#প্রণয়িনী
#মেহরীমা_তাসমীম
||পর্ব ০৭||
আকস্মিক ঘটনায় সকলে হতবাক বিস্মিত।আদ্র সহ সকলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।মুগ্ধতা গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির পানে।মেয়েটা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে আছে।চোখে মুখে রাগ ক্রোধের আভাস।অন্যায়ভাবে ওকে মেরেও কোনো অনুতাপের ছোঁয়া নেই তাঁর মুখমন্ডলে।মুগ্ধতা মেয়েটাকে দেখে কোথাও দেখেছে বলে মনে করতে পারলো না।অথচ মেয়েটা কোনো বাক্য ব্যয় ছাড়াই মেরে দিলো তাঁকে।আশপাশের মানুষজন উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখছে।লজ্জায় মাথানিচু করে নিলো সে।প্রিয়া দৌড়ে গিয়ে ঝাপটে ধরলো প্রাণপ্রিয় বান্ধবী কে।চোখ গরম করে মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘কে আপনি?এভাবে অসভ্যের মতো ওর গায়ে হাত তুললেন কেন?আপনি ওকে চেনেন’?মেয়েটা ক্রোধে ফেটে পরলো।আদ্র রাগে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো।চোখ মুখের অবস্থা বদলে গেলো নিমিষেই।দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
‘তানিশা ওকে মারলে কেন?ও কি ক্ষতি করেছে তোমার’?এতক্ষণে দুজনে বুঝলো মেয়েটা ওদের পরিচিত।মুগ্ধতা মাথা তুলে দুজনের দিকে তাকালো।দুটো মানুষের চেহারায় রাগ ঘৃণা স্পষ্ট।তানিশা কেঁদে দিলো প্রায়। ধরা গলায় বললো,
‘চিনবো না কেন?খুব ভালো করেই চিনি।এই মেয়েটার কারণেই তো আমাকে এত ইগনোর করছো তুমি আর এখন বলছো চিনি কিনা।কি ভাবো আমার তোমার সাথে যোগাযোগ নেই তাই কোনো খবর নেই সব খবর আছে আমার কাছে।ওকে সব জায়গায় প্রটেক্ট করা।ওর সান্নিধ্যে দিন কাটানো সব!সবটাই জানি আমি’।মেয়েটার কথাগুলো শুনে আকাশ থেকে যেন পরলো প্রিয়া এবং মুগ্ধতা।দুজনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।মুগ্ধতা নিজের চোখের পানি মুছে তাকালো আদ্রের দিকে।ও কিছু বলতে যাবে তাঁর আগে সিয়াম বললো,
‘তানিশাপু তোমার ভুল হচ্ছে যেমনটা ভাবছো তেমন কিছু নয়।ওরা জাস্ট আফিফের ফ্রেন্ড।সেদিন ভাই ওদের বাঁচিয়েছিলো বিধায় আজ থ্যাংকস জানাতে এসেছে এছাড়া’আর বলতে পারলো না সায়েম থামতে হলো তাঁকে।আদ্র ওকে থামিয়ে বললো,
‘ওর কাছে এত এক্সকিউজ দেওয়ার কি আছে।আমার যার সাথে ইচ্ছে তাঁর সাথে ঘুরবো।টাইম স্পেন্ড করবো সেখানে নাক গলানোর তুমি কে?ওর কাছে এক্ষুনি ক্ষমা চাও’।
তানিশা নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল রইলো সে কখনও ক্ষমা চাইবে না।সেদিনের এই মেয়ের হাসি এখনও কানে বাজছে তাঁর।তারপর ওকে বাঁচানো।এখন আবার সাথে কফি খাওয়া।যেখানে হবু স্ত্রী হওয়া স্বত্বেও ওকে নিয়ে কখনও ঘুরে নি সেখানে।আবার ওদের বিয়ে ঠিক হতে গিয়ে আদ্রের জন্য হয়নি।এই সবকিছুর জন্য দায়ী একমাএ এই মেয়ে।তাই কিছুতেই মাফ চাইবে না সে।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘ও আমার সংসার ভাঙ্গবে তোমাকে কেড়ে নিতে চাইবে আর আমি ক্ষমা চাইবো কিছুতেই না।মেরেছি বেশ করেছি।এই মেয়ে শোনো আজকের পর যেনো ওর আশেপাশে তোমাকে না দেখি’।আদ্র আরও রেগে গেলো।হাতের রগ ফুলে উঠলো।দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো।অতঃপর বললো,
‘ক্ষমা চাইবে না ওকে এর ফল তোমাকে ভোগ করতে হবে।মেয়েদের গায়ে হাত তোলার মতো কাপুরুষ আমি নই তাই বেঁচে গেলে নইলে’।আদ্র হাত দিয়ে দেয়ালে একটা ঘুষি মারলো।মুগ্ধতার কানে শুধু সংসার শব্দটাই বারি খেলো বারংবার ।তাহলে আদ্র বিবাহিত।বুকের কোথাও চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হলো।অনুভূতিরা যেনো ডানা ঝাপটাতে লাগলো।কই আফিফ তো বলেনি উনি বিবাহিত। সেজন্য সন্দেহের বশে মেয়েটা মারলো তাঁকে।এতটা সুন্দরী একজন মেয়ের এত বাজে ব্যবহার।সত্যি মিথ্যা যাচাই না করেই মেরে দিলো।চোখের জল মুছে একদম সামনাসামনি দাঁড়ালো মেয়িটির।শান্ত অথচ ধারালো সুরে বললো,
‘আমি জানিনা আপনাদের সংসারে কি হয়েছে। আপনাদের দুজনের সমস্যার কারণ সম্পর্কে অবহিত নই আমি।কেন কীভাবে আপনাদের মধ্যে দুরত্ব তৈরী হচ্ছে বা হয়েছে সেটাও অজানা আমার।কিন্তু আপনার কথায় খুব বাজে একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।যেটা মানতে পারছি না ।যদিও সেটা একদম মিথ্যা। যাচাই বাচাই ছাড়াই স্বামীকে কিছু না বলে আমাকে মেরে দিলেন।আপনি যদি উনার প্রকৃত স্ত্রী হতেন তাহলে সবার আগে উনাকে বিশ্বাস করতেন একটা মেয়ের সাথে দেখেই জাজ করতে পারতেন না।একটি সম্পর্কের ভীত হলো বিশ্বাস আর আপনার মধ্যে সেটাই নেই।আর স্বামী স্ত্রীর মাঝে এই বিশ্বাসের খুঁটি শক্ত না হলে সংসার টিকানো যায় না।দ্বন্দ্ব কোলাহল অশান্তি লেগেই থাকে।আপনি উনার স্ত্রী হয়েও বিশ্বাস করতে পারলেন না অথচ এই ক’দিনের পরিচয়ে আমি চোখ বন্ধ করে বলতে পারি উনি কখনও কোনো খারাপ কাজ করতে পারেন না।সেখানে অন্যের প্রতি আর্কষিত হওয়া তো অনেক দূরের কথা।তাছাড়া যার এত সুন্দর রূপ নায়িকাদের মতো ফিগার থাকা স্বত্বেও তাঁকে আটকে রাখতে পারলো না।তাহলে বুঝতে হবে আপনি সর্বগুণী নন।নিজের স্বামীকে নিজের ভালোবসায় আটকাতে ব্যর্থ নারী।যাগগে অনেক বলে ফেললাম উনার খাতিরে আপনাকে আমি ছেড়ে দিলাম নইলে যেই হাত আমার কপোল স্পর্শ করেছে সেই হাত ভেঙ্গে গুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা এই মুগ্ধতার আছে।উনার জন্য বেঁচে গেলেন।আর হ্যাঁ সময় থাকতে স্বামীকে ভালোবাসা ভরসা দিয়ে আটকান নয়তো সত্যি সত্যি পাখি উড়ে অন্য ডালে চলে যাবে চলি’!
মুগ্ধতা আর কোনো সময় ব্যয় না করে চলে গেলো।সায়েম পেছন পেছন ডাকলেও সাড়া দিলো না সে।ওর কথাগুলোয় প্রশান্তির হাওয়া বইলো আদ্রের বক্ষপিঞ্জরে।হাসি ফুটলো তার অধর কোণে।সে ভুল কাউকে চয়েস করেনি একদম খাঁটি হিরে লাইফে এসেছে তাঁর।এবার তানিশাকে ওর প্রাপ্য জায়গা দেখিয়ে দেওয়ার পালা।অন্যদিকে তানিশা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে আছে।মেয়েটিকে চিবিয়ে খাবে এমন অবস্থা তাঁর।আদ্র ততক্ষণ তাকিয়ে থাকলো যতক্ষণ পর্যন্ত মুগ্ধতা দৃষ্টি গোচর না হয়।ওরা চেখের আড়াল হতেই তানিশার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,
‘কাজটা ভালো করলে না তানিশা।সব জানার পরও চুপ ছিলাম কিন্তু আজ লিমিট ক্রস করে ফেলেছো।এবার তেমার ফ্যামিলির সাথে সামনাসামনি কথা হবে।মুগ্ধতা কে কষ্ট দেওয়ার শাস্তি তুমি হারে হারে টের পাবে’।
————
গভীর রাত।আকাশে মেঘের আনাগোনা।চাঁদ ঢেকে রয়েছে কালো আধাঁরে।চারিদিকে নিঃশব্দ।শুধু ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে।সকলে ঘুমিয়ে আছে কিন্তু মুগ্ধতার চোখে ঘুম নেই।অজানা কারণে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তাঁর।ওখান থেকে এসেছে থেকে সে কেঁদে যাচ্ছে। কেন এমনটা হলো এতগুলো মানুষের সামনে মেয়েটা এভাবে অপমান করলো তাঁকে। কিভাবে পারলো আর উনি!উনি কেন বললেন না উনি বিবাহিত।বিবাহিত হয়ে কেন এভাবে আচরণ করতেন তিনি।উনার গভীর চাহনি বার বার অন্য কিছুর আভাস দিতো।কেন এতটা কাছে এসে অদ্ভুত অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে আমাকে দম বন্ধকর পরিস্থিতিতে ফেললেন।কেন সেদিন কলেজ ফাংশনে এত কাছাকাছি এসেছিলেন তিনি কেন! কেন! কেন!কেন এই কেন-র কেনো উওর নেই তাঁর কাছে।কেমন তিক্ত বিশ্রী অনুভূতি হচ্ছে তাঁর।
সেদিন ভার্সিটি ফাংশনে লোকটাকে টার্গেট করলেও তাঁর কোনো প্রমান ছিলো না তাঁর কাছে। এই অনিশ্চয়তা নিয়ে কাটিয়ে ছিলো বেশ কয়েকটা দিন।কিন্তু সেদিন যখন ওই বিপদ থেকে ওকে রক্ষা করলো আদ্র তখন ওর একদম কাছাকাছি গিয়ে জড়িয়ে ধরায় ওর শরীরের সেই পারফিউমের ঘ্রাণ পায় সে।এবং সেদিনের লোকটার কাছে সেই স্মেল থাকায় দুইয়ে দুইয়ে চার মিলায় সে।কিন্তু এসবের মানে কি সেটা বুঝে উঠতে পারে নি।মনে মনে অন্য কিছুর আশংকা করলেও সিওর হয়ে উঠতে পারেনি।তবে আজ সিওর অতশত কিছুই ছিলেো না হয়তোবা সেদিনের অপমানের বদলা নেওয়ার জন্য ওর কোনো ক্ষতি পরক্ষণে নিজেকেই ধিক্কার জানালো সে।যে লোকটা ওর সম্মান বাঁচালো সেই লোকটাই কি-না, না না এসব ভাবা যায় না।এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে ফজরের আযান কানে এলো তাঁর।একটা নির্ঘুম রাত অতিবাহিত হলো।
———
সপরিবারে তানিশাকে সকাল সকাল জরুরি তলব করেছে আদ্র।এই ঘটনার দুদিন কেটে গেছে কিন্তু এখনও কোনো সুরাহা হয়নি।এই দুদিন আদ্র কিংবা মুগ্ধতা কেউ কারো সাথে দেখা বা কথা কোনোটাই হয়নি।মুগ্ধতা মনের মধ্যে যে একটা ভ্রান্ত ধারণা পুষেছিলো সেটা নিজেই বুঝতে পেরেছে সে।আদ্রের তাঁর প্রতি কোনো ফিলিংস নেই।সে এক তরফাই আটকে যাচ্ছিলো আবার নিজেই ফিরে আসবে।ড্রয়িংরুমে বসে আছেন তানিশা,তানিশার বাবা এবং মা।ওর ভাই খানিকক্ষণ পরে আসবে।তানিশাকে দেখে এক গাল হাসলেন আদ্র সায়েমের মা।দুজনেই ওর পরিবারের সবার সাথে কথা বলছেন খুশীতে হাসি হাসি মুখে।কারণ সকলে ভেবেছেন আদ্র হয়তো এবার নিজে বিয়ের ডেটের বিষয়ে কিছু বলবে।অবশ্য আদ্র এমনটাই জানিয়েছে সবাইকে।কিন্তু তানিশার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না।পরশুর ঘটনার পর এভাবে চুপ থাকার ছেলে তো আদ্র নয় তাহলে তাদের ডেকেছে কেন?ফোনে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেও কোনো উওর পায় নি সে। বলেছে আসলে শুনবে।ওর মনটা কু গাইতে শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে। আদ্র কি তবে বিয়ে ভাঙ্গবে।আবার নিজের ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছে সে।এমনটা করবে না।ওর ভাবনার মাঝেই আদ্র নেমে বসলো ওর বাবার পাশে।আদ্রিতা ভোঁতা মুখে দাঁড়িয়ে আছে।ভাইয়ের সাথে এই মেয়ের বিয়ে কিছুতেই মানতে পারছে না সে।এতদিন ভাই রাজি ছিলো না কিন্তু এখন শুনছে ভাইও রাজি।এ নিয়ে দুঃখের শেষ নেই তাঁর।আদ্র তানিশার বাবা মাকে সালাম জানিয়ে তানিশাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘তোমার খবর কি তানিশা?সব ঠিকঠাক তো’?কথাটা শুনেই তানিশার গলা শুকিয়ে যায়।আদ্র কি তবে কিছু আঁচ করেছে।নিজেকে স্বাভাবিক রেখে কোনোমতে হাসিমুখে বলে,
‘হুম ভালো আছি’।আদ্র মুচকি হাসলো।মায়ের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি চোখে পরলো।দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।তারপর বললো,
‘আঙ্কেল আপনারা যত দ্রুত সম্ভব তানিশার বিয়ের ব্যবস্থা করুন।আমি ওকে বিয়ে করছি না।আমাদের যা ছিলো তা দুদিন আগে শেষ হয়ে গেছে শুধু গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজের জন্য অপেক্ষা করছিলাম এখন সেটাও পেয়ে গেছি।তাই এ নিয়ে যত কম কথা বলবেন ততই আপনার মেয়ের মঙ্গল হবে’।
এই মুহূর্তে এই কথাগুলো কেউ কল্পনাও করে নি।সকলের আনন্দ উচ্ছ্বাস কে এক নিমিষে মাটি করে দেবে ভাবনাতীত ছিলো সবার।থমথমে পরিবেশ বিরাজমান।কারো মুখে কথা নেই।সকলেই হতবাক বিস্মিত।
চলবে