প্রণয়ে প্রলয়ের সুর পর্ব-২৩+২৪

0
806

#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_২৩
.
নির্জন নিজের রুমে চলে এলো। হুস্না ভয়ে ভয়ে খানিক পর আবার এসে নক দিল তার দরজায়। নির্জন দরজা খুলে বললো,

– ‘কি হয়েছে?’

– ‘ভাইয়া টেবিলে খাবার দেবো?’

– ‘না খাব না আমি।’

– ‘ম্যাডামও রাতের খাবার খায়নি।’

– ‘তোমরা এখনও খাওনি?’

– ‘না।’

নির্জন পকেট থেকে চাবি বের করে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘ওই রুমে একটা জগে পানি দিয়ে রাখবি। আর এখন খাবার দে। আমি আছি বারান্দায়। আমি বাসায় না থাকলে দরজা খুলবি না।’

– ‘আচ্ছা ভাইয়া।’

হুস্না কেয়াকে খাবার নিয়ে দিল। কেয়া খেল না। বারান্দা থেকে নির্জন বললো, খাবার পানি রেখে দরজা বন্ধ করে চলে আসতে। তাই করলো হুস্না। নির্জন নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। জানিয়ে দিল তাকে বিরক্ত না করতে। হুস্না এলো তরুর রুমে। তরুর সঙ্গে এতদিনে ভীষণ ভাব হয়ে গেছে ওর৷ অবসরে সে তরুর রুমেই এসে গল্প করে সময় কাটায়। সমবয়সীই হবে তারা। ভালো লাগে ওকে হুস্নার। দরজা ঠেলে খুলে দেখে অন্ধকার। বাতি জ্বালায় হুস্না। তরু বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। আলো দেখে তরু মাথা তুলে তাকায়। কান্নায় ওর চোখের সঙ্গে মুখও লাল হয়ে আছে। হুস্না এগিয়ে গিয়ে বললো, ‘তরু আপু খাবে চলো।’

তরু চোখ মুছে উঠে বসে বললো, ‘না, আমি খাব না, উনি খেয়েছে?’

– ‘খাবার রেখে এসেছি, খাবে কি-না জানি না।’

– ‘নির্জন ভাইয়ের কথা বলেছি।’

– ‘না খাবে না বলছে।’

– ‘কেন?’

– ‘জিজ্ঞেস করি নাই। ভয় লাগছে।’

– ‘আচ্ছা যাও আমিও খাব না। ভালো লাগছে না।’

– ‘আপু চলো তো খাবে। ভাইয়া এরকম কখনও রাগ করে না। আজ হঠাৎ রেগে গেছে বাদ দিন।’

তরু চোখের পানি মুছে বললো, ‘কি হয়েছে একটু বলবে আমাকে?’

হুস্না আমতা-আমতা করে বললো, ‘চাচা না করছিলেন কাউকে না বলতে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে। বলবো না-কি চেপে থাকবো। বলবো না বলবো না করে নির্জন ভাইকেও আজ বলে দিলাম।’

তরু হাত বাড়িয়ে কেয়াকে টেনে বসিয়ে বললো, ‘প্লিজ আমাকে একটু খুলে বলবে?’

‘আমি নিজেই সব জানি না আপু। তোমরা শ্রীমঙ্গল থেকে যেদিন এলে। সেদিনই তন্ময়কে ম্যাডাম..।’ হুস্না যেন ভুলেই গিয়েছিল তরুর ফুপু কেয়া। সে থেমে গেছে দেখে তরু তাড়া দিয়ে বললো, ‘সমস্যা নেই বলো।’

– ‘চাচা জানলে সমস্যা হবে আপু।’

– ‘মনে হয় আর সমস্যা হবে না। আর চাপা থাকবে না এসব।’

সেদিনের সন্ধ্যার ঘটনা হুস্না খুলে বললো। সবকিছু শুনে লজ্জায় তরুর মরে যেতে ইচ্ছা করছিল। ফুপু তন্ময়কে রুমে নিয়ে গিয়েছিল? হাতে-নাতে ধরেছেন ফুপা? আজ সেটা নির্জনও জেনেছে? ওইদিন তাহলে শ্রীমঙ্গল থেকে এসে এজন্যই ফুপুকে এই অবস্থায় দেখেছিল?
হুস্ন আমতা-আমতা করে বললো, ‘আপু ওইদিন যাইই হলো, চাচা মেনে নিয়েছেন মনে হলো। কিন্তু হঠাৎ উনি হার্ট অ্যাটাক করলেন কেন? আর কেন ম্যাডামকে হসপিটাল যেতে নিষেধ করছেন? মনে হয় আরও কিছু হইছে।’

তরু আর শুনতে পারছিল না। সে ইতস্তত করে বললো, ‘আচ্ছা তুমি যাও, খেয়ে নাও। আমি ঘুমিয়ে যাব এখন।’

হুস্না উঠে চলে গেল। তরু উঠে বাতি বন্ধ করে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে গেল। সে ভেবে পাচ্ছে না একটা ছেলেকে ফুপু রুমে ঢুকিয়ে নিবে। গা গুলিয়ে উঠছে ঘেন্নায়। মানুষ বুঝি এত বেপরোয়া হয়? তরুর মনে হচ্ছে যেন সেইই এই কাজ করেছে। লজ্জা যেন তারই এটা। কীভাবে সে আর নির্জনের সামনে যাবে ভেবে পাচ্ছে না। এসব বিব্রতকর পরিস্থিতিতে না পড়ার জন্যই চেয়েছিল বাড়িতে চলে যেতে। শ্রীমঙ্গল যাওয়ার আগে তো সে এত ভাবেনি। একটা বিয়ে, মাত্র দু’দিন থাকবে। এই সুযোগে বাসায়ই ওরা এরকম কাজ করবে? এতটুকু লজ্জা নেই? তরু নিজেকে শক্ত করে নিল। সে কালই এখান থেকে চলে যাবে। নির্জন তাকে ভুল বুঝেছে? বুঝুক। সে জেনে-বুঝে কোনো অন্যায় করেনি। বরং চেয়েছিল তন্ময় থেকে ফুপুকে সরাবে। কিছু একটা করবে। শ্রীমঙ্গল মায়ের সঙ্গেও কথা বলেছে৷ উনিও বুঝতে চায়নি তাকে। কি করবে সে?
ফুপুকে বুঝিয়ে সরাবে সেই সুযোগটাও পায়নি। তার আগেই ঝামেলা বেঁধে গেল।
কেউই নিশ্চয় নিজের ফ্যামিলির বদনাম কুটুম বাড়িতে বলে দেবে না। নির্জন যদি এটুকুতে তাকে ভুল বুঝে সে কখনও আর যোগাযোগ করবে না। এই নোংরা বিষয় নিয়ে সে কথাও বলতে চায় না। ভুল ভাঙাতেও চায় না। যতই কষ্ট হোক। তরু বাড়িতে চলে যাবে।

*

নির্জন রুমে পায়চারি করছে। মান-ইজ্জত সব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে এই থার্ডক্লাস মেয়ে। আত্মীয়-স্বজন সবাইকে নিয়েই বিয়েটা হয়েছিল৷ এখন ডিভোর্স হলে সবাইকে কি বলবে তার বাবা? স্ত্রী পরকীয়া করেছে এটা তো বলতে পারবে না? তাছাড়া এই বিয়েতে নির্জনের নানা-মামা কারও মতামত ছিল না। তারজন্য কেউ কিছু বলেনি। এখন কি বলবে ওরা? তার ফুপু, চাচার বাসায় আছেন। ওদের সঙ্গে তাদের খুব একটা ভালো সম্পর্ক নেই। এখন এসব শুনলে ওরা হাসাহাসি করবে। সব সময় সে চেয়েছে ঝামেলাহীন একটি জীবন। সবাইকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে কাটিয়ে দেবে। কিন্তু এই মহিলাকে বাবা বিয়ে করতেই সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেল। শেষমেশ হোটেলে একটি ছেলের সঙ্গে? আবার কত বড়ো সাহস, বাসায় নিয়ে শুয়ে গেছে? ভাবতে ভাবতে হাতের মুষ্টি পুনরায় শক্ত হয়ে গেল তার। বসলো বিছানায়। যে করেই হোক ডিভোর্স দেওয়াতে হবে। তার বাবা না চাইলেও এবার সে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কাজটা করাবে। ফোনটা হাতে নিল। আছমা ফুপুকে কল দিল সে, একবার রিং হতেই রিসিভ হলো,

– ‘হ্যালো ফুপু।’

– ‘হ্যাঁ রে, তোর বাপের অবস্থা কি?’

– ‘ভালো।’

– ‘তুই চোখের দেখাও দেখতে দিলি না।’

– ‘তুমি গেলেই কথা বাড়তো ফুপু।’

– ‘ঠিকই বলেছিস। আমি গেলে উনাকে মন ইচ্ছামতো কথা শুনাইতাম। এই বয়সে এসে পাগল হইছেন।’

– ‘ফুপু শোনো, তুমি কাল আসতে হবে।’

– ‘কেন?’

– ‘আসো পরে বলছি। কি করবো বুঝতে পারছি না। খবিশ মহিলাকে এখন ঘরে বন্দি করেছি।’

– ‘কি বলিস কাকে?’

– ‘কাকে বুঝতেছো না?’

– ‘কেয়াকে?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘কেন?’

– ‘যা শুনলাম বন্দি না করলে যদি সবকিছু নিয়ে পালিয়ে যায়? এই সাইকো মহিলাকে দিয়ে বিশ্বাস আছে? আর মোবাইলও নিয়ে এসেছি। আব্বুর কাছেও কল দিলে প্রব্লেম।’

– ‘তা বুঝেছি, কিন্তু দেখিস, মরে-টরে গিয়ে যদি ফাঁসায় আবার।’

– ‘কি জানি। এখন তুমি আসো কাল। তোমার ভাই দেখো কি চান।’

– ‘হুস্নার কাছে শুনলাম উনি মেনে নিয়েছেন। হাতেনাতে ধরেও উনার বউ প্রতি দরদ যায়নি।’

– ‘না, এরপর আরও ঝামেলা হয়েছে। আব্বু নিজেই কথা বলতে চায়। দেখা যাক কি হয়। তুমি কাল আসো।’

– ‘আর হ্যাঁ, তুই না ওইদিন বললি, তরু মেয়েটি না করছে ওর ফুপুর কোনো রিলেশন নেই।’

– ‘হ্যাঁ বলেছিল।’

– ‘মেয়েটাকে তো ভালোই মনে করতাম। কথায় আছে না, জাতের পক্ষ গাধায়ও দেয়। মেয়েটিও ফুপুর পক্ষ দিয়েছে।’

– ‘ফুপু রাখছি এখন। কাল আসো তুমি।’

ফোনটা রেখে দিল সে। তার মাথায় এখন আরেকটা দুশ্চিন্তা ঢুকেছে। দরজা বন্ধ করে যে এসেছে, যদি ফাঁস-টাস দেয় মহিলা? তাহলে তো আরেক বিপদ। কিছু একটা ভেবে চাবি হাতে নিয়ে কেয়ার রুমের দিকে গেল সে। গিয়ে দরজা খুলে বাতি জ্বালিয়ে দেখে কেয়া পালঙ্কে হেলান দিয়ে মেঝেতেই বসে আছে। টি-টেবিলে খাবার ঢাকা। বাতির আলো দেখে কেয়া মাথা তুলে তাকালো। নির্জন সামনে গিয়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে বললো, ‘খাবার দিয়ে গেছে খাচ্ছ না কেন?’

কেয়া কোনো জবাব দিল না৷ নির্জন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আব্বু যদি চান, তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে। তুমি তখন তন্ময়কে বিয়ে করে নিয়ো। তাহলেই হলো। আমি রাগারাগি করেছি তাই বলে খাবে না কেন? খেয়ে নাও। এখন যে সমস্যা হয়েছে সুন্দরমতোই শেষ হবে।’

কেয়া গর্জে উঠে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে বললো,

– ‘তোর বাপ আবার কি চাইবে রে খানকির পোলা। তুই কে আমাকে এত কথা বলার। আমি নিজেই তোর বাপকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাব। তুই আমার মোবাইল কেড়ে নিয়েছিস। গায়ে হাত দিয়েছিস। গলায় ধরে ধাক্কা দিয়েছিস। তোর বাপ এলে…।’

কথা শেষ করতে পারলো না কেয়া। নির্জন মেঝে থেকে উঠে প্রচণ্ড জোরে কেয়ার গালে চড় দিয়ে চিৎকার করে বললো, ‘তুই আমার মা’কে খানকি বললি? আমার মা’কে? এই খবিশ মহিলা, আগে আমি তোর গায়ে হাত তুলেছিলাম? ধাক্কা দিয়েছি শুধু। এতদিন তোর অনেক খারাপ আচরণ সহ্য করেও মা ডেকেছি। তোর কলিজা আল্লাহ কি দিয়ে বানিয়েছে? এত সাহস কেন তোর..।’

হুস্না নিচ থেকে ছুটে এসেছে। এসে তাকে টেনে ধরে নিতে নিতে বললো, ‘ভাইয়া কি হয়েছে, আসো তো। আসো।’

তারপর বাইরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল হুস্না। নির্জন বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে রইল। রাগে শরীর যেন কাঁপছে তার। নিজের প্রতিই এবার বিরক্ত হচ্ছে সে। গিয়েছিল ভালোর জন্যই। কিন্তু আবার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। বাপের বিয়ে করা স্ত্রীর গায়ে হাত তুলবে, গালি দেবে। এমন চিন্তা সে কখনও করেনি। অথচ আজ সে কি করলো, কি করছে? তার সঙ্গে কেউ মুখ কালো করেও কথা বলে না, সেখানে কেয়ার সরাসরি অনেক খারাপ আচরণ এতদিন সে মেনে নিয়েছে। ভাবতো বাবা বিয়ে করেছেন, উনি তো এখন মাইই তার। মানিয়ে নিলেই হলো। অথচ আজ সে রীতিমতো গায় হাত তুলে ফেললো। ভাবতেই পারছে না আর। বারান্দা পেরিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে নিল সে। তরু ঠিক জানালার পাশে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থেকে দেখলো অনেকটা বিধ্বস্ত অবস্থায় হেঁটে যাচ্ছে নির্জন।

*

পরদিন সকালেই নির্জন কোথাও চলে গেল। দশটার দিকে তরু নিজের সবকিছু গোছগাছ করে রেখে নিচে এলো। হুস্না তখন কিচেনে। ভাত বসানোর জন্য চাল নিচ্ছে। তরুকে দেখে বললো, ‘আপু কিছু বলবে?’

তরু ইতস্তত করে বললো, ‘নির্জন ভাই তো বাসায় নাই?’

– ‘না।’

– ‘আমি এখন চলে যাব। উনি এলে তুমি বইল যে তাকে পাইনি। তাই তোমাকে বলে গেছি।’

হুস্না অবাক হয়ে বললো, ‘এটা কি বলছো আপু? তুমি চলে যাবে মানে? কেউ বাসায়ও নেই।’

– ‘কেউ নেই তুমি তো আছো। এলে শুধু বলবে।’

– ‘উনাকে কল দিয়ে বলো।’

– ‘লাগবে না, শুধু এলে বলবে চলে গেছে।’

হুস্না ‘হা’ করে চেয়ে রইল। কি হচ্ছে এসব কিছুই যেন সে বুঝতে পারছে না। তরু উপরে এসে ওর ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বই-টই ফেলেই বের হয়ে গেল। বাড়িতেও কল দেয়নি সে। খুবই বিরক্ত লাগছে৷ এসব বিষয় সে ফেস করতেও চায় না। কারও সঙ্গে আলোচনা করারও আগ্রহ নেই। বারান্দায় এসে পিছু ফিরে একবার শুধু নির্জনের রুমের দিকে তাকালো। বুকটা কেমন করে যেন উঠলো তরুর। সিঁড়ি দিয়ে নেমে সিটিংরুমে আসতেই হুস্না এসে বললো, ‘ম্যাডামকে বলে যাবে না?’

– ‘না।’

– ‘একবার তো নির্জন ভাইকে কল দিয়ে বলে যাও। উনি রেগে কি থেকে কি বলছে এসবের জন্য চলে যাচ্ছ না-কি?

তরুর চোখ ছলছল করে উঠলো। হুস্নার হাত ধরে বললো, ‘উনার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার লজ্জা লাগছে হুস্না। মুখ লোকাতে পারলেই যেন বাঁচি। তাছাড়া নির্জন ভাই রেগে গিয়ে আমাকে কোনো খারাপ কথা বলে ফেলুক, এই সুযোগ আমি তাকে দিতে চাচ্ছি না। সত্যি বলতে উনাকে ভয় করছে। উনি বাসায় এলে শুধু বলবে তোমাকে বলে গেছি।’

হুস্না মাথা নাড়লো। তরু বের হয়ে চলে গেল বাসা থেকে।

__চলবে…..
লেখা: জবরুল ইসলাম

#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_২৪
.
কলিংবেল বাজতেই আছমা চৌধুরী গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। নির্জন এসেছে।

– ‘তুই কোথায় গিয়ে বসে আছিস বল তো, সেই দুপুরে আমি এসেছি।’

নির্জন ভেতরে এসে বললো, ‘কল দিতে পারতে।’

– ‘কয়বার কল দিয়েছি তার হিসাব আছে?’

নির্জন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে মোবাইল বের করে দেখে তিনটা মিসডকল।

– ‘হ্যাঁ, তাইতো, সাইলেন্ট ছিল ফুপু।’

– ‘হসপিটাল কখন যাবি?’

– ‘গোসল করে খাওয়া-দাওয়া করে যাই। আব্বুর জন্যও খাবার নিয়ে যেতে হবে।’

হুস্না তখন কিচেন থেকে বের হয়ে এসে ভায়ার্ত গলায় বললো, ‘ভাইয়া তরু আপু চলে গেছে।’

নির্জন সিঁড়ির হাতল ধরে পিছু ফিরে তাকিয়ে বললো, ‘চলে গেছে মানে বুঝিনি?’

– ‘তরু আপু ব্যাগ-প্যাক নিয়ে বাড়িতে চলে গেছে।’

– ‘কাকে বলে গেল!’

– ‘আমাকে যাওয়ার সময় বলেছে তোমাকে বলতে।’

নির্জন সিঁড়ির হাতলটা শক্ত করে ধরে দাঁত কটমট করে খানিকক্ষণ চোখবুজে দাঁড়িয়ে রইল। আছমা চৌধুরী বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘গেলে গেছে, ওদের কাউকে বলে যাওয়া আর না যাওয়ার মাঝে তফাত আছে না-কি? গরুর পালদের এগুলো লাগে না। চল, দাঁড়িয়ে আছিস কেন।’

নির্জন কিছু না বলে ওপরে চলে গেল। জোহরের আজান হওয়ায় আছমা চৌধুরী নামাজ পড়লেন। নির্জন গোসল করে নিল। তারপর দু’জনকেই খেতে দিল হুস্না। খাওয়া শেষে টিফিন বক্সে খাবার দিল। সেটা নিয়ে হসপিটাল এলো তারা। ইশহাক সাহেব বিছানায় বসে পত্রিকা পড়ছেন। নির্জন দৈনিক পত্রিকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আছমা চৌধুরীকে দেখেই উচ্ছ্বসিত গলায় তিনি বললেন, ‘যাক তুই এসে ভালোই করেছিস। নির্জন তো কিছু শুনতেই চায় না। এদিকে সুস্থ হয়ে গেছি, অথচ হসপিটাল ফেলে রাখছে।’

আছমা চৌধুরী সামনের সোফায় বসলেন। নির্জন টেবিলে টিফিনবক্স রেখে বললো, ‘আজ সবকিছু শুনবো আব্বু। কিন্তু শর্ত হচ্ছে উত্তেজিত হবে না। শান্ত থেকে বলো।’

– ‘হ্যাঁ, শান্ত আছি, বস তুই।’

নির্জন ফুপুর পাশে বসে গেল। আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে তারা। ইশহাক সাহেবের গায়ে সাদা গোল গলার গেঞ্জি। পরনে লুঙ্গি। এতদিন কিছু একটা বলার জন্য তিনি অস্থির ছিলেন, অথচ হুট করে আজ বলতে গিয়ে যেন ইতস্তত করছেন। আছমা চৌধুরী বললেন, ‘ভাই বলো কি বলবে।’

তিনি গেঞ্জির ঠিক থাকা হাত টেনেটুনে অকারণ ঠিক করতে করতে বললেন, ‘কেয়াকে আমি ছেড়ে দিতে চাচ্ছি। এজন্য বাসায়ও যাওয়া দরকার। ওর সাথে আমার কিছু কথা আছে। ওর পরিবারকেও ডাকবো।’

আছমা চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন? হঠাৎ ছেড়ে দিতে চাচ্ছ কেন?’

নির্জন বিরক্ত হয়ে ফুপুকে বাঁধা দিল। জানা বিষয় পুনরায় জানার নাটক সে পছন্দ করে না। সঙ্গে সঙ্গে বললো, ‘কেন, কি হয়েছে জানতে হবে না। আব্বু আমার কথা শোনো।’

– ‘বল।’

– ‘তুমি বাসায় গিয়ে আম্মুর সাথে কথা বলতে হবে না। আমি ওদের বাড়িতে খবর দিয়ে কাউকে আনি৷ এরপর ওদের সঙ্গে তুমি এখানেই কথা বলবে। ডিভোর্সের ব্যবস্থা হবে। ঝামেলা শেষ, তারা মেয়েকে নিয়ে চলে যাবে। কিন্তু এখন তুমি গিয়ে কথা বললে একটা ঝগড়াঝাটি হবে। হার্টের প্রব্লেম তোমার।’

ছেলের কথাটি শুনে তিনি খুশি হলেন। কেয়ার মুখও দেখতে চান না আর। পাশাপাশি অবাকও হলেন নির্জন সবকিছু এত সহজে বুঝে নিচ্ছে দেখে। সম্মতি জানিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, ওর বাপ-ভাইকে খবর দিয়ে আনা।’

– ‘ওদের বাড়ির নাম্বারটা দাও।’

ইশহাক সাহেব ওকে কেয়ার বাবার নাম্বার দিলেন। নির্জন ফুপুকে নিয়ে বাইরে আসার আগে বললো, ‘তুমি খেয়ে নাও আব্বু, আমরা কথা বলে নিচ্ছি।’

তিনি বিছানা থেকে নামলেন। নির্জন ফুপুকে নিয়ে হসপিটালের বারান্দায় বেঞ্চে এসে বসে বললো, ‘ফুপু আমি কল দিয়ে দিচ্ছি, তুমি একটু সিরিয়াসভাবে ওদের ডাকো। বলো যে একটা ঝামেলা হয়েছে কেয়ার দুয়েকজন অভিভাবক আসা লাগবে।’

আছমা চৌধুরী মাথা নাড়লেন। নির্জন কল দিয়ে মোবাইল দিলো উনাকে। দীর্ঘ সময় তিনি কলে কথা বললেন। সবকিছু খুলে না বলে শুধু বোঝালেন আসাটা জরুরি। ওরা এলো বিকাল পাঁচটার দিকে। কেয়ার বাবা এবং বড়ো ভাই এলেন। হুস্না তাদের সিটিংরুমে বসিয়ে নির্জনকে গিয়ে ডাকলো৷ সে এসে সালাম দিয়ে বসে তরুর বাবাকে বললো, ‘তরু কি পৌঁছে গেছে?’

তাদের খানিকটা হতভম্ব দেখাচ্ছে। তরুর বাবা আসলাম সাহেব বললেন, ‘ওর সাথে আমাদের দেখাই হয়নি বাবা। বাসে ছিলাম। তখন হঠাৎ ওর মা কল দিয়ে বললো তোমরা ঢাকা যাচ্ছ, আর তরু দেখি হঠাৎ বাড়িতে এসে হাজির। আমি বললাম কেন কি হয়েছে। ওর মা বললো এসেই দরজা বন্ধ করে রুমে বসে আছে৷ কিছু বলে না। এখন বলো তো বাবা সমস্যাটা কি হয়েছে। আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘সবই বলবো, অনেকদূর থেকে কষ্ট করে এসেছেন, এখন চা-নাশতা করুন’ বলে সে হুস্নাকে চায়ের জন্য ডাকলো। কেয়ার বাবা আরিফুল সাহেব বললেন, ‘কেয়াকে তো দেখছি না।’

‘আছেন উনি, আমি ফুপুকে আনি’ বলে সে উঠে গেল৷ সে কথা না বলে মুরব্বি কেউ বললে ভালো। তাই উপরে গিয়ে আছমা চৌধুরীকে নিয়ে নিচে এলো। উনি সালাম করে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করলেন। হুস্না আগেই চা বসিয়ে নিয়েছিল। তাদেরকে এনে চা দিল। আরিফুল সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে পুনরায় তাড়া দিয়ে বললেন, ‘কি এমন হয়েছে যে এত জরুরি তলব করলেন। এদিকে নাতনিও হঠাৎ চলে গেল।’

আছমা চৌধুরী চায়ের কাপ নিয়ে বললেন, ‘আপনার জামাই হসপিটাল জানেন তো।’

– ‘না, কেউ না বললে জানবো কি করে।’

– ‘তাহলে চা খেয়ে হসপিটাল যাই। ওইখানেই কথা বলে নিব।’

আসলাম সাহেব বললেন, ‘কেয়া কোথায় দেখছি না যে, ডাকেন ওকে।’

নির্জন ইতস্তত করে বললো, ‘চা খেয়ে নিন। উনার সঙ্গে দেখা করে হসপিটাল চলে যাব।’

ওরা চা খানিক তাড়াতাড়িই খেয়ে নিল। নির্জন বা আছমা চৌধুরী ঘটনাটি যতটা হালকাভাবে দেখেছিলেন। এখন কেমন যেন জটিল লাগছে। আরিফুল সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কেয়া কই চলুন নিয়ে।’

নির্জন তাদের নিয়ে উপরে এলো। চাবি পকেট থেকে বের করে তালা খুলছে দেখে আসলাম এবং আরিফুল সাহেব দৃষ্টি বিনিময় করছেন। দরজা খুলে নির্জন বাতি জ্বালিয়ে দিল। কেয়া খাটের মাঝখানে বালিশ ছাড়া ঘুমিয়ে আছে। আরিফুল সাহেব অবাক হয়ে গিয়ে বিছানায় বসে ওর মাথায় হাত রেখে ডাকলেন, ‘মা কেয়া, ঘুমিয়ে আছিস না-কি?’

কেয়া প্রথমে চোখ মেলে তাকালো। তারপর বাবা এবং ভাইকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে আরিফুল সাহেবকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আব্বা আমি আর একমুহূর্ত এই বাড়িতে থাকতে চাই না। আমি এখনই এই বাড়ি ছেড়ে তোমাদের সাথে চলে যেতে চাই..।’ তারপর আঙুল দিয়ে নির্জনকে দেখিয়ে বললো, ‘ওই গরুর বাচ্চা আমাকে বন্দি করে রেখেছে, চড়-থাপ্পড় মেরেছে, মোবাইল কেড়ে নিয়েছে।’

আসলাম সাহেব অবাক হয়ে নির্জনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কিছুই তো বুঝতে পারছি না। এসব কি? আমার বোনকে বন্দি করে রেখেছো কেন?’

আছমা চৌধুরী এগিয়ে এসে বললেন, ‘এখানে অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে। হসপিটাল চলুন। ওখানে গেলে সবকিছু জানতে পারবেন।’

আরিফুল সাহেব ক্রোধান্বিত গলায় বললেন, ‘কি এমন ঘটনা ঘটে গেল যে আমার মেয়ের গায়ে হাত তোলা হয়েছে, বন্দি করা হয়েছে, সবই বুঝা লাগবে। চলুন হসপিটাল।’

কেয়া উঠে বললো, ‘আব্বা আমি তোমাদের সাথে এখনই চলে যেতে চাই।’

আছমা চৌধুরী বললেন, ‘তলই সাহেব, ওকে হসপিটাল নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না, বাসায় থাকুক সে।’

আরিফুল সাহেব মেয়েকে বাসায় থাকতে বললেন।
নির্জন প্রচণ্ড বিব্রতবোধ করছে। সে বাইরে এসে দরজা ভেজিয়ে কি করবে বুঝতে পারছে না। আছমা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কি করবো ফুপু।’

তিনি আরিফুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তালই, তালা দিয়ে যাবে না-কি?’

তিনি মলিন চেহারায় বললেন, ‘এখন জিজ্ঞেস করে কি করবেন? তালা মেরেই তো রেখেছেন ওকে। মগের মুল্লুক পেলে হাত-পাও বেঁধে রাখেন।’

আছমা চৌধুরী বিনয়ের গলায় বললেন, ‘আপনারা রাগ করছেন বুঝতে পারছি। কিন্তু ব্যাপারটা শুনলে বুঝতে পারবেন..।’

– ‘হ্যাঁ আজ শুনেই যাব। কি এমন দোষ করলে ছেলে বাপের বিয়ে করা বউয়ের গায়ে হাত তুলে আজ শিখে যাব।’

নির্জন দরজা তালা না দিয়ে ভেজিয়ে রেখেই পিছু পিছু এসে কল দিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বললো সে। চারজন গাড়ি নিয়ে চলে এলো হসপিটাল।

দরজা খুলে ভেতরে যেতেই ইশহাক সাহেব তাদের দেখে বিছানায় থেকে নেমে সালাম করে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বসতে বললেন। আসলাম এবং আরিফুল সাহেব বসলেন সোফায়। নির্জন দাঁড়িয়ে রইল। আছমা চৌধুরী ভাইয়ের পাশে গেলেন।
আরিফুল সাহেব বললেন, ‘এবার বলুন আমাদেরকে কেন এভাবে ডেকে আনা হলো।’

কথা বলার ভঙ্গি দেখে ইশহাক সাহেবও দ্রুত প্রভাবিত হয়ে গেলেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘ডেকে আনা হয়েছে আপনার মেয়ের জন্যই..।’

কথাটি শেষ করার আগেই আরিফুল সাহেব বললেন, ‘মেয়ের জন্য আনা হয়েছে, আমরাও এসে মেয়ের অবস্থা দেখলাম। ওর গায়ে স্বামী হাত তুললেও একটা কথা ছিল। তুলেছে ছেলে। তার ফোন কেড়ে নিয়ে দরজা তালা মেরে রাখা হয়েছে।’

ইশহাক সাহেব বিস্মিত হয়ে নির্জনের দিকে তাকালেন। নির্জন কি বলবে ভেবে না পেয়ে ইতস্তত করছিল। ইশহাক সাহেব আরিফুল সাহেবকে বললেন, ‘আপনি এসব কি বলছেন? কে বলছে এগুলো আপনাকে?’

– ‘কেন, নিজের চোখে দেখে আসলাম। দরজার তালা খুলে ভেতরে নিল আপনার ছেলে। তারপরই কেয়া সবকিছু বললো আমাদের।’

ইশহাক সাহেব অবাক হয়ে নির্জনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তাই না-কি? তুই হঠাৎ করে এসব করতে কেন? আমি তো কিছু জানি না।’

– ‘পরিস্থিতিটাই অন্যরকম ছিল আব্বু..।’

আসলাম সাহেব কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘যে পরিস্থিতিই হোক, তুমি ওর গায়ে হাত তোলার রাইট কোথায় পেলে?’

নির্জনের আবার মেজাজটা খারাপ হতে শুরু করেছে। কাল থেকে ভেবেছে আর মাথা গরম করবে না। ওরা আসবে। মুরব্বি এবং মেহমানও তাদের। যথাসম্ভব সুন্দরভাবে সমাধান করবে। কিন্তু আবার সে তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে। আসলাম সাহেব পুনরায় বললেন, ‘বলো, তোমার কোনো রাইট আছে?’

– ‘উনি আমাকে ‘খানকির পোলা’ বলে গালি দিয়েছে। এরপর আমি চড় মেরেছি।’

আরিফুল সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ‘তাই বলে তুমি চড় মেরে দেবে? তুমি তোমার বাবাকে বলতে পারতে। আমরাও ছিলাম।’

– ‘পরিবেশটা তো সব সময় একরকম থাকে না।’

আসলাম সাহেব বললেন, ‘আর তোমাকে সে গালিও তো এমনি দিয়ে দেওয়ার কথা না। সে কেন গালি দিবে?’

– ‘মোবাইল এনে তালা মেরেছি তাই।’

– ‘তালা মারবে কেন? সে কি পাগ..।’

‘থামুন, এত উত্তেজিত হবেন না’ ইশহাক সাহেব থামিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, ‘ও যদি অন্যায় করে থাকে, সেটা পরে দেখা যাবে। দরকার হয় মাফ চেয়ে নিব, আগে আমার..।’

আরিফুল সাহেব প্রতিবাদ করলেন, ‘আশ্চর্য কথা, আপনি এত ঠান্ডা মাথায় কথা বলছেন কি করে? গায়ে তুলছে, বন্দি করে রাখছে, এখন মাফ চাইলেই শেষ?”

নির্জনের মোবাইল তখনই বেজে উঠলো। হুস্না কল দিয়েছে৷ সে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, ‘ভাইয়া, আপনারা কোথায়। ম্যাডাম চলে গেছে। আমি আঁটকে রাখতে চাইছিলাম পারি নাই..।’

___চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে