প্রণয়িনী পর্ব-০১

0
1384

#প্রণয়িনী
|#মেহরীমা_তাসমীম
||পর্ব ০১||

জনসম্মুখে একটি মেয়ে আয়ান খান আদ্রকে জুতো পেটা করেছে।মেয়েটির দাবি আয়ান খান তাকে বেশ ক’দিন ধরে ১৮+ম্যাসেজ এবং আজ সরাসরি ডেকে এনে তার সেক্রেটরিকে দিয়ে কু প্রস্তাব দিয়েছে।সেজন্য সে এহেন আচরণ করেছে।পর পর বার কয়েক একই কথা গুলোর পুনরাবৃত্তি করে মুচকি হাসছে সায়েম।অন্যদিকে চেয়ারে বসে ওর দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে রয়েছে আদ্র।সেটা দেখে ভীত না হয়ে এক নাগাড়ে হেসে চলেছে সে।রাগে চোখ বন্ধ করে সকালের ঘটনাটি মনে করতে থাকে আদ্র।

সকাল বেলা অফিস থেকে একটি মিটিং যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যায় আদ্র এবং সায়েম।ক্লাইন্ট না আসায় গাড়িতে বসে কারো সাথে ফোনে কথা বলছিল আদ্র।তখন খেয়াল হয় লাল থ্রি পিস পরিহিতা একটি মেয়ে ওদের দিকে তেড়ে আসছে।সেটা দেখে সায়েম রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকায় ওর সামনে দাঁড়ায় এবং তাকে জিজ্ঞেস করলে সে রাগে সব বলে।কথাগুলো শুনে সায়েম যেনো বিস্মিত হয়।একবার পেছনে ভাইয়ের দিকে তাকায় আরেকবার মেয়েটির দিকে।মেয়েটির উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রং।হাইটও মোটামুটি খাটোও না আবার লম্বা না।।এদিকে আয়ান গাড়িতে বসে কিছুই শুনছে না।সায়েম কে পার করে সামনে এগোয় মেয়েটি।সায়েম আটকাতে গিয়ে পারে না।আদ্রর সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ির কাঁচ নামাতে বলে সে।কিন্তু আদ্র শুনতে পায় না তবুও গ্লাস নামায় সে।এবং কিছু বুঝে উঠার আগে মেয়েটির কর্কশ কন্ঠের কয়েকটি কথা কানে আসে।মেয়েটি বলে,

‘ দেখে ত বড় লোক আর ভদ্রলোকের পোশাকে ভদ্রলোক মনে হচ্ছে।গাড়ির ভিতর কি ইনোসেন্ট সাহেব সেজে বসে রয়েছেন।ওহ বুঝে গেছি বড় লোক বাবার বখে যাওয়া সন্তান নির্ঘাত তাই এসব কুকর্ম করে বেড়াচ্ছেন।এই শোন আজকের পর যদি এসব আবার করিস তাহলে চাপকে তোকে সিধে করে দেবো’।আঙ্গুল উঁচিয়ে কথাগুলো বলে থামে মেয়েটি।আদ্র হতভম্ব হয়ে বসে রইলো।সায়েমের মুখের দিকে তাকিয়ে অভিব্যাক্তি বুঝার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সে।সায়েম বুঝে নি ইশারায় বুঝিয়ে দিলো।একসময় আদ্র বলে,

‘এই যে মিস আমাদের উপর একরকম হামলা করছেন কেন?সায়েম কিছু করেছে?করলে সরাসরি বলুন প্লিজ।আপনার বিহেভিয়ারে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না আমার’।কথাটা শোনামাত্র ফুঁসে উঠলো মেয়েটি।আদ্রর দিকে পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করে কটাক্ষ করে বলল,

‘ও বাবা এ তো দেখছি সাধু দরবেশ বাবা।নিজে কুকর্ম করে এখন এই ভোলা ভালা ছেলেটার উপর দোষ চাপাচ্ছে।ওই শোন এ কিছু করে নি।তুই করেছিস’।মাঝখান থেকে সায়েম বলল,

‘ম্যাডাম ভুল হচ্ছে কোথাও উনি এসব করবেন না।সেইরকম মানুষই নন তিনি’। এতক্ষণে এটা স্পষ্ট মেয়েটা কোনো কিছুর জন্য আদ্রকে ব্লেইম করছে তাই গলা ঝেড়ে শান্ত সুরে বলল,

‘এই যে মিস কখন থেকে অনেক কিছু বলে যাচ্ছেন। কিন্তু আসল রিজন টাই জানি না।এবার বলুন কিসের উপর ভিওি করে এতসব কথা বলছেন।কি করেছি আমি’। মেয়েটা বিরক্তি নিয়ে চ জাতীয় কিছু উচ্চারণ করে বলল,

‘রোজ দিন রাত ২৪ ঘন্টায় আপনি আমায় যাচ্ছে তাই ম্যাসেজ দিচ্ছেন।সবগুলো ম্যাসেজে বাজে ইঙ্গিত করছেন।আজ ত নিজের সেক্রেটরিকে দিয়ে সরাসরি কু প্রস্তাব পাঠালেন আর এখন সব ভুলে গেলেন।বলি আপনার ঘরে মা বোন নাই’।

সকাল সকাল মেয়েটার বকবকানি আর মিথ্যা অপবাদে মাথা ধরে গেলো আদ্রর।তাছাড়া কথাবার্তা শুনে অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলল,

‘দেখুন আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে আমি কেন আপনাকে এসব পাঠাতে যাবো তাছাড়া আমি আপনাকে এর আগে কখনও দেখিও নি নাম্বারও নেই’।মেয়েটা রাগে টগবগ করতে করতে বলল,

‘ওহ রিয়েলি এখন একদম দুধে ধোয়া তুলসী পাতা।চিটার বাজে খারাপ ছেলে।মেয়েদের সাথে এসব করতে খুব মজা লাগে অসভ্য ইতর কোথাকার’।নিজের নামে এতগুলো বাজে কথা শুনো ক্ষেপে গেলো সে।দাঁতে দাঁত ঘষে প্রতিওোরে বলল,

‘এই মেয়ে চুপ করো। মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছ।না জেনে এভাবে কাউকে ব্লেইম করো না।’

মেয়েটি যেন আরও তেঁতে উঠলো কিছু বলতে যাওয়ার আগে সায়েম বলল,

প্লিজ আপু সত্যি বলছি উনি এসব করেন নি।আর উনার সেক্রেটরি কোথায় পাবেন।উনি তো সবে’।কথাটা আর পূর্ণ করতে দিল না সে।চোখ গরম করে তাকালো সায়েমের দিকে।ওর চোখের দিকে তাকিয়ে চুপসে গেলো সে।আদ্র রাগে গজগজ করে মেয়েটার দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

‘সায়েম গাড়ি স্টার্ট দে আমি সিওর এই মেয়ের মাথায় প্রবলেম আছে।এর উদ্দেশ্য হয়তো আমাকে ফাঁসিয়ে কিছু টাকা আদায় করা।ধান্দা বাজ মেয়ে এদের আমি হারে হারে চিনি’!

মুহূর্তেই মেয়েটা রেগে বোম হয়ে গেলো।পায়ের জুতো হাতে নিয়ে তেড়ে গেলো আদ্রর দিকে।মেয়েটার সাহস দেখে হতবাক অবাক সায়েম।আদ্র নিজেও বিস্মিত।সায়েম নিজের অবাকত্বকে সাইডে রেখে দৌড়ে মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে অনুনয় করে বলল,

‘সত্যি ম্যাডাম উনি এমন নন।পাবলিক প্লেসে এভাবে উনার মান সম্মানের ফেলুদা বানাবেন না।প্লিজ হাত জোর করছি’।সায়েমের কথায় হাত থেকে জুতো ফেলে দিলো মেয়েটি।আদ্র চোয়াল ঝুলিয়ে বসে আসছে।একটু আগে কি হচ্ছিলো সেই ভাবনায় ভগ্ন সে।নিজের ভাবনার ইতি ঘটিয়ে গাড়ি থেকে নামতে চাইলে সায়েম লক করে দেয়।কিছুতেই বাইরে বেরুতে পারে না।সায়েমের উপর রাগ ঝারলে ধমকিয়েও কাজে দেয় না।অনেক অনুনয় মাফ চেয়ে মেয়েটিকে বিদায় করে সে।শেষ বারের মতো ওয়ার্নিং দিতে ভুলে না মেয়েটি।আদ্র দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নেয়।তাছাড়া মেয়ে বলে ছাড় পায় নইলে এইরকম দুঃসাহসিকতা দেখানোর জন্য ওর কলিজ্বাটা বের করে আনতো সে।

সকালের ভাবনা শেষ করে সায়েমের দিকে তাকাতেই মুখের হাসি উবে যায় তার।করুন চোখে তাকায় ভাইয়ের দিকে।সেসবের তোয়াক্কা না করে আদ্র বলে উঠে,

‘খুব মজা পাচ্ছিস তাই না।আমাকে একটা অচেনা মেয়ে রাস্তায় এতটা অপমান করেছে সেটা নিয়ে হাসি তামাশা করছিস।জোকার মনে হচ্ছে আমায়।আরে আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছিস পারছিস না।উল্টে আমাকে লক করে ঐ মেয়েকে এমনি এমনি যেতে দিলি ‘।

সায়েম চুপসে গেলো।আসলেই মেয়েটার বিহেভিয়ার খুবই বাজে আর বিশ্রী ছিলো।না জেনে না বুঝে কত অপমান করলো।শেষ পর্যন্ত জুতো হাতে নিলো।ছিহ!মুখভার করে বলল,’ভাই বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা টা।ব্যাপারটা খুবই সহজ মেয়েটা ভুল বুঝে তোমাকে এসব বলেছে।হয়ত কার্লপিট অন্যকেউ সে জায়গায় ভুক্তভোগী তুমি।পরে বুঝবে আর ওখানে কথা বাড়ালে আরও বড় কিছু করতে পারতো সেই ভয়ে আমি’।

‘সে যাইহোক বুঝে হোক বা না বুঝে মেয়েটা আমায় অপমান করেছে।ওর ফোন নাম্বার নাম ঠিকানা সব বের কর।ভুল এলিগেশনে আমাকে শাসিয়েছে এবার না হয় সেই ভুল কাজটাই করব।এরপর বুঝবে আদ্রকে অপমান করার মজা’।

‘আচ্ছা ভাই’।
_________
একরাশ বিরক্তি নিয়ে ভার্সিটি গেইটে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে ।বারকয়েক হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিরক্তকর চাহনি নিক্ষেপ করছে রাস্তায়।মেয়েটির নাম মুগ্ধতা জামান।দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে ছোট সে।আজ তার অনার্স প্রথম বর্ষের ফার্স্ট ক্লাস।ভিতরে একা যেতে সংকোচ আর অস্বস্তি হচ্ছে বিধায় ফ্রেন্ড সার্কেলের জন্য দাঁড়িয়ে আছে।।কিন্তু অনেক্ক্ষণ হলো দেখা নাই কারোর।আবারও তাকাতেই সবকয়টাকে নজরে এলো দাঁত বের করে এগিয়ে আসছে তার দিকে।ওদের দেখে তেড়ে কিল ঘুষি দুচারটা বসিয়ে দিলো।ওরা একেকজন হাসতে হাসতে সরি বলে ওর সাথে ভাব করে নিলো।

ক্লাস শেষে বেরুতেই প্রিয়া বিরক্ত নিয়ে বলল,
‘ধুর এসব আর ভালো লাগছে না।খালি প্যারা আর প্যারা।কত আশা নিয়া ইন্টার শেষ করলাম বাপ মায় বিয়া দিব। তা না করে আবার চার বছরের জন্য পড়ার সাথে হান্দাইয়া দিলো জীবনটা তেজপাতা’।সবকয়টা অবাকত্ব নিয়ে ওর দিকে তাকালো। প্রিয়ার মাথায় চাটি দিয়ে আফিফ বলল,

‘তোর এই বিয়ার স্বপ্ন আজীবন অপূর্ণই রয়ে যাবে দেখিস।জীবনেও বিয়ে হবে না’।

তেড়ে উঠে আফিফকে বলল,

বদ দোয়া দিবি না।বিয়া ছাড়া ভাল লাগে না।বিয়া তো হইবই হইব তুই দেখিস’।

মুগ্ধতা প্রিয়াকে কিছু বলতে নেবে তার আগে পেছনে গলা খাকড়ি পেয়ে সকলে পেছনে তাকালো।ওদের সকলের চোখকে উপেক্ষা করে প্রিয়ার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কেউ বলল,

‘এত বিয়ে পাগল যখন বিয়েটা করে নিলেই পারেন।তাহলে ভার্সিটি এসে বিয়ে নিয়ে হা হুতাশ করতে হবে না মিস বিয়ে পাগলী’।কথাটা কর্ণগোচর হতেই তড়িৎ গতিতে ছেলেটার পানে তাকালো প্রিয়া ততক্ষণে ছেলেটা দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেছে।অচেনা ছেলেটি কথাটা যেনো পুরো বোম ফাটলো।সকলে অট্রহাসিতে ফেটে পড়ল।রিয়াদ হাসতে হাসতে বলল,

‘দেখছত খালি আমরা না সবাই তোরে বিয়া পাগলী কয়।আজকেও মাফ নাই অচেনা মানুষও তোরে একবার দেইক্কাই কইয়া দিলো।আসলে তোকে দেখলেই বিয়া পাগল লাগে।তোর চেহারায় একটা জামাই পাগল জামাই পাগল ভাব আছে’।
হু হা করে হাসতে লাগলো সকলে।প্রিয়া ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো রিয়াদকে তাড়া করে তার আগেই উধাও সে।

————–
সন্ধ্যায় মায়ের সাথে টুকটাক কথা বলছে আর বসে বসে চা খাচ্ছে মুগ্ধতা । ম্যাসেজের শব্দে ফোনের স্কিনে তাকাল সে।গত দুদিন ধরে শান্তিতে আছে।সেদিন কড়া কথা শোনানোর পর ফোনে কোনো ম্যাসেজ আসে নি এখনো।সেজন্য খুব শান্তিতে ছিলো।কিন্তু আজ আবার।ম্যাসেজ চেক করতেই দেখলো সেই ছেলেটির নাম্বার নয় বরং ভিন্ন নাম্বার থেকে পাঠানো। ক্ষুদে বার্তাটি ছিল,

‘ওগো প্রণয়নী!দিন শেষে তুমি আমারই রমনী’।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে