#প্রণয়িনী
#মেহরীমা_তাসমীম
||পর্ব ০২||
ম্যাসেজ নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবনা চিন্তা করেও কোনো সুরাহা করতে পারলো না মুগ্ধতা।কে কেন কিসের জন্য পাঠালো মাথায় আসলো না।আবার সেই ছেলেটা ভাবলেও অবিশ্বাস্য লাগে কারণ যে ছেলেটা আজেবাজে ম্যাসেজ ছাড়া কোনো ম্যাসেজ দেয় না সে এখন দিচ্ছে ভাবতে ভাবতে কয়েক মুহূর্ত কাটিয়ে দিলো সে।অনেক্ক্ষণ ভেবে ‘কে আপনি’ লিখে সেন্ড করলো সেই নম্বরে।কিছুক্ষণ পর রিপ্লে আসলো,
‘আমি তো সেই আপনার নিকট রহস্যে ঘেরা কোনো এক প্রাণী’।
ম্যাসেজটা পেয়ে হা হয়ে গেলো মুগ্ধতা। লোকটা কে কোনোকিছুই বোধগম্য নয় তাঁর। আদৌও লোকটা কে ওই লোকটা নাকি অন্য কেউ এসব ভাবতে ভাবতে আর কোনো রিপ্লে দিলো না।ফিরতি ম্যাসেজ আসলো,
‘অত ভেবো না সাবালিকা প্রেয়ে পড়ে যাবে’।
ভাবনার অথৈ সাগরে পড়ে গেলো মুগ্ধতা।নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলতেও পারছে না।যদি ওই লোকটা না হয় তখন। কি করবে না ভেবে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলো সে।
—————–
বারান্দায় বসে কোলের উপর ল্যাবটপ নিয়ে কিসব কাজ করছে আদ্র সেসময় এক কাপ কফি হাতে ঘরে প্রবেশ করলো সুন্দরী এক রমনী।শর্ট টপস আর হাইহিল পড়ে এগিয়ে আসছে আদ্রর দিকে মুখে তার এক চিলতে হাসি।একদম সামনে দাঁড়িয়ে ও কোনো সাড়াশব্দ পেলো না তাঁর ।তাই নিজেই বললো,
‘তোমার জন্য কফি এনেছি আদ্র খেয়ে নাও’!আদ্র নিজের কাজে ব্যস্ত রইলো একটিবার ফিরেও তাকালো না সেই রমণীর পানে।ব্যাপারটায় মনঃক্ষুণ্ণ হলো তাঁর। তাতেও কিছু করার নেই কারণ সে জানে আদ্র কাটখোট্টা স্বভাবের। কখনও ওর দিকে মুগ্ধতা কিংবা ভালোবাসার নজরে তাকিয়ে দেখেনি।নিজে থেকে সামনে না আসলে কখনও খোঁজ খবর পর্যন্ত নেয় না।ওর বাগদওা হলেও দুজনের মধ্যে যোজন -যোজন দুরত্ব।অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো মেয়েটির।জানে ওর থেকে বেশি কিছু আশা করা উচিৎ নয় কিন্তু তবুও মনকে মানাতে পারে না সে।নিজের রাগ গুলোকে ধামাচাপা দিয়ে মিষ্টি হেসে বললো,
‘কেমন আছো তুমি’?
‘দেখছো তো তানিশা ভালো আছি। কাজ করছি ভালো না থাকলে এসব কিছুই করতে পারতাম না’।
এমন প্রতিওোরে বিষাদে ছেয়ে গেলো তানিশার মন।এত ভালোবাসার পরও তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহ্য হয়না তাঁর।যেখানে ওকে ভালোবাসা বিয়ে করার জন্য অনেকে পাগল সেখানে ও এমন একজনকে ভালোবাসে চায় যার কাছে তাঁর বিন্দু মাএ দাম নেই।মন খারাপের রেশ নিয়ে বললো,
‘আট দিন পর তোমার কাছে এলাম।তোমার জন্য নিজ হাতে কফি বানিয়ে আনলাম তাও একবার তাকালে না পর্যন্ত।কেন আদ্র এরকম উদাসীনতা কেবল আমার বেলায় কেন’?
এবার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো আদ্র।মেয়েটা বরাবরই সুন্দরী রূপবতী।মুখের হাসি সব কিছুই সুন্দর।যেই আকৃষ্ট হতে বাধ্য সেই রূপবতী মেয়েতে।পরিবারের সবাই তানিশাকে পছন্দ করে বউ করতে চায়।একমাএ ওর ছোর বোন আদ্রিতা বাদে।আদ্রিতা দু চেখে দেখতে পারেনা।আদ্র নিজেও ওকে বউ করতে চায় না।সকলের জোরজবরদস্তির কারণে বিয়েতে মত দিয়েছে।কথাবার্তা শেষ সামনের বছর বিয়ে হবে ওদের।কিন্তু এরমধ্যে তানিশার প্রতি কোনো টান নেই ও থাকলে যেমন কিছু যায় আসে না তেমনি না থাকলেও সমস্যা হয় না।এই ব্যাপারটা নিজেই বুঝে না সে।
‘দেখ তানিশা এই ব্যাপারে তোমাকে আগেই জানিয়েছি তুমি সব জেনেই বিয়েতে মত দিয়েছো।বলেছো আমাকে ভালোবাসতে হবে না।একদিন তুমি ঠিক আমায় জয় করবে তাহলে এখন এসব কোথা থেকে আসছে।কারো প্রতি যদি আমার ফিলিংস না আসে তাহলে আমি কি করব’।
তানিশার চোখ বন্ধ করে সবগুলো কথা শুনলো।যদিও উওরগুলো জানা তাঁর। কিন্তু তবুও নিজেকে মানাতে পারে না বিধায় রাগের বশবর্তী হয়ে বলে ফেলেছিলো।বিষয়টাকে এড়িয়ে যেতে বললো,
‘আগামীকাল একটু ঘুরতে নিয়ে যাবে আমায়’?ওর কাতর কন্ঠ টা ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছে করলো না আদ্রর।কিন্তু কিছু করার নেই।বললো,
‘কাল প্রোগ্রামে আমাকে এটেন্ড করতে হবে অনেক বিজি থাকবো সরি’।তানিশা চোখ বুজলো দুচোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরলো তাঁর ।পাথরে মাথা ঠুকে লাভ নেই তাই কোনো বাক্য ব্যয় না করে প্রস্থান করলো সে।আদ্র সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মনে মনে বললো,
‘আগুনে ঝাপ দিতে নেই জেনেও কেন আগুনে পুড়তে চাইছো তানিশা নিজেকে সামলাও’।
______________
সকালের ব্রেকফাস্ট রেডি করে সকলকে খেতে ডাকলেন বাড়ির দুই কর্তী মরিয়ম এবং ফারহানা বেগম।তাঁর পূর্বে এক দফা চা \কফি দিয়ে এসেছে আমিনা।সকলে হাজির ব্রেকফাস্ট টেবিলে কেবল আদ্রিতা আসে নি।ওর রোজকার অভ্যেস এটা।ঘুম থেকে দেরী করে উঠে তাড়াহুড়ো করে কলেজ যাওয়া।আরহাম খানের এক ছেলে আর এদক মেয়ে।আদ্র আর আদ্রিতা। অন্যদিকে আবিদ খানের দুই ছেলে কোনো মেয়ে নেই।সায়েম আর শিহাব।সকলের বড় আদ্র।ওদের খাওয়া দাওয়ার মধ্যে আদ্রের মা মরিয়ম বললেন,
‘তুমি নাকি তানিশার সাথে রুড বিহেভ করেছো?আমি বুঝিনা এত ভালো মেয়েটাকে নিয়ে তোমার এত সমস্যা কেন’?আদ্র কোনোকথা না বলে চুপচাপ খাচ্ছে ওর বাবা আরাম খান বললেন,
‘একটা সম্পর্কের সূচনা ঘটতে যাচ্ছে এখন এভাবে ওর সাথে ব্যবহার করতে পারো না।ওকে একটু টাইম দাও বুঝার চেষ্টা করো’।
‘সরি বাবা!এসব আমি পারছি না।আমি তো বলেছি এসব আমার দ্বারা হবে না।তাহলে তানিশা কেন রাজি হলো আর তোমরাই বা কেন জোর করছো বুঝতে পারছি না’।পাশ থেকে ওর দাদু বললেন,
‘ভালোবাসা জোর করে হয় না সেটা আমি জানি।একদিন না একদিন ও ঠিক তোমার মনে জায়গা করে নেবে’।
‘তাহলে সেই আশায় থাকো’।মাঝখানে সায়েম বললো,
‘ও মন জয় করতে করতে অন্য কেউ বিশ্বজয় করে চলে যাবে’।আদ্র চোখ গরম করে তাকাতেই চুপ করে গেলো সে।আদ্রিতা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো,
‘তাহলে সবথেকে খুশি হবো আমি। আল্লাহ ডাইনির হাত থেকে বাঁচাও আমায়’।ওর মা রেগে বললো
‘এটা কি হচ্ছে।মুখ বন্ধ করো।মেয়েটাকে কেন তোমরা ভাই-বোন দেখতে পারো না আমি বুঝি না’।
‘দেখার মতো হলে ঠিক দেখতাম’।আদ্র ঠোঁট চেপে হাসলো।ওর মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলো।
————-
কলেজ প্রাঙ্গনে বসে আছে দুই বান্ধবী। এখনও আফিফ আসে নি।আজ বাড়ি যেতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যাবে।কারণ আজ এই ভার্সিটিতে ফাংশন আছে।।সেই সুবাধে অনেক কাজ আছে সকলের।নতুন হওয়ায় খুব বেশি দায়িত্ব নেই মুগ্ধতা দের।আজকের প্রধান অতিথি এই ভার্সিটির প্রাক্তন ছাএ।
নয়না কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো প্রধান অতিথি কে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করার।কিন্তু শেষ সময়ে সে এসে পৌছায় নি।এদিকে গেস্টও এসে গেছে কিন্তু কাউকে পাচ্ছেন না তারা।রাগে কিড়মিড় করছেন প্রিন্সিপাল স্যার।তখন নজরে আসে মুগ্ধতা নামক মেয়েটিকে।পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো তারা।ওকে ডাক দেন তিনি।একটা ফুলের মালা হাতে ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে দেন স্টেজে।স্যারের কথা ফেলতে পারে নি তাই সেও দাঁড়িয়ে পড়লো সেখানে।স্যার পাশে এসে বললেন,
‘তোমার নাম টা যেনো কি’?
মুগ্ধতা আমতা আমতা করে বললো,
‘মুগ্ধতা জামান’।তিনি আবারও চলে গেলেন মাইকের সামনে গিয়ে নাম এনাউন্স করলেন তার এবং এখানে আসা অতিথির।অতিথি এসে সামনে দাঁড়ালে মুগ্ধতা কে ইশারা করলেন স্যার।মুগ্ধতা মুখে হাসি ফুটিয়ে গলায় মালা দিয়ে উনার দিকে তাকাতেই অবাক বিস্মিত সে।সেদিনের সেই লম্পট ছেলেটি।মুহূর্তেই মুখয়বের পরিবর্তন ঘটলো তাঁর।দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলো।অন্য দিকে আদ্র ওর দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।এবং বসতে যাওয়ার সময় কানে কানে বলে,
‘যাকে জুতো পেটা করতে চাইলেন আজ তাকে ফুলের মালা পরালেন এর মানে কি জানেন?হাহ!একেই বলে রাজ কপাল’।
মুগ্ধতা রেগে মেগে তাকালো ততক্ষণে বসে পরেছে সে।স্টেজ থেকে দ্রুত গতিতে নেমে প্রিয়াকে খুঁজতে লাগলো।
—————–
আনমনে হাঁটছে প্রিয়া।এদিক সেদিক দেখছে সে।মুগ্ধতা আসলে দুজনে কোথাও বসে পরবে।তখন কানে আসলো কারো কন্ঠধ্বনি,
‘এই যে মিস বিয়ে পাগলি?কাউকে খুঁজছেন নাকি’?
পেছন ঘুরে তাকালো প্রিয়া।পেছনে ইয়াং শ্যামলা রঙের ছেলে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কপাল কুঁচকে বললো,
‘কিছু বললেন আপনি’?ছেলেটা হাসলো হেসে বললো,
‘আশে পাশে কেউ নেই মনে হয় আপনাকে বলেছি না ডেকেছি’।কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
‘আমার নাম প্রিয়া সো ওই নামে ডাকবেন।কি যেন আজেবাজে নামে ডাকছিলেন ওসব নামে ডাকবেন না’।
‘সরি!আমি পারব না।বিয়ে পাগলি কে বিয়ে পাগলি ছাড়া কিচ্ছু ডাকতে পারবো না’।
‘আশ্চর্য আমি কখন বিয়ের জন্য পাগলামি করলাম’?
‘হাহ!বিয়ের জন্য সারা ভার্সিটি লাফিয়ে এখন বলছে ‘আমি কখন লাফালাম’।তাহলে সেদিন বিয়ে জামাই সংসার এসব নিয়ে কে কথা বলেছিলো’?
প্রিয়া ভ্রু ভাজ করে সেদিনের ঘটনা মনে পরতেই এক রাশ লজ্জা আড়ষ্টতা জড়িয়ে ধরলো তাঁকে।ইশ!কি বিচ্ছিরি ব্যাপার।নত মস্তকে দাঁড়িয়ে হিসেব মিলালো তাহলে সেই অচেনা ছেলেটি এ ছিলো ভাবতেই ছেলেটি ওর ভাবনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বললো,
‘হাই!আমি রাফসান আহমেদ।পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছি’।প্রিয়া শুধু মুখ থেকে ‘ও’ শব্দটা বের করে দ্রুত প্রস্থান করলো সেখান হতে।ব্যাপারটায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো রাফসান।
————-
প্রিয়াকে খুঁজে খুঁজে হয়রান মুগ্ধতা কিন্তু কোথাও হদিস নেই তার।ফোনও তুলছে না।ব্যাপারটায় চরম বিরক্ত সে।হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত।বারবার বসার জন্য স্যার বকা দিচ্ছেন কিন্তু সে যাবে না এখন সোজা বাড়ি যাবে।এত খারাপ লোকের প্রোগ্রাম সে দেখবে না।আসলে মুখোশের আড়ালের কুৎসিত মানুষকে সবাই চিনতে পারে না।ওই তো মাইক হাতে নিয়ে ওর সফলতা আর সততার বক্তৃতা দিচ্ছেন স্যার কিন্তু লোকটা কতটা ঘৃণ্য সেটা ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারছেন না তিনি।হাঁটতে হাঁটতে একটা ফাঁকা ক্লাস রুমে বসলো সে।প্রিয়া ও আফিফকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে এখানে আছে বলে বসে রইলো ।কিচ্ছু ভালো লাগছে না।কিচ্ছু না।ফিরতি বার্তা পেয়ে ফোনের স্কিনে চোখ বুলালো সে।
‘ওগো প্রণয়িনী প্রাণ নাশিনী কোথায় তুমি’?
‘তোমাকে খুঁজে হয়রান অস্থির এই আমি’!
ম্যাসেজটায় বেজায় বিরক্ত সে।এই লোকটা কে কোথা থেকে উদয় হলো কে জানে।পুরো মাথা নষ্ট করে দিচ্ছে।ওর ভাবনার মাঝেই হঠাৎ রুমের দরজা বন্ধ হয়ে গেলো।সকল জানালা বন্ধ বিধায় সাথে সাথে রুমটা অন্ধকার হয়ে গেলো।উঠে দাড়িয়ে তাড়াতাড়ি ফ্ল্যাশ অন করতে যাবে তাঁর আগেই খপ করে কেউ ওর হাত ধরে ফেলে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়।ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে মুগ্ধতা।কথা বলার শক্তি হারিয়ে যাচ্ছে তাঁর।অজানা আশংকা আতঙ্কে কুঁকড়ে আছে।কারো ভারী নিঃশ্বাস আছড়ে পরছে ওর কাঁধে।লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে গিয়েও সরাতে পারলো না। এলোপাতাড়ি কিল খুশি কোনোকিছুতেই কিছু করতে পারলো না। রাগে দুঃখে অপমানে ভয়ে কান্না পেলো তাঁর।কাঁদতে কাঁদতে বললো,
‘কে আপনি এরকম করছেন কেন?প্লিজ ছেড়ে দিন আমায়’!ওর ভয়কে আরেকটু বাড়িয়ে লোকটার বুক থেকে মাথা তুলে ওর মুখ নিজের দু’হাতের মুঠোয় ভরে ওষ্ঠ যুগল এগিয়ে নিলো ওর দিকে।চোখ খিঁচে রইলো সে একদম কাছাকাছি নিঃশ্বাস পড়ায় ঘাবড়ে গেলো কি হতে চলেছে বুঝতে পেরে মাথাটা খানিক পিছিয়ে নিলো লোকটা আড়ালে হাসলো।যেই হাসির কোনো শব্দ নেই।চোখের অলক্ষ্যে রইলো সেই হাসি।
চলবে