#প্রণয়িনীর_হৃদয়কোণে
#আফসানা_মিমি
|দ্বিতীয় পর্ব |
❌ কোনভাবেই কপি করা যাবে না।❌
” তুমি নাকি ঐ মেয়েকে বিয়ে করবে ভাইয়া?”
আমাদের দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে আর শেষ হওয়ার খবর থাকে না। কিছুক্ষণ আগেই যুদ্ধ সমাপ্ত করেছি এখন আবার যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতে ছোট ভাই প্রস্তুত!
” তোকে এই কথা কে বলেছে?”
নেংটি কইতর চিন্তিত। বিয়ের কথা আদৌও শুনেছে কি না ভাবছে। এদিকে আমার মনে তো ভয়ংকর ঘণ্টা বাজছে। চুরি করে ধরা পড়ে গিয়েছি যে তাই। একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম সেটা আর আমার দ্বিতীয় শত্রু হতে দিল না। সোফা থেকে আস্তে করে ব্যাগ বুকে গুঁজে ভোঁ দৌড়। এদিকে পিছন থেকে শুনতে পাচ্ছি সাদা কইতরের মা চিল্লিয়ে আমার উদ্দেশ্যে বলছে,
” তুবা কোথায় যাচ্ছিস? পায়েস রেধেছি, খেয়ে যা।”
কে শুনে কার কথা। জুতা হাতে নিয়েই দৌড়। পথে পেট মোটা আনারস আঙ্কেলের সাথে দেখা। আমাকে দেখেই উনি থেমে গেলেন। হয়তো ভয় পাচ্ছেন। উনাকে দেখে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আটলো।
” কেমন আছেন পেট মোটা আনারস আঙ্কেল?”
” এই মেয়ে দূর হও।”
” আরে যাবো তো যাবো। আসেন আগে আপনার প্রেশার মাপি। তখন দেখেছিলাম পত্রিকা দিয়ে বাতাস করছেন। এখন আপনাকে দেখতেও সুপারি গাছের মতো শুকনা লাগছে। দেখি দেখি হাতটা দেখি।”
আমার কথার যুক্তির সাথে পেরে উঠা অসম্ভব। পেট মোটা আনারস আঙ্কেল ঠিকই উনার হাতটা এগিয়ে দেন। আমিও বিজ্ঞ মানুষদের মতো হাতের বন্ধনীতে সময় দেখে দেখে উনার হাত ধরে প্রেশার মাপতে থাকি। এক মিনিট দুই মিনিট তিন মিনিট পাড় হয়ে যায়। আমার নড়চড় নাই। সত্যি বলতে আমি তো ভাব ধরছি। ঐ যে বাংলা সিনেমাতে দেখতাম হাতুড়ে ডাক্তাররা হাত ধরে প্রেশার মাপে।
” আর কতক্ষণ লাগবে?”
“হুঁশ” বলে মুখে আঙুল দিয়ে পেট মোটা আনারস আঙ্কেলকে চুপ করাই। উনি অধৈর্য হয়ে যান। মিনিট পাঁচেক পাড় হতেই আমি চিৎকার দেই।
” ও পেট মোটা আনারস আঙ্কেল, আপনার পাল্সে শক্তিই নেই। আপনি মরে গেছেন।”
আমার কথা শুনে পেট মোটা আনারস আঙ্কেল যতটুকু না ভয় পেয়েছেন তারচেয়ে বেশি আমার চিৎকার শুনে ভয় পেয়েছেন। আমাকে
” বেয়াদব মেয়ে” বলে হনহন করে হেঁটে চলে যান বাড়ির পথে।
—————————-
ছুটির দিন আমার কাছে ঈদের দিনের মতো। সারাদিন বাবা আর ভাইয়ার সাথে দুষ্টুমি করি আর তাদের মাথা নষ্ট করি। আজও ব্যতিক্রম হয়নি। ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ হাতে নিয়ে ছাদে চলে যাই। বাবা তখন টমেটো গাছে পানি দিচ্ছিল। আমাকে দেখে হাসেন। আমার কাছে এসে মাথার এলোমেলো চুলগুলো একপাশে করে দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলেন,
” আমার দুষ্টু মামনি।”
বলা বাহুল্য আমার গায়ের রং হলদে ফর্সা, মাথায় এক ঝাঁক কোকড়া চুল। ইচ্ছে হলে গুছিয়ে রাখি নয়তো আউলে রাখি। আমাকে গুছিয়ে রাখার জন্য আমি ছাড়া সবাই আছে। বাবা ছাদ থেকে নেমে পড়তেই মনে হলো দূরের ছাদে কাউয়া থুক্কু অনেক কইতর বসে আছে। দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে মিনি দূরবীন নিয়ে আবার ছাদে চলে আসলাম। দূরবীন চোখে দিতেই আমার মুখে মিষ্টি হাসির রেখা ফুটে উঠে। যা ভেবেছিলাম তাই। আমার দুই দুইটা কইতর ছাদে উড়াউড়ি থুক্কু ঘোরাঘুরি করছে।
এক হাতে ব্রাশ করছি অপর হাতে দূরবীনে দেখছি। মুখ ভর্তি ফেনা কোথায় ফেলব ভেবে ছাদের কিনারায় গিয়ে নিচে না দেখেই থু দিয়ে ফেলে দিলাম। আমাদের মইনুল আঙ্কেল ঠিক তখনই নিচ দিয়ে হেঁটে বাজারে যাচ্ছিলেন। মাথার উপর ফেনা জাতীয় কিছু দেখতে পেয়ে স্লো মোশনে উপরে তাকান। ততক্ষণে আমি ব্রাশ নিচে ফেলে মুখ মুছে দাঁড়িয়ে দূরবীনে এদিক সেদিক দেখছি। আশেপাশে কি হচ্ছে তা না জানার অভিনয় করে আকস্মাত নিচে তাকিয়েছি, মানে অভিনয় করছি। মইনুল আঙ্কেল তখন আমাদের ছাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি তখন মুখে হাত দিয়ে অবাক হয়ে যাওয়ার অভিনয় করি।
” আপনার মাথায় দেখি কাউয়া হাগু করেছে, মইনুল আঙ্কেল!”
আমার সরাসরি কথা শোনার জন্য ভোজনপ্রিয় আঙ্কেল প্রস্তুত ছিলেন না। আশেপাশে তাকিয়ে দেখেন অনেক মানুষ উনাকে নিয়ে হাসছে। আমারও হাসি পাচ্ছে কিন্তু যদি উনি বুঝে যায়! এমনিতেই বায়ু দূষণে পরিচিত মইনুল আঙ্কেল। এখন আবার উনি কাউয়ার বাথরুম হিসেবে পরিচিত হলেন। মনের কষ্টে মইনুল আঙ্কেল বাড়ির পথে রওনা হলেন। ইশ বেচারা এসেছিল বাজার থেকে রসালো মিষ্টি আর তৈলাক্ত রুটি খেতে। আজ আর খাওয়া হলো না।
এদিকে মইনুলের আঙ্কেলের চক্করে ঐপাড়ের আমার দুই কইতরদের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। চোখে দূরবীন দিয়ে আবারো সেদিকে তাকালাম। দুই ভাই মিলে ছাদে ব্যায়াম করছে। বড় ভাইয়ের হাতে দুইটা বড় বড় ডাম্বা। ডাম্বা বলছি এই কারণে, কারণ সেগুলোর নাম আমার জানা নেই। আর ছোট ভাইয়ের হাতে একটা চিকন কাঠি যেটা দিয়ে সে হাত উপর থেকে নিচে, নিচে থেকে উপরে উঠানামা করছে। ওদের এই অবস্থা দেখে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চেপে গেল। ছাদের এক কোনায় দেখতে পেলাম একটি লম্বা বাঁশ আছে। দূরবীন ফেলে সে বাশে একটি লাল কাপড় বেঁধে দিলাম। বাঁশের আগায় দিলে কাপড় এলোমেলো ভাবে উড়বে আর তারাও ব্যায়াম ফেলে আমার দিকে মনোযোগ দিবে। সমান ইটের উপর তো সোজাভাবে বাঁশ রাখা সম্ভব না তাই তাদের দৃষ্টি এদিকে আনার জন্য শরীরে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে বাঁশ দাঁড়া করলাম। সেই কখন থেকে নাড়াচাড়া করছি! তারা দেখছে না। বেশি ওজন না হওয়াতে এবার ছাদের একপাশ থেকে অপরপাশে চক্কর লাগাতে শুরু করলাম, সাথে তো দূরবীন আছেই। কিছুক্ষণ পর দেখি নেংটি কইতরের চোখ আমার ছাদের উপর পড়ে এবং সে হাতের ইশারায় সাদা কইতরকেও এদিকে তাকাতে বলে। সাদা কইতর বিরক্তি চোখে তাকাতে দেখতে পায় আমার কাজ। জানিনা সাদা বিলায়ের তখন কি হলো, দূরবীনে স্পষ্ট দেখতে পেলাম সে খিলখিল করে হাসছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে তার হাসি আমি এখান থেকে অনুভব করতে পারছি। লজ্জায় পড়ে গেলাম। বাঁশ, কাপড় ফেলে দৌড়ে ছাঁদ থেকে নেমে গেলাম। আহা সাদা কইতরের কী হাসি! তার হাসিতে একখানা ছন্দ আসে মনে,
” সাদা কইতরের রে
তুই উড়াল দিস না রে!
নেংটি কইতর বল রে তাকে ,
সাদা কইতর হাসলে,
ভাগবে সকলে”
ভেবেছিলাম সাদা কইতরকে কিছু একটা করে জ্বালাতন করব। উল্টা তার হাসির জ্বালাতনে আমি জ্বলে গেলাম।
—————
তুরান ভাইয়া সকালে হাঁটতে গিয়ে চারটা গেন্ডারি কিনে নিয়ে এসেছে। একটা বাবা আর একটা ভাইয়া খেয়েছে বাকী দুইটা আমার জন্য রেখে দিয়েছে। এখন আমি যে অলস মেয়ে আমার দ্বারা গেন্ডারি ছিলে খাওয়া সম্ভব না। এখন সময় বিকেলবেলা। বাবা এবং ভাইয়া দুজনেই তাদের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে চলে গিয়েছেন। আমি আর কি করব। বাড়িতে তালা দিয়ে দুই গেন্ডারি হাতে নিয়ে বের হয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য গেন্ডারির মেশিন গাড়ি। দুই গেন্ডারি টেনে নিয়ে যাচ্ছি। এগুলো মেশিনে পিষে রস করে পেট ভরে খাব।
আমাদের বাড়ি থেকে দুই গলি দূরে গেন্ডারের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। গাড়ির ছেলেটার নাম হচ্ছে লুৎফুর। আমি মজা করে তাকে লুৎফা খালা বলে ডাকি। তার পিছনে একটা ঘটনা আছে। আর সেটা হল, লুৎফুর মেয়ে স্বভাবের। সবকিছু মেয়েদের মত শুধু লুঙ্গি ফতুয়া পরিধান করা ছাড়া। তাকে যখন সুন্দর ডাকা হয় তখন এত খুশি হয় যে বিনিময়ে আমার সব খরচ মাফ হয়ে যায়।
একা একা রাস্তায় হাঁটা একজন মেয়ের জন্য খুবই কষ্টকর। বর্তমানে তাই মনে হচ্ছে। হাঁটছি আর ভাবছি, ইস আমার যদি একটা জামাই থাকত! গেন্ডারিটা তার হাতে গুঁজে আমি তার সামনে নাচতে নাচতে হাঁটতে থাকতাম। কিন্তু আমার তো জামাই নেই। বাবাকে কতবার বলেছি আমাকে বিয়ে দিয়ে দাও কোন এক সাদা ভূতুমের সাথে। উনি শুনে কষ্ট পায় মন খারাপ করে বলে, “তুই চলে গেলে আমার কে থাকবে?”
লুৎফুরের কাছে আসতেই সে আমাকে দেখে গাড়ি নিয়ে ছুটতে শুরু করল। বুঝলাম বিগত বকেয়ার জন্য সে পালাচ্ছে।
” যেও না গো লুৎফুর ভাই! তোমার মেশিনে অনেক জাদু আছে আমার এই দুই গেন্ডারিকে রস করে দাও। বিনিময়ে আজ তোমাকে পয়সা দিব।”
লুৎফর গাড়ি নিয়ে থেমে গেল। বলে না! অতি লোভে তাঁতি নষ্ট। লুৎফুরও তাই হয়েছে। পয়সার কথা শুনে তার কান নাক গরম হয়ে গিয়েছে। বাজারের কাছাকাছি উপযুক্ত এক স্থানে থামিয়ে দাঁড়িয়ে দুই গেন্ডারি রস করলাম। দুই গেন্ডারের রস বলতে অনেক রস। যেখানে একজন স্বাভাবিক মানুষের এক গ্লাস রস খেলে পেট ফুলে যায়। সেখানে আমার এত রস খেলে পেটের অবস্থা খারাপ হয়ে মইনুল আংকেলের মত বায়ু দূষণ হওয়া শুরু করবে।
এক গ্লাস গেন্ডারির রস খেয়ে আরো এক গ্লাস খেলাম। এরপর চলে আসতে নিতেই লুৎফুর আমার পথ আটকায়। কত বড়ো সাহস ছেলেটার! এই আয়মান তুবার কাছে পয়সা চায়? মেরে কে’টে ফেলে দিব। কোমর হাত রেখে বললাম,
” কত বড় সাহস তোর লুৎফা? আমার সাথে উঁচু গলা কথা বলছিস? জানিস আমি কে? আমি হচ্ছি এই রাজ্যের রাজকন্যা। তুই রাজকন্যার কাছ থেকে পয়সা মানছিস?”
” রাজকন্যা না ছাই! তুমি একজন বাটপার মেয়ে, প্রতিবার আমার কাছ থেকে আখের রস খেয়ে টাকা না দিয়ে পালিয়ে যাও। আজ তোমাকে ছাড়ছি না।
” আজকে আমি পালাব। তোর নাকে খত দিব তারপর পালাব। দেখি তুই আমাকে কিভাবে ধরিস।”
আমাদের মাঝে বিশাল বড়ো ঝগড়া বেঁধে গেল। দেখা যাচ্ছে আশে পাশে কিছু মানুষজন এসে জমা হতে শুরু করেছে। লজ্জাকর কথা হলেও সত্য হচ্ছে, আমি লুৎফুলের মাথার চুল ধরে টানাটানি শুরু করে দিয়েছি।
কিছুক্ষণ পর মনে হল আমি হাওয়ায় ভাসছি। কেউ আমার কোমর চেপে ধরে লুৎফুরের থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। আমি চটে গেলাম। আমাকে কেউ ছুঁয়ে দিয়েছে? কত আশা ছিল, কত সাধ ছিল একমাত্র আমার জামাই আমাকে ছুঁয়ে দেবে। আর সেখানে কোন মাতব্বরের ব্যাটা আমার কোমাড়ে হাত দিয়েছে। পেছনে কে আছে না দেখেই ফিরে চোখ বন্ধ করে ঠাস করে থাপ্পড় মেরে দিলাম তার গালে।
জনসম্মুখে কাউকে থাপ্পড় মেরেছি অবশ্যই খারাপ করেছি। আমি ভাবছি ঠিক করেছি। ভেবেছি মানুষটা লজ্জা পাবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সে মানুষটা ঠুস করে জমিনে ফেলে দিল।
” ঐ কোন জলহস্তী রে?
উপরে তাকিয়ে রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখশ্রী দেখে শুকনো ঢোক গিললাম। কেননা সেই মানুষটা আর কেউ নয়। আমার সাদা কইতর। ভয়ে নখ কামড়াতে শুরু করলাম। তখনই আমার কানে সাদা কইতরের স্বর ভেসে আসলো,
” তোমার সাহস তো কম না আয়মান! মেয়ে হয়ে ছেলেদের গায়ে হাত তুলো?”
জনসম্মুখের সামনে এবার জোরে কেঁদে উঠলাম। দুই হাত কানে ধরে সাদা কইতরের উদ্দেশ্যে বললাম,
” আজ আমার রক্ষা নাই,
সাদা কইতরের মনে দয়া মায়া নাই।
ও সাদা কইতররেরররর
ছেড়ে দে আজকে,
নয়তো তোর খবর হবে।
তোর নয় বউ ডাইনি হবে।”
চলবে………