#প্রণয়িনী
#মেহরীমা_তাসমীম
||পর্ব ০৫||
আদ্রিতা টিউশনি থেকে ফিরছিলো তখন তানিশার সাথে দেখা।তানিশা নিজে থেকে এসে ওর সাথে কথা বলছে। ভালো মন্দ খোঁজ খবর নিচ্ছে।আদ্রিতা মনে মনে বেশ বিরক্ত ভালো লাগছে না তার।কতক্ষণে এই আপদ টার হাত থেকে রেহাই পাবে কে জানে।তানিশা আজ বেশ ভালোভাবেই কথা বলছে।অন্য সময় খোঁচা না মেরে থাকতে পারে না কিন্তু কি হলো ভেবে পায় না সে।ওর ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে টিটকাটির সুরে বললো,
‘খুব চাইছিলে না আমি যেন তোমার ভাবী না হই।কিন্তু কি জানো তো ননদিনী শকুনের দোয়ায় গরু মরে না’।আদ্রিতা ভ্রু কুঁচকালো মুখে হাসি এনে বললো,
‘তো স্বীকার করলে তুমি মানুষ না আস্ত একটা গরু।আর আমি নিশ্চিত গরুকে আমার ভাই বিয়ে করবে না’।অপমানে মুখ থমথমে হয়ে গেলো তানিশার।এ যে ঠান্ডা মাথার অপমান বুঝতে বাকী রইলো না তার।তবুও হাসি টেনে বললো,
‘গরু বলো আর মানুষ যাই হই না কেন?বউ কিন্তু তোমার ভাইয়েরই হচ্ছি।এবং সেটা খুব শীঘ্রই’।
‘আরও একবছর ম্যাডাম!অতদিন পর দেখ কি হয়’।
‘এক বছর নয় গো পিয়ারী ননদিনী।ধরো আর মাস খানেক।দুই চারদিনের ভিতর তারিখ ঠিক হয়ে যাবে’।কথাটা শুনে চমকালো আদ্রিতা।অবাকও হলো বেশ।কিন্তু প্রকাশ করলো না সে।ব্যঙ্গ করে বললো,
‘পাগলের সুখ মনে মনে’।ক্ষেপে গেলো তানিশা।রাগে ফেটে পরলো সে।হাত উঠিয়ে মারতে গিয়েও মারলো না।হাত নামিয়ে নিলো।কন্ঠে তেজ নিয়ে বললো,
‘আজ তোকে ছেড়ে দিলাম। একবার শুধু ওই বাড়িতে ঢুকতে দে।তারপর ভাই বোনের পিরিত বার করে ছাড়বো’।কথাটা বলেই আর দাঁড়ালো না সে।গটগট করে চলে গেলো।ভদ্রবেশী এই মেয়েকে এই জন্যই সহ্য হয় না আদ্রিতার।সবসময় একটা খোলসে আবৃত থাকে।আর একমাত্র আদ্রিতাই পারে ওকে নিজের রূপে বার করে আনতে।
———-
গাড়ি থেকে নামিয়ে দুটো মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে কোথাও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে ছেলেগুলো।প্রিয়া সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছে।অপরদিকে মুগ্ধতা কাঁদে নি কারণ সে কাঁদলে প্রিয়া আরও ভেঙ্গে পরবে।কিন্তু এই মূহুর্তে ওর কান্না, ভয় নয় মনোবল আর সাহস প্রয়োজন।এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার পর ঠিক কি ঘটতে চলেছে দুজনের সাথে ইতিমধ্যে অবগত আছে তারা।কিন্তু কি করবে ভেবে পাচ্ছিলো না।একমাএ সুযোগ গাড়ি থেকে নামানোর পর।তখন সন্ধ্যা সূর্য অস্ত যাচ্ছে।কোথাও থেকে ভেসে আসছে আযানের ধ্বনি।দুজনকে নামিয়ে কয়েক হাত দুরত্বে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইশারা করলো একজন।মেয়েগুলোর মুখ বেঁধে দিয়েছে কাপড় দিয়ে যাতে কোনোরূপ আওয়াজ না করতে পারে তারা।চারজন ছেলে মিলে দুজনকে নিয়ে যাচ্ছে।মুগ্ধতা শুধু সুযোগের অপেক্ষায় কিভাবে কি করবে সে।হঠাৎ একটা ছেলের পকেটে চোখ যেতেই কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা চোখে পরে। আশার আলো দেখলো সে।আচমকা বললো,
‘ওই তো পুলিশের গাড়ি আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না প্রিয়া।এবার বুঝবি সবকয়টা’।কথাটা যেনো বিস্ফোরন ফুটালো। তখন ভয়ে সবাই সড়কের দিকে তাকালো সেই সুযোগে পকেট থেকে চাকু নিয়ে বসিয়ে দিলো একটা ছেলের হাতে।ছেলেটা ওমাগো বলে একটু দূরে চলে গেলো।অন্যজনকে লাথি দিয়ে সরিয়ে দিলো।প্রিয়াকে ছেড়ে ওই দুটো ছেলে ওর দিকে এগুলো।এবার আরেকজনকে তাক করলেও কোনো ফল হলো না।ছেলেটা সরে গেলো।তখনি প্রিয়ার মুখ খুলে ঠেলে রাস্তার দিকে দৌঁড়াতে বললো সে।কিন্তু প্রিয়া ভয়ে যাচ্ছে না তাছাড়া প্রিয় বান্ধবী কে ছাড়া সে যাবে না।ওকে নিয়ে মুগ্ধতা দৌড় লাগালো এবং দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বুঝালো যাতে একজন সেইফ থাকে তাহলে অন্যজনকে বাঁচানো যায়।প্রিয়া বুঝলো ওকে এগিয়ে দিয়ে মাঝ পথে দাঁড়িয়ে রইলো সে।প্রিয়া এতক্ষণে অনেক দূর চলে গেছে এবার বিপদমুক্ত সে।ছেলেগুলো দৌড়ে এসে ওর সামনে দাঁড়ালো।একজন হাঁপিয়ে বললো,
‘ভাই ওই মেয়েটা কোথাও চলে গেছে দেখা যাচ্ছে না।ওদিকটায় খুঁজবো’।আরেকটা বললো,
‘থাক এটা হলেই চলবে।এটা দরকারি ওইটা তো ফ্রী এনেছিলাম।শিকার আটকে গেছে আর কি চাই’।মুগ্ধতার হাতের ছুরিটা দিয়ে আঘাত করতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে হাতে আঘাত পাওয়া ছেলেটা ওকে ধরে ফেললো।ধস্তাধস্তি করে ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে সকলে অট্রহাসিতে ফেঁটে পরলো।
—————-
প্রিয়া কাঁদতে কাঁদতে দৌঁড়াতে থাকে।তাড়াতাড়ি ওকে পৌঁছাতে হবে।আশেপাশে মানুষজন রয়েছে বিধায় একজনের কাছ থেকে ফোন নিয়ে রিফাত আর আফিফকে জানিয়ে দিয়েছে বিষয়টা।ওরা দ্রুত আসছে বলে জানিয়েছে।আর ওকে যতটুকু সম্ভব সামনে এগুতে বলেছে যাতে ওদের থোকে ধরা ছোঁয়ার বাহিরে থাকে সে।বেখেয়ালে তড়িৎ হাঁটায় গাড়ির সাথে হোঁচট খেতে খেতে বেঁচে যায়।সাথে সাথে গাড়ি থামিয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে পরিচিত একটি মুখ।এদের দেখে খানিকটা সাহস পায় সে।সায়েমকে কিছু না বলে আদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকে সে।ওর অবস্থা দেখে দুজনেই চমকায় বেশ।চুল এলোমেলো কেঁদে কেটে চোখ মুখের কি বিশ্রী অবস্থা।আদ্র গাড়ি থেকে নেমে প্রিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘কি হয়েছে প্রিয়া?তোমার এই অবস্থা কেন’?প্রিয়ার কান্নার বেগ বাড়ে।বিকালের ঘটনা মনে পড়ে আরও ভেঙ্গে পড়ে সে।ওর অবস্থা দেখে যা বুঝার বুঝে নেয় দুজনে।সায়েম বলে,
‘কীভাবে আসলে এখানে’?প্রিয়া চোখ মুছে বলে,
‘চারজন ছেলে এখানে তুলে এনেছিলো আমি কোনোভাবে পালিয়ে এসেছি’।স্বস্তির শ্বাস ফেলে আদ্র।তারপর বলে,
‘যাক কোনো ক্ষতি হয়নি।গাড়িতে উঠো তোমাকে পৌছে দিচ্ছি আর ওদের চেনো তুমি’।
‘ক্ষতি হয়নি নয় ভাইয়া হতে যাচ্ছে।আমাকে সেইফ করে পাঠিয়ে মুগ্ধতা আটকা পরেছে ওদের হাতে।আফিফ রিফাত আসছে।ভাইয়া আমার বান্ধবী কে ওই কুকুরদের হাত থেকে বাঁচান প্লিজ’!মুগ্ধতা নামটা শুনেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো ওর।মুগ্ধতা আটকা পরেছে বারবার কথাটা আওরালো।তারপর ভীত কন্ঠে বললো,
‘এখন মুগ্ধতা কোথায়?আর তুমি এতক্ষণ কেন বললে না তোমরা দুজন ছিলে’?কথাটায় রাগের আভাস পাওয়া গেলো।পাশ থেকে সায়েম বললো,
‘জলদি গাড়িতে উঠো আর কোথায় ওকে রেখে এসেছো আমাদের নিয়ে চলো’।তিনজনে গাড়িতে উঠলো একটু দূর গিয়েই রাস্তা দেখালো প্রিয়া।আদ্র প্রিয়ার কাছে সায়েমকে থাকতে বললো কিন্তু সে থাকবে না ওর সাথে যাবে।অগত্য প্রিয়াকে গাড়িতে লক করে দুজনে সামনে এগুলো।আসার সময় প্রিয়াকে সায়েমের ফোন দিয়ে আসলো যদি কোনো সমস্যা হয় তাহলে ওদের জানাতে পারে।ততক্ষণে রাদিফ আর আফিফও পৌঁছে গেছে।প্রিয়া সায়েমের ফোন থেকে কল করে লোকেশনে পৌছাতে সাহায্য করে।রিফাত পুলিশ স্টেশন গেছে ওদের নিয়ে আসছে।
বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর কোথাও কোনো হদিস পাওয়া গেলো না।চারদিক থেকে কোথাও খোঁজ নেই তাঁর।কি করে খুঁজবে তাঁকে।রাগটা এবার মুগ্ধতার উপর হলো তাঁর।কি প্রয়োজন ছিলো এত সাহস দেখানোর।এসব না করলে তো বিপদে পরতো না।মেয়েটার সব কিছুতে বাড়াবাড়ি।এবার কোথায় খুঁজবে তাঁকে।রাদিফ আফিফও এক হলো ওদের সাথে কিন্তু কোথাও নেই।এরপর চারজন চারদিকে খুঁজতে থাকলো।রাদিফ একটা ওড়না পেলো একটা পুরাতন বাড়ির সামনে সাথে সাথে কল লাগালো আদ্রকে।আদ্র মিনিট পাঁচেক পর পৌঁছালো সেখানে।
———
অন্ধকার রুমে একটি চেয়ারের সাথে বাধা রয়েছে মুগ্ধতা।চারিদিকে কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই।তখন ওকে এখানে এনেই ওরা বাহিরে যায় খেতে।যাওয়ার সময় একজন বলে গেছে ফিরে এসে সব হিসেব সুদে আসলে উশুল করবে সে।কথাটার সে কোনো অর্থে বলেছে সেটা ভেবেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তাঁর।এতটা বাজে পরিস্থিতিতে পরতে হবে কখনও ভাবতেও নি সে।আজ এখান থেকে বেরুনোর কোনো রাস্তা নেই।হাত মোচড়ামুচড়ি করেও লাভ হচ্ছে না কোনো।অন্যদিকে পরবর্তী ঘটনার কথা ভেবেই দিশেহারা সে।রাগে দুঃখে কান্না পাচ্ছে তাঁর। এতক্ষণ শক্ত খোলসের ভিতর থাকলেও এখন পারছে না সম্ভব হচ্ছে না।ওর ভাবনার মাঝেই একটা ছেলে ভিতরে ঢুকলো।মুখে তার রাজ্য জয় করা হাসি।ছেলেটাকে দেখেই গা গুলিয়ে এলো তাঁর।মুখ ঘুরিয়ে রইলো।ছেলেটা হেলেদুলে সামনে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপর ওর থুতনি ধরে মুখটা উপরে তুলে বললো,
‘খুব তেজ তোর তাই না।আমার এই হাতে আঘাত করেছিলিস ঠিক আছে এবার বুঝবি আমাকে আঘাত করার কি ফল’।
ছেলেটা হাসতে হাসতে ওর জামার এক হাতা টান দিয়ে ছেঁড়ার চেষ্টা করে।কয়েকবারের চেষ্টায় সফল হয় সে।কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ওর হাত খুলে জোরজবরদস্তি শুরু করে।মুগ্ধতা নিজের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করছে নিজেকে বাঁচানোর কিন্তু পারছে না।এক পর্যায়ে একটা কিছুর আওয়াজে থমকে রয় মুগ্ধতা।ছেলেটা মুখ থুবড়ে পরে খানিক দূরে।মুগ্ধতা কিছু বুঝে উঠতে পারে না।ছেলেটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকাতেই দিশেহারা জীবনে একটুখানি আলোর দেখা পায় সে।সামনে আদ্রকে দেখে স্বস্তি মিলে। নিজেকে সেইফ মনে করে আচমকা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আদ্র নামক ছেলেটাকে।আদ্র সেখানে স্থির দাঁড়িয়ে রয়।ওর বুকের মধ্যিখানে একদম মিশে আছে মেয়েটা।যেন দিন দুনিয়ার হুশ হারিয়ে যাচ্ছে তাঁর।
অনেক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর যখন ওর ওড়না মিললো তখন সবাই মিলে বাড়িটাতে ঢুকলো।একেকজন একেক দিকে ছড়িয়ে পরলো।কয়েক রুম খোঁজাখুঁজির পর দ্বিতীয় তলায় দেখা মিললো আদ্রতার।দরজার সামনে দুজন ছিলো তাদের রাম দুলাই দিয়ে ভিতরে এসেছে সে।মুগ্ধতা শক্ত করে ধরে আছে।আরো দুটো ছেলে দুদিক থেকে ঘিরে ধরে ওদের।মুগ্ধতা কে ছাড়িয়ে পাশে দাঁড় করিয়ে ওদের দুজনকে কয়েকটা দিলো বসিয়ে।এরমধ্যে সবাই জড়ো হয়ে গেছে।মারতে মারতে প্রায় শেষ করে দিচ্ছে ওদের।সবাই এসে ওকে থামাতে চাইছে কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না।অনেক চেষ্টা করে ওকে সকলে মিলে থামালো।
———-
পুলিশ সব কয়টাকে নিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে।প্রিয়ার গলা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুগ্ধতা।হাঁটতে হাঁটতে আদ্রের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তাঁরা।আদ্র আঁড়চোখে একবার মেয়েটাকে দেখলো।এক হাত ছেঁড়া কোনোভাবে সেটা ঢাকার চেষ্টায় রয়েছে সে।চোখ গুলো ছোট ছোট করে ভয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।এলোমেলো চুল ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।এখন ওকে টাটিয়ে দুটো চড় থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছে তার।ন্যাকা মেয়ে ভালো কোনো কাজ যেনো ডিকশনারিতে নেই সব অকাজের ভান্ডার খুলে রেখেছে।।কিছুক্ষন নীরবতায় কাটলো সবার।শুধু মুগ্ধতার ফ্যাচ ফ্যাচ শব্দ ছাড়া কিচ্ছু শুনা যাচ্ছে না।এসবে বিরক্ত হয়ে রেগে বললো,
‘আফিফ এই অসভ্য অভদ্র বাঁচাল মেয়েটাকে কাঁদতে বারণ কর।আর যেন আমি কান্নার আওয়াজ না শুনি ইডিয়ট একটা’।আফিফ কিছু বলার আগে রাদিফ বললো,
‘রাগিস না দোস্ত!মেয়েটা এমনিই অনেক ভয় পেয়েছে তার উপর যদি তুইও ধমকাস তাহলে কি করবে ও’।
‘ আমি তো ধমকাচ্ছি ওরা তো।যাগগে যা পারবো না তা করতে যায় কেন?আজ যদি আমরা সবাই না আসতাম এতক্ষনে কি ঘটতো আইডিয়া আছে ওর।কেয়ারলেস মেয়ে কোথাকার।খালি ভুল বুঝতে পারে আর সেই ভুলের উপর স্থির থাকাটা ওর স্বভাব’।মুগ্ধতা কোনো জবাব দিলো না তো কথা বললো।চুপচাপ শুনে গেলো সে।কিই বা বলার আছে তার।সত্যি আজ যদি ওরা না থাকতো বা সময়মতো উনি না পৌঁছাতেন তখন!আর ভাবতে পারলো না মুগ্ধতা মাথা পেতে সয়ে নিলো সবার সব অভিযোগ।
চলবে