প্রণয়িনীর হৃদয়কোণে পর্ব-৯+১০

0
1868

#প্রণয়িনীর_হৃদয়কোণে
#আফসানা_মিমি
| নবম পর্ব |
❌ কোনভাবেই কপি করা যাবে না।❌

” ভাই সাহেব, আজকের মতো তুবাকে ক্ষমা করে দেন।”

আমার প্রিয় বন্ধু সুন্দরী আন্টি উরফে সাদা কইতরের মা। তিনিই এখন আমার পক্ষে। আমাদের বাড়িতে বিচার বসেছে। দোষী অবশ্যই ভোলা ভালা আমি। বিচারকের দায়িত্বে আমার বাবা, ভাই, আর সুন্দরী আন্টি। নেংটি কইতর ও সাদা কইতরও আছে। নেংটি কইতর মনের সুখে গেমস খেলছে আর সাদা কইতর আমার বিচার করার জন্য বেত আনতে গিয়েছে।

ছলছল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছি। আজ বাবা প্রচন্ড রেগে আছে। আজ মনে হচ্ছে রক্ষে নাই। সব দোষ সাদা কইতরের। ইচ্ছে করেই আমাকে ফাসিয়েছে। নিজে শাস্তি দিলেও তো পারতো। বাবা ভাইয়াকে বলতে গেল কেন? প্রচন্ড কান্না আসছে। আমাকে কেউ ভালবাসে না, কেউ আমাকে আদর করে না। সবাই আমার শত্রু।

” এই যে লাঠি আঙ্কেল! আজ এমনভাবে মারবেন যেন আর জীবনেও রাত বিরাতে মিথ্যা বলে বাহিরে না বের হতে পারে। ভাবতে পারছেন আঙ্কেল! এখনই মেয়ের এই অবস্থা, পরবর্তীতে না জানি আর কি কি করে!”

এবার সত্যিই কান্না করে দিব। এরা সব জোট বেঁধে আমাকে শায়েস্তা করতে এসেছে। বাবার স্বর কানে আসে,
” মিথ্যা বলেছিলে কেন?”
” বাবা,,,,,,

ছলছল চোখ, স্বর গলায় আটকে, নাক টানছি। বাবার দিকে ফিরে তাকালাম। বাবার পিছনে সাদা কইতরের দিকে চোখ গেল। সাদা কইতর খুব খুশি। খুশিতে হাত পা ঝেড়ে নাচতেছে ঠিক হিন্দি সিনেমার নায়কদের মতো।
” কথা বলছো না কেন?”

বাবার ধমকে এবার উচ্চশব্দে কেঁদে ফেললাম। সাদা কইতরের মা এসে পরম আদরে জড়িয়ে ধরলেন।
” হয়েছে ভাইজান। বাচ্চা মেয়েটাকে আর বকবেন না। মেয়েটা কান্না করছে।”

” দুষ্টুমি করুক সমস্যা নেই। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত দুষ্টুমি করা আদৌও ঠিক?”

” হয়েছে ভাইজান। তুবারাণীর বেড়াতে ইচ্ছে করছে। আপনারা বাবা ছেলে মেশিন হতে পারেন। আমার মেয়েটা না।”

সাদা কইতরের মায়ের কথা শুনে আমি সহ সবাই অবাক হয়ে যায়। সাদা কইতর দুষ্টুমি ছেড়ে বলে,
” তোমার মেয়ে মানে?”

আমি দেখতে পেলাম সাদা কইতরের মা থতমত খেয়ে গেলেন। নিজেকে কিছুটা সংশোধন করে পুনরায় বললেন,

” বেশি বকিস কেন?”

সাদা কইতরের মুখ একটুখানি হয়ে গেল। মায়ের বকুন খেয়েছে বলে। কান্নার মধ্যেও আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সুন্দরী আন্টির বুকে থেকে মুখ তুলে সাদা কইতরকে ভেংচি কাটলাম। তখনই সাদা কইতরের মা আবারো বললেন,

” আজ থেকে আগামী এক মাস তুবা আমাদের বাসায় থাকবে। আপনি আপত্তি করবেন না। মেয়েকে ইচ্ছে হলে রাস্তা পার হয়ে দেখে আসবেন। এছাড়া আপনারা তো কাজের জন্য বাহিরে থাকেন। মেয়েটা একা একা বাসায় থেকে বিরক্ত হয়ে যায়। এজন্যই তো অতিরিক্ত দুষ্টুমি করে। আশা করছি আমার আবদার আপনি রাখবেন।”

সকলের মুখ হাঁ হইয়ে আছে। ঐ যে টেলিভিশনে যেমন দেখায় ঠিক তেমন। নেংটি কইতর গেম খেলা বাদ দিয়ে মোবাইল ছুড়ে মেরে মাথায় হাত রেখে বলল,

” সর্বনাশ হয়ে গেছে।”

সাদা কইতরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছি না। সাদা কইতরও অবাক। ভাবভঙ্গি বুঝা মুশকিল। এদিকে বাবা আর ভাইয়ার মুখ চিন্তিত। তখনই ভাইয়ার করুণ স্বর শোনা যায়।

” আমরা বোনুকে ছেড়ে কখনো একা থাকিনি। আপনার সাথে কীভাবে!”

” আরে বাড়ির পাশেই তো থাকবে। গিয়ে দেখে আসবে, সমস্যা কি?”

এদিকে সাদা কইতরের দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে বিড়বিড় করে বললাম,

” এবার তোমার রক্ষা নাই,
তুবার চোখে ঘুম নাই।
বসে থাকবে নির্ঘুমে
তুবা থাকবে আরামে।
ডাকবে তুমি ও আব্বা গোওওওও,
আমি বলব,
এবার বুঝো কি মজা গোওওওও!

দীর্ঘ এক ঘন্টার কথা কাটাকাটির শেষে রাতের বারোটায় আমাকে নিয়ে সাদা কইতরের মা বাসায় ফিরে আসেন। সুন্দরী আন্টি আমাকে ঠিক সাদা কইতর এবং নেংটি কইতরের মাঝ বরাবর ঘর দিলেন। সাদা কইতর, নেংটি কইতর চুপচাপ নিজ ঘরে চলে যায়।

গভীর রাত। পুরো পৃথিবীর মানুষ ঘুমে বিভোর কিন্তু অভ্যাস মোতাবেক আমার চোখে ঘুম নেই। আমার হাত, পা চুলকাচ্ছে সাদা কইতর এবং নেংটি কইতরকে জ্বালাতন করার জন্য। এই দুজনকে কীভাবে জ্বালাতন করব তাই ভাবছি। অবশেষে মাথায় একটি জম্পেশ আইডিয়া চলে আসলো। ঘর থেকে চুপি চুপি বের হয়ে উঁকি দিয়ে চেক করে দেখলাম কেউ আছে কিনা। নাহ! কেউ নেই। এখন আমি আমার নিজের কাজ করতে পারব। নিচে গিয়ে ফ্রিজ খুলে দেখতে পেলাম পায়েসের বাটি এবং কিছু মিষ্টান্ন রয়েছে। সেগুলো দুই হাতে নিয়ে চলে আসলাম নেংটি কইতরের ঘরে। নেংটি কইতর ছোট মানুষ বিধায় ঘর সর্বদা খোলাই থাকে। আমার জন্য সহজ হল। সাদা কইতরের মায়ের কাছ থেকে শুনেছি উনার দুই ছেলে দুই রকমের, একজনের মিষ্টি পছন্দ অপরজনের টক। নেংটি কইতরের নাকের সামনে যদি মিষ্টির ধরা হয় তাহলে সেটার ঘ্রাণ শুঁকে চোখ বন্ধ করেই খাওয়া শুরু করবে। এছাড়া যতোই ঘুমে থাকুক না কেন ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে যায় মিষ্টি খাওয়ার জন্য। বিষয়টা পরীক্ষা করার দরকার। একটা মিষ্টি নিয়ে নেংটি কইতরের নাকের সামনে ধরলাম। ও মা! নেংটি কইতর নড়াচড়া করছে। কিছুক্ষণ পর চোখ বন্ধ করা অবস্থায়ই উঠে বসে আমার হাত থেকে মিষ্টি নিয়ে গপাগপ খাওয়া শুরু করেছে।

” আরো চাই। মা, আরো মিষ্টি চাই।”

ইশশশ মিষ্টি চাই। বললেই হলো! নেংটি কইতরের সামনে কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ধমক দিলাম,

” ওরে খাদকের বাচ্চা খাদক। আমি এখানে এসেছি তোর সাথে কিছু কথা আলোচনা করতে আর তুই এখানে বসে বসে খাচ্ছিস।!”

বেচারা ঘুমের ঘোরে তখন মুষ্টির স্তুবে হাবুডুবু খাচ্ছিল। আমার ধমকে ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে যায়। আমার দিকে পিটবিট চোখে তাকিয়ে বলে,

” শুরু হয়েছে। এবার আর শান্তি পাব না। বলো কি করতে হবে।”

আমার মুখে শয়তানের হাসি ফুটে উঠলো। সাদা কইতর আমার সাথে এত বড় একটা তান্ডব করেছে আর আমি প্রতিশোধ নিবো না! তা তো হয় না।

” তোমার ভাইয়ের এলার্জি কোন জিনিসে?”

আমার প্রশ্নে নেংটি কইতর একটু একটু বিরক্ত হল। দুই হাত বুকে গুঁজে মুখ ভোঁতা করে বলল,

“তুমি।”
” কি বললে?”

” আমার ভাইয়ের এলার্জির প্রধান কারণ হচ্ছে তুমি। তুমি যতক্ষন ভাইয়ের আশেপাশে থাকো ভাইয়া এলার্জির মত ফুলতে থাকে।”

নেংটি কইতরের কথা শুনে ভীষণ রাগ হল। মাথায় একটা চাট্টা মেরে বললাম,
” তুই ঘুমা হাদারাম গাধা। বড়ো ভাই যেমন তুইও ঠিক তেমন।”

নেংটি কইতরের ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। বিচ্ছুটার থেকে কোন কথাই আদায় করতে পারলাম না। ভাবতে থাকলাম সাদা কইতরকে কীভাবে হেনস্থা করা যায়। ব্যাস আইডিয়া পেয়ে গেলাম! এখন তো গভীর রাত। সবাই ঘুমে মগ্ন। সাদা কইতর না ঘুমিয়ে ডান্স করছে না, অবশ্যই ঘুমাচ্ছে। নিজের ঘরে চলে গেলাম। প্রয়োজনে জিনিসপত্র নিয়ে এসে এবার সাদা কইতরে ঘরে ঢুকলাম।
ডান হাতের উপর মাথা রেখে বাম হাত বালিশের উপর রেখে ঘুমাচ্ছে। ইশ কি সুন্দর দেখাচ্ছে আমার সাদা কইতরকে। আমার সাদা কইতর না! একদম ধবধবে সাদা। শরীরে আচর দিলেই লাল,নীল হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ বসে থেকে সাদা কইতরকে মনোযোগ সহকারে দেখলাম আর আফসোস করতে লাগলাম। সাদা কইতর যদি ভালো মানুষ হতো, আমার সাথে টক্কর না দিতো, আমাকে শাস্তি না দিতো তাহলে একেই জামাই বানাতাম কিন্তু আমি তো এখন সাদা বিলাকে পছন্দ করি না। সাদা কইতর আমার প্রথম শত্রু। আর শত্রু কখনো মিত্র হতে পারে না। কস্মিনকালেও না।
যাইহোক এত কথা ভেবে কাজ নেই। নিজের কাজ সম্পন্ন করে চুপিচুপি ঘরে চলে আসলাম। এবার শান্তিতে ঘুম দিব। অপেক্ষা করব সারাক্ষণ সকালের বিনোদনের।
——————–

সকাল ছয়টা বাজে। এবাড়ির মানুষেরা এত কীভাবে ঘুমায় কে জানে? একটি পাতলা হুডি ওয়ালা গেঞ্জি পরিধান করে নিয়েছি। দিন দুপুরে চোর ডাকাতের ভয় অনেক আছে। আপনাকে কোন দিক থেকে কীভাবে আক্রমণ করে ফেলবে বুঝতেই পারবেন না! চুপি চুপি সকলের অগোচরে সাদা কইতরদের ছাদে চলে আসলাম। আহ! কী সুন্দর ছাদ! আমার কত দিনের ইচ্ছে ছিল সাদা কইতরদের ছাদে নাচার! আশেপাশে ভালোভাবে লক্ষ্য করে একটা নির্দিষ্ট স্থানে এসে ধুমধাম নাচতে শুরু করলাম। আমার নাচ দেখলে নৃত্যশিল্পীরাও হিংসে করবে। নাচ এবং ব্যায়ামকে একসাথে মিশিয়ে বেনাচ বানিয়ে ফেলেছি। গতকাল রাতেই জুতার বক্স লক্ষ্য করেছিলাম। সেখান থেকে শক্ত একজোড়া বুট জুতা নিয়ে লাফাচ্ছি আর গান গাইছি,

” তুমি জাগাইয়া গেলা তুবার দুষ্টুমি,
সহ্য করবা কিবাআআআআআআ।।”

কান খাড়া করে শুনতে পেলাম, নিচে কেউ চিৎকার চেঁচামেচি করছে। আমি জানি মানুষটা কে! মুখ হাত দিয়ে দুষ্টু হাসছি। এবার বুঝো মজা।
ধপাধপ পা ফেলে নেংটি কইতর ছাদে এসে উপস্থিত হয়। বেচারা হাঁপাচ্ছে। চোখ ফুলে আছে হয়তো চেঁচামেচি শুষে বেচারা লাফ দিয়ে উঠে পড়েছে!

” কি করেছো? বাবা তোমাকে ডাকছে।”

কাম সারছে! পেট মোটা আনারস আঙ্কেল আমাকে ডাকছে। আজকে রক্ষা নাই। আমার তো সাদা কইতরের থেকে পেট মোটা আনারস আঙ্কেলকে বেশি ভয় করে। কথায় কথায় রেগে যায় আর বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। আজব মানুষ। পা টিপে টিপে নিচে নেমে আসলাম। তখনই সাদা কইতরের স্বর শুনতে পেলাম,

” তো মহারানী এসেছে। মা দেখো আয়মান আমার কি অবস্থা করেছে।”

সাদা কইতর এতক্ষণ পিছনে ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার আভাস পেয়ে সে এবার সামনে ফিরে তাকায়, নিশ্চুপ পরিবেশ, সকলেই নীরব। একে অপরের মুখে তাকিয়ে সকলে একসাথে হাসা শুরু করলাম। হে হি হু হা করে যেভাবে পারছে হাসছে। পেট মোটা আনারস আঙ্কেল হাসতে হাসতে পেট চেপে ধরেছে এই ভয়ে না জানি ঐ পাঁচ শেরা পেটের ভেতর থেকে সব বের হয়ে আসে।
এদিকে সুন্দরী আন্টি কপাল চাপড়াচ্ছেন। নেংটি কইতর সোফার উপর দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে ঝুলে পড়ছে। আমি ভদ্র বাচ্চার মতো মুখে চেপে হাসছি। আমাদের সকলকে একসাথে হাসতে দেখে সাদা কইতর আরো বেশি রেগে যায়। চিৎকার করে সবাইকে চুপ করতে বলে। আমরাও চুপ হয়ে যাই।

মূলত সাদা কইতরের মুখে আমি কিছু একটা লিখে এসেছিলাম। সেটা হচ্ছে, কপালে লিখেছি ‘আমি’ বামগাল লিখেছি, ‘ চুরি’ ডান গালে লিখেছি ‘করেছি’ যার পরিপূর্ণ অর্থ হচ্ছে ‘আমি চুরি করেছি।’

নেংটি কইতর এবার বলেই ফেলল,
“ভাইয়া, তুমি কি চুরি করেছো?”

সাদা কইতর ভয়ংকর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। সাথে সাথে আমার হাসিমাখা মুখখানা চুপসে যায়। সাদা কইতর এক পা দু পা করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। এদিকে আমি পিছিয়ে যাচ্ছি। সুযোগ পেলেই দৌড় দিব। ভাগ্য ভাল ছিল। সুযোগ পেয়েই, ‘ও বাবা রে’ বলে ভোঁ দৌড়ে লাগালাম। আমার সাথে সাথে সাদা কইতরও দৌঁড়ে বলছে,

” আজ তুমি কোথায় পালাবে, জানেমান!”
এমনভাবে বলছে যেন আভি তার প্রেমিকা লাগি। আমি তো জানি আজ সাদা কইতরের হাতের নাগালে লাগলেই রক্ষা নেই। প্রতুত্তুরে আমি তখন বলি,

“মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে,
আমায় বাগে পাবে না
তুবাকে শাস্তি দিয়ে রে!
শান্তি তুমি পাইবা না।”

চলবে……..

#প্রণয়িনীর_হৃদয়কোণে
#আফসানা_মিমি
| দশম পর্ব |
❌ কোনভাবেই কপি করা যাবে না।❌

হেলানো বাতাস বইছে। কয়েক মিনিটেই প্রকৃতির রূপে পরিবর্তন এসেছে। আকাশের কালো খণ্ড খণ্ড মেঘের ভেলারা জমে জানান দিচ্ছে আজ বর্ষণ হবে, প্রবল বর্ষণ। প্রকৃতি ধীরে ধীরে শীতকালের আভাস দিচ্ছে।
ছাদের কুর্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছি। পিছনে পা ফেললেই নীচে পড়ে যাব। উপর ওয়ালার কাছে না গেলেও হাত পায়ের হাড্ডিকে অচিরেই হারিয়ে ফেলবো। এতে সাদা কইতর আমাকে আরো শাস্তি দিতে পারবে। সামনে জম পিছনে মরণ। কোথায় পালাব! সাদা কইতরের মুখে বিশ্ব জয়ী হাসি। যেন ব্যাটা এভারেস্ট জয় করে ফেলেছে। বিশ্বাস করেন পাঠকগণ! সাদা কইতরের গালের লিখা দেখে এখন দেখতে সত্যি সত্যিই চোর মনে হচ্ছে।
” এবার কোথায় পালাবে, ফুলটুসি?”

ইশশ কথার কী ধরণ! গুন্ডা নাকি? কোথায় শিখেছে এরূপ! অন্যপাশে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। সাদা কইতর আরো সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়ায়। ভয় পাচ্ছি, ভীষণ ভয়। হৃদপিন্ডের যন্ত্রটা ঢিপঢিপ করে বাজছে।

” সাদা কইতরের মতো পাখা থাকলে তো পালিয়েই যেতাম। এভাবে ভয়ে কাঁপতে হতো কী?”

সাদা কইতর বাঁকা হাসি হেসে বলল,
” ভয় পাচ্ছো, মনপাখি?”

এবার রাগ মাথার তালুতে উঠে গেল। কিছুক্ষণের জন্য আমি অন্য মেয়েদের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। তুবার মাঝে আর অন্য মেয়ের মাঝে কোন তফাৎ ছিল না। সাদাকইতরের দিকে ফিরে তাকালাম। কোমরে হাত গুঁজে উত্তর দিলাম,

” সেই তখন থেকে জানেমন, মনপাখি, টিয়াপাখি, কচুরপাখি, ফুলটুসি এসব বলে ডাকছো? আমি কবে থেকে পাখি হলাম! আর মুখে ভালো কথা আসে না! ইস কথার কি অবস্থা! মনে হচ্ছে পাশের বস্তিতে থাকা আবুল চাচার ভাতিজা।”

” আবুল চাচা কে?আর তার ভাতিজার খবর তুমি কীভাবে জানো?”

কথায় কথায় উল্টাপাল্টা কথা বলে দিলাম। আর এখন তার কাছে জবাবদিহিতাও করতে হবে কেন যে আমার মুখটা বেশি চলে! বুঝি না। মনে মনে নিজেকে বকে নিলাম।

“সেটা তোমার না জানলেও চলবে। নাও নাও শাস্তি দাও। আমি জানি এখন তুমি প্রতিবারের মতো শাস্তি দিবে। নাও আমি তৈরি শাস্তির জন্য। ”

সাদা কইতরের মুখ থেকে বাঁকা হাসি সরছেই না। ইচ্ছে করছে ব্যাটার মুখের মধ্যে একটা ঘুষি মেরে আরো বাঁকা করে দিতে।

” চোখ বন্ধ করো মনপাখি? তোমার শাস্তি তোমার অগোচরেই দেব।”

” চোখ বন্ধ করলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে। আমি খুব ভাল করে জানি।”

সাদা কইতর একটু বিরক্ত হলো বটে! আমাকে ধমক দিয়ে বলল,

” সব সময় বেশি বুঝো! চোখ বন্ধ করতে বলছি।”

কথা না শুনলেও বকা দেয় শুনলেও বকা দেয়। কি আর করার! চোখ বন্ধ করে নিলাম। সাদা কইতর একদম আমার কাছে এসে প্রথমে চোখে এক হাত দিয়ে ঢেকে দিল। এরপর আমার মুখে কিছু একটা দিয়ে আঁকিবুকি করতে শুরু করল।
এদিকে আমি জমে ফ্রিজ হয়ে গেছি। সাদাকইতরের নিঃশ্বাস আমার মুখের উপর পড়ছে। মনের মধ্যে আলাদা অনুভূতি তৈরি হচ্ছে।

” এইতো শেষ। এবার তোমার চাঁদ মাখা মুখখানা দেখো মনপাখি!”

সাদা কইতর দেখি একদম সবকিছুর প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। হাতে একটা আয়না নিয়েও দেখছি এসেছে। আমার সামনে আয়না ধরাতে আমি চিৎকার করে উঠলাম। হে আল্লাহ! এই সাদা কইতর আমাকে কি বানিয়েছে! দেখতে একদম বানেরর নানী লাগছে। ঠোঁটের চারপাশে লাল লিপস্টিক দিয়ে মোটা করে এঁকে দিয়েছে। দুই গালে লাল লাল গোল্লা আর নাকে জোকারের মতো ইয়া বড়ো লাল টমেটো।

এবার সাদা কইতর হাসতে হাসতে গড়াগড়ি অবস্থায়। আমি রেগে বোম। সাদা কইতরকে আচ্ছা মত ধোলাই দিব আজ। রাগে হিতাহিত জ্ঞান লুপ পেয়ে সাদা কইতরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সাদা কাইতর ব্যালেন্স ধরতে না পেরে ছাদের মেঝেতেই শুয়ে পড়ল। আমি সাদা কইতরের বুকে আচ্ছামত কিল, ঘুষি দিচ্ছি আর বলছি,

” আমাকে ভুত সাজিয়ে হাসা হচ্ছে! নে কিল, নে ঘুষি। সাদা কইতর আস্ত একটা ধানের ভুসি।”

দুষ্টুমির ছলে দুজন দুজনার কাছাকাছি। বিষয়টা সর্বপ্রথম আমি খেয়াল করেছি। সাদা কইতর তখনো হাসছে। সাদা কইতরেরহাতের মুঠোয় আর হাত। দুজনের স্তম্ভিত ফিরে আসলে আমি ঠিক হয়ে দাঁড়িয়ে যাই। এরপর মিনমিন করে বলি,

“তুবা অনেক ভাল পরী,
দিও না বাবা ডান্ডার বারি।
সাদা কইতরের কছম খাচ্ছি,
জীবনেও পালাব না আমি।”

———————–

প্রকৃতি শান্ত। তবে আমার মনটা খুবই অশান্ত। মনকে আগের স্থানে ফিরে আনতেই নেংটি কইতরকে নিয়ে বিকেলে বের হয়ে আসলাম। উদ্দেশ্য আমার বাড়ির পাশের চায়ের দোকানের বাটারবন। সেই সকালে একজন লোক এসে কিছু রুটি,বাটারবন,কেক দিয়ে যায়। সারাদিন সেগুলো বিক্রি হয়। দুপুরে নেংটি কইতরের সাথে দোকানের গল্প করার পর নেংটি কইতর একপ্রকার পাগল করে ফেলেছে। সাদা কইতর বাড়ি নেই সেই সকালে আমার সাথে অকাজ করার পর যে বের হয়েছে বাড়ি ফেরার নাম নেই। অবশ্য এতে করে আমার জন্য ভাল হয়েছে। মনের সুখে সারা বাড়ি দুষ্টুমি করে বেড়িয়েছি।

চায়ের দোকানের কাছে আসতেই আমার চোখ ছানাবড়া। মইনুল আঙ্কেল বসে আছে এবং উনার পাশে লাজুক মুখে একজন মহিলা বসে আছে। যার আকৃতির বিবরণ করলে আমার সকল পাঠক ভয়ে দৌড় লাগাবে। একপু বলি, মইনুল আঙ্কেলের চেয়ে দুই গুন মহিলাটি। পরিধানে ঢিলেঢালা কুর্তি। মইনুল আঙ্কেলের হাতে হাত রেখে হেসে হেসে কথা বলছে। কথার ছলে এক দুইবার মইনুল আঙ্কেলের উপর ঢলে পড়তেই বেচারা মইনুল আঙ্কেল বেঞ্চের সাথে মিশে পড়ে। আমার পাশ দিয়ে দুজন লোক যাচ্ছিল। তাদের কথোপকথন আমার কানে আসে।

” শুনছি মইনুল রেজিনারে বিয়া করছে। বেডি কি মোটা রে! এরে ঘরে ঢুকাইব কীভাবে?”

আমার মুখটাকে কেউ স্কচটেপ দিয়ে আটকে দাও। মুখ ফসকে সকলের সামনে বলে ফেলি,

” কীভাবে কি হবে জানা নেই। তবে এবার একসাথে দুজন খাবে আর জায়গায় জায়গায় বায়ু দূষণ করবে।”

আমার কথায় চায়ের দোকানে হাসির রোল পড়ে গেল। মইনুল আঙ্কেল ভ্যাবলাকান্তের ন্যায় হাসছে সাথে দশ মনের পেট ও দুলছে। এদিকে নেংটি কইতর আমাকে খোঁচা দিয়ে জিজ্ঞেস করছে,

” আচ্ছা তুবারাণী! এই লোকের পেটে কী হাতি ঢুকেছে? এর পেট এতো বড়ো কেন? নাকি ঐ পেটে বাবু আছে?”

সর্বনাশ! আজকালকার বাচ্চারা একটু না একটু বেশিই চালাক। আমি এই কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। এখানে আর থাকা যাবে না। নেংটি কইতরেরহাত ধরে পাশের আরেক দোকানেবসে দুইটা চা আর বাটারবনের অর্ডার দিলাম।

” তুমি ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করো কেন? ”

আশেপাশে মানুষজনের রং তামাশা দেখছিলাম। নেংটি কইতরের কথা শুনে হাসিমুখে জবাবা দিলাম,

” সাদা কইতরকে জ্বালাতন করতে ভাল লাগে তাই।”

” ভাইয়ার বোনে এজন্যই বুঝি তোমার ছবি আছে? যেন তোমার ছবি দেখে ইচ্ছে মতো বকতে পারে?”

নেংটি কইতরের কথায় স্তব্ধ বনে গেলাম। সাদা কইতরের ফোনে আমার ছবি! এর মানে কী? সাদা কইতরকেই প্রশ্ন করতে হবে!

চা চলে এসেছে। নেংটি কইতর গপাগপ চা দিয়ে বাটারবন খাচ্ছে। আমার ধ্যান পুরোপুরি সাদা কইতরের কাছে। গরম চা মুখের সামনে ধরতেই কোথায় থেকে একজন আমার পাশে চা নিয়ে চুমুক দিয়ে দেয়। অবাক হলাম বটে! ভালভাবে খেয়াল করে দেখতে পেলাম, সাদা কইতর খুব আরাম করে বসে আমার জন্য আনা চায়ি চুমুক দিয়ে খাচ্ছে। চা তো নয় যেন অমৃত পান করছে। আ ও করে কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারছি না। পাশ থেকে লোকজনের দৌঁড়ে আসা দেখতে পাচ্ছি। আমার মুখে ভাষা নেই। সাদা কইতর কাহিনী জানতে একজনকে প্রশ্ন করলে সে উত্তর দেয়,

” বউ পাল্টাবে কিন্তু মইনুলের স্বভাব পাল্টাবে না। এতদিন সহ্য করতাম একজনের দূষণ এখন থেকে সহ্য করতে হবে জামাই বউয়ের যেথায় সেথায় বায়ু দূষণ।”

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে