#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-১৯
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
জুঁই সকলের সামনে এসে ফারিশকে জড়িয়ে ধরায়, অনন্যা ভ্রু কুচকে তাঁকায় জুঁইয়ের দিকে। রেশমি খান এবং এনাও কিছুটা থতমত খেয়ে যায়। ফারিশ স্হীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার চোখমুখ শক্ত! জুঁই ফারিশকে জড়িয়ে থেকেই ফিসফিস করে বললো, ‘ অফিস থেকে না হয় বিদায় করে দিয়েছো, কিন্তু? এই বাড়ি থেকে আমাকে কি করে বিদায় করবে তুমি ফারিশ? তুমি যতই আমাকে দূরে সরাতে চাইবে, আমি ততই তোমার কাছাকাছি চলে আসবো।’
ফারিশ কোনপ্রকার জবাব দিলো না। এমন পরিস্হিতিতে খালেদ খান কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু তার মা রুমা খান উপর থেকে নেমে গাম্ভীর্যের সাথে চেচিয়ে উঠে বললেন, ‘ এইসব কি হচ্ছে এখানে?’
রুমা খানের আওয়াজ শুনে, ফারিশ তৎক্ষনাৎ জুঁইকে একপ্রকার ঠেলে নিজের থেকে সরিয়ে ফেললো। জুঁই ধাক্কা সামলাতে না পেরে,নীচে পরে যেতে নিয়েছিলো কিন্তু আরশ এসে জুঁইকে ধরে ফেলে। জুঁইকে এইভাবে ধাক্কা দেওয়ায় আরশ কিছু বলতে চাইলে, জুঁই আরশকে চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলে।জুঁই আরশকে আকড়ে ধরে কোনরকম জোড় করে হেসে বলে, ‘ আসলে অনেকদিন পর, সবাইকে দেখলাম তো! তাই আর কি এক্সাইটেডমেন্টে! যাই হোক, এনা ও আরশ তোরা আয়! লেটস গিভ মি হাগস! কতদিন পর তোদের দেখলাম। ‘
এনা ও আরশও একসাথে জুঁইকে জড়িয়ে ধরে। আরশের থেকে বয়সে জুঁই ছোট হওয়ায়, আরশ জুঁইকে এনার মতোই ভালোবাসে, অপরদিকে এনাও বড় বোন হিসেবে জুঁইকে অনেক পছন্দ করে। জুঁই, এনা ও আরশের সাথে কুশল বিনিময় করে, রেশমি বেগমকে জড়িয়ে ধরে, ‘ খালা! কি অবস্হা তোমার?’
রেশমি বেগম উত্তর দিলেন না, তবে তাকে খুব দুশ্চিন্তিত লাগছে! ড্রইয়ং রুমে ৪টার মতো এসি! বাইরে আজ মেঘলা আবহাওয়া, তবুও সে ঘামছে! তিনি খুব ভালো করে বুঝতে পারছেন, জুঁই মোটেও তাদের জন্যে আসেনি। ছোটবেলা থেকে সে ফারিশকে পছন্দ করে, সে একপ্রকার মরিয়া হয়ে উঠেছে ফারিশকে পাওয়ার জন্যে। নিশ্চই কোন পরিকল্পনা নিয়েই সে আজ এসেছে খান বাড়িতে কিন্তু তিনি ফারিশকেও ভালো করে চিনেন। একরোখা, জেদি টাইপ ছেলে। সে বেশকয়েকবারই জুঁই এবং ফারিশের বিয়ের প্রস্তাব রেখেছেন প্রতিবারই তীব্রভাবে অপমানের সহিত সেই প্রস্তাব নাখোচ করেছে ফারিশ! বাড়িতে জুঁই চলে আসায় বেশ বড়সড় ঝামেলা হবে ভাবতেই মাথা ঘুড়াচ্ছে রেশমির! কিন্তু তার অজ্ঞান হলে চলবে না! নাহলে সবকিছু সামলাবে কে?
এতোকিছুর মাঝে সবেমাত্র ঘোর কাটলো অনন্যার! এতোক্ষন সে একটা বিরাট বড় ঘোরের মধ্যে ছিলো , জুঁই সম্পর্কে রেশমি খানের বোনের মেয়ে হয়! তার মানে ফারিশের সাথে তার আত্বীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। সেদিন অভির সাথে জুঁইয়ের হুট করে বিয়ে ঠিক হওয়ায়, প্রথম থেকেই অনন্যার সংদেহ হচ্ছিলো,সবকিছুর মধ্যে কোথাও না কোথাও জুঁইয়ের হাত রয়েছে। আজ সে পুরো নিশ্চিত, এতো বড় ষড়যন্ত্রে জুঁইয়েরও হাত রয়েছে। অনন্যার এখন মনে হচ্ছে সেদিনের ভিডিও হয়তো মিথ্যে না! সেদিন রাতের পুরো ঘটনা তার মনে নেই! এর পিছনে শেফালি এবং জুঁই সমানভাবে জড়িত! জুঁইকে সে ভালো করে চিনে, সে কিছুতেই সত্য কথা স্বীকার করবে না, অন্যদিকে বাকি রয়েছে শেফালি কিন্তু তার সাথে যোগাযোগ করবে কীভাবে অনন্যা? তার ফোনটাও তো ফারিশের কাছে জমা রয়েছে।
অনন্যা ভাবনার মাঝেই, জুঁইয়ের নজর গিয়ে পরে, অনন্যার উপর। অনন্যা দেখেই ইচ্ছে করেই, খানিক্টা হেসে প্রশ্ন করে , ‘ এই মেয়ে কে? আজ নতুন দেখলাম। নতুন সার্ভেন্ট নাকি?’
রেশমি খান হাল্কা হেসে বললেন, ‘ হ্যা! আমাদের বাড়ির কাজের লোক। ‘
‘ রেশমি খান একটা কথা আপনাকে কতবার বলতে হবে? মিস অনন্যা শুধুমাত্র আমার পার্সোনাল কাজের লোক! সব বিষয়ে আপনি কেন এতো ইন্টারফেয়ার করেন?’
ফারিশের প্রশ্নে চুপ হয়ে গেলো রেশমি খান। এনা এগিয়ে গিয়ে জুইকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘ আপু! চলো তো উপরে।কতদিন পর, তোমায় দেখলাম। অনেক গল্প করা বাকি আছে। ‘
এনার কথার বিপরীতে, জুঁইও ফারিশের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ সমস্যা নেই। এসেছি যখন, বেশ কয়েকদিন থেকে তবেই যাবো। ‘
ফারিশ আগের ন্যায় কোনপ্রকার উত্তর দেয় না কিন্তু বাঁকা হাসি দিয়ে নীচের দিকে তাঁকায়! তার মষ্তিষ্কে হয়তো এমন কিছু এসেছে তা ভয়ংকর! তবেই সে এতোটা শান্ত। তাদের কথার মাঝেই, আরশের ফোন আসে। অপাশ থেকে একটা মেয়ের নাম্বার দেখে সঙ্গে সঙ্গে কেটে দিয়ে, মেয়েটার নাম্বারে মেসেজ করে লিখে, ‘ তুমি রেডি থাকো বেবি! আমি জাস্ট কিছুক্ষনের মধ্যে হোটেল রুমে পৌঁছে যাচ্ছি। ‘
আরশ ফোনটা রেখে, জুঁই এবং এনার দিকে তাঁকিয়ে বলে, ‘ আমার ফ্রেন্ডসদের সাথে ছোটখাটো একটা পার্টি আছে, তোমরা যাও! আমি পার্টিটা শেষ করে, জলদি চলে আসবো। ‘
‘ ওকে ভাইয়া, কিন্তু তাড়াতাড়ি আসবে কিন্তু। ‘
এনা কথাটি বলেই, জুঁইকে নিয়ে উপরে যেতে থাকলে, জুঁই খেয়াল করে অনন্যা ঘৃণার দৃষ্টিতে তার দিকে তাঁকিয়ে আছে, কিন্তু তা সে একপ্রকার এড়িয়েই উপরে চলে গেলো। ফারিশও অফিসের উদ্দেশ্য যাচ্ছিলো কিন্তু পিছন থেকে খালেদ খান ড্রাইনিং টেবিলে বসে থেকে প্রশ্ন করে, ‘ ফারিশ শোনো একটু! আমাদের নেক্সট ক্লাইন্টকে হ্যান্ডেল করতে, ভাইকে দেশে আসতে বলবো ভাবছি। জাপানের ক্লাইন্ট তো! বেশ ঝামেলা করে এরা। ভাই আবার জাপানের ক্লাইন্টদের সাথে উঠাবসা। তিনি সবকিছু ভালো করে হেন্ডেল করতে পারবে। তোমার কি মতামত? ‘
ফারিশ পিছনে না ঘুড়েই জবাব দিলো,’ মি: খালেদ খান, আপনার কি কোনভাবে আমার স্ট্রাটাজির উপর সংদেহ রয়েছে? থাকলে বলুন। এই অর্ডার থেকে আমি নিজেকে সরিয়ে ফেলবো। ‘
‘ এইসব কি বলছো ফারিশ? তোমার উপর আমি কী করে সংদেহ করতে পারি? আসলে জাপানের পার্টি তো বুঝতেই পারছো! তার মধ্যে প্রায় ১০০কোটি টাকার অর্ডার, তাই আর কি…..
সম্পূর্ন কথা শেষ করতে পারলেন না খালেদ তার আগেই ফারিশ উচ্চগলায় বলে উঠে, ‘ আজকেই আমি সেই জাপানের ক্লাইন্টদের সাথে বসে, অর্ডার কনফার্ম করে ফেলবে। তার জন্যে রাশেদ খানকে, সদূর জাপান থেকে চলে আসতে হবেনা। তিনি যদি কোনভাবে আমার কাজে ইন্টারফেয়ার করে, তবে আমি নিজেকে বিসনেজ থেকে সরিয়ে ফেলবো। আমার লাস্ট এন্ড ফাইনাল ডিসিশন। আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ। ‘
ফারিশ কথাটি বলেই বেড়িয়ে যায়। খালেদ খান ও কথা বাড়ালেন না, তিনিও বেশ ভয় পান তার ভাইয়ের ছেলে। ছেলে যখন একবার সতর্ক করে দিয়েছে তখন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করলে, ঝামেলা হবে বড়! ফারিশ ব্যাবসায়ী ছেলে বাবার মতো!এতো বছর ধরে সাফল্যের সাথে খান বাড়ির ব্যাবসা সামলাচ্ছে যদিও ফারিশ ডিগ্রি পেয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। কিন্তু ব্যাবসায়ীক ক্ষেত্রে সে তুখোর! তাইতো খান ইন্ড্রাস্টির এমডি সে। খালেদ খানের ধারণা, ফারিশ যখন বলে দিয়েছে তখন সে তাকে নিরাশ করবে না আজ। সে একাই এতো বড় অর্ডার কনফার্ম করে ফেলবে। অপরদিকে এইসব দেখে রুমা খান হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।নিজের বাবার প্রতি ফারিশের এমন বিদ্বেষ দেখে, অনন্যা রুমা খানের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘ দাদি! অনেক দিন ধরেই একটা কথা বার বার জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম। ‘
‘ কি কথা রে দিদিভাই?’
‘ এই বাড়িতে সবাই আছে, কিন্তু ফারিশ খানের বাবা-মা এই বাড়িতে থাকে না কেন? উনারা কি দুজনেই বিদেশে থাকে?’
অনন্যার এমন প্রশ্নে রুমা খানের মুখস্রী শুকনো হয়ে যায়। তিনি থমথমে গলায় জবাব দেয়, ‘ ফারিশ দাদুভাইয়ের যখন ৭বছর তখন তার মা মারা যায়। রোকেয়া মারা যাওয়ার ৮মাসের মাথায় ফারিশের কথা ভেবে, রাশেদ আরেকটা বিয়ে করে। কিন্তু সেই মাকে কিছুতেই মেনে নেয় না ফারিশ এবং সেই ঘরে বাচ্চা- কাচ্চা হওয়ার পরে, রাশেদের স্ত্রীও রাশেদকে নিয়ে বিদেশে চলে যায়, ছেলেটাকে একা করে। কতই বা বয়স ছিলো ছেলেটার? অতটুকু বয়সে বাবা-মা দুজনকেই হারিয়ে ফেলে সে। সৎ মা তো সৎ মা’ই হয়। এখন রাশেদ বউ, ছেলে- মেয়ে নিয়ে বিদেশেই থাকে। শীতের মধ্যে একবার করে তারা আসে শুধু এতটুকুই।’
রুমা খানের কথা অবাক হয়ে যায় অনন্যা! নিজের বাবা- মাকে ছাড়া বড় হয়েছে ফারিশ। ছোট বয়স থেকেই বিষাক্ত দুনিয়াকে অনুভব করেছে সে, তাইতো তার মনে মায়া -দয়া জিনিসটা কম। অনন্যা প্রশ্ন করলো, ‘ আপনি তার বাবা কে, এতটুকু ছেলেকে রেখে, বিদেশে যেতে অনুমতি দিয়েছিলেন কেন দাদী?’
‘ সৎ মায়ের ছায়ায় বড় হওয়ার থেকে, তার থেকে দূরে থাকাই ভালো দিদিভাই। আমি তো দুনিয়াটি বুঝি রে দিদিভাই। তাই সেদিন রাশেদকে আটকায়নি, নাহলে আমার অনুমতি ব্যাতীত রাশেদ কখনোই যেতে পারতো না। আমি তো জানি ইশিকা ঠিক কেমন মানুষ! আমার নাতীকে সে কখনোই মমতা দিয়ে কাছে ডাকেনি। তার জন্যেই আজ বাবা- ছেলের মধ্যে এতোটা দূরুত্ব! ‘
বলেই আরো একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন রুমা খান। অনন্যা নিজের রুমে এসে, নিজে নিজেই বলতে লাগলো, ‘ লোকটার হার্টলেস হওয়ার পিছনে কারণ আছে। ছোটবেলা থেকে বাবা- মাকে ছাড়া বড় হয়েছে। বিয়ে করার পরও সংসার সুখ জুটলো না। বউটাও মারা গেলো। মেয়েকে নিয়ে বেঁচে আছে এখন। ‘
এইসব বলতে বলতে পরক্ষনে অনন্যা ভাবলো কিন্তু এতোকিছুর মধ্যে তার বা তার ফ্যামেলির কি যোগসুত্র রয়েছে? যার কারণে এইভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে ফারিশ। ফারিশের করা কাজের কথা পুনরায় মস্তিষ্কে আসতেই, তৎক্ষনাৎ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায় অনন্যা! যত যাই হয়ে থাক। ফারিশ একজন নিকৃষ্ট মানব, তাকে নিয়ে মায়া করা বিরাট বড় অন্যায় বলে অনন্যার ধারণা। আজ তার প্রতিশোধের
নেশাতে, ভালোবাসা, পরিবার হারিয়ে শূন্য অনন্যা।
___________________
অফিস শেষে গাড়ি করে বাড়ির দিকে ফিরছিলো অভি, কিন্তু ঢাকা শহর বলে কথা! ঢাকা শহরে জ্যাম থাকবে না তা প্রত্যাশা করা সবথেকে বড় ভুল! আধাঘন্টা যাবত জ্যামে বসে আছে অভি। বিরক্ত হয়ে অভি গাড়ির মিউজিক অপশনে গিয়ে, একটি রবীন্দ্রসংগীত ছেড়ে দেয়। মিউজিক সিস্টেম থেকে ভেঁসে আসে, সেই পরিচিত গানটি….
‘ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে’
গানটি শুনে অভির মনে পরে পুরনো কিছু স্মৃতি! প্রত্যেক শুক্রবার যখন সে অনন্যার সাথে দেখা করতে যেতো, তখন লাল পাড়ের মধ্যে তাতের সাদা শাড়ি পরতো অনন্যা। মুখস্রীতে থাকতো হাল্কা সাঁজের প্রলেপ! কপালে একখানা ছোট্ট কালো টিপ! লম্বা চুলে করা থাকতো খোপা। কি সুন্দর স্নিগ্ধ দেখাতো মেয়েটাকে। অভি তার কাছে গান শুনতে চাইলে, সে প্রথমেই বলতো, ‘ আগে বলো? বেলীফুলের গাজরা এনেছো? গাজরা না আনলে, নো সিনগিং! ‘
অভি তখন মুচকি হেসে গাজরা সামনে রাখতো অনন্যার। তা দেখে বিশ্বজয়ের হাসি দিতো অনন্যা। অভি অনন্যার খোপায় গাজরা পরিয়ে দিতো এবং অনন্যা তার মিষ্টি গলায় গাইতো সেই রবীন্দ্রসংগীত..
‘ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে ‘
সেই পুরনো দিনের কথা মনে পরতেই, অভি কি মনে করে যেনো গাড়ি থেকে চট করে নেমে গেলো। পাশে ছিলো ফুলের দোকান! সে দোকানে গিয়ে একটি গাজরা কিনে ফেললো। গাজরাটা কেন কিনলো সে জানেনা। তবে পরম ভালোবাসা নিয়ে সে গাজরাটির দিকে তাঁকিয়ে ছিলো।
________________
সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে ফিরে এলো ফারিশ। অন্যদিনের তুলনায় আজ তাকে বেশ খুশি খুশি লাগছে। কারণ আজ সে একাই এতো বড় অর্ডার কনর্ফাম করিয়েছে জাপানি ক্লাইন্টদের দিয়ে। ফারিশ উপরে গিয়েই, নিজের ফোন মানিব্যাগটা রেখে, চটজলদি ওয়াশরুমে চলে যায়। অনন্যা ফারিশের রুমে এসেছিলো কফি নিয়ে। ফারিশকে ওয়াশরুমে যেতে দেখে, সে চট করে ফারিশের ফেনটা হাতে নিয়ে নেয়। সকালে মিষ্টি যখন ফারিশের ফোনে গেম খেলছিলো, তখন ফারিশের ফোনের পার্সওয়ার্ড সে দেখেছিলো। এই বাড়িতে একজন সার্ভেন্ট এর কাছেও ফোন নেই, তার মধ্যে বাড়ির কেউই তাকে নিজের ফোন দিচ্ছিলো না, তাই বাধ্য হয়ে, ফারিশের ফোন থেকেই শেফালির নাম্বারে ডায়েল করে অনন্যা। সে জানে পাক্কা ২০ মিনিট এর আগে ওয়াশরুম থেকে বের হবেনা ফারিশ কিন্তু…..
শব্দসংখ্যা-১৬১৫
চলবে কি?
#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-২০
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
ফারিশ ওয়াশরুমের দরজা খুলার শব্দ শুনে, ডায়াল করা নাম্বার টা ডিলেট করে দিয়ে, ফোনটি তার আগের অবস্হানে দ্রুত রেখে দেয় অনন্যা। সে চটজলদি পিছনে ঘুড়তেই, ওয়াশরুম থেকে টাওয়াল গাঁয়ে বেড়িয়ে আসে ফারিশ। অনন্যা তা দেখে সঙ্গে সঙ্গে চোখে হাত দিয়ে দাঁড়ায়। ফারিশ ভ্রু কুচকে স্বাভাবিকভাবেই কফি হাতে নিয়ে, বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। সে জানে তাকে খালি গাঁয়ে দেখে এইভাবে চোখ বন্ধ করে ফেলা, নিত্যদিনের কাজ অনন্যার। ফারিশ কফি খেতেই খেতেই, গম্ভীর সুরে অনন্যাকে আদেশ করলো, ‘ মিস অনন্যা?’
‘ জ্বী?’
‘ কাবার্ডে আমার সাদা রংয়ের শার্টটি আছে। চটজলদি নিয়ে আসুন। ‘
অনন্যা নিশব্দে কাবার্ড থেকে ফারিশের শার্টটি এনে, বারান্দায় দরজার দাঁড়িয়ে থেকে, মাথা নিচু করে বললো, ‘ এনেছি, নিন। ‘
ফারিশ নিলো না। কফি খেতে খেতেই বাঁকা হেসে বললো, ‘ মিস অনন্যা! আমার পার্সোনাল সার্ভেন্ট থাকতে, আমি নিজে নিজে শার্ট পরবো? ইটস টু মাচ বেড! আই থিংক ইউ স্যুড ডু দিজ, ইটস ইউর ডিউটি। ‘
ফারিশের কথা শুনে আকাশ থেকে একপ্রকার পরলো অনন্যা।লোকটাকে এতোদিন তার শুধু নিষ্ঠুর মনে হতো! কিন্তু লোকটা তাকে জ্বালানোর জন্যে এমন অসভ্যমার্কা কাজও করাবে? এখন তাকে গিয়ে এই লোককে শার্টও পরিয়ে দিতে হবে? উহু! সে জীবনেও করবে না। অনন্যা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বললো, ‘ আমি একদম পারবো না! পারবো না, মানে পারবো না। ‘
ফারিশ তড়িৎগতিতে অনন্যার কাছে গিয়ে রেগে প্রশ্ন করলো, ‘ পারবেন না মানে? আপনি কী ভুলে গিয়েছেন? আমি ঠিক কী কারণে আপনাকে এই বাড়িতে এনেছি। শুধু রান্না করতে নিয়ে আনেনি, আমার পার্সোনাল কাজও আপনার কাজের মধ্যে পরে। ‘
ফারিশকে এইভাবে কাছে আসতে দেখে বড় বড় নি:শ্বাস ফেলে, কিছুটা দূরত্ব বজিয়ে দাঁড়ালো অনন্যা। অত:পর বিড়বিড়িয়ে বললো, ‘ ফারিশ দ্যা খারুশ তো না,যেনো কচি খোঁকা! তার পার্সোনাল কাজ এখন আমার কাজের মধ্যে পরে। কয়েকদিন পরে বলবে মিস অনন্যা! আপনি থাকতে আমি কেন একা একা গোসল করবো? আসুন, আমাকে গোসল করিয়ে দিন, উহু! বাথরুমে না। আমার আজকে মুড হয়েছে, আমি ছাদের সুইমিংপুলে গোসল করবো। সেখানে আপনি সারা গাঁয়ে সাবান লাগিয়ে দিয়ে, আমাকে একটা ধাক্কা মেরে দিবেন পুলে। ব্যাস! গোসল শেষ। বেটা আসলেই একটা খারুশ! ‘
অনন্যাকে বিড়বিড় করতে দেখে, ফারিশ ভ্রু কুচকে বলে উঠে, ‘ কি এতো বিড়বিড় করছেন? একদম টাইম ওয়েস্ট করবেন না। আপনি তো জানেন, টাইম ওয়েস্টিং আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ। ‘
অনন্যা মনে মনে বেশ কয়েকবার ফারিশকে একপ্রকার ধুয়ে দিয়ে, শার্টটা হাতে নিয়ে, কাঁপাকাঁপা হাতে ফারিশের কাছে যেতে চাইলে, ফারিশ নিজ থেকেই অনন্যার কাছে চলে আসায়, অনন্যার হাত দ্বিগুনভাবে কাঁপতে থাকে। ফারিশ বিরক্ত হলেও, স্হীর ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ফারিশের মজাও লাগছে! অনন্যাকে শাস্তি দিলে কিংবা তাকে অস্বস্হিতে রাখলে একপ্রকার দারুন অনুভুতি অনুভব করে সে। অনন্যা কাঁপাকাঁপা হাতে শার্টটি ফারিশের গাঁয়ে জড়িয়ে দেয়। সে শার্টের বোতামে, হাত দিতেই, ফারিশ শক্তভাবে তার হাত ধরে ফেলে। এতে তীব্রভাবে পূর্বের ন্যায় কেঁপে উঠে অনন্যা। ফারিশ কাঠিন্যের সাথে বলে, ‘ হোয়াট আ নোনসেন্স! এমন কাঁপাকাঁপি করছেন যেন, আমরা এখন বাসর ঘরে এবং আপনি সদ্য বিবাহিত নববধু! একটু পর আপনার সাথে কি হবে না হবে ভেবে ভয়ে কাঁপছেন। ‘
‘ ছিহ! আপনার মুখে কী কিছু আটকায় না? ‘
‘ ছিহ করার কি আছে? আমি চাইলেই কিন্তু এখুনি করতে পারি মিস, যাই বলুন। সেই ক্ষমতা ফারিশ খানের আছে। ‘
কথাটি বলেই বাঁকা হাসি দিয়ে উঠে ফারিশ। আসলে সে অনন্যাকে ভয় দেখাতে কথাটি বলেছে কিন্তু অনন্যা সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে, দ্রুত শার্টের বোতাম লাগাতে থাকে। মিষ্টি তার টেডি হাতে একপ্রকার লাফাতে লাফাতে রুমে ঢুকে, এমন দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে পরে। তারপর টেডি রেখে, খুশিতে লাফাতে লাফাতে বলে, ‘ কি মজা! আমার বাপিকেও মা নিজের হাতে শার্ট পরিয়ে দিচ্ছে। কি মজা! ‘
মিষ্টির আওয়াজ শুনে ফারিশ এবং অনন্যা দুজনেই দ্রুত সরে দাঁড়িয়ে মিষ্টির দিকে অবাক হয়ে তাঁকায়। মিষ্টি ফারিশ এবং অনন্যার সামনে দাঁড়িয়ে, নিজের ফোঁকলা দাঁতে হেসে বলে, ‘ এতোদিন আমার সব বন্ধুরা আমাকে শুনাতো, তাদের বাবা- মায়ের গল্প। তাদের মা নাকি তাদের বাবাকে অফিসে যাওয়ার সময় শার্ট- টাই পরিয়ে দেয় কিন্তু মিষ্টির মা তো এতোদিন ছিলো না, তাই এমন গল্প মিষ্টি বলতে পারতো না, কিন্তু কালকে গিয়ে মিষ্টি তার বন্ধুদেরকেও তার বাবা- মায়ের গল্প বলবে। আজ মিষ্টির মাও মিষ্টির বাপিকে শার্ট পরিয়ে দিয়েছে। কি মজার ঘটনা! হুরেএএ। ‘
মিষ্টির কথা শুনে ফারিশ এবং অনন্যা দুজনেই ভরকে যায়। ফারিশ আমতা আমতা করে বলে,
‘ মা, তুমি যা ভাবছো তেমন না। আসলে….’
ফারিশের কথাকে একপ্রকার অগ্রাহ্য করে, দৌড়ে নীচের দিকে খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে চলে যায় মিষ্টি।
‘ মিষ্টি মা! শুনো মা। এইভাবে যেও না। তুমি আমার কথা তো শুনো। ‘
মিষ্টিকে হাক ছেড়ে ডাকতে ডাকতে, অনন্যাও নীচে চলে যায়, যেনো মিষ্টি এইসব কথা ভুলেও বাড়িতে না বলে। তাদের চলে যেতে দেখে ফারিশ সুদীর্ঘশ্বাস ফেলে, সোফায় নিজের ল্যাপটপ খুলতেই, তার মুখস্রীতে গাম্ভীর্য এসে হাতছানি দেয়।
_______________
অভি গাজরাটা হাতে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই, মায়ের সমক্ষে গিয়ে দাঁড়ায়। ছেলেকে দেখেই অভির মা অস্হির হয়ে বলতে লাগলেন, ‘ জানিস, অভি কি কান্ড হয়েছে?’
অভি গাজরটা হাতে নিয়েই, সোফায় বসে উত্তর দিলো, ‘ না, জানিনা। তুমি না বললে কী করে জানবো? এক গ্লাস পানি দাও মা। তারপর জেনে নিবো। ‘
অভির মা ছেলেকে পানি দেওয়া অবদি অপেক্ষা করলেন না। গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললেন,
‘ জুঁইয়ের কথা আর কি বলবো? তার এন্গেজমেন্ট এক সপ্তাহ পরে, অথচ সে নাকি এখন খালার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে।’
বলেই ছেলের দিকে পানির এগিয়ে দিলেন অভির মা। অভি ‘ ওহ, আচ্ছা। ‘ বলে নিশব্দে পানি পান করতে লাগলো।
‘ তুই একবার ভেবে দেখ! এই সময় কী ঘুড়ে বেড়াবার সময়? মেয়ে তো ফোন ধরেই না, তার বাবা ফোন ধরে আমাকে এইসব জানালো। আমি কিছু শুনতে চাইনা, তুই কালকে গিয়ে তাকে খালার বাড়ি থেকে নিয়ে আসবি। বিয়ের পরে না হয়, তুই এবং সে গিয়ে খালা, চাচাদের বাড়ি ঘুড়ে বেড়াবি কিন্তু এখন কাজের সময়! কত শপিং করা বাকি আছে। এখন কী ঘুড়ার সময় তুই বল? তুই কিন্তু কালকে যাবি। ‘
‘ আচ্ছা, যাবো। ‘
‘ এড্রেস দিয়েছে কোন এক খান বাড়ির। তা তো চিনেনা তবে তুই এড্রেস মিলিয়ে মিলিয়ে, চলে যাস। ভদ্র লোক তো দিতেই চাচ্ছিলো না কিন্তু আমি জোড় করে নিয়েছে। মনে হচ্ছে বাপ- মেয়ের মধ্যে কিছু চলছে। হয়তো বিয়ে পিছানোর ধান্ধা করতে পারে। কেন এমন করবে, তা জানিনা। তবে করছে। বুঝলি?’
‘ হ্যা, বুঝলাম। ‘
বলেই আবারো গাজরার দিকে তাঁকিয়ে রইলো। অভির মা বিরক্ত হয়ে, ছেলের থেকে গাজরা টা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘ এইসব কি ধরনের খামখেয়ালি অভি? তুই হু, আচ্ছা করছিস কেন? মনে তো হচ্ছে এই বিয়ে নিয়ে তোর কোন ইন্টারেস্টই নেই। ‘
মায়ের কথা শুনে সোফা থেকে উঠে, কিছুটা ক্ষেপে গিয়ে অভি চেঁচিয়ে বলে, ‘ তুমিও বা এই বিয়েটা দেওয়ার জন্যে উঠে পরে লেগেছো কেন মা? ‘
‘ এইসব কি বলছিস তুই? তুই নিজেই তো বিয়েটা করতে চেয়েছিলি। ‘
‘ হ্যা, কিন্তু তখন রাগের বশে অনন্যাকে দেখিয়ে নিজের বিয়ের কথাটি বলেছিলাম, কিন্তু তাই বলে ১০ দিনের মাথাতেই তুমি বিয়ের আয়োজন করে ফেলবে? শুনো মা! অনন্যা আমাকে ঠকিয়েছে আমি জানি। সে যত খারাপ হোক, আফটারঅল আমি তাকে সবর্চ্চটুকু দিয়ে ভালোবেসেছিলাম! তুমি এখন যতই আমাকে দ্রুত বিয়ে করিয়ে, অনন্যাকে আমার মন থেকে মুছে ফেলতে চাও, তা পারবে না কখনো। ‘
‘ তুই এখন ওই মেয়ের জন্যে নিজের মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করবি? দিনশেষে ওই ঠকবাজ মেয়েটা, তোর কাছে বেশি ইম্পোর্টেন্ট হয়ে গেলো?’
কথাটি বলেই অভির মা কাঁদতে লাগলেন। অভি তার মাকে থামালো না। শুধুমাত্র অভির মায়ের থেকে জুঁইয়ের খালার এড্রেসেট কাগজটি নিয়ে,ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে উপরে চলে গেলো। ছেলেকে উপরে যেতে দেখে, অভির মা দ্রুত আখিজোড়া মুছে বললেন, ‘ কালকে কিন্তু অফিসে না গিয়ে, দ্রুত জুঁইয়ের বাসা থেকে জুঁইকে নিয়ে আসবি। ‘
অভির থেকে কোনপ্রকার উত্তর না পেলেও, অভির মা বুঝতে পেরেছেন অভি কালকে জুঁইকে আনতে, তার খালার বাড়ি যাবে। কারণ অভি তার মায়ের আখির অশ্রু সহ্য করতে পারে না।
_______________________
রান্নাঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে মিষ্টির জন্যে লুডুলস বানাচ্ছিলো অনন্যা। আজকেও সে কোনভাবে শেফালির সাথে যোগাযোগ করতে পারলো না! এইভাবে চলতে থাকলে সে এই বাড়ি থেকে নিজেকে নির্দোশ প্রমাণ করে বের হবে কীভাবে? জানেনা অনন্যা। অনন্যার ভাবনার মাঝেই, করিমা লুকিয়ে লুকিয়ে অনন্যার কাছে এসে, ফিসফিস করে বলে,
‘ আফা! আমার একটা বাটন ফোন আছে। সবসময় লুকাইয়া রাখি। বাড়ির মানুষগুলো জানলে সমস্যা হইবো, বুঝলেন? আপনার না কালকে কি যেনো দরকার আছিলো। এইযে নেন। ‘
করিমার থেকে বাটন ফোনটা পেয়ে, আনন্দের সহিত অনন্যা বলে উঠে, ‘ করিমা আপু! তুমি যে আমার কত বড় উপকার করলে। ‘
কথাটি বলেই অনন্যা শেফালির নাম্বারে ডায়াল করে ফোন করে লুকিয়ে, কিন্তু প্রথমে শেফালি ফোন ধরে না। তারমাঝে উপর থেকে ফারিশ হাক ছেড়ে ‘ মিস অনন্যা ‘ বলে ডাকতে শুরু করে। ফারিশের ডাক শুনে করিমা বলে, ‘ আফা জলদি যান! স্যার ডাকতাছে। ‘
করিমার কথা শুনে, অনন্যা উপায় না পেয়ে শেফালির নাম্বারে মেসেজ করে লিখে, ‘ আমি অনন্যা বলছি শেফালি। আমি অনেক বড় বিপদে। এই বিপদে তুই আমাকে নির্দোশ প্রমাণ করতে পারিস। আমি ফারিশ খানের বাড়িতে বন্দী। I just need your help!’ ম্যাসেজটা স্যান্ড করে দিয়েই, করিমার হাতে ফোনটা দিয়ে, দ্রুত উপরে চলে যায় অনন্যা।
চলবে কী?
শব্দসংখ্যা- ১৩৭৫