প্রণয়ে প্রলয়ের সুর পর্ব-১১+১২

0
781

#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_১১
.
নির্জন ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তখনই জানালার সামনে কেয়াকে দেখতে পেল। ওর দৃষ্টি লক্ষ্য করে তরুও তাকিয়ে দেখে কেয়া মিটমিট করে হাসছে।

– ‘ফুপু কিছু বলবে?’

কেয়া জবাব না দিয়ে ভেতরে এলো। তার মন-মেজাজ ভালোই মনে হচ্ছে। পাশে এসে বসে বললো, ‘ফুপুকে রেখে একা একা আইসক্রিম এনে খাচ্ছিস?’

‘তোমরা গল্প করো আমি গিয়ে পানি নিয়ে আসি’ বলে নির্জন বসা থেকে উঠে চলে গেল।

তরু পুনরায় ওকে আইসক্রিম খেতে বলতে গিয়েও ফুপুর জন্য পারলো না৷ ভেতরে কেমন একটা খচখচ করতে শুরু করলো। কেয়া ওর উরুতে চিমটি দিয়ে বললো, ‘ঘটনা কি? তুই না ভাব দেখাইতি? আমার ছেলে গুন্ডাদের মতো, চোখ মার্বেলের মতো। এখন দেখি পিছু নিয়েছিস?’

– ‘আজাইরা বকবে না তো ফুপু। পিছু নিয়েছি কে বললো।’

– ‘তাহলে আইসক্রিম নিয়ে এখানে কেন?’

তরু বলতে যাচ্ছিল ‘থ্যাংকস’ দিতে এসছিলাম। কিন্তু বললো না। শেষে ফুপু আরও বেশি খোঁচাবে। ইতস্তত করে বললো, ‘বারান্দা থেকে শব্দ শুনে এদিকে এসেছিলাম। এটা নিয়ে তোমার কাছেই যেতাম। নাও খাও আইসক্রিম। যা গরম পড়ছে না।’

কেয়া আইসক্রিম নিয়ে মুখে দিয়ে বললো, ‘চকলেট আইসক্রিম ভালো লাগে অনেক। আচ্ছা শোন, তোর মোবাইল মনে হয় রুমে রেখে এসেছিস।’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তোর আম্মা কল দিয়েছিল।’

– ‘কেন?’

– ‘তোর মামাতো বোনের বিয়ে পরশুদিন। তোকে যাওয়ার জন্যই কল দিয়েছে।’

– ‘ওমা এত তাড়াতাড়ি বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। শুনেছিলাম কথাবার্তা চলছে।’

– ‘তাড়াতাড়িই তো দিব। তোদেরকে ঘরে রাখা যাচ্ছে না। ছেলেদের জিমের ঘরে চলে যাচ্ছিস।’

তরু দাঁত কটমট করে তাকিয়ে রইল। কেয়া রহস্য করে হাসছে৷ তরু মনে মনে বলছে, ‘কত রূপ যে দেখাইবা ফুপু। এই রোদ এই বৃষ্টি৷ মুড সুইং এর মান-ইজ্জত শেষ করে দিচ্ছ।’

‘এত ঠান্ডা’ বলে কেয়া আইসক্রিম ফিরিয়ে দিয়ে বললো, ‘বিয়েতে যাবি?’

– ‘হ্যাঁ, আম্মুর সঙ্গে কথা বলে দেখি। তুমিও চলো। বিয়ের পরেরদিন চলে আসলাম।’

– ‘আমি?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তোর মা যেতে বলে নাই, তাই যাব না।’

– ‘আম্মু বলবে।’

– ‘তুই বলাবি। তাই বাদ, যাব না। এক কাজ কর। নির্জনকে নিয়ে যা। শ্রীমঙ্গলের পাহাড় জঙ্গলে দুইজন ঘুরে বেড়াবি..।’

– ‘ফুপু তুমি অতিরিক্ত বকছো কিন্তু।’

কেয়া খিলখিল করে হেসে উটলো। নির্জন জলের বোতল নিয়ে এসে বললো, ‘কি অবস্থা? কি নিয়ে কথা হচ্ছে?’

কেয়া স্বাভাবিক চেহারায় বললো, ‘তরুর মামাতো বোনের বিয়ে। ও চাচ্ছে তোমাকে নিয়ে যেতে। গেলে শ্রীমঙ্গলের চা-বাগান টা-বাগান ঘুরে আসতে পারবে।’

তরু প্রতিবাদ করতে যেয়েও থেমে গেল। সে এই কথা বলেনি বললে নির্জন কী ভাববে? সে চায় না নিতে? তাই চুপ করে রইল।

নির্জন ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘শ্রীমঙ্গল তোমার নানাবাড়ি?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘বাহ, ছবিতে দেখেছি, বেশ সুন্দর। চা-বাগান, পাহাড়, সবুজ গাছগাছালি। আমার শ্রীমঙ্গল যাওয়া হয়নি এখনও।’

তরু খানিক অবাক হয়ে বললো, ‘আসলেই জাননি?’

– ‘একবার যাওয়ার প্রোগ্রাম করে পরে যাওয়া হয়নি।’

– ‘তাহলে চলুন না। দেখে আসবেন।’

নির্জন এক চুমুক জল খেয়ে রানিং মেশিনের কাছে গিয়ে বললো, ‘না, এভাবে যাওয়ার ইচ্ছা নেই। তবে বন্ধু-বান্ধব মিলে কখনও ঘুরতে যাব।’

কেয়া বসা থেকে উঠে বললো, ‘তরুর এমনিতেই একা যেতে হবে। পারলে চলে যাও। ঘুরে দেখে আসবে। ভালো লাগবে।’

নির্জন কিছু একটা ভেবে বললো, ‘কবে বিয়ে?’

– ‘পরশুদিন। তোমরা কালই চলে যাবে।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে যাব৷ কিন্তু কাল গিয়ে বিয়ের পরেরদিন চলে আসবো।’

তরু মাথা নাড়লো।

পরদিন দুপুরে নির্জন রেডি হয়ে সিটিংরুমে বসে তরুর জন্য অপেক্ষা করছে। সঙ্গে একটা ব্লু ব্যাগ নিয়েছে। পরনে কালো ব্লেজার। নিচে সাদা গেঞ্জি। খানিক পরই দেখে সিঁড়িতে জুতোর শব্দ তুলে তরু নিচে নেমে আসছে। নির্জন মুগ্ধ হয়ে তাকালো। খুবই সাধারণ পোশাক। কালো একটি ড্রেস। সামনের দিকে কাজ করা। কনুই অবধি কামিজের হাত। মোহনীয় কালো চুল ওর কাঁধ দিয়ে বেয়ে পড়েছে। চোখে কাজল। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। এই লালটা একদম রক্তের মতো। মেয়েটিকে তার বেশ লাগে। ওর ফুপুর প্রতি ক্ষোভ। এবং তাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করায় দেখার আগে থেকেই তরুর প্রতি একরকম খারাপ ধারণা ছিল তার। যখন শুনলো এই মেয়ে আসবে। এসে রীতিমতো থাকবে। তার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়েছিল। নিতান্তই কেয়া আর তার বাবার কথা শুনে মেনে নেয়। বুঝতে দেয়নি ভেতরের বিরক্তি। স্টেশনে যাওয়ার পর যখনই তরু বললো, ‘একই ছাতা দিয়ে যেতে হবে না-কি?’ ব্যস, তার ভেতরের ক্ষোভটার বিস্ফোরণ হলো। এভাবেই বারবার রেগে যাচ্ছিল। কিন্তু একটা সময় বুঝতে পারে মেয়েটি তাকে উলটো রাগিয়ে বারবার মজা নিচ্ছে। ধীরে ধীরে তার রাগটাও কমে গেল। ওইদিন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাকে শুনিয়ে ফোন আলাপটাও সে বুঝেছে। এগুলো তাকে রাগানোর জন্যই করা। মেয়েটির চালচলন আর কথাবার্তায় চড়ুই পাখির মতো চঞ্চলতার একটা ব্যাপার আছে। রাগারাগি, ঝগড়াঝাটির মধ্যেও ওর ভেতরের টলমলে নরম মন প্রকাশ পায়। সেটা সে প্রথমদিনই বুঝেছে। এত রাগারাগির মধ্যে রান্না করতে গেল কেন? তার জন্য ডিম সিদ্ধ করলো কেন? তখনই বুঝেছে এই মেয়ে আর যাইহোক, ফুপুর মতো না। বেচারি ঝগড়া করতে গিয়ে, রাগাতে গিয়ে, বারবারই যত্ন নিয়ে ফেলেছে তার। অজান্তেই মমতা প্রকাশ করে ফেলেছে বারবার। ওইদিন রিকশার হুড তার জন্যই তুলেছিল। এবং রাগাতে গিয়ে, ঝগড়া করতে গিয়ে মেয়েটি এত মজা পাচ্ছিল যে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বেশি বেশি করতো।

‘স্যরি, স্যরি, আপনি এত তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে গেছেন ভাবিনি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করালাম।’ তরু কাছে এসে বললো।

নির্জন ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বললো, ‘দেরি করা তো মেয়েদের স্বভাবই। সাজতে সাজতে দেরি হয়ে যায়।’

– ‘এটা আমার উপর অপবাদ হয়ে গেল। আমার এত সাজগোজের অভ্যাস নেই।’

– ‘এটাও সকল মেয়ে দেরি করে এসে বলে।’

তরু দাঁত কটমট করে তাকিয়ে বললো, ‘আপনার সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করবো না বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু আপনিই শুরু করছেন আবার। আমি এসেই কিন্তু স্যরি বলেছি।’

নির্জন মুচকি হেসে বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, চলো। আর তোমার ফুপুকে বলে এসেছো তো?’

– ‘হ্যাঁ, এসেছি।’

দু’জন বের হয়ে এলো বাসা থেকে। গেইট খুলে বাইরে আসার পর তরু নিজের একপাশের চুল কানে গুঁজে বললো, ‘সাজগোজ তো দেখছি আপনি করেছেন।’

– ‘আমি?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘শার্ট, প্যান্ট তো সবাইই স্বাভাবিক পরে।’

– ‘হাতে ঘড়ি, বুকে সানগ্লাস সবই তো নিয়েছেন। ছেলেদের আর সাজগোজের কি আছে শুনি? শাড়ি-চুড়ি পরার পর কি সাজের ষোলকলা পূর্ণ হবে?’

নির্জন চেষ্টা করলো আগের মতো রেগে তাকাবে। কিন্তু হলো না। এরকম কথাবার্তা শুনলে তার কাছে উলটো ভালো লাগে। রিকশা একটা দেখে হাত তুলে থামিয়ে উঠে বসে। তরু ভ্যানিটিব্যাগ সহ উঠতে সমস্যা হচ্ছিল। সে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘ধরেই উঠো, পড়ে-টরে গেলে আবার গিয়ে নতুন করে সাজগোজ করতে করতে সূর্য ডুবিয়ে ফেলবে।’
তরু মুচকি হেসে ওড়নাটা কাঁধে ঠিক করে রেখে, বাঁ হাতে ভ্যানিটিব্যাগ নিয়ে ডান হাত বাড়িয়ে দিল। ওইদিন হাত ধরে তুলতে গিয়েই নির্জনের কাছে ভীষণ কোমল মনে হয়েছিল। আজও তাই হলো। কিন্তু ওর নখগুলো কোথায়? তরু উঠে এসে বসার পর বললো, ‘তোমার নখ না লম্বা ছিল। ওইদিন তো মোরগের মতো আঁচড়ে দিয়েছিলে।’

তরু বাঁ হাত মেলে ধরলো। অনেকটা ফুল ফোটার মতো। পরিষ্কার নখগুলো মাঝারি ধরনের লম্বা। লম্বা নখে মন্দ লাগে না মেয়েদের। যা কিছুতে মানুষকে সুন্দর লাগে, সেগুলোর ফ্যাশন কখনও পুরাতন হতে পারে না৷ এটা আজীবন চলতে পারে। তরু মুচকি হেসে বললো, ‘নখ খুঁজলেন কেন? আরেকটা খামচি খাবেন?’

– ‘না, খামচি ওইদিন খেয়েই বুঝেছি, খুব একটা টেস্টি খাবার না। তুমি ট্রাই করতে চাইলে দিতে পারি?’

তরু মুখে হাত দিয়ে হাসলো। সঙ্গে চুলগুলো সামনে চলে এলো। অবাধ্য চুলগুলো কানে গুঁজে বললো, ‘আপনার তো নখই নেই, খামচি কি দিয়ে দেবেন।’

– ‘বুঝেছি নখ রাখতে হবে।’

কথা বলতে বলতে তারা বাস স্টেশনে এসে পৌঁছে গেল। রিকশা থেকে নেমে টিকিট কেটে সিট পেল অনেকটা সামনের দিকে। ব্যাগটি উপরে রাখলো নির্জন। তরু জানালার পাশে গিয়ে বসলো। খানিকক্ষণ পর সে ওপর পাশের ফুটপাতে হাওয়াই মিঠাই দেখে বললো, ‘উফ হাওয়াই মিঠাই, এখন কি করে আনবো। বাস কি ছেড়ে দেবে?’
নির্জন ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে বললো, ‘বাচ্চাদের মতো হাওয়াই মিঠাইও খেতে ইচ্ছা করে?’

‘কালারটাই দেখুন না, দেখলেই খেতে ইচ্ছা করে’ বলে সে দাঁড়িয়ে গেল।

নির্জন দাঁত কটমট করে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি বসো, আমি নিয়ে আসছি।’

সে রাস্তা পেরিয়ে গেল হাওয়াই মিঠাই আনতে। সেখান থেকে বাসের ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে দেখে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে দৌড়ে এসে উঠলো। হাঁপাতে হাঁপাতে সিটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো, ‘নাও তোমার হাওয়াই মিঠাই।’
বাস তখনই টান দিল, নির্জন টাল সামলাতে না পেরে বাঁ হাতে সামনের সিট খামচে ধরলো। ডান হাতে হাওয়াই মিঠাই। চলতি বাসের জন্য বাঁ হাত টানটান হয়ে পুরো শরীর তাদের পেছনের সিটে পড়লো। মুখ গিয়ে পড়লো তরুর গলায়। নির্জনের চুলের সঙ্গে ঘষা খেল তরুর গাল। তরু দ্রুত হাত বাড়িয়ে ওকে ধরতে গিয়ে নাক ঠোঁটও ডুবে গেল চুলে। এক অজানা-অচেনা অনুভূতিতে তরুর কিশোরী মনে দোলা লাগে, শিরশির করে উঠে বুক।
___চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_১২
.
‘আমাকে ছেড়ে তোমার হাওয়াই মিঠাই নাও।’
নির্জন কথাটি বললো। একেবারে তরুর গলার কাছে তার ঠোঁট। তরুর গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। নির্জনের নাক, ঠোঁট দিয়ে উষ্ণ একটা হাওয়া এসে তার গায়ে পড়েছে। সেই উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়েছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এক হাতে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে বললো, ‘উঠুন আপনি।’

নির্জন উঠে তার সিটে বসে পড়লো।
তরু বুকে হাত বেঁধে তাকিয়ে রইল জানালার বাইরের দিকে। ঘন শ্বাস-প্রশ্বাসে বুক খানিকটা উপরে উঠা-নামা করছে। নাকের ফুটো দু’টো ফুলে ফুলে উঠছে।

নির্জন মুচকি হেসে বললো, ‘বাবা বাস্তব ছেড়ে হুট করে তোমাদের রোমান্টিক উপন্যাসে ঢুকে পড়েছিলাম লেখিকা ম্যাডাম।’

তরু ভীষণ লজ্জা পেল। কোনো কথা বললো না। ফিরেও তাকালো না। খানিক সময় নিল সে। তারপর শান্ত হয়ে নির্জনের দিকে না তাকিয়েই বললো, ‘আপনি আমার উপন্যাস পড়েন কেন?’

– ‘ওরে বাবা, এটা কোনো কথা হলো? ফেইসবুকে পাবলিক করা লেখা। সবাইই তো পড়বে।’

– ‘ফুপু ছাড়া কিন্তু আমার পরিচিত কেউই জানে না লেখালেখি করি।’

– ‘তাই না-কি?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তো আমার পড়া নিষেধ?’

– ‘অবশ্যই নিষেধ, কারণ ছেলেরা রোমান্টিক লেখা পছন্দ করে না। তাদের কাছে এই সবকিছুই ঢং মনে হয়।’

– ‘কেন পড়ে না বলে তোমার ধারণা।’

তরু ফিক করে হেসে বললো,

– ‘কারণ ছেলেরা আনরোমান্টিক।’

নির্জন ভ্রু-কুঁচকে বললো, ‘আমাকে আনরোমান্টিক মনে হয়?’

– ‘হতেও পারেন।’

– ‘রোমান্টিক হতে হলে কেমন হতে হয় শুনি?’

– ‘অনেক বেশি কেয়ারিং হতে হয়, রাগারাগি কম করতে হয়, প্রেমিকা বা বউয়ের ছোট ছোট আবদার পূরণ করতে হয়।’

নির্জন ওর হাত থেকে টান দিয়ে হাওয়াই মিঠাই এনে বললো, ‘আমি যে এটা দৌড়ে গিয়ে আনলাম। একটুর জন্য বাস ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। তবুও আমাকে মনে হয়নি কেয়ারিং। অন্যের ছোট ছোট আবদার পূরণ করার মতো ছেলে।’

তরু হাসতে হাসতে বললো, ‘বিয়ের পর ভাবির আবদার পূরণ নাও করতে পারেন। দিন, হাওয়াই মিঠাইগুলো আমার হাতে দিন।’

– ‘না, এটা আর দেবো না।’

‘আনরোমান্টিক’ বলায় এত রেগে যাওয়া দেখে তরুর অকারণ প্রচণ্ড হাসি পেল। দুইহাতে মুখ ডেকে নিল সে। ক্ষীণ সময় পর হাসি আঁটকে গেলে, এক হাত দিয়ে আচমকা হাওয়াই মিঠাই নিতে ঝাপটা দিতেই সরিয়ে নিল নির্জন। হাত পড়লো গিয়ে তার উরুতে। তরু লজ্জা পেয়ে এবার জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে বাইরে তাকায়। ইট-পাথরের যান্ত্রিক শহর ছেড়ে বাস অনেকদূরে চলে এসেছে। রাস্তার পাশে এখন সবুজ মাঠ। মাঠের মধ্যে গরু। গরুর কাঁধে প্রহরীর মতো বসা শালিক। তরু মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছে।

খোলা জানালা দিয়ে ছুটে আসা বাতাসে তরুর চুল উড়ছে। নির্জন মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল। তরুর সবকিছুই তার কেমন ভালো লাগছে আজকাল। অথচ কখনও সে এত হাসে না, কারও সঙ্গে মিশে না। একটুতে রেগে যাওয়ার বদ অভ্যাসটাও তার পুরনো। অথচ এখন ওর কোনোকিছুতেই রাগ হচ্ছে না। চট করে সকল কথার উচিত জবাব দেয়া দেখেও ভীষণ আনন্দ পাচ্ছে। তার নিঃসঙ্গ জীবনে যেন বন্ধুর মতো আবির্ভাব হলো তরুর।

বাস আরেকটু এগুতেই মুগ্ধতায় তরুর দমবন্ধ হবার অবস্থা। ছবির মতো সুন্দর দৃশ্য। আদিগন্ত সূর্যমুখী ফুলের ক্ষেত। যেদিকে চোখ যায় হলুদ ফুল আলো ছড়াচ্ছে। তার মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা। রাস্তা দিয়ে একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি সাইকেল চালিয়ে আসছে। পরনে লুঙ্গি। গায়ে বেগুনি শার্ট। নাকের নিচে পানার নিচের মূলের মতো কালো গোঁফ। বুকটা কেমন করে উঠলো তরুর। চট করে ইচ্ছা হলো নির্জনকে দেখাবে। বাইরে থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে অবাক হয়ে যায়। নির্জন বিমোহিত হয়ে তাকিয়ে তাকেই দেখছে। কেমন যেন তার চাহনি। তরু সঙ্গে সঙ্গে চোখ বাইরের দিকে ফিরিয়ে নিল। তার বলতে ইচ্ছে করছে, ‘প্লিজ এভাবে তাকাবেন না।’

‘কিছু বলবে?’ রাশভারি গলায় জিজ্ঞেস করলো নির্জন।

তরু না তাকিয়ে মিহি গলায় বললো,

– ‘সূর্যমুখী খেতটা দেখুন, কি সুন্দর।’

নির্জন ওর দিকে নিবিড় হয়ে এসে জানালায় হাত রেখে ভালো করে বাইরে তাকায়। বিস্তৃত খোলা মাঠে যেন হলুদের আগুন লেগে গেছে। সে গাঢ় আবেগি গলায় বিড়বিড় করে বললো, ‘সুন্দর, তবে বাতাসে তোমার চুল উড়ার মতো দৃশ্য থেকে নয় তরু।’

কথাটি শুনে তরু অবাক হয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে গেল। তাতেই নাক-মুখ ঘষা খেয়ে গেল নির্জনের বুকের সঙ্গে। অদ্ভুত এক মিষ্টি ঘ্রাণে, ভালো লাগায় চোখবুজে নিল তরু। তখনই টের পেল চোখে কিছু পড়েছে। খোঁচা লাগছে ভীষণ। নির্জন সরে গেল। এক চোখের বারবার পাতা ফেলছে তরু।

নির্জন বুঝতে পেরে বললো, ‘এত চোখ মারছো কেন? কি হয়েছে?’

– ‘গেঞ্জিতে সুঁই নিয়ে ঘুরে বেড়ান না-কি। ঘষা খেয়ে এখন চোখে খোঁচা লাগছে।’

নির্জন মুচকি হেসে বললো, ‘আমি দেখবো একটু?’

– ‘দেখুন।’

নির্জন এগিয়ে এলো একেবারে তরুর কাছে। দুই হাতের ভ্রু আঙুল দিয়ে ওর চোখের পাতা টেনে ধরলো সে। তরু দুইহাতে নির্জনের ব্লেজার ধরে আছে। খানিক পর একটা পাপড়ি এনে বললো, ‘এটা আমার সুঁই তাই না।’

তরু চোখের পাতা ফেলে বললো, ‘উফ, এবার শান্তি লাগছে।’

নির্জন নিজের সিটে বসে বললো, ‘ছেলেরা আনরোমান্টিক হলে, মেয়েরাও অকৃতজ্ঞ।’

– ‘কেন?’

– ‘কোনো কিছুর জন্য ধন্যবাদটুকুও নেই।’

– ‘এগুলোর জন্য মনে মনে ধন্যবাদও আশা করেন। আচ্ছা যান অনেকগুলো ধন্যবাদ।’

বাস বিরতি দিল তিনটার দিকে। নাশতা করে দু’জন এসে উঠে বসলো। বাস ছেড়েছে৷ মিনিট পাঁচেক পড়েই দূর্ঘটনাটি হলো। তাদের বাসটা আচমকা অন্যদিক থেকে আসা একটা ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষ হলো। নির্জন পলকে তরুকে বুকে টেনে আনলো। তার কপাল গিয়ে লাগলো সামনের সিটে। চারদিকে চিৎকার আর আর্তনাদ শোনা গেল। কারও মাথা লেগে গেছে গ্লাসে। কেউ উলটে গিয়ে পড়ছে সিটের বাইরে। ড্রাইভার প্রচণ্ড আহত হয়েছে। মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। তরু শক্ত করে নির্জনকে জড়িয়ে ধরে আছে। ক্ষীণ সময় পর ভয়ার্ত চোখে মাথা তুলে নির্জনের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ঠিক আছেন আপনি?’

– ‘হ্যাঁ।’

তরু ঠোঁট ভিজিয়ে। শুকনো ঢোক গিলে বললো, ‘এত হইচই কেন। আমাদের বাসের কি অবস্থা।’

– ‘ভয় পেও না। আসো দেখি কি হয়েছে।’

তরুর বুক ধুকপুক করছে। নির্জন ওকে ধরে দাঁড় করালো। তরু দাঁড়িয়েই দেখলো তাদের বাসের সামনের গ্লাস ভাঙা। আশেপাশে রক্ত। সামনের ট্রাকের ড্রাইভারের মাথার একদম ম*গজ বের হয়ে গেছে। রক্তে ভেসে গেছে রাস্তা। পেট গুলিয়ে উঠলো, মাথা ঘুরতে শুরু করলো তরুর। নির্জনের হাতটা ধরে বললো, ‘আমার মাথা ঘুরছে। আমি আর চোখ খুলে এখানের কিছুই দেখতে চাই না৷ প্লিজ তুমি আমাকে নিয়ে এখান থেকে যাও। যেকোনো গাড়ি নিয়ে চলে যাব আমরা।’
অনেক মানুষ ছুটে এসে বাসে উঠেছে। আহত মানুষদের ধরে নামাচ্ছে। একজন এগিয়ে এসে বললো, ‘আপনাদের কিছু হয়নি?’

– ‘না।’

– ‘ম্যাডামের মনে হয় সমস্যা হচ্ছে নেমে যান।’

নির্জন তার ব্যাগটা নামিয়ে কাঁধে নিল। তারপর তরুর ভ্যানিটিব্যাগ হাতে নিয়ে ওকে ধরে বললো, ‘আসো তুমি আমার সঙ্গে। চোখ খোলা লাগবে না।’

চারপাশে তাকিয়ে তার নিজেরও মাথা কেমন ভনভন করছে। দ্রুত এখান থেকে হেঁটে সরে এলো তারা। হঠাৎ করে তরু তাকে বললো, ‘ছাড়ুন আমাকে।’
তারপর রাস্তার পাশে বসে বমি করে ফেললো সে। নির্জন দ্রুত ছুটে গিয়ে রাস্তার একটা টং দোকান থেকে পানি নিয়ে এলো। এসে মুঠোয় নিয়ে ওর মাথায় একটু জল দিয়ে বললো, ‘পানি খাও, ভয় পেও না। আমরা ওখান থেকে তো চলেই এসেছি।’

তরু বোতল হাতে নিয়ে কুলি করে মুখটাও ধুয়ে নিল।

নির্জনও বোতল নিয়ে পানি খেয়ে মুখটা ধুয়ে নেয়। তার নিজেরও মাথা ব্যথা করছে। সামনের টং দোকানে আবার গিয়ে নির্জন বললো, ‘ভাই এখনকার কোনো লোকাল গাড়ির নাম্বার আছে?’

– ‘হ্যাঁ আছে, কেন? আপনাদের বাস কি এক্সিডেন্ট করছে?’

– ‘জি।’

– ‘কোথায় যাবেন?’

– ‘শ্রীমঙ্গল, একটু তাড়াতাড়ি কল দিয়ে আনেন।’

– ‘আচ্ছা বেঞ্চে বসেন কল দিচ্ছি।’

তরুর মাথা ধরেছে। শরীর কেমন কাঁপছে। বমি করে দূর্বলও লাগছে। বিছানা পেলেই সে ঘুমিয়ে যেত। তার চোখে শুধু রক্তাক্ত মানুষগুলোর চেহারা ভাসছে। রক্ত দেখলে এমনিতেই তরুর মাথা ঘুরে। খুবই সমস্যা হয়। স্থির থাকতে পারছে না এখন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ‘গাড়ি কখন আসবে আমার অস্থির লাগছে, আবার বমি করবো।’

নির্জন ইতস্তত করে বললো, ‘চলে আসবে গাড়ি, তুমি আমাকে ধরে বসো সমস্যা হলে।’

তরু সঙ্গে সঙ্গে আবার দ্রুত রাস্তার পাশে দৌড়ে গেল। পুনরায় বমি করলো সে। একটা কার এলো আরও মিনিট পাঁচেক পর। তরু মুখ-হাত ধুয়ে নিল আবার।
পানি এবং পলিথিনের ব্যাগ নিল নির্জন। তারপর তরুকে ধরে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। উঠার পরও তরু নির্জনের এক হাত শক্ত করে ধরে নিজের কোলে রেখে চোখবুজে রইল। এখনও বুকের ধুকপুকানি যাচ্ছে না তার। সাঁই সাঁই করে ছুটছে গাড়ি। তরু বিড়বিড় করে বললো, ‘প্লিজ ড্রাইভারকে বলুন একটু দেখেশুনে আস্তে চালাতে।’

নির্জন ওর মাথায় হাত রেখে বললো, ‘আস্তেই চালাচ্ছে। তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

তরু সত্যিই মিনিট কয়েক পর ঘুমিয়ে গেল। কিন্তু বারবার সামনের দিকে চলে যাচ্ছিল ওর মাথা। কেঁপে কেঁপে উঠছিল ঘুম থেকে। নির্জন শেষপর্যন্ত ইতস্তত করে বললো, ‘তুমি চাইলে আমার কাঁধে মাথা রাখতে পারো।’
তরু তাই করলো। কিন্তু ঘুমানোর পর ঢলে পড়লো তার কোলে। নির্জন তার ব্লেজার খুলে ওর মাথার নিচে দিল। হাত বাড়িয়ে পা তুলে দিল সিটে। গুটি-শুটি মেরে তরু ঘুমিয়ে গেল। নির্জন বাঁ হাতে ওকে সিটে ঠেলে ধরে রেখে মায়াবি মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা সময় মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করে।

___চলবে…..
লেখা: জবরুল ইসলাম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে