গলায় বললো, ‘এত অস্থির হইয়ো না। আশা করছি তোমার মেয়েকে নিয়েই ফিরবে। অপেক্ষায় থাকো।’
– ‘কি কইতাছিস? ওকে নিয়ে রাইতের বেলা কেন আসবে?’
– ‘তোমরা বলো না, দুই নৌকায় কখনও পা দিতে নেই। দিলে ধপাস করে পানিতে পড়ার ঝুঁকি থাকে। তোমার মেয়েও দুই নৌকায় পা দিয়েছে, সে এখন ঢাকা থেকে রূপগঞ্জ এসে ধপাস করে পড়বে।’
– ‘কি পড়া পড়ির কথা কস তরু। কি হইছে খুইলা ক।’
তরু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। নাহেরা বেগম ওকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘তোর এত মুরব্বিদের মতো কথা বলতে হবে না, চুপ আছিস চুপ থাক। আম্মা তুমি খাও তো। ওরা আসুক।’
এরপর কেউ কিছু বললো না। চুপচাপ খেয়ে তরু আবার রুমে চলে এলো। রাত এগারোটার দিকে বারান্দায় আরিফুল সাহেবের গলা শুনলো। ধীরে ধীরে বাড়িতে খানিকটা নীরব যুদ্ধ, ফিসফিসানি শুরু হলো। তরু অন্ধকারে বসে রইল চুপচাপ। কিছু সময় পর তরুর দরজায় নক দিল কেউ। সে দরজা খুলে দেখে ওর মা কেয়ার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন।
– ‘তুই বের হয়ে আয়, এখানে কেয়া থাকবে।’
তরু বের হয়ে এলো। সামনে দাদার রুমে বাতি জ্বলছে। আসলাম সাহেব ওকে বারান্দায় দেখে ডেকে দিলেন। তরু অনাগ্রহে গেল সেখানে। আরিফুল সাহেব ওকে দেখে বললেন, ‘কেয়া এতকিছু করলো তুই জানিস না? আমাদের বলতে পারলি না?’
– ‘তোমার মেয়ে আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে এসব করে বেড়িয়েছে না-কি?’
– ‘তবুও কাজের মেয়ে পর্যন্ত জানে তুই জানতি না?’
– ‘যখন জানছি ওরাই না করেছিল বাড়িতে না জানাতে।’
আসলাম সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ওরা না করলেই তুই চুপ থাকবি?’
– ‘চুপ থাকিনি। বিয়েতে আম্মাকে বলছি। সে উলটো আমাকে ধমক দিয়েছে।’
– ‘তুই আজ এভাবে চলে আসলি কেন?’
– ‘লজ্জায় এসেছি। ওরা আমাকেও খারাপ ভাবছে। কারণ আমাকে নির্জন ভাই একদিন জিজ্ঞেস করেছিস ফুপু সবার সাথে এত খারাপ আচরণ করে কেন। ওকে জোরে বিয়ে দেয়া হয়েছিল কি-না। ওর কোনো রিলেশন আছে কি-না। আমি তখন না করেছিলাম। এই কারণে আমার ওপরও ও রেগেছে।’
আরিফুল সাহেব রেগে গিয়ে বললেন, ‘এই শয়তানের জন্য ইশহাক ছেড়ে দিতে চাচ্ছে। না হলে সমঝোতা করা যেত..।’
তরু বিরক্ত হয়ে বললো, ‘দাদা, আরেক ছেলেকে গালি না দিয়ে নিজের মেয়েকে দাও। তোমার মেয়ে ওইখানে যা করেছে আমি নিজ চোখে দেখেছি।’
– ‘তুই আমারে জ্ঞান দিতেছিস? ওই ছেলে কেয়ার গায়ে পর্যন্ত হাত তুলেছে। সে কেন তুলবে? নেহাত বাজে অবস্থা দেখে চুপচাপ চলে এসেছি। না হলে জিজ্ঞেস করতাম ওরাই বা কেমন ভালো মানুষ।’
– ‘তোমার মেয়ের কত খারাপ আচরণ নির্জন ভাই সহ্য করেছে তুমি জানো সেটা? সব সময় চেয়েছে কীভাবে ওর সংসারে মন বসবে। গায়ে হাত তোলার মতো কাজ করেছে তাই তুলেছে।’
আসলাম সাহেব ধমক দিয়ে বললেন, ‘তুই মুখে-মুখে তর্ক করতেছিস কেন? যা এখান থেকে।’
আরিফুল সাহেব বললেন, ‘ও দুইদিন পর কেয়ার মতো করবে না তার গ্যারান্টি কি? ওদেরকে মাথায় তুলে রাখার দিন শেষ। কালসাপ একেকটা। মান-ইজ্জত আর থাকছে না। আর চ্যাংড়া চ্যাংড়া মেয়েদের হাতে মোবাইল কেন? তরুর মোবাইল এনে আমার কাছে দিবা বউমা। এখন থেকে এ বাড়ির মেয়েদের স্কুল-কলেজেও একা যেতে দেওয়া হবে না।’
তরু পুরো কথা না শুনেই রেগে-মেগে বের হয়ে এলো। মাঝের রুমে ওর ছোটো ভাইবোন থাকে। সেই বিছানায় এসে চুপচাপ শুয়ে রইল সে।
পুরো ঘটনা শুনে নেহারা বেগম বললেন, ‘এরকম হলে ডিভোর্স তো দিবেই আব্বা৷’
আরিফুল সাহেব চুপ করে রইলেন। আসলাম সাহেব বললেন, ‘জানাজানি তো হবেই। এগুলো লুকিয়ে থাকে না-কি। ওর জন্য এখন আমাদের ছেলে-মেয়েদেরও বিয়ের সময় লোকে কতকিছু বলবে।’
নাহেরা পুনরায় বললো, ‘যে ছেলের জন্য এতকিছু করেছে। ওর কাছেই বিয়ে দিয়ে দাও।’
– ‘ওই ছেলে করবে না-কি বিয়ে?’
আরিফুল সাহেব বললেন, ‘বউমা কেয়ার সাথে তুমি কথা বলো। কার সঙ্গে কি করছে। ও বিয়ে করলে এই বাড়ি ছেড়ে বিদায় হোক। ওর মুখ দেখতে চাই না আর।’
– ‘ঠিক আছে আব্বা আমি দেখছি। এখন যা হওয়ার হইছে৷ কেউ ওকে গালাগালি কইরেন না। আর খাবার দিচ্ছি, হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসেন এসে।’
আসলাম সাহেব কেয়ার মোবাইল বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা নাও।’
নাহেরা বেগম হাতে নিলেন। রাতে সবাই খেয়ে যার যার রুমে চলে গেছেন। নাহেরা বেগম খাবার নিয়ে গেলেন কেয়ার কাছে। সে বিছানায় বসে আছে। খাবার আর পানি রেখে তিনি বললেন, ‘কেয়া খাবার খা।’
– ‘আমি কিছু খাব না ভাবি।’
– ‘পাগলামি অনেক করেছিস আর না। চুপচাপ এখন খা। যা হওয়ার হয়েছে।’
– ‘আমার মোবাইল কোথায়, মোবাইলটা এনে দাও।’
– ‘আগে খা, দিচ্ছি এনে।’
কেয়া চুপচাপ খেতে শুরু করলো। নাহেরা বেগম গিয়ে মোবাইলটা নিয়ে আসলেন। এসে পাশে বসে বললেন, ‘যে ছেলের সাথে এতকিছু করলি, সে কি বিয়ে করবে?’
কেয়া কোনো জবাব দিল না। নাহেরা ওর পাশে ফোন রেখে বললো, ‘কেন যে এমন করতে গেলি কেয়া। মানলাম জামাইর বয়স বেশি। কিন্তু বিয়ে তো বসেই গেছিস। আর পুরুষ মানুষের পঞ্চাশ কেন, ষাট-সত্তুর বছর বয়সে বিয়ে করে বাচ্চা জন্ম দিতে পারে।’
কেয়া তবুও কিছু বললো না, নাহেরা একা একাই কথা বলে যাচ্ছেন, ‘হ্যাঁ, অনেক ইয়াং ছেলেও শারীরিক অক্ষম থাকতে পারে। কিন্তু আজকাল কত চিকিৎসা আছে এসবের। জামাইর টাকা-পয়সার অভাব নেই। বলতি চিকিৎসার করাও..।’
কেয়া বিরক্ত হয়ে প্লেট রেখে বললো, ‘শারীরিক অক্ষমের কথা তোমারে বলছি আমি?’
– ‘তাহলে জামাই তৃপ্তি দিতে পারলেও কেন এমন করলি? ওই ছেলের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলি?’
কেয়া চুপ করে রইল। নাহেরা আবার বললো, ‘আচ্ছা ওই ছেলে কি বিয়ে করবে বল। আমরা এখন তোকে নিয়ে তো টেনশনে।’
‘তোমাদের এত টেনশন করতে হবে না’ বলে প্লেটে পানি ঢেলে হাত ধুয়ে নিল কেয়া।
‘বাহ, তাহলে তো বাঁচলাম আমরা। নিজের টেনশন নিজে কর’ বলে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে নাহেরা বেগম চলে গেলেন।
কেয়া ওড়না দিয়ে তাড়াতাড়ি মুখ মুছে মোবাইল হাতে নেয়। মোবাইলটার জন্য এই কয়দিন সে অস্থির হয়ে আছে। তন্ময়ের নাম্বার বের করে কল দিয়ে কানে লাগালো। ওকে সব জানাতে হবে, সব। কিন্তু কেয়াকে অবাক করে দিয়ে তন্ময়ের ফোন বন্ধ দেখালো। দ্রুত সে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিল, অফলাইন। ফেইসবুকে গিয়ে দেখে ওর ফেইসবুক আইডি ডিএক্টিভ। কিছুই মাথায় ঢুকছে না ওর। বারবার কল দিয়ে রুমে পায়চারি করতে শুরু করলো।
তরু দরজা বন্ধ করে, বাতি নিভিয়ে নিয়েছে আগেই। পাশ ফিরে শুয়ে নির্জনের ছবি বের করে তাকিয়ে আছে। প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে ওর। সমস্ত কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। অথচ তার কোনো দোষ নেই। ক্ষণিকের জন্যই হয়তো নির্জন তার মনে জীবনে এসেছিল। এসে মনে আলোড়ন তুলেছে। ভালোবাসা শিখিয়েছে। অনুভূতি জাগিয়েছে। যা খুব দ্রুত হয়েছিল, দ্রুতই বুঝি সমাপ্তি ঘটে গেল? নির্জনকে পাওয়ার আর পথ কোথায়? নেই, একদম নেই। নির্জন তাকে ভুল না বুঝে যদি আবার চায়ও। তবুও তো মিলন সম্ভব নয় তাদের। দু’টো পরিবারের যেভাবে বিচ্ছেদ হতে যাচ্ছে, তাতে আরেকটা সম্পর্কের সম্ভবনা কতটুকু? নেই, একদম নেই। তরুর গাল বেয়ে বালিশে পানি পড়ছে। নাক টানলো সে। এরকম যদি দূরত্ব তৈরি হবেই, তাহলে কেন সম্পর্কটা হলো? অল্প কিছুদিনে কি সীমাহীন ভালোবাসা পেয়েছে সে। তরুর মনে হয়েছিল পৃথিবীতেই আস্ত একটি স্বর্গ পেয়ে গেছে৷ চোখের সামনে একে একে শ্রীমঙ্গল যাওয়ার দিনের গাড়িতে পাশাপাশি বসা, টং দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চা খাওয়া, পার্কে কোলে মাথা রেখে নির্জনের শুয়ে থাকা, রুমে একে অন্যের খুব কাছাকাছি যাওয়া। সব, সবকিছু ভীষণ মনে পড়ছে তরুর। এমন একটি মানুষকে জীবনে পেয়েও তরু কীভাবে হারিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে বুঝতে পারছে না। একদম মরে যাবে সে। ভেতর গুলিয়ে কান্না এলো তরুর। ওড়না সহ দুইহাতে মুখ ঢেকে ফেললো সে।
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম
#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_২৬
.
রাতটা ভীষণ অস্থিরতায় কেটে গেল কেয়ার। তন্ময়ের ফোন অফ কেন, ফেইসবুক ডিএক্টিভ কেন, কিছুই বুঝতে পারছে না সে। তাই ভোর ছয়টায় কাউকে কিছু না বলে, ওড়নাটা মাথায় দিয়ে, ভ্যানিটিব্যাগ নিয়েই বাড়ি থেকে আলগোছে বের হয়ে গেল সে। উঠোন পেরিয়ে পুকুর ঘাট। আস্তে-আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নেমে মুখ-হাত ভালো করে ধুয়ে নিল। তারপর সোজা হেঁটে হেঁটে খানপুর এলো। আসতে প্রায় চল্লিশ মিনিট লেগে গেল ওর। খানপুর স্কুলের পাশের রাস্তা দিয়ে গিয়ে মিনিট দুয়েক হেঁটে ডানদিকে মসজিদ। এর পাশ দিয়েই খানিকটা হাঁটলে তন্ময়দের বাড়ি। কেয়া পুরো রাস্তা ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে মাথা নিচের দিকে দিয়ে এলো৷ ওদের বাড়ির রাস্তার প্রথমেই একটি পুরনো তালগাছ। সরুপথ পেরিয়ে দুইটা বাড়ি প্রথমে। এরপরই তন্ময়দের ঘর। সে চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে সেদিকে হাঁটা ধরলো। যা হয় হবে। ওর সঙ্গে যোগাযোগ করা ভীষণ প্রয়োজন। দুরুদুরু বুকে দু’টো বাড়িই পেছনে ফেলে এলো। বাড়ির বাইরের রাস্তা থেকে তন্ময়দের উঠানে এসেই কেয়ার বুক ‘ধক’ করে উঠে। ওদের হাফওয়াল টিনের ঘর৷ দরজায় তালা ঝুলছে। কেয়া এগিয়ে বারান্দায় গিয়ে সেই তালায় অকারণ টানলো। দরজায় চাপড় দিল। সেখানে দাঁড়িয়ে তন্ময়ের ফোনে কল দিয়ে নাম্বার পুনরায় বন্ধ পেল। গলা শুকিয়ে আসছে কেয়ার। শুকনো ঢোক গিললো সে। কি হচ্ছে এসব! তন্ময়ের মা-বোন ছিল। সে না থাকলে তো ওরা অন্তত বাড়িতে থাকার কথা। কেয়ার মাথা কেমন ঝিমঝিম করছে। সে মাথায় হাত দিয়ে বারান্দায় বসে গেল। খানিক পর একজন মধ্যবয়সী মহিলা এসে উঁকি দিয়ে বললেন, ‘কেটা মা তুমি? কাউরে খুঁজতাছো?’
কেয়া চোখ মেলে মহিলাকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। ইতস্তত করে বলে, ‘আপনি কি পাশের ঘরের?’
– ‘হ।’
– ‘ওরা কোথায় গেছে জানেন?’
– ‘বরিশাল চইলা গেছে। তন্ময়ের নানাবাড়ি সেইখানে।’
– ‘কবে আসবে জানেন?’
– ‘একেবারেই চইলা গেছে। জমি ছিল এক্কান ওইটা সহ বাড়ি বিক্রি কইরা দিছে। বাড়ি রাখছি আমরা আর জমি সরকার ব্যাটা কিনছে।’
কেয়া কিছু বুঝতে পারছে না। তন্ময় যদি কোনো প্রয়োজনে গিয়েই থাকে। নাম্বার অফ কেন! সে আমতা-আমতা করে বললো, ‘ওদের নাম্বার আছে কারও?’
– ‘হ, তন্ময়ের মায়ের নাম্বার আছে।’
– ‘একটু কল দিবেন?’
– ‘কিন্তু আপনে কে কন তো?’
কেয়া ইতস্তত করতে লাগলো। কি বলবে এখন সে? এর ভেতরে আরেকজন পুরুষ মানুষ খালি গায়ে ছাঁই দিয়ে দাঁত ঘাষতে ঘষতে এদিকে আসছে৷ কিছু একটা ভেবে কেয়া তাড়াতাড়ি বললো, ‘আত্মীয় হই।’
– ‘কোনোদিন তো দেখি নাই আপনারে।’
পুরুষ লোকটি কাছে এসে বললো, ‘কি হইছে?’
মহিলা বিস্তারিত বুঝিয়ে বললো। লোকটি বললো, ‘দিয়া দাও একটা কল।’
মহিলা মোবাইল আনতে চলে গেল। খালি গায়ে লুঙ্গি পরা পুরুষটি দু’পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে কেয়াকে ভালো করে দেখতে লাগলো। মহিলা ফোন নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে কল দিয়ে ফোন কানে লাগালেন। খানিক পর রিসিভ হতেই বললেন, ‘মতিয়া, বাড়িতে আইসা একজন তোদের খুঁজতেছে… হ কইল আত্মীয়..আইচ্ছা দিতাছি।’
কেয়ার দিকে ফোন বাড়িয়ে দিল মহিলা। কেয়া ফোন কানে নিয়ে সালাম দিল। ওপাশ থেকে জবাব দিলেন মতিয়া বেগম। তরু আমতা-আমতা করে বললো, ‘আন্টি তন্ময় কোথায়?’
– ‘ও তো ঘুমে, কেন কি হইছে?’
– ‘ওকে একটু দেয়া যাবে?’
– ‘আপনে কে?’
– ‘আমি ঢাকায় ওর পরিচিত বন্ধু। ওকে একটু দিন দয়া করে।’
– ‘লাইনে থাইকেন দিতাছি।’
মতিয়া খানিক পর তন্ময়কে ডাকতে শোনা গেল। সে দরজা খুলে বললো, ‘কি হয়েছে আম্মা।’
– ‘কোন মেয়ে জানি কল দিয়ে তোকে চাচ্ছে।’
– ‘তাই না-কি? কি বলে?’
– ‘ঢাকার না-কি পরিচিত তোর।’
– ‘কেটে দাও কল। তোমার নাম্বার কোত্থেকে পেল।’
– ‘আমাদের বাড়িতে আইছে। রশিদার মোবাইল দিয়া কল দিছে।’
পুরো কথোপকথন কেয়া শুনতে পেল। তন্ময় এরপর ফোন নিয়ে বললো, ‘হ্যালো কে বলছেন?’
কেয়া চোখবুজে শুকনো ঢোক গিলে বললো, ‘আমি কেয়া। তোমার ফোনে কি হয়েছে পাচ্ছি না কেন?’
– ‘আরে ওই একটু সমস্যা। কিন্তু তুমি খানপুরে কেন?’
– ‘তোমার খুঁজেই এসেছি।’
– ‘তাই বলে পাড়ার লোকদের মোবাইল দিয়ে কল দিবে? বোকা না-কি। আচ্ছা শোনো, আমি একটু ঝামেলায় আছি। তোমার সঙ্গে মাস খানেক পর যোগাযোগ করবো। এখন আমার মোবাইলও নেই।’
– ‘তন্ময় কি বলো এসব তুমি? আমি ওকে ছেড়ে রূপগঞ্জ একেবারে চলে এসেছি..।’
– ‘পাগল হয়েছো না-কি? এগুলো লোকদের সামনে বলছো? ধারেকাছে কেউ নাই?’
– ‘আছে, তো কি হয়েছে?’
‘এখন এগুলো বলার দরকার কি। রূপগঞ্জ এসেছো, সেখানে থাকো। আমি তো আছিই। যোগাযোগ করবো কিছুদিন পর। আর এই নাম্বারে কল দিয়ো না। এটা আম্মুর নাম্বার, চিল্লাচিল্লি করবে’ বলেই কল কেটে দিল সে।
কেয়া ‘হ্যালো হ্যালো’ করে ফোন কান থেকে নামিয়ে নিল। মহিলা হাত বাড়িয়ে মোবাইল নিলেন। পুরুষ লোকটি ‘থু-থু’ ফেলে বললো, ‘কি সমেইস্যা হইছে কন তো?’
‘না কিছু হয়নি’ বলে কেয়া বারান্দা থেকে নেমে হাঁটা ধরলো।
*
নির্জন ভোরেই পার্কে চলে এসেছিল। সবাই জগিং করছে। কিন্তু সে সবুজ ঘাসে চিত হয়ে শুয়ে আছে, তরুর সঙ্গে সেদিন যেখানে বসা ছিল ঠিক সে জায়গায়৷ সাতটায় এসেছিল, এখন প্রায় দশটা। প্রচণ্ড রোদ উঠেছে। নির্জন উঠে বসলো। পরনে একটি গেঞ্জি, ট্রাউজার আর কেডস। পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে বোতল নিয়ে এক চুমুক জল খেল। তারপর বসা থেকে উঠে হেঁটে হেঁটে বাইরে এসে রিকশা নিয়ে বাসায় ফিরলো সে। কলিংবেল চাপতেই খুলে দিল হুস্না। ভেতরে এসে বললো, ‘আব্বু কোথায়?’
– ‘অফিসে চলে গেছেন। আপনি হাত-মুখ ধুয়ে আসেন। নাশতা দিচ্ছি।’
‘বাইরে করে এসেছি’ বলে উপরে চলে গেল। রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পড়লো সে। শরীরজুড়ে কেমন অবসাদ। কোনোকিছুই ভালো লাগছে না তার। উঠে গিয়ে ফ্রেশ হবে তাও না। যে ঝামেলাটার সে নায়ক ছিল। সেটির মাধ্যমে কেয়ার সঙ্গে পরোক্ষভাবে তরুকেও তো বিদায় করে দিয়েছে। জেনেই যেন না জানার মতো কাজগুলো করেছে সে। তরুর প্রতি তার খানিকটা রাগ আছে। তাই বলে সেটা গুরুতর নয়। এগুলোর জন্য তরুকে তো ভুলে যেতে পারে না। কেয়ার চলে যাওয়ার পরই কল দিতে চেয়েছিল, কিন্তু দেয়নি। একটু সময় যাক। ওদের বাড়িতেও নিশ্চয় ভিন্ন পরিবেশ তৈরি হয়েছে। নিজেকে এত বুঝিয়েও কল না দিয়ে যেন থাকতে পারছে না। মনে হচ্ছে কল দিলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে না৷ ওদের বাড়ির লোক তার প্রতি নাখোশ হয়েছে। কিন্তু তারই বা কি করার ছিল? নিজের বাবার এমন দুর্দিনে, দুর্দশায় সে প্রভাবিত না হয়ে কি পারে? উঠে বসলো সে বিছানায়। গোসল-টোসল করে একবার মেসেজ না হয় দেবে তরুকে। তাছাড়া বাইরে খেয়ে আসেনি, অকারণই বলেছে খেয়েছে। বাথরুমে সবকিছু নিয়ে গিয়ে গোসল করলো নির্জন। গা মুছে বের হয়ে দেখে ট্রে-তে নাশতা নিয়ে আছমা চৌধুরী এসেছেন।
– ‘কিরে নাশতা না-কি বাইরে করেছিস।’
– ‘হ্যাঁ’
‘বাইরে আবার কিসের খাওয়া’ বলে টেবিলে ট্রে রেখে বললেন, ‘খেয়ে নিস।’
নির্জন গেঞ্জি গায়ে চাপিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে সত্যিই নাশতা করতে বসে। তারপর হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে তরুকে মেসেজ দেয়, ‘হ্যালো।’
অফলাইনে দেখায় ওকে। মেসেঞ্জারেও দিল মেসেজ। সেখানেও অফলাইন। অস্থির লাগে তার। অফলাইনে কেন থাকতে হবে? বাড়িতে একটা ঝামেলা চলছে মানছে। তাই বলে অফলাইনে থাকার কি আছে? ডায়রেক্ট কি কল দেবে? যদি আর কেউ ধরে বা দেখে? এসব ভেবে আর কল দিল না সে। নাশতা করে বাইরে গেল। কিন্তু কোথাও যেন মন টিকে না তার। বারবার বাসায় ফিরতে মন চায়। ফিরেও এলো ঘণ্টা দুয়েকের ভেতরে। এসে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে তরুর ছবি দেখতে শুরু করলো। দেখতে দেখতে এলো ওই দিনের বাসের ছবি। তরু সিট নামিয়ে ঘুমিয়ে আছে। সেও সিট নামিয়ে কাছাকাছি নিয়ে পাশাপাশি শুয়ে সেলফি তুলেছিল। কি ভীষণ মায়াবী চেহারা ওর। গাল দু’টো থেকে এখনও যেন শিশুসুলভ কোলমলতার ছাপ যায়নি। নিষ্পাপের ছায়া সরেনি। এই মেয়েটিকে ধমক দিল কীভাবে সেদিন? না হয় একটু ভুলই করেছিল তার তরু? ম্যাডামের বুঝি ধমকের জন্য ভীষণ রাগ হয়েছে? এই কারণে চলে গেছে না বলে? ভাবতে ভাবতে আবার সে হোয়াটসঅ্যাপ এবং মেসেঞ্জার চেক করে দেখে নিল মেসেজ সিন হলো কি-না। কিন্তু প্রতিবারের মতোই হতাশ হলো। এভাবেই অস্থিরতায় তার পুরো দিন কেটে গেল। বিকেল পাঁচটার দিকে আছমা চৌধুরী এসে ডাকলেন। সে দরজা খুলে দিল। তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘কিরে সারাদিন ঘুমাচ্ছিস না-কি? চোখ দুইটা এমন লাল হয়ে আছে কেন? কি হয়েছে তোর?’
– ‘কিছু না ফুপু।’
– ‘অবেলায় ঘুমিয়ে না থেকে বাইরে যা। না হয় নিচে এসে বস। চা খা, টিভি দেখ।’
– ‘আচ্ছা চা বসাও, যাও।’
তিনি চলে গেলেন। বিছানার পাশে থাকা ফোনটায় মেসেজ নোটিফিকেশন বাজলো তখনই। ‘ধক’ করে উঠলো নির্জনের বুক। নিশ্চয় তরু মেসেজ দিয়েছে। দ্রুত গিয়ে হাতে নিল সে ফোনটা। লক খুলেই আশাহত হলো। সনিয়ার মেসেজ, ‘কিরে আড্ডায় আয়, ব্যাটা মানুষ মহিলাদের মতো সারাদিন বাসায় কি করিস?’
বিরক্ত হয়ে রিপ্লাই না দিয়েই ডাটা অফ করে দিয়ে মোবাইল রেখে বিছানায় বসলো। কেমন ঘাড় ব্যথা করছে তার। চা খেতে পারলে অবশ্য ভালোই লাগতো। বাথরুমে গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে নিচে গেল। আছমা চৌধুরী এসে বসে নানান বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। সে সোফায় হেলান দিয়ে চোখবুজে রইল। খানিক পর হুস্না চা নিয়ে এলো।
– ‘ভাইয়া চা নিন।’
নির্জন চোখ মেলে তাকিয়ে চা নিল। হুস্না পাশে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করে বললো, ‘তরু আপু কি আর কোচিং করবে না ভাইয়া?’
নির্জন চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, ‘জানি না।’
আছমা চৌধুরী বললেন, ‘ওদের বংশের কেউ কি ঢাকায় থাকে যে সেখানে থেকে কোচিং করবে? আর তোর এত দরদ কেন? সারাদিন থেকে দেখি মুখ কালো করে আছিস। এত দরদ থাকলে ফকিন্নিদের সাথেই চলে যেতি।’
হুস্না চলে গেল এখান থেকে। নির্জন বিরক্ত হয়ে বললো, ‘ওর সঙ্গে অকারণ এভাবে কথা বলছো কেন?’
– ‘তো কি করবো। সারাদিন থেকে তরু আপু, তরু আপু করছে। তরু মেয়েটা কি ফেরেশতা? এরা সবাই একই গোয়ালের গরু।’
নির্জন কিছু বললো না। চা শেষ করে উঠে চলে গেল ওপরে। আরেকবার মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ চেক করে, মোবাইলে গান ছেড়ে চোখবুজে বালিশে মাথা পেতে শুয়ে রইল সে। মিনিট দশ-পনেরো পরেই বারবার চেক করে অনলাইনে এলো কি-না। অফলাইনেই দেখায় ওকে। হঠাৎ মাথায় এলো ইন্টারনেট কি নেই ওর? হয়তো বাইরে যেতেও পারছে না, কাউকে বলতেও পারছে ফ্লেক্সিলোড করবে৷ সে বিকাশ থেকে এক হাজার টাকা পাঠিয়ে দিল ওর মোবাইলে। তারপর মিনিট কয়েক বাদেই চেক করছিল অনলাইনে আসে কি-না। এলো না তরু। ইশহাক সাহেব রাত আটটায় বাসায় ফিরলেন। দশটায় খাবার খেল তারা। নির্জন ঘোরের মধ্যে খেয়ে চলে এলো রুমে। এসেই মোবাইল হাতে নিয়ে চেক করলো এবং তার পুরো শরীরে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল। তরু মেসেজ সিন করেছে। কিন্তু কোনো রিপ্লাই দেয়নি। সে সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ দিল, ‘তরু অনলাইনে যেহেতু এসেছো রিপ্লাই দাও, না হয় কল দিয়ে দেবো। কথা আছে, রিপ্লাই দাও প্লিজ।’
মেসেজটি সিন হলো না। সে তবুও ধৈর্য ধরে থাকলো। গান শুনলো, ফেইসবুকে গেল। তরু রিপ্লাই দিল এগারোটা পর।
– ‘হ্যাঁ বলুন।’
নির্জন উত্তেজনায় বিছানায় উঠে বসলো। কি বলবে এখন? মাথা যেন ফাঁকা হয়ে গেছে। সে টাইপ করলো, ‘তুমি চলে গেলে কেন তরু?’
– ‘ফুপু চলে এলে আমি ওইখানে কি পরিচয়ে থাকবো?’
– ‘তখন তো সে ছিল।’
– ‘আমি জানতাম থাকবে না। সুতরাং অকারণ আমি এসব ফেস করতে চাইনি।’
– ‘তরু আমি কল দেই? ফোনে কথা বলি আমরা?’
– ‘জি না, ফুপুর এসব শুনে সবাই এমনিতেই ক্ষুব্ধ। আমার ফোনও নিয়ে নিতে চাইছে।’
– ‘আচ্ছা আমি কল দিচ্ছি না, তুমি প্লিজ ফোনটা দিয়ো না। চ্যাটে কথা হবে আমাদের। তোমার ইন্টারনেট ডাটা শেষ হলে আমি পাঠিয়ে দেবো৷’
– ‘আমাকে আপনি একটু আগে টাকা পাঠিয়েছেন?’
– ‘হ্যাঁ, ভাবলাম ইন্টারনেট নেই তাই অফলাইন।’
– ‘আমি এমনিই ফোন হাতে নেইনি। ইন্টারনেট না থাকলেও মেসেঞ্জার চালানো যায়। ঢুকলে পেতেন। আর ফোন নিয়ে নিলে আমার কিছু তো করার নেই।’
– ‘যদি নিয়ে নেয় আমি ফোন দেবো। লুকিয়ে চালাতে পারবে না?’
– ‘ওরা এখনও নেয়নি, সুতরাং আপনার ফোনের দরকার নেই। তাছাড়া আপনি দেবেন কীভাবে?’
– ‘তুমি কলেজে ভর্তি হবে তো কোথাও?’
– ‘হলে খানপুর। আর একা যেতে দেবে না। কেউ সঙ্গে থাকবে এখন থেকে।’
– ‘কি বলো এগুলো তরু? তাহলে আমাদের যোগাযোগ হবে কীভাবে?’
– ‘যোগাযোগ আর থেকেই বা কি হবে বলুন? আমাদের সম্পর্ক রাখার আর মানে আছে?’
নির্জন অবাক হয়ে গেল। তার মানে কী? তাদের সম্পর্ক রাখার মানে থাকবে না কেন? তরু এভাবে কথা বলছে কেন? ফুপুর সঙ্গে এমন করায় সেও কি তার প্রতি নাখোশ? তরুকে বুঝিয়ে বলতে হবে৷ কলে কথা বলা দরকার। নির্জন কল দিল।
তরু তখন বিছানায় বসা। ওর বাবা তখনই কিছু একটা খুঁজে রুমে এসে ঢুকলেন। তরুর বুক ‘ধক’ করে উঠলো। কল কেটে দিল সে। ভ্রু-কুঁচকে তাকালেন আসলাম সাহেব। আবার কল দিল নির্জন। তরু ইতস্তত করছে। হঠাৎ ভাবলো বান্ধবী কারও নাম বলে কলে কথা বলবে। না হলে বাবা সন্দেহ করবেন। তরু রিসিভ করে মোবাইল কানে লাগিয়েছে। তখনই আসলাম সাহেব এগিয়ে এসে বললেন, ‘দেখি কার কল, মোবাইল দে এদিকে।’
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম