প্রণয়িনী পর্ব-০৬

0
815

#প্রণয়িনী
#মেহরীমা_তাসমীম
||পর্ব ০৬||

গাড়িতে চুপচাপ বসে আছে মুগ্ধতা মুখে কোনো রা নেই তাঁর একদম নীরব সে।থানার ব্যাপারটা আফিফ আর রাদিফ সামলাচ্ছে।মুগ্ধতার বাড়ির কাউকে খবর দেওয়া হয়নি এখনও।তখন তাড়াহুড়োয় কেউ খবর দেয় নি।এখন যখন ও সেইফ তখন আর টেনশন দেওয়ার কোনো কারণ নেই তাই দেওয়া হয় নি। সবাই যার যার বাসায় চলে গেছে শুধু ওরা বাদে।প্রিয়া আজ মুগ্ধতার সাথে ওদের বাসায় থাকবে।দুজনেই মেন্টালি সিক তাই একজন যাতে অন্যজনের সাথে থাকতে পারে সাপোর্ট পায় সেজন্য আদ্র প্রস্তাবটা রাখে।এবং প্রিয়াও মেনে নেয়।এমনিতেই মন ভালো নেই বাসায় যেয়ে বাবা ছাড়া কেউ নেই তাই ওর সাথে থাকাটাই বেটার মনে করছে সে।প্রিয়ার বাবা এসে মেয়েকে দেখে গেছেন এবং ওখানে থাকার পারমিশন দিয়ে গেছে যাতে করে দুজনে প্রফুল্ল,খুশী থাকে।রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে মুগ্ধতার জন্য একদিন ওড়না কিনেছে আদ্র সেটা দিয়ে নিজেকে পুরোপুরি ঢেকে নিয়েছে সে।

দুজনকে নামিয়ে আদ্র নামে গাড়ি থেকে নামে কিন্তু কোনোকথা বলে না।মুগ্ধতা নিজের ওড়না টাকে শালের মতো পেঁচিয়ে ভালোভাবে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।তারপর ওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বললো,

‘আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই।আজ আমার জন্য যা করলেন তাঁর জন্য আমি চিরকাল আপনার নিকট ঋণী থাকবো’।আদ্র তাকিয়ে রইলো মেয়েটার মুখের দিকে।ফর্সা গালে পানির বলিরেখা এখনও লেগে আছে।কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে মুখমন্ড কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।।ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ফর্মালিটি দ্বায়ে এসব বলতে হবে না আমাকে।আমি কারোর জন্য কিছু করিনি যা করেছি তা একমাত্র নিজের জন্য।চোখের জলে মহাসমুদ্র না বানিয়ে ব্যাপারটা ভুলে হাসুন।এমন ভান করবেন যেন কিছু ঘটেই নি।আর হ্যাঁ সাহস থাকাটা ভালো কিন্তু এতটা সাহস মঙ্গলজনক নয়’।কথাটা বলে আর কোনো বাক্য ব্যয় না করে চলে গেলো সে।

———-
বাড়িতে ঢুকেই নানা বিদ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো মুগ্ধতা কে।ঘটনাটা না জানানোর জন্য বকাও খেতে হলো বেশ।আবার যে লোকটা বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে তাঁকে বাসায় নিয়ে আসেনি তাঁর জন্য কম কথা শুনে নি সে।মুগ্ধতার আম্মু আবেগপ্রবণ হয়ে বেশ কিছুক্ষণ কাঁদলেন।ওর বাবা বাসায় আসলে থানায় এ নিয়ে বেশ কথাও হলো।ওরা যেনো সহজে ছাড়া না পায় শাস্তি পায় সেই ব্যবস্থাও করলেন।এরপর দুজনের মাথায় স্নেহের পরশ বুলালেন তিনি।দুজনকে ফ্রেশ করিয়ে জোর করে মুখে তুলে খাওয়ালেন তাঁর মা।প্রিয়া এই মানুষটাকে দেখলেই নিজের মাকে আরও বেশি কাছে পাওয়ার ইচ্ছে জাগে।মানুষটি কখনও নিজের মেয়ে থেকে কমে ভাবেন নি তাকে।সবসময় মায়ের মতো স্নেহ আর শাসনও করেছেন বেশ।এসবে ভালো লাগা কাজ করে তাঁর।উনার মাঝেই খুঁজে পায় মা নামক নরম মনের মানুষটি।

—————
বাসায় এসেই সোফায় ধপ করে বসলো আদ্র।এখন বেশ রাত হয়েছে।মুগ্ধতাকে নামিয়ে একটা কাজে গিয়েছিলে সে সেখান থেকে মাএ ফিরেছে।বাসার সকলে এখন ঘুমিয়ে আছে ঘুমায় নি শুধু তাঁর মা।ছেলের জন্য বসে রয়েছেন তিনি।এটা নতুন কিছুনা নয় যেদিনই ফিরতে দেরি হয় তাঁর সেইদিনই ছেলের পথও চেয়ে বসে থাকেন তিনি।এ নিয়ে আদ্র অনেকবার নিষেধ করলেও কথা শুনেন নি তিনি।ছেলেকে খাইয়ে তবেই নিশ্চিন্তে ঘুমাবেন।আজও ব্যাতিক্রম হয়নি।সায়েম আর আদ্র দুজনকে ফ্রেশ হতে বলে খাবার বেড়ে দিলেন তিনি।দুজনে খাচ্ছে এমন সময় বললেন,

‘পরশু তানিশাদের বাসায় যাবো।দুজনে সেদিন কোনো কাজের বাহানা দেবে না।ওখানে গিয়ে বিয়ের ডেট ফাইনাল করে আসবো আর অপেক্ষা করতে চাইছি না আমরা’।আদ্রের হাত থেমে গেলো নীরব চোখে মায়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো।তারপর বললো,

‘এত আগে ডেট ফিক্সড করে কি হবে মা।বছর যাক তারপর এটা নিয়ে ভাববো’।

‘এখানে ভাবাভাবির কিছু নেই।আমি পুএবধূর মুখ দেখবো তাই সামনের বা তার পরের মাসে আমি ওকে ঘরে তুলবো’।কথাটায় আদ্রের অভিব্যাক্তি বুঝা গেলো না।সে দিব্যি খাচ্ছে।যেন এমন কিছু হবে জানতো সে।সায়েম মাঝ খান থেকে রয়েসয়ে বললো,

‘বড় মা এভাবে তাড়াহুড়োর কি আছে।বউ তো তোমার দেখাই আর নতুন করে কি দেখবে’।

‘এই দেখা আর সেই দেখা সমান নয়।আমি আমার ঘরে একেবারে দেখতে চাই।যেখানে চাইলেই ওকে দেখতে পারবো গল্প করতে পারবো শাশুড়ী সেবা পাবো সেভাবে’।সায়েম আর কোনোকথা বললো না।যেখানে যার বিয়ে সে নীরব দর্শক সেখান তার নাক না গলানোই উচিৎ বলে মনে করছে সে।এরইমধ্যে খাওয়া শেষে হাত ধুতে ধুতে বললো,

‘আম্মু আমাকে জোর করে কোনো লাভ হবে না এতে হিতে বিপরীত হবে।সময় আসুক তখন দেখবো এখন এসবের সময় নেই।এই নিয়ে আমি ওর সাথে কথা বলবো তুমি চিন্তা করো না’।

‘তোমার এমন হেলালি পনা আমি মানবো না।মেয়েটা আজও কল দিয়ে কেঁদেছে।আমি রিকুয়েষ্ট করায় বাসায় এসেছিলো সারা সন্ধ্যা বসে থেকে আটটার দিকে মলিন বিষন্ন মুখ নিয়ে বাসায় গেছে।ও এতটা তুচ্ছ ফেলনা নয় যে তুমি এমন করবে’।কথাগুলো যেন শুনলোই না সে।ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে প্রস্তান করলো।সেখানে দাঁড়িয়ে রাগে টগবগ করতে লাগলেন তিনি।এই ছেলেকে কখনও কথার বিরুদ্ধে কাজ করাতে পারেন নি।যদিও বিয়েতে অনেক কষ্টে রাজি হয়েছে আদৌও কি বিয়ে টা হবে পারবে তানিশার সাথে ভালো থাকতে।আবার নিজের ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে মনে মনে বলেন,

‘তানিশার পাগলের মতো ভালোবাসে ওকে।একদিন ছেলে টাও ওকে খুব ভালোবাসবে।সুখী হবে দুজন’।

—————
রকিং চেয়ারে বসে মুগ্ধতার ভাবনায় বিভোর আদ্র।মেয়েটাকে দেখলেই অন্য এক জগতে চলে যায় সে।যদিও মেয়েটা সম্পর্কে ধারণা খুব একটা ভালো নয় তাঁর তবুও ওই মেয়েটাই যেন চোখের তৃষ্ণা মিটানোর হাতিয়ার। হৃদয়ের প্রশান্তির কারণ হয়ে উঠেছে আজকাল।আজকে মেয়েটার স্পর্শ যেন সকল সুখ বইয়ে দিয়েছে বুকে।যখন শুনেছিলো ওই অসভ্য মেয়েটা বিপদে আছে তখন যেন পাগল হয়ে উঠেছিলো সে।মনে হচ্ছিলো ওকে হারিয়ে ফেলছে।কিন্তু কেন এমন মনে হয়েছিলো জানা নেই তাঁর।আবার মেয়েটার দেখা প্রত্যাশার বাইরে ওকে ছোঁয়া ঠিক কতটা শীতল করেছিলো মন মস্তিষ্ক কে সেই অনুভূতিটা বুঝানো দুঃসাধ্য তাঁর কাছে।আচ্ছা সে কি মেয়েটাকে ভালোবাসে।ভালোবাসলে বুঝি প্রিয় মানুষটার সুখ দুঃখ সব কিছু ছুঁয়ে যায় অপর পাশের মানুষটিকে।হয়তোবা এমনই হয়।আচ্ছা তানিশাকে কেন ভালো লাগে না তাঁর।মেয়েটা রূপ মাশাআল্লাহ!কিন্তু সেই রূপ ওকে আকৃষ্ট করে না কেন?এতদিনেও কেন ওর মনে এতটুকু জায়গা হলো না তার।সেখানে এই মেয়েটা দুদিনে ওর সবটা জুড়ে বসে আছে।যেখানে প্রথম দিনেই ঘটিয়েছিলো অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবনাতীত ঘটনা।সেখানে আর ভাবতে পারলো না আদ্র।কালো আধাঁরে ঢেকে গেলো ওর মনখানা।প্রথমদিনের কথা ভাবলেই মেয়েটাকে ঘৃণা হয় তাঁর কিন্তু কই ঘৃণা করতে পারে কই সে তো ওর মাঝেই আটকে রয়।

—————–
❝সকালের সোনালি আলো,
মুছে যাক মনের সব দুঃখ যাতনা গুলো❞।

সকাল সকাল ম্যাসেজ টা দেখেই ঠোঁটের কোণে নিজের অজান্তেই হাসি ফুটলো তাঁর।এই লোকটা কি করে যেন ওর মনের সব খবর জেনে যায়।যখনই মন খারাপ করে বসে থাকে তখনই সে কোনো না কোনোভাবে হাসানোর চেষ্টা করে তাঁকে।আজকে মুগ্ধতার খুব করে ইচ্ছে হলো লোকটার সাথে কথা বলার।কল করবে কিনা করবে না দ্বিধায় পরে গেলো সে।পরে ভেবেচিন্তে এই কল করা থেকে বিরত রইলো ।সেদিনের পর কেটে গেছে সপ্তাহ খানেক।মন থেকে এসব ঝেড়ে ফেলেছে মুগ্ধতা।তবে চাইলেই কি সব ভুলা যায়,যায় না।সেও ভুলতে যেয়েও পারে না।আজকে আদ্রের সাথে দেখা করবে সে।সেদিনের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইবে।আফিফের কাছ থেকে সায়েমের নম্বর নিয়ে ওর সাথে কথা বলে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে সে।তবে এই বিষয়ে কোনে ভাবে অবগত নয় আদ্র।সায়েম কোনো একটা বাহানায় রেস্টুরেন্টে নিয়ে আসবে।

———-

সামনাসামনি বসে রয়েছে আদ্র এবং মুগ্ধতা।অপরদিকে পাশাপাশি বসেছে সায়েম এবং প্রিয়া।আদ্র বারবার ওর দিকে তাকাচ্ছে।খয়েরি সেলোয়ার- কামিজের সাথে খয়েরি হিজাব মেয়েটাকে অপরূপা লাগছে।শুধু ইচ্ছে করছে তাকিয়ে থাকতে।কিন্তু পারছে না মেয়েটা কি ভাবে কি না ভাববে সেই ভাবনায় কয়েকবার চোখ তুলে তাকিয়ে আবার নামিয়ে নিয়েছে।নীরবতা ভেঙ্গে মুগ্ধতা বললো,

‘আসলে আজ আপনার সাথে কিছু কথা বলার জন্য আপনাকে ডেকেছি।আমি জানি আপনি অনেক ব্যস্ত একজন মানুষ আপনার সময়ের অনেক দাম।সেই মহামূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য আগেই ক্ষমা চাচ্ছি।আসলে আমি’।মাঝপথে থামিয়ে আদ্র বললো,

‘ভাষণ শেষ হলে আসল কথায় আসেন’?।ওর কথায় চুপসে গেলো মুগ্ধতা।লোকটা একটু বেশিই কথা বলে।এভাবে বলার কি প্রয়োজন ছিলো।নরম ভাবে বললে হতো না কি!ওর ভাবনার মাঝে আবারও বললো,

‘হ্যালো’!ধ্যান ভঙ্গ হলো তাঁর ।তারপর বললো,

‘আপনার সাথে আমার প্রথম দেখা পুরোটাই একটা এক্সিডেন্ট ছিলো।তখন একটা লোক আমায় রোজ ম্যাসেজ কল দিয়ে জ্বালাতন করতো।সেদিন রাস্তায় এসে সোজাসুজি বাজে কথা বলে এবং আমি রেগে মারতে গেলে বলে আপনাকে দেখায় আমিও সেটা ভেবে খারাপ ব্যবহার করে বসি।তখনও জানতাম না সেটা আপনি নন।তারপর জানতে পারি যে আপনি সে ছিলেন না।অনেকবার সরি বলতে যেয়েও বলতে পারিনি আপনার কথাগুলো শুনে রাগ লেগেছিলো।তারপর রাগে জেদে আটকে গেছি।সেদিন বলতে পারিনি আজ বলছি আমার ব্যবহারের জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।আমাকে ক্ষমা করবেন’।

আদ্র ওর কথার বিনিময়ে ঠোঁট চওড়া করে হাসলো।কথা বলার সময় কেমন চোখ মুখও যেন সেই কথার তালে তাল মিলায়।যা ওর হাসির অন্যতম কারণ।মুচকি হেসে বললো,

‘প্রথমদিন বেশ রাগ হয়েছিলো।মনে হয়েছিলো আপনাকে তুলে একটা আচার দেই।যেটা সায়েমের জন্য পসিবল হয়নি।সময়ের ব্যবধানে সেটা ভুলতে বসেছি প্রায়।সেই কবে বাদ দিয়ে দিয়েছি।ক্ষমা চাইতে হবে না’।মুগ্ধতা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তারপর আবার বললো,

‘আর সেদিন যা করলেন তাঁর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না।আপনার উছিলায় আমরা দুজন ঠিক আছি।ধন্যবাদ দিচ্ছি না দোয়া করি আপনর সব স্বপ্ন গুলো যেন পূর্ণতা পায়’।ওদের কথার মাঝখানে কফি চলে এলো।চারজনের সেটা হাতে নিয়ে সায়েম বললো,

‘এসবের জন্য ভাইকে কিছু বলতে হবে না।ও সেই কবে এগুলো বাদ দিয়ে দিয়েছে।সেদিন যেই ঝাড়ি গুলো খেয়েছি বইন আমার মনে আছে’।মুগ্ধতা লজ্জা পেলো বেশ।মাথা নিচু করে বললো,

‘সরি ভাইয়া’!হঠাৎ হাতে টান পরলো মুগ্ধতার।হেঁচকা টানে বসা থেকে টেনে তুললো কেউ।ভালোভাবে দাঁড়ানোর পূর্বেই গালে পরলো শক্তপোক্ত একটা থাপ্পড়।সাথে সাথে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো তাঁর।মুহূর্তেই চোখের কোণে অশ্রুরা ভীড় করলো।ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো সামনের ব্যাক্তিটির পানে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে