#প্রণয়িনীর_হৃদয়কোণে
#আফসানা_মিমি
| পঞ্চম পর্ব |
❌ কোনভাবেই কপি করা যাবে না।❌
তুবার জ্বর। পুরো ১০২°। তথ্যটি পুরো মহল্লায় ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই নিশ্চিত মনে আজ ঘুমাবে বলে নিয়ত করেছে। অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। এদিকে আমি ভালো নেই। জ্বরের কারণে বাবা,ভাইয়া অফিস কামাই করেছে। আমার পাশাপাশি, কাছাকাছি দুজন সর্বদা, সবসময় ঘোরাফেরা করছে। এটা সেটা এনে খাওয়াতে চেষ্টা করছে। আমি কিছুই খাচ্ছি না। খাবোও না। ঘাস-লতা তো গরুরা খায়। আমি তো নিতান্তই ভদ্র বাচ্চা। একটা আবদারই তো করেছিলাম। “মেরিডিয়ান ক্রিস্পি চিকেন স্টিকস চিপ্স” খেতে চেয়েছিলাম। আসলে চিপ্স চকলেটের প্রতি আমার কোন ইন্টারেস্ট নাই। আমি তো বড়ো তাই না! এখন আপনারা বলবেন, একবার নিজেকে বলো বাচ্চা তো একবার বলো বড়ো! এটা কেমন কথা? আমি প্রত্যুত্তরে বলবো, আপনারা এখনো তুবাকে চিনেন নাই?
সকালে জ্বরের ঘোরে ছাদে গিয়েছিলাম। তখন সকাল সাতটা বাজে। আমাকে একা ঘরে আবদ্ধ রাখতে কার ক্ষমতা আছে? আশপাশে তাকিয়ে লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করলাম। সকালের সতেজ আবহাওয়া গায়ে লাগতেই সকল জ্বর পালিয়ে গেছে মনে হচ্ছে। অদৃরে পরিচিত বিল্ডিংয়ের দিকে তাকালাম। কেউ আছে মনে হচ্ছে এবং সে এদিকেই তাকিয়ে আমাকে দেখছে তা আমি নিশ্চিত। চিলেকোঠার ঘরেই দূরবীন রেখে দিয়েছিলাম সেটা এনে চোখে লাগাতেই আমার মুখে মিষ্টি হাসির রেখা ফুটে উঠে। আমার সাদা কইতর দাঁড়িয়ে আছে। সকাল সকাল ছাদের ফুল গাছে পানি দিচ্ছে। নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে তবে আমার তো মনে হচ্ছিল সাদা কইতর এতক্ষণ এদিকেই তাকিয়ে ছিল। হয়তো আমার আসার অপেক্ষা করছিল। এখন এমন ভাব যেন আমি দূরের শত্রু। দূরবীন চোখেই হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকছি। সাদা কইতর তাকাচ্ছে না। ইশ কী ভাব! যেন কইতর রাজ্যের রাজা মহারাজা। জ্বরটা আবারো চলে আসছে তবে আমার এখন যাওয়া যাবে না। সাদা কইতরকে জ্বালাতে হবে তো? জ্বর আসার কারণও যে সে। গতকাল আমাকে এভাবে না দৌড়ালে আজ আমি সুস্থ সবল একজন বাচ্চা থাকতাম।
এত এত বড়ো ছেলেরা থাকতেও ছক্কা,চার দেওয়া বলগুলো আমাকেই আনতে হয়েছে। শেষে তো পা ব্যথায় বসে কান্না করে দেই। তখন সাদা কইতর কাছে এসে বলেছিল,
” আরো আমার পিছনে লাগতে আসবা? উলটা পালটা কাজ করবে?”
তখন কান্না করে বলেছিলাম,
” আপনার জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলব সাদা কইতর।”
সাদা কইতরকে তার বন্ধুরা ধরে বেঁধে নিয়ে চলে গিয়েছিল। আমি অনেক কষ্টে পায়ে হেঁটে বাসায় আসি। তারপর থেকেই জ্বর, প্রচন্ড জ্বর। এক গ্লাস ঠান্ডা পানি যদি আমার পেটের উপর রাখা হয় তো আমার মনে হচ্ছে গরম হয়ে ফুটতে শুরু করবে।
“সাদা কইতর” বলে জোরে ডাক দিলাম। হ্যাঁ এবার সাদা কইতর তাকিয়েছে। হাতের ইশারায় হায় জানালাম। দূরবীনে দেখছি সাদা কইতর রেগে আছে। আমি বুঝি না বাপু এই ছেলের নাকের আগায় এত রাগ কেন। মাথা ঝিমঝিম করছে। এখনই চলে যেতে হবে। এই প্রথম তুবা হেরে গেছে। মাথায় চেপে ধরে দেয়াল হাতরে নিচে নেমে আসি। বাবা,ভাই যখন থেকে জানতে পারে তখন থেকেই কিছু খাওয়াতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। ঐ যে! আমি যা চাইছি তা তো দিচ্ছে না। অবশেষে আমি জিতেছি। ভাইয়া আমার জন্য ‘মেরিডিয়ান ক্রিস্পি চিকেন স্টিকস চিপ্স’ অনেকগুলো এনেছে। প্যাকেট থেকে চিপ্স বের করে করে খাওয়ার মানুষ এই তুবা না। কাঁচের একটা বাটিতে চার প্যাকেট চিপ্স ঢেলে তাতে সস মিশিয়ে নিলাম। এখন খেতে আরাম পাবো। বাবা আমার কাণ্ডে হাসছেন। মাথার হাত বুলিয়ে বলেন,
” তুই বড়ো হবি কবে রে মা!”
বাবার কথায় মনে লাড্ডু ফুটে। মুখ ফসকে বলেই ফেলি,
” আমি তো সেই কবেই বড়ো হয়েছি। শুধু তোমার চোখেই পড়ে না। ঘটক সাহেবকে খবর দাও সে দেখেই বলে দিবে যে, মেয়ে বড়ো হয়েছে তা কি ভাবছেন তুবার বাবা?”
আমার কথায় বাবা হাসছেন। এত দুষ্টু মিষ্টি বাচ্চার কথায় না হেসে পারা যায়?
” আমার মা তো এখনো আমাকেই কোলে নিতে পারে না। আবার বলে সে বড়ো হয়েছে। শুয়ে থাক তুবা। একদম উঠবে না। যা ইচ্ছে ভাইয়ার কাছে আবদার করবে। বাহিরে বের হবে না। আমি বাহিরে যাচ্ছি,তাড়াতাড়ি ফিরব।”
বাবা চলে গেলেন। ভাইয়া কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। আমি মনের সুখে চিপ্স খাচ্ছি। ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলি,
” কি সাহেব! সুযোগ করে দিলাম নিপা ভাবীর সাথে কথা বলার। আর তুমিই রাগ দেখাচ্ছো?”
আমার কথায় ভাইয়া থতমত খেয়ে গেল। বাহিরের সকল খবর এই তুবা রাখে আর ঘরের খবর রাখবে না?
” তুই নিপার কথা কীভাবে জানিস?”
” ভাবীই তো এসে বলল, তুমি আমার ননদ হবে? সেই সময় থেকেই চিনি। এখন যাও তো! আমি চিপ্স খাব।”
দিলাম প্যাঁচ লাগিয়ে। ভাইয়া চিন্তা করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমি জানি এখন ভাইয়া নিপা ভাবীকে কল দিবে এবং প্রচুর ঝগড়া করবে হি হি হি।
দেয়াল ঘড়িতে সময় আটটা দশ। সাদা কইতরের আসার সময় হয়ে গেছে। তবে আমার আজ যেতে ইচ্ছে করছে না। খালি পেটে অতিরিক্ত চিপ্স খাওয়ায় পেট গুলিয়ে আসছে। ওয়াক ওয়াক করে বাথরুমে গিয়ে সব সাবার করে আসছি। হ্যাঁ এবার ঠিক আছে।
———————————
আজ তিনদিন যাবত বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছি। জ্বর থামার নামই নেই। আমি নীরব তো সব নীরব। শুয়ে শুয়েই খবর পাচ্ছি, মইনুল আঙ্কেলের বাড়িতে আগুন ধরেছে। কীভাবে ধরেছে সেটা নাই বলি। উনার বউ কেঁদে কুটে বাপের বাড়ি চলে গেছে। যাওয়ার আগে কারণটাও বলে গিয়েছে অবশ্যই! পাড়ার এক মহিলাকে ধরে সেই কি কান্না করেছে! তার বউয়ের বক্তব্য ছিল এরূপ,
” মইনুল সারাদিন খায় আর ঘরে এসে বাথরুমে বসে থাকে। আমারে যে সময় দিবে তা না। এ বেডারে তো বাথরুমের লগে বিয়া দেওয়া উচিত ছিল। আমি এই বেডার সংসার করমু না। আজই বাপের বাড়ি চলে যামু।”
ব্যাস! মইনুল আঙ্কেলের কপাল পুড়ল। কিছুক্ষণ পর পর বায়ু দূষণের বলে বাড়িতে আগুন ধরল। মইনুল আঙ্কেলের বউ পরেরদিনই বাপের বাড়ি চলে গিয়েছে। আহারে! বেচারা মইনুল আঙ্কেল। এবার যদি একটু বুদ্ধি সিদ্ধি হয়!
বালিশ কোলে নিয়ে ভাবছিলাম। তখনই হুরমুর করে কেউ আমার ঘরে প্রবেশ করে। ওমা! এতো নেংটি কইতর। আমার ঘরে প্রবেশ করে সরাসরি আমার বিছানার উপর বসে কপালে হাত রাখল। বিজ্ঞ মানুষের মতো জ্বর মেপে পকেট থেকে নোট প্যাড বের করে লিখল, জ্বর কম।
আরে এটা হলো কী? উড়ে এসে জুড়ে বসে গেল নেংটি কইতর।
” রাদের কাছ থেকে শুনলাম তোর জ্বর এসেছে। দেখি তো?”
ওমা! আমার সুন্দরী আন্টি দেখি হাজির! ঠিক আমার কপালে হাত রেখে জ্বর মেপে নিল। তাদের দেখে অবাক হয়েছি বটে!
বলা নেই, মেহমান এসে হাজির! কিন্তু আপ্যায়নটা করব কী করে! আমি তো অসুস্থ। আমার এই দুর্বল শরীরে উঠতে গেলে ঠুসঠাস পড়ে গিয়ে কোমড় ভাঙ্গবো। দরজার কাছে বাবাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম। বাবাকে হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি তাদের চেনো বাবা?” বাবা ইশারায় হ্যাঁ বলে চলে গেল নাস্তা পানি আনতে। এদিকে সাদা কয়তরের মা এলাহি কান্ড করে বসল।
আমি যখন সদা কইযরের মাকে ঢুকতে দেখেছি তখন হাত খালি ছিল এখন দেখি মিনিটেই আমার সামনে তিন চার বাটি খুলে সাজাচ্ছে। যার মধ্যে সাদা ভাত, কিছু ভর্তা এবং ঝাল করে মুরগির গোস্ত রান্না করা।
মুরগি আমার খুব পছন্দ। মাঝে মাঝে সাদা কইতরের মায়ের কাছে আবদার করি মুরগি খাব বলে। কিন্তু আমি যে দুরন্ত মেয়ে! এক মিনিটে যাই, এক সেকেন্ডে চলে আসি সে বাড়ি থেকে। কিন্তু আজকে এসবের আয়োজন কেন? সাদা কইতরের মাকে প্রশ্ন করি,
” কি ব্যাপার সুন্দরী! ভুল ঠিকানায় চলে এসেছ নাকি? এত খাবার কার জন্য?”
” আমার ছেলের বউয়ের জন্য।”
বাংলা সিনেমাতে শাবানা যখন কোন অবাককর কথা বা কষ্টের কথা শুনে তখন না বলে একটা চিৎকার করতে দেখেছি। আমারও এখন এমন চিৎকার মারতে ইচ্ছে করছে। তার করলাম না ঠান্ডা মাথায় বললাম,
” তোমার দুই ছেলের এক ছেলের বউ হওয়ার শখ আমার নেই। তোমার বড় ছেলেটা হচ্ছে আমার প্রথম শত্রু আর দ্বিতীয়টা দ্বিতীয় সূত্র। এমন নিকটবর্তী শত্রুর সাথে বন্ধুত্ব করা ঠিক না।”
“তুই তো বলিস যে আমাকে তো শাশুড়ির মত লাগে। ধর আমার কোন ছেলেই নেই। মিছেমিছি ছেলের জন্য তোকে বউ বানিয়ে রেখেছি। হয়েছে তো! এবার শুরু কর।”
” আমি খাব না। তুমি তোমার দুই কইতরকে খাওয়া। এসব দেখে আমার কেমন বমি আসছে।”
” দাঁড়া আমি খাইয়ে দিচ্ছি। ঝাল করে মুরগির মাংস রান্না করেছি খেলে বমি আসবে না। ঔষধও নিয়ে এসেছি।”
” ওষুধ আবার কিনলে কখন? তুমি জানো না আমি ওষুধ খেতে পারিনা।”
” কখন কিনলাম! রাদ কিনে দিয়েছে। বলেছে, একটা গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ এবং একটা এখান থেকে ওষুধ তোকে খাইয়ে দিতে।”
” ওই সাদা কইতর কীভাবে জানায় আমি অসুস্থ?”
” শুধু তোর সাদা কইতর না। পুরো মহল্লার মানুষ জানে যে তুই অসুস্থ। এজন্য গিয়ে দেখ অনেকেই মসজিদে সিন্নি বিতরণ করছে। তোর জ্বালাতন যে বন্ধ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যা আর আগের মত সবাইকে জ্বালাতন শুরু করে দে।”
একমাত্র, শুধু একমাত্র রাদের মা আমার পরম বন্ধু। সে আমার সকল কিছু বুঝে। বেশি কথা না বলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিলাম। শেষে মায়ের হাতের রান্না কবে খেয়েছি মনে নেই। সাদা কইতরের মায়ের হাতে জাদু আছে। পুরো একবাটি ভাত আমাকে খাইয়ে দিয়ে তারপর ছেড়েছেন। ওষুধ খাইয়ে তারপর বললেন,
” এবার তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাতো! আমি চলে যাই।”
” না, চা নাস্তা কিছু খেয়ে যাও।”
” নিচ থেকে খেয়ে নেব। তুই শুয়ে থাক,আরাম কর।”
পেট ভর্তি খাবার খেয়েছি শরীর একটু শক্তিও পেয়েছি। কিন্তু দুর্বলতা রেশ কে’টে যাওয়াতেও চোখে ঘুম চলে আসছে। বিছানায় শুয়ে পড়লাম। নেংটি কইতরেরর দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, সে তার নোটপ্যাডে পয়েন্ট টু পয়েন্ট যা যা হচ্ছে তাই লিখে নিয়ে যাচ্ছে।
” ওই নেংটি কইতর, তোর হাতের খাতাটা আমাকে দে তো?’
” ইউ অসুস্থ মেয়ে! ডোন্ট কথা। এইটা আমার পেইন্টিং খাতা। তোমাকে দিলে তুমি নষ্ট করে ফেলবে।”
” ওরে আমার বুঝবান বালক রে! দিতে বলেছে দে। নয়তো তোকে তেলাপোকার স্যুপ খাইয়ে দেব।”
নেংটি কইতর কিছুটা ভয় পায় মুখটা ভাড় করে খাতাটা আমার দিকেএগিয়ে দেয়। আমি শুয়ে শুয়ে পেজ উল্টিয়ে কিছু একটা এঁকে দেই এবং তার পাশে লিখে দেই জাস্ট ফর ইউ সাদা কইতর।
এরপর নোটপ্যাড বন্ধ করে সাদা কইতরের হাতে তুলে দিয়ে বলি,
” ভুলেও এই নোটপ্যাড খুলে দেখতে চেষ্টা করবে না। সোজা তোর বড়ো ভাই সাদা কইতরের হাতে দিবে এবং বলবে তাকে আমি একটা ভেংচি কেটেছি এবং বলেছি,
” সাদা কইতর একটা ধলা কইতর
ডানা ঝাপটায় সারাক্ষণ
তোর বউ আসে তোকে দেবে খুব বকুন,
তুবার পিছে লাগা!
বউ বলবে, ওই ব্যাটা দাঁড়া!
সাদা কইতর তখন দৌড়াবে,
আর আমার মুখে হাসি ফুটবে।”
চলবে……
#প্রণয়িনীর_হৃদয়কোণে
#আফসানা_মিমি
| ষষ্ঠ পর্ব |
❌ কোনভাবেই কপি করা যাবে না।❌
রাতের আঁধারে ঘুম না আসলে চিন্তা করবেন না। আপনাকে ভয় দেখানোর জন্য আশেপাশের টিকটিকি,ইঁদুর, চিকা,পোকামাকড়রা পাশের বাসার প্রতিবেশী সেজে আসবে। আপনারা ভয় পাবেন না। আমার মতো কম্বলের নিচে শুধু লুকিয়ে থাকবেন। ভূত পেত্নির থেকেও ভয়ংকর আওয়াজ এই প্রাণীদের। আপাতত শরীরে প্রচন্ড জ্বর। ১০৩°ও হতে পারে। থরথর করে কাঁপছি আর বকে যাচ্ছি,
“টিকটিকির নাম দিলাম টিকটিক,
বলিও না আর ঠিকঠিক।
বিয়ে দিয়ে দিব সত্যি,
ইঁদুরকে কাজি বানাব বলছি।”
মধ্যরাতে ইঁদুর ধরতে মনে হয় বিড়াল মাসি এসেছে। ঠাসঠুস কিছু পড়ার আওয়াজ কানে আসছে। কম্বলের নিচে থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে কষ্ট লাগছে। আমি তো ধরেই নিয়েছি সেটা বিড়াল। চুপি চুপি খাবার চুরি করতে এসেছে। আসুক তাতে আমার কী! আমিই তো পথ খুলে দেই তার জন্য। পৃথিবীর সকল প্রাণীদের খাবারের হক রয়েছে। বিড়াল বাদ যাবে কেন? পদচারণার আওয়াজ থেমে গেছে তারমানে বিড়াল মাসি নিচে চলে গেছে। আকস্মাত দরজা আটকানোর আওয়াজ কানে আসে। এই সময়ে কে আসবে? বাবা, ভাইয়া তো কখনোই আসবে না। আবার আসতেও পারে। ঘরের ভদ্র বাচ্চার জ্বর বলে কথা! নানান ভাবনার মাঝে কারোর ফিসফিস আওয়াজ কানে আসে। কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে,
” আয়মান, এই আয়মান!”
পৃথিবীতে একজন মানব আমাকে আয়মান বলে সম্বোধন করে আর সে হচ্ছে আমার সাদা কইতর। তারমানে বিড়াল মাসি সেজে সাদা কইতর আমার ঘরে ঢুকেছে, তাও এত রাতে? কম্বল সরিয়ে নিশ্চিত হতে হবে। দেখা গেল, আমার কষ্ট করে কম্বল সরাতে হয়নি। সাদা কইতর এক এক করে আমার গা থেকে কম্বল সরিয়ে নিচ্ছে। এদিকে আমি চোখ খিচে বন্ধ করে রেখেছি। আমি জানি কম্বল সরিয়ে সাদা কইতরের প্রথম প্রশ্ন কী হবে।
” দশটা কম্বল গায়ে দিয়ে কোন পাগল ঘুমায় আয়মান? তোমার শরীর ভারী মনে হয় না?”
” আমার শরীর লোহার তৈরি। দশটা কম্বল তো এই তুলনায় তুলা।”
আমার কথায় সাদা কইতর হাসছে। অন্ধকারে সাদা চকটকে দাঁত দেখতে পাচ্ছি। বিছানা থেকে উঠে বসলাম। অন্ধকারে হাতড়ে গায়ে ওড়না জড়িয়ে নিলাম। টেবিল লাইট জ্বালাতে চাইলে সাদা কইতর বাঁধা প্রদান করে।
” পাগল হলে? লাইট জ্বালিয়ে আমাকে মার খাওয়ানোর ফন্দি আটছো তাই না? আজ তোমার কোন ফন্দিতে আমি আটব না।”
সাদা কইতরের কথা শুনছি না। আমি ভাবছি নেংটি কইতরের কী উলটা পালটা কথা বলেছে? যার কারণে সাদা কইতর এখন আমাকে মারতে এসেছে!
” এত রাতে আমাকে অপহরণ করতে এসেছেন, সাদা কইতর?”
আলো জ্বলে উঠল। সাদা কইতর একটা গ্যাসলাইটের সাহায্যে আলো জ্বালিয়েছে এবং চোখ অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা ভেবে আমার কাছাকাছি এসে বসে বাঁকা হেসে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে প্রত্যুত্তরে বলে,
” তোমাকে বিয়ে করতে এসেছি আয়মান। এই হৃদয়ের রাণী করে নিব বলে এসেছি। পৃথিবীর সকল কিছু উপেক্ষা করে তোমায় আপন করতে এসেছি।”
একা রাত, একাকীত্ব একজন ছেলের পাশে থাকা বিপদসীমার কাছাকাছি। বিছানা থেকে দূরে গিয়ে বসলাম। কিন্তু সাদা কইতরের নিয়ত যে আজ বড্ড দুষ্টু ভুলেই গিয়েছিলাম। সাদা কইতর আমার সরে যাওয়াতে বিছানার উপর উঠে বসে। নিজের আত্মরক্ষার কলাকৌশল করা আমার জানা আছে। সাদা কইতর আমার দিকে আগাচ্ছে, হাত বাড়াচ্ছে। এটাই মোক্ষম সুযোগ নিজের প্রতিরক্ষা করার। চোখ বন্ধ করে নাকে একটা ঘুষি মেরে দিলাম।
‘আহ’ সাদা কইতর নাকে হাত দিয়ে বসে আছে। ব্যথার তাড়নায় ইতিমধ্যে গ্যাসলাইট বন্ধ করে ফেলেছে। চারদিকে অন্ধকার। ল্যাম্পপোস্টের আবছায়া আলো সাদা কইতরের চোখে পড়ে। সাদা কইতরের চোখে পানি। হাত বাড়িয়ে স্বান্তনা দিতে চাইলে সাদা কইতর আমার হাত আটকে ধরে।
” দোহাই লাগে। আর উলটা পালটা কাজ করিও না। এসেছিলাম একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে। ফিরে যাব নিজে অসুস্থ হয়ে।”
” এমা! আপনার আবার কী হয়েছে?”
” চুপ, একদম চুপ বাচাল মেয়ে। দেখি চুপ করে বসে তোমার কপালে হাত রাখতে দাও।”
রেগেমেগে লাল হয়ে গেছে, সাদা কইতর অনেক রেগে গেছে। এখন তিড়িংবিড়িং করলেই গালের নিচে দিবে এক চড়। কপালের তাপমাত্রা মেপে পকেট থেকে একপাতা নাপা এক্সট্রা বের করে নিজের হাতেই খাইয়ে দিল। আমি অবাক! আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী প্রথম শত্রু আমার সেবা করছে? ফায়রাজ রাদ আজ কোন প্রতিশোধ নিচ্ছে না। মনে মনে খুশি হলাম। ভেবে নিলাম, এই সাদা কইতরকেই আমার জামাই বানাব।
সাদা কইতর বিছানা থেকে নেমে গিয়ে বাজে একটা কাজ করে বসলো। মাত্র একটা, মাত্র একটা কম্বল ছাড়া সব কম্বল নিচে নামিয়ে ফেলে বিরক্তির সহিত বলল,
” তোমার মতো মাথা মোটা মেয়ে এই জীবনেও দেখিনি। জ্বরের শরীরে এতো কম্বল নিয়ে ঘুমালে তো জ্বর বাড়বেই। আমি চলে যাচ্ছি, একটা কম্বল নিয়ে ঘুমাবে।”
সাদা কইতরের কথায় অবাক হলাম। মুখ ফসকে প্রত্যুত্তরে বললাম,
” আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। সাদা কইতর আমার খেয়াল রাখছে।”
আমার কথায় সাদা কইতর বাঁকা হাসে। কাছে এসে হাত ধরে সেখানে কুটুস করে একটা কামড় বসিয়ে দেয়। আমি চিৎকার করতে নিলে আমার মুখ চেপে ধরে বলে,
” হুঁশ, আবার কথা বললে কামড় ট্রান্সফার হয়ে নাকে চলে যাবে। আরেকটা কথা, ফায়রাজ রাদ কখনো প্রতিশোধ নিতে পিছপা হয় না।”
কত বড়ো কথা শুনেছেন আপনারা? আমি নাকে কামড় খেতে চাই না। চোখ খিচে বন্ধ করে রইলাম। একটু পর অনুভব করলাম সাদা কইতর আমার মাথার কাকের বাসার চুলগুলো সযত্নে একপাশে করেছে। আরো কিছু করার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিছু সময় পর কোন আভাস না পেয়ে চোখ খুলে তাকাই। সাদা কইতর চলে গেছে। আমকে রেখে গিয়েছে হাজারো প্রশ্নের পথে। হাতের যন্ত্রণায় আহ খরে উঠলাম। হাতের উপর তেত্রিশ দাঁত বসানো দাগ। মনে মনে পন করলাম এর প্রতিশোধ সুস্থ হলেই নিব।
মনির কষ্টে বিড়বিড় করে বলছি,
” তোমাকে কখনোই বিয়ে করব না, সাদা কইতর।”
———————–
তুবা রাণী সুস্থ। পুরো পৃথিবীর মানুষকে অসুস্থ করার জন্য সে তৈরী। একটি নির্ঘুম রাতের পর সকালে নিজেকে ভালোভাবে তৈরি করে নিচ্ছি। কলেজের পোশাক পরিধান করে বর্তমানে চুল বাঁধছি। আমার এই কাকের বাসা আমি কিভাবে গুছাব নিজেও জানিনা। দুই বিনুনি করব কিন্তু করতে গেলে আমার পিঠ সমান চুল ঘাড় পর্যন্ত যে চলে আসবে! দুই বিনুনি করে গলায় ওড়না ঝুলিয়ে নিলাম। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এবার ঢ্যাংঢ্যাং করে নিচে নেমে গেলাম।
মইনুল আংকেলকে দেখতে পেলাম আজও উনি তেলে চুবচুবে রুটি খাওয়ার জন্য বের হয়েছেন। তবে একদম চুপচাপ সে। আহারে বেচারা মইনুল আঙ্কেল! বউয়ের অভাবে এবার যদি খাওয়া কমায় আর জায়গা বুঝে বায়ু দূষণ করে।
সকাল সকাল মন ভালো হয়ে যাওয়ার আরেকটা জিনিস পেয়ে গিয়েছি। আর সেটা হচ্ছে আমার সবচেয়ে প্রিয় কুলফি। খেতে অনেক মজা। এই কুলফিটা সচরাচর এদিকে পাওয়া যায় না। একজন বৃদ্ধ মহিলা এবং একজন বৃদ্ধ পুরুষ বিক্রি করে। প্রায় চারমাস পর উনারা এদিকে এসেছেন। এত খুশি হয়েছে যে আজ এক দৌড়ে তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। আমাকে দেখে তারা হাসিমুখে বলে,
” কেমন আছো দাদুভাই? ফুলফিন নিবে বুঝি?
” ভালো আছি দাদু। ঝটপটা আমাকে একটা কফি দাও, না না দুইটা কুলফি দাও। দুই হাতে দুইটা করে খেতে খেতে কলেজে যাব।”
এ দুই দাদা দাদু আমাকে খুব আদর করে। দাদু আমার কথা শুনে মুখ ভেংচি কে’টে বলে,
” অ্যাহ দুটো খেতে খেতে কলেজে যাবে। তুই এখনো ছোট নাকি রে! কুলফি তো ছোট রা খায়।”
” এই বুড়ি! ছোটরা কুলফি খায়, তাহলে আমার কাছে বিক্রি করো কেন? ভুলে যাও না আমি তোমাদের সবচেয়ে বড়ো কাস্টমার। তোমাদের কাছ থেকে এত এত কুলফি আমি ক্রয় করি। এত কথা না বলে আমাকে কুলফি দাও তো! না হলে কিন্তু সকল কুলফি খেয়ে দৌড় দিব, পয়সা দিব না।”
দুই হাতে দুইটা কুলফি নিয়ে খাচ্ছি আর গুনগুন করে গান গাইছি।
” প্রথম দেখাতে এমন জাদু করে দিলে,1
তুমি আমার হৃদয় তোমার করে নিলে।
না জানি কী হবে?
কী হবে কে জানে?
এসো এই মুহূর্তকে যাপন করি একসাথে।
বর্তমানে আমার গান শুনলে যে কেউ বলবে, আর আই পি পেহলী নাজার মে গান।যে যাই বলুক আমার কী! কুলফি মুখে নিতেই কানে গানের পরের অন্তরার স্বর কর্ণধারে আসে,
মে হু ইয়া হা,
তু হে ওয়া হা
মেরি বাহো মে আ, আভি যা!
ও জানে যা! দো নো জাহা
মেরি বা হো মে আ আভি যা!
পিছনে তাকিয়ে দেখি সাদা কইতর আমারই পিছনে দাঁড়িয়ে বাঁকা হাসি দিয়ে গান শেষ করে শিষ বাজাচ্ছে। আজকাল এই সাদা কইতরের কি হয়েছে জানিনা। তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এই লোকটা আমার কুলফিতে ভাগ বসাতে এসেছে।
” আরে সাদা কইতর যে! আজকে এই রাস্তায়? ভার্সিটির রাস্তা ভুলে গেছ নাকি?”
সাদা কইতর প্রতুত্তুর করল না। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে আমার হাত থেকে দুইটা কুলফি নিয়ে চলে গেল। কীভাবে হল, কেন হল, কে নিয়ে গেল, ভাবছি। যখন আমার স্তম্ভিত ফিরে আসে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। দুই হাতে দুই কুলফি নিয়ে খেতে খেতে সাদা কইতর সামনে এগোচ্ছে।
আমি আমার স্থান থেকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলি,
“এটা তো আমার এটো খাওয়া কুলফি। আপনার এতই খেতে ইচ্ছে করছে আমাকে বলতেন, নতুন একটা কুলফি কিনে দিতাম!”
আমার কথার প্রতুত্তরে সাদা কইতর এদিকে ফিরে বলে,
” দুঃখিত আয়মান, আমি কিছু শুনতে পাই না।”
রাগে দুঃখে বাসায় চলে আসলাম। আজকের দিনে সখালে কার মুখ দিয়ে উঠেছি মনে নেই। মন তো ছিল রাতের ঘটনা নিয়ে। তারউপর আজ কুলফিও খেতে পারলাম না। প্রতিশোধ নিব, চরম প্রতিশোধ। সাদা কইতরকে গাছে উল্টিয়ে ঝুলাব তারপর কাতুকুতু দিব।
মধ্যাহ্নের শেষ সময়। আরেকটু পরেই সাদা কইতরের ভার্সিটি ছুটি হবে। সাদা কইতরের বাড়ির আগের গলিতে ঘাপটি মেরে বসে আছি। আজকে ব্যাটা আসুক, ঘাড় মটকে দেব। আমাকে কামড় দেওয়া এত সহজ না। আমি তো প্রতিশোধ নিবই নিব।
ওই তো সাদা কইতর আসছে। আমিও সব কিছু নিয়ে তৈরি! কাছে আসলেই আক্রমণ করব। আমার কাজের মাঝে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে আকস্মাত সাদা কইতরের সামনে একজন মেয়ে এসে দাঁড়ায়। লজ্জায় মরি মরি ভাব। শরীরকে হেলিয়ে দুলিয়ে ওড়নার কোণা ধরে প্যাঁচাচ্ছে তো খুলছে।
সাদা কইতর চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করছে,’ কি হয়েছে?’ মেয়েটি তখন ওড়নার নিচ থেকে একটি চিঠি এনে সাদা কইতরের হাতে দেয়। সাদা কইতর সুন্দর করে হাতে নিল, খুব মনোযোগ সহকারে চিঠিটা পড়ে শেষ করে ঠাস করে মেয়েটার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। মেয়েটা কান্না করতে করতে দৌড়। বিশ্বাস করেন রাসেল ভাই! মনে হচ্ছিল ওটা যেন আমার গালেই দিয়েছে। এমন অকাজ অকর্মঠ কাজ আমার দ্বারাই সম্ভব।
সাদা কইতরের সাথে কত দুষ্টুমি করেছি হিসাব নেই। আমি তো সাহসী রমণী! আমার সাথে সারা কইতর পেরে উঠতে পারে না। যদি একবার ধরতে পারে তাহলে অবশ্যই শূলে চড়াবে।
মেয়েটা কান্না করতে করতে চলে গেল। সাদা কইরের মুখ রক্তিম। রাগ ভেসে উঠেছে চোখে মুখে। এটাই মোক্ষম সুযোগ! পলিথিন থেকে কয়েকটা মার্বেল সাদা কইতরের পায়ের কাছে ছড়িয়ে দিলাম।
এক, দুই, তিন! মার্বেল এর উপর পা পড়তেই অসাবধানতাবশত গড়িয়ে পড়ে যেতে নিয়েও যেন পরড় না। ইস মিস হয়ে গেল! কিন্তু একটা কাজের কাজ তো হলো! কিছুক্ষণ আগে একটা লোক মহিষ নিয়ে এই পথেই যাচ্ছিল। মহিষ রাস্তাকে তার হাম্মামখানা বানিয়ে রাস্তা দুষিত করে ফেলে। সেখানেই সাদা কইতর পা ফেলেছে।
ইয়াক থু! সাদা কইতর রেগে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি নিষ্পাপ শিশুর মতো। সাদা কইতর পা ভাঙ্গা রোগীর মতো খুঁড়ে খুঁড়ে এগিয়ে আসছে। এদিকে আমি পিছাচ্ছি। মনে মনে বিপদে পড়লে যেই দোয়া পড়তে হয় তাই পড়ছি,
” লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জলিমিন।”
চলবে…….