#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_১০
.
নির্জন খানিকক্ষণ তরুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘তাহলে আপনার ধারণা কি? কেন এমন করছেন আপনার ফুপু?’
তরু সরাসরি না তাকিয়ে ওড়না ঠিক করতে করতে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললো, ‘কি জানি কেন।’
নির্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্ষীণ সময় ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আপনি বিরক্ত হচ্ছেন মনে হয়, তাই না?’
‘না, তা হবো কেন। ভালোই লাগছে’ তারপর মুচকি হেসে পরিবেশটা হালকা করতে বললো, ‘কিন্তু আমি ভেবেছিলাম ফুপাতো ভাই আজ আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে, এখন বুঝলাম প্রয়োজনে।’
নির্জন মুচকি হেসে বললো, ‘আচ্ছা কফি নিয়ে আসি, বসুন।’
মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে ওর যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে
তরু। মানুষটা তো অদ্ভুত, পরিবারের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে ছেলেরা এত ভাবে বুঝি? মিথ্যেটা বলা উচিত হয়নি তরুর। বুঝতে পারছে সে। তবুও তো ফুপুর বদনাম তার শ্বশুরবাড়িতে বলা যায় না। পারিবারিক মান-ইজ্জত বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু তার ফুপু কি করতে চলেছেন? এটার কীভাবে বিহিত হবে? কাকে বলবে সে? মা’কে? একবার অবশ্যই কল দিয়ে বলবে সবকিছু। কাউকে তো বলা দরকার। নির্জন কফি নিয়ে এসে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘নিন।’
‘থ্যাঙ্কিউ’ বলে মুচকি হেসে কফি হাতে নিল তরু।
নির্জন পাশে বসে কফিতে চুমুক দিল। তরু চোরা চাহনিতে দেখলো। উনাকে কি তার কোনো গল্পের নায়ক দেয়া যায়? হবে না, এরকম ছেলেরা বাস্তব জীবন বর কিংবা প্রেমিক হিসাবে পার্ফেক্ট। গল্পে শান্তশিষ্ট, কম কথা বলা নায়ক পাঠকদের আনন্দ দিতে পারে না। নির্জনই নীরবতা ভেঙে বললো, ‘তন্ময়ের এরকম আসা-যাওয়াকে কীভাবে দেখছেন?’
তরু কফিতে চুমুক দিয়ে তাৎক্ষণিক কিছু ভাবলো। ভেবে বললো, ‘বাড়াবাড়ি বটে, তবে ফুপুকে বলেছিলাম। উনি বললেন ফুপার না-কি বিশেষ পছন্দ ছেলেটা। তাই উনিই খাতির করে আনেন। আমার মনে হয় আপনি বুঝিয়ে তন্ময়কে এ বাড়িতে আসা বন্ধ করলে ভালো হয়।’
নির্জন ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কেন ভালো হয়?’
তরু সতর্ক হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বললো, ‘একজন বাইরের মানুষ কেন আসবে? ও তো আমাদেরও রক্তের কেউ না।’
‘হুম ঠিক বলেছেন’ বলে সে কফিতে চুমুক দিল। দু’জন নীরব। নির্জন পুনরায় বললো, ‘আচ্ছা এসব থাক। আপনার কথা বলুন। আপনি কি খেতে পছন্দ করেন?’
তরু মুচকি হেসে বললো, ‘খাওয়া ছাড়া কি পছন্দের আর কিছু থাকতে পারে না।’
– ‘পারে, কি দেখতে, কি পড়তে, কোথায় ঘুরতে পছন্দ জিজ্ঞেস করা যেত। কিন্তু আপনার তো কোচিং এর পড়া আছে। সেসব করতে পারবেন না এখন। খেতেই পারবেন শুধু।’
তরু ফিক করে হেসে ফেললো।
– ‘হ্যাঁ তাইতো।’
নির্জন ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আপনার হাসি বেশ মিষ্টি, আর কথা বলে মনে হচ্ছে ঝগড়াটে হলেও ফুপুর মতো না।’
– ‘আমি মোটেও ঝগড়াটে না, আপনার কারণেই ঝগড়া করেছি। আর ফুপুকে এত ঘৃণা করলে সামনে এত খাতির কেন দেখান?’
নির্জন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আমার কারণে আমার মা মারা গিয়েছিলেন মিস তরু। ফুপু বলেন, আমারই কারণে আমার বাবা বিয়ে করতেন না। ভাবতেন সৎ মা জ্বালাবে আমার ছেলেকে। এখন বড়ো হয়েছি। বাবার সেই ভয় নেই হয়তো। অথবা আপনার ফুপুকে দেখে মানুষটার ভালো লেগেছে, সবার সঙ্গে কথা বলে, ইভেন আমার মতামত নিয়ে বিয়ে করেছেন। বিয়ের পর থেকে বুঝতে পারছি আব্বা প্রচণ্ড পছন্দ করেন উনাকে। যদি আমার কারণে ঝামেলা হয় কষ্ট পাবেন। কিংবা কোনো কারণে যদি সংসার না টিকে, কোনো অঘটন ঘটে বুঝতে পারছেন? উনার কিন্তু হাই প্রেশার, হার্টও দূর্বল৷ এজন্য ভেবেছি একটু মানিয়ে নিলেই তো হয়ে যায়৷’
– ‘আমি কি আমার বাড়িতে জানাবো?’
– ‘না না এতে ঝামেলা হতে পারে। এর চাইতে আপনি চোখের সামনে আছেন, দেখছেন সবকিছু, উনাকে বুঝান। হয়তো ধীরে ধীরে বুঝবেন।’
– ‘সে আমি বুঝাবো, কিন্তু একটা কথা।’
– ‘ হ্যাঁ বলুন।’
– ‘আমাকে এই ‘আপনি, আপনি’ না করলে হয় না? আপনি তো আমার ফুপাতো ভাই। দূরের কেউ না।’
– ‘হ্যাঁ তা ঠিক বলেছেন।’
– ‘বলেছেন না ‘বলেছো।’
হাসলো নির্জন। তারপর বললো, ‘কি পছন্দ করো বললে না যে?’
– ‘আইসক্রিম।’
– ‘শুধু আইসক্রিম?’
– ‘ফুসকাও পছন্দ।’
– ‘হুম বুঝেছি।’
– ‘কি?’
– ‘কিছু না, চলো এবার যাওয়া যাক।’
দু’জন এগিয়ে এসে ফুসকা খেয়ে রিকশায় উঠলো। বাসায় ফিরলো আটটার আগে। এসে দেখা গেল জিমের সরঞ্জামগুলো লোকজন দিয়ে নেয়া হচ্ছে উপরের একটি কামরায়। নির্জন কিছু না বলে নিজের রুমে চলে গেল। তরু উত্তরদিকের ওই জিমের রুমটা গেল দেখতে। জানালার কাছে গিয়ে দেখে কেয়া, ইশহাক সাহেব এবং তন্ময় দাঁড়িয়ে আছে। সবকিছু ঠিকঠাক করছে তিনজন লোক। তরু সরে চলে যেতে চাইছিল। ইশহাক সাহেব দেখে ফেললেন, ‘আরে তরু মা এসেছো তোমরা?’
– ‘ হ্যাঁ, ফুপা।’
– ‘নির্জনকে ডাক দাও তো একটু।’
‘আচ্ছা’ বলে সে গিয়ে দরজায় নক দিল।
নির্জন খুলে দিলে বললো, ‘ফুপা ডাকছেন।’
সে বের হয়ে গেল জিমের রুমে। তরু দাঁড়িয়ে রইল জানালার কাছে।
ইশহাক সাহেব তাকে দেখে বললেন, ‘ঠিক আছে তো সবকিছু?’
– ‘হ্যাঁ বাবা সব ঠিক আছে।’
– ‘কাল থেকে বাড়িতেই করতে পারো তুমি।’
– ‘এখানে তো সবকিছু নেই বাবা। আমার বাইরেই যেতে হবে।’
– ‘কি বলো, হবে না এগুলোতে?’
– ‘না হবে, এখানে যথেষ্টই আছে, এমনিতে আমি যেদিন জিমে যাব না এখানেই করবো। কিন্তু সন্ধ্যায় হবে না৷ আমি দিনেই করবো।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
নির্জন পুনরায় চলে গেল তার রুমে। তরুও সরে গেল জানালার কাছ থেকে।
*
পরদিন প্রচণ্ড রোদ উঠেছে। কোচিং থেকে ফিরে এলো সে দুইটার দিকে। এসে দরজা খুলে প্রথমেই টেবিলে চোখ পড়লো। একটা চকলেট আইসক্রিমের বক্স। এগিয়ে গিয়ে হাতে নিলে দেখে পাশে এক টুকরো কাগজ। সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, ‘হ্যাঁ, তোমার জন্যই লেখিকা ম্যাডাম।’
মুচকি হাসলো তরু। বুঝতে পারছে কার কাজ এটা। অদ্ভুত এক ভালো লাগায় তার মনটা ভরে গেল। বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে আইসক্রিম হাতে নিয়ে গেল পেছনের ঝুলন্ত বারান্দায়। এদিকটায় ফুরফুরে মিহি বাতাস বইছে। ডিবাটা খুলে আইসক্রিম মুখে দিল তরু। বরফ ঠান্ডায় শিরশির করে উঠলো দাঁত। তবুও ভালো লাগে তার। সামনে অনেকটা জায়গাজুড়ে গাছগাছালি। কোথাও একটা কোকিল ‘কুহু-কুহু’ করে ডেকে হারিয়ে গেল। নির্জন ভাই কোথায় এখন? নিশ্চয় রুমে। সে কি গিয়ে “ধন্যবাদ” দেবে? তাছাড়া একই বাসায় মাঝেমধ্যে তো যেতেই পারে। তরু আইসক্রিম খেতে খেতেই ওর দরজার কাছে গিয়ে দেখে বন্ধ। পাশেই জিমের রুম থেকে শব্দ আসছে। তরু জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। রানিং মেশিনে নির্জন দৌড়াচ্ছে। পায়ে কেডস, পরনে থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট এবং মেগি হাতা গেঞ্জি। ঘেমে একাকার। তাকে দেখতে পেল নির্জন। স্পিড কমিয়ে ডাক দিল, ‘তরু ভেতরে আসো।’
জানালা থেকে সরে দরজার কাছে গিয়ে দেয়ালের আড়ালে ক্ষীণ সময় দাঁড়ালো সে। ভেতরে যেতে কেমন যেন লাগছে তরুর। আবার যেতেও ইচ্ছা করছে। জুতো খুলে আইসক্রিমের বক্স হাতেই ভেতরে গেল সে। নির্জন দৌড় থামিয়ে জানালা থেকে রুমাল এনে মুখ মুছে ফ্যানের নিচে বসলো। তরু দাঁড়িয়ে থেকে তাকিয়ে আছে। ঘেমে গিয়ে মুখ কেমন লাল হয়ে আছে। হাতের পেশি অসম্ভব ফরসা। গেঞ্জির ভেতরেই সব সময় থাকে বলেই হয়তো।
– ‘বসো, ময়লা একটু লাগলে কিছু হবে না।’
তরু বসলো হাত তিনেক দূরে। তারপর ইতস্তত করে বললো, ‘থ্যাংকস।’
নির্জন মুচকি হেসে তাকিয়ে বললো, ‘এটার জন্য থ্যাংকস দিতে খুঁজছিলেন না-কি?’
– ‘হ্যাঁ।’
‘কেন..’ তারপর নিজেই বললো, ‘থাক উত্তর দিতে হবে না। নিশ্চয় বলবে আমার মতো লোকের কাছ থেকে আশা করা যায় না।’
বলে হাসলো সে। তরুও হাসিতে যুক্ত হয়ে বললো, ‘আসলেই তাই, কিন্তু হুট করে কি মনে করে আইসক্রিম?’
– ‘গতকাল বললে না আইসক্রিম পছন্দ?’
– ‘আমার পছন্দ হলেই এনে দেবেন এমন তো না। আপনার না খুব রাগ সামান্য ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করিনি বলে।’
রুমাল দিয়ে মুখ মুছে নির্জন মুচকি হেসে বললো,
– ‘রাতে তো একসেপ্ট করলে।’
– ‘তাতেই রাগ শেষ?’
এবার খানিক সিরিয়াস দেখালো নির্জনকে। সে আরাম করে বসে বললো, ‘আসলে হয়েছে কি, গতকাল তোমার থেকে যখন জানলাম আম্মুর পূর্বে কোনো রিলেশন নেই। এদিকে তন্ময়কে বাবাইই আনেন। সব মিলিয়ে মনে হলো আমার মনে হয় সমস্যা আছে। হয়তো নেগেটিভ ছাড়া আমি আর কিছু ভাবতে পারে না..।’ তারপর থেমে ঠোঁট ভিজিয়ে মুচকি হেসে বললো, ‘তোমার ব্যাপারটাও বলে ফেলি। আসলে তোমার সঙ্গে রাগারাগিটাও আমার ভুল ছিল।’
– ‘বাহ, তা হঠাৎ কেন মনে হলো।’
– ‘বলবো?’
– ‘হ্যাঁ, অবশ্যই বলুন।’
– ‘আসলে কারও কাছে আমাকে ভালো না লাগতে পারে। মনে হতে পারে আমার চোখ মার্বেলের মতো। দেখতে গুন্ডার মতো। এটা শুনে ওই মানুষটির উপর রেগে যাওয়া সত্যিই শিশুসুলভ ব্যাপার। বললাম না নেগেটিভই ভাবি শুধু হয়তো। এখন থেকে ঠিক করেছি সবকিছু পজিটিভ চিন্তা করবো। তাতে আলাদা প্রশান্তি আছে।’
তরু ভ্রু-কুঁচকে বললো, ‘মানে কি বুঝাতে চাইছেন?’
– ‘তুমি তো এগুলো আমাকে বলেছিলে একদিন, তাই না? তোমার ফুপুর হোয়াটসঅ্যাপে।’
তরু বক্সটা রেখে বললো, ‘আশ্চর্য এগুলো আপনি দেখেছেন? ওটা তো আমি ফুপুর ক্ষ্যাপানোর যন্ত্রণায় বলেছি..।’ তারপর থেমে বললো, ‘ওইদিন ফোনেও যে কথা বলেছিলাম। ওটাও মিথ্যে, আপনাকে রাগানোর জন্য।’
নির্জন ভ্রু-কুঁচকে বললো, ‘তাই?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘আচ্ছা এগুলো বললেও আসলে আমার রাগারাগির কিছু নেই। খুবই স্বাভাবিক বিষয়।’
– ‘বিশ্বাস করেন, এগুলো সত্য বলিনি, কসম।’
বাচ্চাদের মতো কসম বলা দেখে হাসলো নির্জন। তারপর চারদিকে তাকিয়ে বললো, ‘পানি না নিয়ে চলে এসেছি।’
তরু আইসক্রিম দেখিয়ে বললো, ‘আপনার গরম লাগছে, খাবেন? চামচ আনবো?’
___চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম