প্রণয়ের রংধনু পর্ব-১৬+১৭

0
645

#প্রণয়ের_রংধনু 🖤
#পর্ব- ১৬
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
‘ আমি অভিকে বিয়ে করতে পারবো না বাপি, আই জাস্ট ওয়ান্ট মাই ফারিশ। ‘
‘ এমন মুহুর্তে এইসব কি বলছো তুমি জুঁই? ফারিশকে চাও মানে কি? বিয়ে কী তোমার কাছে পুতুলখেলা? আজ একজন, কালকে অন্যজন। ‘

‘ আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না বাপি। আমি সেই ছোটবেলা থেকে ফারিশকে ভালোবাসি এবং বিয়ে করলে ফারিশকেই বিয়ে করবো। আমি তো অভিকে ভালোবাসি না, জাস্ট একটু নাটক করেছিলাম, কিন্তু তাই বলে আমাকে কেন অভিকে বিয়ে করতে হবে?’

কথাটি বলে জুঁই সোফায় বসে কপালে হাত রাখলো। আনোয়ার নিজের মেয়ের এমন কথাবার্তায় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।ম/মরা মেয়েকে নিজের হাতে মানুষ করেছেন তিনি। মেয়েটার বড্ড জেদ! আনোয়ার ভাবতে পারছেন না তিনি এখন কি করবেন? জুঁইয়ের কথাতেই অভির মায়ের সাথে তিনি বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা এগিয়েছিলেন কিন্তু মাঝখানে তার মেয়ে এইভাবে বিষয়টাকে জটিল করে দিবে না স্বপ্নেও ভাবেন নি তিনি, ভাবলে হয়তো বিয়ের বিষয়টি এতোদূর এগিয়ে নিয়ে যেতেন না। কয়েকদিন সময় নিতেন, ভাবতেন। অত:পর ভেবে চিন্তে একটি সিদ্বান্তে আসতেন। এদিকে অভির মা এন্গেজমেন্ট এর জন্যে ইতিমধ্যে ফাইভ স্টার হোটেল বুকিং করে ফেলেছেন। ভদ্রমহিলাকে এইবার কী জবাব দিবেন তিনি? ভাবতে পারছেন না। শরীর ঘামছে তার। জুঁইয়ের সাথে তিনি আর কথা বাড়ালেন না। উপরে চলে গেলেন, আপাতত জুঁইকে একা ছেড়ে দেওয়া মঙ্গল,নয়তো সে বেঁকে বসবে, তবে তিনি বুঝাবেন। রাতে খাবার টেবিলে আরেক দফা জুঁইকে নিজের পাশে বসিয়ে ভালো ভাবে বুঝাবেন। জুঁইকে বুঝতে হবে দুনিয়াটা এতো সহজ নয়! সবকিছু ছেলেখেলা ভাবলে চলবে না।

আনোয়ার সাহেবকে উপরে যেতে দেখে জুঁই ফের আরেকবার ফেসবুকের মেসেঞ্জারের দিকে দৃষ্টি ফেললো। ফারিশ তার মেসেজ দেখেছে তবে এখনো অব্দি কোনপ্রকার উত্তর দিচ্ছে না। জুঁইয়ের অস্হির অস্হির লাগছে সবকিছু! সে পারছে না, ফারিশকে ছাড়া থাকতে। ফারিশ কেন বুঝতে পারছে না তার অনুভুতি? উহু, ফারিশকে বুঝতে হবে, ফারিশকে অনুভব করতে হবে, জুঁই ঠিক কতটা তাকে মন থেকে চায়। ফারিশকে ভালোবেসে, নিজের বন্ধুর সাথে প্রতারণা অব্দি করেছে তবুও কেন জুঁইয়ের ভালোবাসা নিয়ে সংশয় আজ ফারিশের মনে? জুঁই ঠিক করেছে সে খান বাড়ি যাবে, এই মুহুর্ত তার খালা রেশমা খান তাকে হয়তো সহায়তা করবে।

অপরদিকে…জুঁইয়ের মেসেজ দেখে একপ্রকার তা এড়িয়ে, গাড়ি ঘুড়িয়ে অফিসের উদ্দেশ্য রওনা দিলো ফারিশ, বেশ গুরুত্বপূর্ণ মিটিং রয়েছে তার আজ! জুঁইয়ের এইসব কথাবার্তা নিত্য নতুন। শুধুমাত্র সে সম্পর্কে আত্বীয় বলে, জুঁইকে এড়িয়ে চলছে, সবকিছু সহ্য করছে কিন্তু জুঁই এইসব বারংবার করলে সে মোটেও সহ্য করবে না বরং ভয়ংকর পদক্ষেপ নিবে।

____________
অনন্যা নিজের রুমে বসে ছিলো, করিমা এসে অনন্যার কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে, ‘ আফা খাইবেন না। ‘

‘ হ্যা খাবো, তবে এখন না। ‘

‘ বেলা পেরিয়ে দুপুর হইয়া যাইবো। আহেন কিছু খাইয়া লন। এহনো অবদি সকালের খাওয়ান ডাই খান নাই। ‘

করিমার কথা শুনে, অনন্যা রান্নাঘরে গিয়ে তার জন্যে খাবার খুঁজতে গিয়ে পায় না। সে পাশে থাকা কাজের মেয়ে লতাকে প্রশ্ন করে, ‘ আমার জন্যে প্লেটে রুটি বানিয়ে রেখেছিলাম। তুমি কী কোথাও রেখেছো?’

‘ আসলে আফা, রেশমি ম্যাডাম বলেছেন ফেলে দিতে, তাই ফেলে দিয়েছি। ‘

‘ ফেলে দিয়েছো মানে? ‘

রেশমি খান হাতে পার্স নিয়ে শপিং এর উদ্দেশ্য বাইরে যাচ্ছিলেন, অনন্যার প্রশ্ন শুনে সে থেমে যান। অত:পর রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন,

‘ আমাদের বাড়িতে এক বেলার খাবার অন্য বেলা অবদি এতোক্ষন থাকে না। সেই খাবার হয়ে যায় বাসি। এখানে সব হয় ফ্রেশ এন্ড ফ্রেশ! সকালের খাবার দুপুরের ১২ টার পর একদম এলাও না। এখন লাট সাহেবের বেটির জন্যে তো আর বাড়ির রুলস ব্রেক করবো না। মনে রাখবে মেয়ে, তোমার পরিচয় টা। ‘

করিমাও সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়,’ আপনার দেওয়া এতো কাম করতে করতেই তো আফা নিজের নাস্তাডা সারতে পারলো না, আর আপনেই তার খাবার ফালাইয়া দিলেন? ফারিশ স্যার কিন্তু কইছিলো, আফা শুধু স্যারের কাম করবো কিন্তু আপনে গুরুজন মানুষ দেইখ্যা আফায়, আপনার বেডশিট ধুইয়া শুখাইলো, বাগানে যাইয়া মালির কাম অবদি করলো। ‘

করিমার এমন উত্তর তেঁতে উঠেন রেশমি খান। ঝাঁঝালো গলায় বলেন, ‘ বাহ! এই লাট সাহেবের বেটির সাথে থেকে, তোরও দেখি মুখে বলি ফুটেছে। কাজের লোকেদের মুখে এতো বড় বড় কথা মানায় না! ওই লাট সাহেবের মেয়ে না হয় ফারিশের লোক, কিন্তু তুই? তুই অন্তত ভুলে যাস না, তোর চাকরী নট করতে আমার এক সেকেন্ডও সময় লাগবে না।’

গরীব মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে বারংবার তাদের চাকরী নিয়ে ভয় দেখানোর মালিকদের একধরণের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কোথাও কোন অন্যায়, কিংবা ভুল হলে তারা তখন চাকরীর ভয়ে অসহায় হয়ে পরে, চাইলেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না। তখন তারা হয়ে যায় চরম অসহায়!
সেই কষ্টের সীমা থাকে না তখন। করিমাকে মাথা নিচু করতে দেখে, অনন্যা কঠিন গলায় বলে,

‘ মনিব হোক কিংবা কাজের লোক, প্রতিটা মানুষের জন্যেই সমান কিছু রুলস আছে ম্যাডাম। খাবার নষ্ট করা আদোও কোন রুলসের মধ্যে পরে বলে, আমার মনে পরে না। আপনি আমার খাবার টা ফেলে না দিয়ে কোন গরীব দু:খিকে খায়িয়ে দিতেন, যারা দিনের পর দিন অনাহারে কোনরকমে বেঁচে আছেন। আপনি কী জানেন? খাবার জিনিস টা কী? একটা ছোট্ট মাসুম বাচ্চা রাস্তায় ভিক্ষার থালা নিয়ে বসে, শুধু একটা মাত্র রুটির আসায়, একটু খাবারের আসায়। ক্ষুধা এমন এক ভয়ংর জিনিস , যার ফলে মানুষ ক্ষুধার্ত থাকলে, খাবার না পেয়ে, ক্ষুধার যন্ত্রনায় রাস্তার নোংরা আবর্জনা থেকে অব্দি খাবার কুড়িয়ে, নিজের ক্ষুধার জ্বালাকে নিবারণ করে।আপনি কি জানেন?বিশ্বজুড়ে গত বছর তীব্র খাদ্যসংকটে ভুগেছে অন্তত ৭৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষ। সেখানে আপনি খাবার ফেলে দিচ্ছেন? যদি এমনই হয় এই বাড়ির রুলস, তবে আমি কখনোই মানবো না, এমন রুলস।’

অনন্যার কথা শুনে রেশমি খান চুপ হয়ে যায়। মাথা নিচু করেই, হাতে তালি বাজিয়ে, ‘ জিও আপামনি। ‘ বলে মুচকি হাসে।রেশমি খান বিরক্ত হয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। অনন্যা নামক মেয়েটির কাছে প্রতিবার তাকে যুক্তিতে হারিয়ে ব্যাপারটা সত্যি তার অপমানজনক।

রেশমি খানকে বেড়োতে দেখে, হাফ ছেড়ে জোড়ে নি:শ্বাস নিয়ে, করিমা বলে, ‘ আপামনি আপনে আইজক্যা যা কইলেন না, একদম ফাটাইয়া দিছেন। দজ্জাল বেডির মুখডা দেখছেন আফা? কেমনে শুখাই গেছিলো। দজ্জাল বেডি শুধু পারে পায়ের উপর পা রেখে, হুকুম দিতে, আর আকাম করতে। কুটনি বেডি একটা।’

‘ আহ, করিমা আপু, এইভাবে বলিও না। ‘

‘ আফা, আমি চট করে আরেকটা রুটি বানাই? আপনার ক্ষুধা লাগছে, দেইখাই বুঝা যাইতাছে। আপনার মুখডা অনেক শুকনা। ‘

‘ না, এখন আর খাবো না। আমার চট করে দুপুরের খাবারের ব্যাবস্হা করতে হবে। মিষ্টির স্কুল থেকে আসার সময় হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে, উনার লিস্ট মতো রান্নাও করতে হবে। দুপুরে এসে, খাবেন। সময়ের হের ফের হলে, সমস্যা হবে। ‘

‘ কিন্তু আফা আপনে না খাইয়া থাকবেন এতোক্ষন। আপনার কষ্ট হইবো না?শরীর খারাপ হইবো তো।’

‘ রিযিকের মালিক আল্লাহ, তিনি যদি নসিবে রাখেন, তাহলে তোমার আফা মনি না খেয়ে থাকবে না। ‘

বলেই ক্ষীন্ন হাসলো অনন্যা। করিমাও সামান্য হাসলো।

_____________
অপরদিকে অভির মাথায় শুধু লতিফ হাওলাদেরের কথা গুলো ঘুড়পাক খাচ্ছে, ‘ আমার মেয়ে নির্দোষ, সব দোষ আমার। ‘ এমন কথা বলার মানে কি দাঁড়ায়? সব দোষ উনার মানে? অভি আরো কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাইছিলো, কিন্তু লতিফ হাওলাদার উত্তেজিত হওয়ার ফলে, উনার শ্বাস কষ্ট শুরু হয়ে যায়। শেফা বেগম ঘাবড়ে গিয়ে হাক ডেকে ডক্টরদের ডাকেন। ডক্টরও চলে এসে, অক্সিজেনের পাওয়ার বাড়িয়ে দেয়। শেফা বেগম দ্রুত অভির কাছে এসে বলে, ‘ কেন এসেছো তুমি? কিসের এতো প্রশ্ন তোমার হ্যা? আমার মেয়ে এখন তোমার কেউ না। ওর যা ইচ্ছে হোক, তাতে তোমার কী? তোমার জন্যে উনি আরো অসুস্হ হয়ে পড়লেন। এখন যাও তো। দয়া করে আর এসো না। আমরা কেউ তোমার সাথে কথা কিংবা দেখা করতে চাই না। ‘

‘ কিন্তু আন্টি…….

‘ কোন কিন্তু নয় অভি। বেড়িয়ে যাও চুপচাপ। উনাকে একটু সুস্হ হতে দাও। আমাদের মেয়েকে আমরা ঠিক ফিরিয়ে আনবো কিন্তু তোমাকে যেনো আমি আর না দেখি। এখুনি বেড়িয়ে যাও। ‘

শেফা বেগমের কাঠিন্যে বলা কথাগুলো শুনে অভি নিশব্দে বেড়িয়ে যায়। সে এমন এক পরিস্হিতিতে রয়েছে, যেখানে সবকিছু তার কাছে অপস্পষ্ট! এমন পরিস্হিতিতে কী করা উচিৎ সে বুঝতে পারছে না। কেউ তাকে সাহায্য করছে না, সত্য মিথ্যার বেড়াজালে ফেঁসে তার অবস্হা খারাপ! এমন পরিস্হিতিতে তার করনীয় কী? সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তার ভাবনার মাঝেই, তার মায়ের ফোন আসে। অভির মা আজ ঠিক করেছেন ছেলেকে নিয়ে, জুঁইয়ের জন্যে এন্গেজম্যান্ট রিং কিনতে যাবেন। জুঁইয়ের বাবার থেকে কয়েকদিন আগেই জুঁইয়ের আংটির মাপ নেওয়া হয়েছিলো তার। অভির অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, মায়ের ফোনে করা অনুরোধে সে শপিং মলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

___________________
করিমা এবং অনন্যার কথার মাঝে মিষ্টি লাফাতে লাফাতে স্কুল থেকে ফিরে এসে। এসেই অনন্যাকে ‘ মা ‘ বলে জড়িয়ে ধরে। অনন্যাও মিষ্টির কপালে চুমু খেয়ে বললো, ‘ কি ব্যাপার? মিষ্টি মা! আজ এতো খুশি লাগছে যে বরং! স্পেশাল কিছু ঘটেছে?’

মিষ্টি তার ফোকলা দাঁত দিয়ে মুচকি হেসে, তার টিফিন বক্স বের করে, অনন্যার সামনে ধরে বলে,

‘ আজকে আমাদের স্কুলে, কুকিং ক্লাস হয়েছে সেখানে আমি নিজের হাতে ফার্স্ট টাইম টিচারের হেল্প নিয়ে পরোটা বানিয়েছি, একটা তোমার, আরেকটা বাপির এন্ড আরেকটা বড় গ্রেনির। তুমি খেয়ে দেখো, মিষ্টি কেমন রান্না করেছে। ‘

বলেই, মিষ্টি অনন্যার মুখে পরোটা দিয়ে দিলো। অনন্যার আখিজোড়ায় জল চলে আসে। সে না খেয়ে থাকলে, তার মা শেফা বেগম পরোটা বানিয়ে, অনন্যাকে খায়িয়ে দিতো। অনন্যাও তার মাকে খায়িয়ে দিয়ে হাসতো। মা-মেয়ের কত সুন্দর মুহুর্ত ছিলো! আজ মিষ্টিকে তার আরেকটা মা মনে হচ্ছে। তার ছোট্ট মা! অনন্যা কিছুটা খেয়ে মিষ্টিকেও খায়িয়ে দিলো। ফারিশের মিটিংটা হঠাৎ ক্যান্সাল হয়ে যাওয়ায়, সে বাড়ি ফিরে আসে। বাড়ি ফিরে এমন মুহুর্তে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। না চাইতেও সে মুগ্ধ হয়!

________________

রেশমি বেগম গাড়ির ভিতরে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। হঠাৎ জুঁইয়ের ফোন পেয়ে তিনি ভ্রু কুচকে তা রিসিভ করে বলে, ‘ হ্যালো!’

‘ হ্যালো খালা, তুমি কোথায়? ‘

‘ আমি তো মার্কেট যাচ্ছি এখন, কেন?’

‘ আমি কাল বা পরশু তোমাদের বাড়ি আসছি। ‘

‘ হঠাৎ, আমাদের বাড়িতে? ‘

‘ এতোকিছু বলার সময় নেই। আমি আসছি। জানিয়ে দিলাম। ‘

বলেই কট করে ফোনটা রেখে দিলো জুঁই।

পর্বসংখ্যা-১৫০০
চলবে কী?

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-১৭
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
ফারিশ পকেটে হাত গুজে মুগ্ধ নয়নে অনন্যা এবং মিষ্টিকে দেখছে। করিমা দরজা দাঁড়িয়ে থাকা মুগ্ধ নয়নে দাঁড়িয়ে থাকা ফারিশ নামক যুবককে খেয়াল করে তৎক্ষনাৎ , মাথা নিচু করে বললো,
‘ আরে ভাইজান! আপনে? এই সময়। ‘
করিমার কথা শুনে অনন্যা ফারিশের দিকে তাকালো, মিষ্টিও ছুটে তার বাপির কোলে ঝাপিয়ে পরে বললো, ‘ বাপি জানো, আজ আমি নিজ হাতে কুকিং ক্লাসে রান্না করেছি, তুমি খাবে না? মিষ্টির মা কিন্তু খেয়েছে।’
ফারিশ কিছুটা গম্ভীর গলায় শুধায়, ‘ কিন্তু মা, তুমি রান্না কেন করেছো? যদি কোন ক্ষতি হয়ে যেতো তখন? আমি কালকেই স্কুলে গিয়ে বলে দিয়ে আসবো, এইসব কুকিং ক্লাস ফ্লাসে যেনো তোমাকে এন্টারফেয়ার না করা হয়।’

‘ কিন্তু বাপি…..

‘কোন কিন্তু নয়। এখন উপরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও মা। আমাকে লাঞ্চ করেই আবার বেড়িয়ে পরতে হবে।’

‘ কিন্তু বাপি, আমি যে নিজ হাতে রান্না করলাম, তুমি কী খাবে না?’

‘ না, মা! তুমি তো জানো, এইসব ওয়েলি ফুড আমি ক্যারি করতে পারি না। আমি ডায়েটে থাকি সবসময়। তুমি এখন উপরে যাও বরং। ‘

ফারিশের কথা শুনে ফারিশের কোল থেকে নেমে, মিষ্টি টিফিন বক্স টা টেবিলে রেখে মন খারাপ করে উপরে চলে যায়। মিষ্টিকে চলে যেতে দেখে, অনন্যা ফারিশকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘ মেয়েটা শখ করে রান্না করে, আপনার জন্যে পরোটা নিয়ে এসছিলো অথচ আপনি ওর মন এইভাবে ভেঙ্গে দিলেন? একটু পরোটা খেলে কি এমন হয়ে যেতো? আপনি কোন সিনেমার হিরো হবেন? যার জন্যে সবসময় টাইগার শফের মতো বডি মেইন্টেইন করতে হচ্ছে। নিজের মেয়ের মন রক্ষার্থে যদি একদিন ডায়েট মিস হয়, তাহলে কোন মহাভারড অসাধ্য হবে?’

‘ আমাদের বাবা- মেয়ের ব্যাপারে আপনি ইন্টারফেয়ার না করলেও চলবে মিস। ইউ নো না? ফারিশ খান নিজের মন মর্জি মতো চলে। কাউকে কৈফিয়ত দিতে সে বাধ্য নয়। আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ টাইপ অফ কুইশ্চেনস। ‘

অনন্যা প্রতিউত্তরে কিছু বলে না, শুধু ক্ষিপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ফারিশও গলার টাই টা খানিক্টা ঢিলা করে নিয়ে, উপরে উঠতে গিয়ে, অনন্যার কাছে এসে বলে, ‘ জলদি ব্ল্যাক কফি বানিয়ে উপরে আসুন। অনলি ফাইভ মিনিসটস এর মধ্যে। আপনি তো জানিনই সময় নষ্ট করা! আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ। সো ফাস্ট!’

কথাটি বলেই উপরে চলে যায় ফারিশ। ফারিশকে চলে যেতে দেখে মুখ বেকিয়ে কিছুটা ব্যাঙ্গ করে অনন্যা বলে,

‘ আই জাস্ট ডোন্ট লাইক দিজ! এই এক কথা আর মানুষকে হার্ট করা ছাড়া আর কী পারে এই লোক? ফারিশ না হয়ে, এই লোকের নাম খারুশ হলে একদম ঠিক হতো। একদম হার্টলেস লোক!ছোট্ট মেয়েটার মনটা অবদি খারাপ করে দিলো।কি খারুশ লোক রে বাবা! ঠিক বলেছে না করিমা আপু?’

করিমা হেসে বলে, ‘ হ্যা আফা, একদম ঠিক কইছেন।’

‘ আমি বরং যাই, মেয়েটাকে দেখে আসি। ছোট্ট মেয়েটার মন টা খারাপ হয়ে আছে। ‘

‘ কিন্তু আফা আপনে আগে কফি লইয়া যান, নাইলে স্যার রাগ কইরা আবার শাস্তি দিবো আপনারে।’

অনন্যা করিমার কথা গুরুত্ব না দিয়ে উপরে যেতে যেতে বললো, ‘ বাদ দাও তো আপু! উনার কথা সবসময় শুনতে হবে নাকি?’

করিমা মাথায় হাত দিয়ে দিলো।

___________________

অভি তার মায়ের সাথে শপিংমলের একটি বিরাট বড় ডায়মন্ড এর শো – রুমে ঢুকেছে। অভির মা নানারকমের রিং বের করিয়ে, বাছাই করার একটি কঠিন পক্রিয়া করছেন। তবে পক্রিয়াটা তার কাছে বেশ জটিল মনে হচ্ছে। একটার মধ্যে ডিজাইন ভালো লাগলে,ডায়মন্ডের ওজনের দিকে থেকে কম মনে হয়, অন্যদিকে ডিজাইন ভালো লাগলে কালারটা ঠিক ভালো লাগে না। বেশ ঝামেলার ব্যাপার! অভির মা চেয়েছিলেন জুঁই নিজে এসে, নিজের এন্গেজমেন্টের রিং টা পছন্দ করে যাক, কিন্তু সে এলো না, তার সাথে কথা হয়নি। সে ফোন ধরে নি তবে তার বাবা আনোয়ার সাহেব বলেছেন তার মেয়ে কিছুটা অসুস্সু। তাদের পছন্দ করা রিং বিনা শর্তে পরে নিবে জুঁই বলে, আসস্হ অবদি করেছেন আনোয়ার সাহেব, তবুও অভির মায়ের চিন্তার অন্তর নেই, আদো ও জুঁইয়ের তার পছন্দ করা আংটি পছন্দ হবে কিনা? শো- রুমে অভি ঘুড়তে ঘুড়তে একটি ডায়মন্ড রিং এর দিকে নজর যায়। অভি এগিয়ে গিয়ে দোকানদারকে বলে, আংটি টি বের করিয়ে দিতে। দোকানদার আংটি টি বের করে, অভির হাতে ধরিয়ে দেয়। অভি আংটি টি ভালো করে খেয়াল করে দেখে ডায়মন্ডের মধ্যে হাল্কা গোল্ডেল শেডের মধ্যে পিংক পাথর! অদ্ভুদ এক সুন্দর! রিং টা অনন্যার ফর্সা হাতের অনামিকায় পরালে, রিংটার সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি পাবে! অভির মনে হচ্ছে আংটিটি তৈরিই হয়েছে অনন্যার জন্যে। অনন্যার হাতের রিং এর মাপ অভি জানে। তাদের এন্গেজমেন্ট এর সময়ে, সে এবং অনন্যা এসে তাদের এন্গেজমেন্টের আংটি কিনে গিয়েছিলো। সব ঠিক থাকলে, আজ তাদের ভালোবাসা পূর্নতা পেতো!কথাগুলো ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো । অভি আংটিটার দিকে তাঁকিয়ে ভাবতে লাগলো,আচ্ছা তার দেওয়া এন্গেজমেন্টের আংটি কি এখনো অনন্যার হাতে রয়েছে? অভির ভাবনার মাঝেই, অভির হাত থেকে খপ করে আংটি টা নিয়ে নেয় অভির মা। আংটি টা দেখে তিনি আনন্দিত গলায় বললেন, ‘ বাহ, বাহ! আংটি টা বেশ চমৎকার! এতোক্ষন অবদি একটা আংটিও পছন্দ হচ্ছিলো না কিন্তু এই আংটি টা দেখেই মনে হচ্ছে বিশেষ। জুঁইয়ের হাতে ভালো মানাবে। এইটাই ফাইনাল করে নেই বরং। ‘

অভির মা আংটি টা নিয়ে কাউন্টারে চলে গেলেন। অভির বড্ড আটকাতে ইচ্ছে করলো তার মাকে। বলত ইচ্ছে করলো, ‘ মা এই আংটি টা জুঁইয়ের হাতে একদম মানাবে না। ভালো করে খেয়াল করে দেখো, আংটি টা দেখে মনে হচ্ছে, আংটা টা অনন্যার জন্যে তৈরি করা হয়েছে। অনন্যার হাতেই বড্ড সুন্দরভাবে মানাবে। আমি কী ফারিশ খানের বাড়িতে গিয়ে অনন্যাকে আংটি টা দিয়ে আসবো মা?’

কিন্তু আফসোস! কথাগুলো চাইলেও বলতে পারবে না অভি। পরক্ষনে নিজের অদ্ভুদ ভাবনার উপর নিজেরই রাগ উঠে যায় অভির! সে কি ভেবে চলেছে এইসব?

__________________________
অনন্যা মিষ্টির রুমে উঁকি দিয়ে দেখে, ছোট্ট মিষ্টি মন খারাপ করে, তার ময়না পাখির সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, ‘ জানিস ময়না? আমি এতো কষ্ট করে পরোটা বানিয়ে নিয়ে আসলাম, অথচ বাপি খেলোই না। আমাকে বকে দিলো উল্টো। বাপি একদম ভালো না, বাপি খারুশ বাপি হয়ে গিয়েছে। আজ থেকে মিষ্টি তার বাপি খারুশ বাপি বলে ডাকবে, যেমনটা মিষ্টির মা তার বাপিকে ফারিশ দ্যা খারুশ বলে ডাকে, ঠিক তেমনি, বুঝলি? এইবার তুই বল তো! খারুশ বাপি, বল, বল……’

দরজার অপাশ থেকেই মিষ্টির কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলে অনন্যা। মিষ্টি অনন্যার হাসি শুনে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, কোমরে হাত রেখে,

‘ তুমি হাসছো কেন, মিষ্টির মা? তুমি কী জানো না? মিষ্টি তার খারুশ বাপির উপর রেগে আছে, মিষ্টি রেগে থাকলে কিন্তু বেশ সিরিয়াস হয়ে যায়। সিরিয়াস টাইমে নো লাফিং। ‘

অনন্যা সঙ্গে সঙ্গে কানে হাত দিয়ে বললো, ‘ ইস! বড্ড বড় মিস্টেক হয়ে গিয়েছে। সিরিয়াস মোমেন্টে তো একদমই হাসা উচিৎ হয়নি আমার। ‘

মিষ্টি কিছু না বলে, মাথা নিচু করে থাকে। অনন্যা হাটু গেড়ে বসে, মিষ্টির গালে হাত রেখে প্রশ্ন করে,

‘ রাগ করে আছো বেশি?’

‘ হু! খারুশ বাপি আমায় একদম ভালোবাসে না। দেখলে না? আমার বানানো পরোটা টা অবদি খেলো না। ‘

অনন্যা গালে হাত রেখে কিছুটা ভাবার অঙ্গভঙ্গি দেখিয়ে বলে, ‘ মিষ্টির বাপি খারুশ বটে কিন্তু সে তার প্রিন্সেস কে অনেক ভালোবাসে। অনেক অনেক! তা নিয়ে কোন সংদেহ নেই। ‘

‘ সত্যি বলছো? ‘

‘ একদম পাক্কা সত্যি। আচ্ছা আমরা তোমার বড় গ্রেনিকে দিয়ে তোমার খারুশ বাপিকে বকা খাওয়াবো। তাহলে আমার মিষ্টি বুড়ির রাগ কমে যাবে তো?’

‘ একদম, একদম! আই লাভ ইউ মাম্মা। ‘

কথাটি বলেই অনন্যাকে জড়িয়ে ধরে মিষ্টি।

_________________

মিষ্টির রুম থেকে এসে দ্রুত রান্নাঘরে গিয়ে, কফি বানিয়ে ফারিশের রুমের সামনে এসে নক করলো অনন্যা। ফারিশ ফাইল হাতে নিয়ে, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলে, ‘ টাইম দেখেছেন আপনি? কখন কফি টা নিয়ে আসতে বলেছিলাম আমি?’

ফারিশের কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেলে অনন্যা।

ফারিশ তার হাতের সবগুলো আঙ্গুল দেখিয়ে বলে, ‘ ঠিক ১০ মিনিট পর আপনি কফি নিয়ে এসেছেন। ৫মিনিটই লেইট আপনি। টাইমের কি আদোও কোন মূল্য আছে আপনার কাছে?’ জাস্ট রিডিউকিউলাস! ‘

বলেই কফি টা হাতে নিয়ে, অনন্যার দিকে এগিয়ে যায় ফারিশ। ফারিশকে দেখে অনন্যা পিছিয়ে আমতা আমতা করে বলতে থাকে,’আসলে…আমি…’

কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই, ফারিশ স্বাভাবিক ভাবেই অনন্যার হাতে গরম কফি ঢেলে দেয়, অনন্যা ব্যাথায় চেচিয়ে উঠলে, সঙ্গে সঙ্গে অনন্যার মুখ চেপে ধরে ফারিশ। শান্ত গলাতেই বলে, ‘ ডোন্ট সাউন্টিং! বলেছিলাম আপনাকে। ফারিশ খানের রাজ্যে এসেছেন আপনি, ছোট্ট একটা ভুলে পদে পদে শাস্তি পাবেন। ভোগ করবেন চরম ভয়ংকর যন্ত্রনা! ‘

অনন্যার আখিজোড়া বেয়ে জল গড়িয়ে পরে সে চাইলেও বর্তমানে আর্তনাদ করতে পারছে না। ঠিক পাঁচ মিনিট পর, অনন্যার মুখ ছেড়ে দেয় ফারিশ। অনন্যা চিৎকার না করলেও, ফুঁপাতে থাকে ব্যাথায়। ফারিশ অনন্যার হাত ধরে, সামনে থাকা বেসিং এর সামনে দাঁড় করিয়ে, পাশে থাকা ফ্রিজ থেকে বরফের একটা টুকরা বের করে, হাল্কা করে ঘষে দেয়, যেন অনন্যার হাতে ফোসকা না পরে তবুও হাল্কা দাগ হয়ে গিয়েছে। অনন্যা পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে ফারিশের কার্যকলাপ গুলো দেখে যাচ্ছে।ফারিশ এমনভাবে বরফ দিয়ে ঘষছে যার ফলে অনন্যার বাম হাতের অনামিকা থেকে অভির দেওয়া সেই এন্গেজমেন্ট রিং টা খুলে বেসিং এ পরে যায়। অনন্যা আংটি টা তুলতে নিলে, ফারিশ তাতে বাঁধা দিয়ে বলে,

‘যেই সম্পর্কের অস্তিত্ব নেই, সেই সম্পর্কের স্মৃতি বয়ে বেড়ানোর যন্ত্রনা, আপনার পুড়ে যাওয়া হাতের যন্ত্রনার থেকেও মাত্রাধিক বেদনাদায়ক মিস। বুঝলেন?’

শব্দসংখ্যা- ১৩৮০
চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে