প্রণয়িনীর হৃদয়কোণে পর্ব-০১

0
5950

#প্রণয়িনীর_হৃদয়কোণে
#আফসানা_মিমি
|প্রথম পর্ব |

” এই ছেলে আমাকে বিয়ে করবে?”

আমাদের প্রথম সাক্ষাতে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম মানুষটাকে। আজ সে আমার প্রিয় এক নাম্বার শত্রু।

“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?
মুখে হাসি, বুকে বল তেজে ভরা মন
মানুষ হইতে হবে এই যার পন।”

শতাব্দী আগে কবি কুসুমকুমারী দাসের কবিতার সাথে একজন মানুষের জীবনী মেলাতে বৃথা চেষ্টা করছি। আমাদের দেশে আমার চাক্ষুষ সামনে একজন ছেলে ঠিকই আছে, সে কথায় কাজে দুটোই বড়। যদি বলে আজ তোমার ঘাড় মটকাব! কাজে কর্মে সেটাই করে। এটা নিয়ে খুব বিপদে আছি। ছেলেটা আমাদের পাশের বাড়ি অর্থাৎ রাস্তার ঐপাড় থাকে। আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে মিনি দূরবীনের সাহায্যে তাদের ছাদের গাছপালা দেখা যায়। যে যাই বলুক, ছেলেটা কিন্তু ধবধবে সাদা ঠিক পাশের বাড়ির ধবল রোগীর মত। নাম তার রাদ, কেউ জিজ্ঞেস করলে একটু ভাব নিয়ে সে বলে, আ’ম ফয়রাজ রাদ। ইয়েহ! কি নাম বাবা। একবার তো ধবল রোগী বলে সম্বোধন করেছিলাম সেবার যা দৌঁড়ানি খেয়েছিলাম বাবারে! এরপর থেকে অনেক ভেবেছি ছেলেটাকে কী নামে ডাকা যায়। অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করেছি তাকে সাদা কইতর ডাকব। কইতর ডাকার কারণ না হয় অন্যদিন বলি! সাদা কইতরের একটা ছোট ভাই আছে দেখতে তার মতোই ধবধবে ফর্সা। তাকে ডাকি নেংটি কইতর। এখন নেংটি সম্মোধন শুনে আবার আমাকে মারতে আসবেন না। নেংটি মানে ছোট। অনেক অভিধান ঘেঁটে ঘুঁটে এই নাম বের করেছি।
প্রথম প্রথম সাদা কইতরকে দেখেই সিনেমার নায়িকাদের মতো কল্পনায় ডুব দিতাম। সাদা কইতরের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে, বছর যেতে না যেতেই আমাদের ফুটফুটে মেয়ে বাচ্চা হয়েছে। নাম রেখেছি তার ফুল কুমড়ো। কুমড়োর মতো টসটসে আর ফুলের মত সুন্দর। আহা কী কল্পনা করছিলাম! সেই কল্পনা ঝল্পনার মাঝে এক চামচ ঘি ঢেলে সাদা কইতর আমার মন ভেঙে দিয়েছিল। বর্তমানে সে আমার প্রাণের এক নাম্বার শত্রু। দুই নাম্বার শত্রুর কে তা পরে বলব।
আপাতত আমি অতীব জরুরি কাজ সম্পাদন করতে যাব। সকালের এই সময়ে সাদা কইতর নায়ক সেজে ভার্সিটিতে যায়। যা দেখে আমার গা পিত্তি জ্বলে উঠে। আব্বু গতকাল রাতে ইয়া বড়ো জাম্বুরা এনেছিল। ভেতরে লাল টসটসে,মুখে দিতেই গলে মোম!
আমার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সাদা কইতরের আসার অপেক্ষা করছি। রাস্তার এপাড়ে এসে উল্টো পথে তার ভার্সিটির রাস্তা। মিনি দূরবীন দিয়ে দেখতে পাচ্ছি সাদা কইতর মাত্র গেইট থেকে বের হয়েছে। আমারই বারান্দার দিকে তাকিয়ে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তা দেখে নিচে বসে পড়ি। জমের চোখে পড়ার আগেই লুকিয়ে পড়ি। সাদা কইতর ভয়ে ভয়ে পা ফেলছে। প্রতিদিন নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি কিন্তু আজ তার বিপরীত করব। আমাকে চারপাশে খুঁজে না পেয়ে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এই সুযোগেরই অপেক্ষা করছিলাম। বারান্দার নিচ বরাবর আসতেই জাম্বুরার ছিলকা সাদা কইতরের মাথার উপর ফেলে দিলাম।
সাদা কইতর হাঁটা থামিয়ে দেয়। তাকে দেখতে অনেকটা জোকারের মামু লাগছে। আশেপাশের দোকানদার, পথচারীরা সাদা কইতরকে দেখে হাসছে। আমাদের এলাকার মইনুল চাচার তো সাদা কইতরকে দেখে হাসতে হাসতে হাসতে বায়ু দূষণ হয়ে যায়। যার শব্দ স্পষ্টত আমার কানে আসে। এদিকে আমার হাসি তো থামছেই না। হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে আসে।
সাদা কইতরের দিকে তাকিয়ে দেখি সে রাগে বোম হয়ে আছে। মাথার উপরে থাকা জাম্বুরার ছিলকা হাতে নিয়ে উলটা আমার দিকে নিক্ষেপ করে বলে,

” বদমাইশ মেয়ে। নিচে নেমে আসো বলছি!”
” ও সাদা কইতর! আপনাকে দেখতে হনুমানের চাচা মনে হচ্ছে, হা হা হা।”
” আয়মান, তোমাকে একবার হাতের কাছে পাই। জলপাইয়ের আচার বানিয়ে দিব।”

সাদা কইতরের কথা শুনে হাসছি তাকে আরেকটু ক্ষ্যাপাতে বলি,

” ও আমার সাদা কইতর রে!
যা যা তুই উড়াল দিয়া যা।”

রাদ মানে আমার সাদা কইতরের ভার্সিটির দেরী হয়ে যাচ্ছে বলে সে রাগে ধুপধাপ পা ফেলে চলে যায়। সময় থাকলে হয়তো উপরে এসে হলেও প্রতিশোধ নিত।

আমার কলেজের ক্লাস শুরু হয় সকাল আটটা ত্রিশ মিনিটে। অথচ এখন সকাল নয়টা বাজে। বাবার কড়া আদেশ কলেজ ফাঁকি দেওয়া যাবে না। আমি অবশ্য কলেজ ড্রেস পরিধান করে তৈরি হয়ে আছি। সুযোগ পেলেই দৌড় দিব। জুতো, ব্যাগ হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে বাবার ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে উঁকি দিচ্ছি। বাবা ঘরে নাই। পিছন থেকে কেউ মাথায় চাপড় দিলে আহ শব্দ করে উঠি।
” কিরে পিচ্ছু! বাবার ঘরের সামনে কী? আবার কি দুষ্টুমি করার মতলব করছিস।”

তুয়ান আমার বড়ো ভাইয়া। অফিসেই যাচ্ছিল মাঝপথে আমাকে দেখে এসেই তদারকি শুরু করল।

” দেখছিলাম বাবার ঔষধের গ্যাস আছে কি না?”

” ঔষধে আবার গ্যাস আসে কোথায় থেকে?”

” আরে ভাইয়া তুমি বুঝো না! বাবা এক বস্তা ঔষধ সেবন করে। ঔষধ খেতে খেতে বাবার পেটে গ্যাসে জমে যায় আর সেই গ্যাস যখন বায়ু হয়ে বের হয় তখন তো পুরো ঘর গ্যাসে টইটম্বুর হয়ে যায়।”

আমার কথাগুলো ভাইয়া এতক্ষণ মনোযোগ সহকারে শুনছিল। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে কথার মর্মার্থ বুঝে তুবা বলে চিৎকার দিয়ে উঠল হা হা হা।
আমি তো সেই কখন কথা শেষ করে পারাপার। ভাইয়ার সামনে থেকে উত্তম মাধ্যম খেতে চাই না।

ফ্রিজ থেকে তিনদিনের আগের আমড়া ভর্তা নিয়ে একটা বক্সে পুরে নিলাম। কলেজে যাইনি কিন্তু সময় কাটাতে হবে তো? এখন আমার টার্গেট সাদা কইতরের বাড়ি। সাদা কইতরের মা মানুষটা শাশুড়ি হিসেবে পারফেক্ট। ঐ বাড়ি গেলে আমাকে মাথায় তুলে রাখে। ব্যাগের ভেতর বক্স ঢুকিয়ে গুনগুন করে গান গাইছি,

” আমি মিস তুবা রাণী,
করি শুধু বাঁদরামি।
আমি মিস তুবা রাণী,
করি শুধু ইতরামি।”

সাদা কইতরের বাড়িটা একটু অন্যরকম। বহু হিসাব নিকাশ করে বের করেছি, তাদের বাড়ির নকশা কিছুটা ‘এক দিওয়ানা থা’ সিনেমার নায়ক নায়িকা যেই বাড়িতে ভাড়া থাকতো সেই বাড়ির গেইটের মতো। আমার তো মনে হয় যাই লোকটা এই বাড়ির নকশা করেছে সে ভারত থেকে নকশার উপর পড়াশোনা করে এসেছে। সাদা কইতরের বাড়িতে শুরুতে প্রবেশ করতেই ঢাকা শহরের বড়োলোকদের বাড়ির গেইটের মতো গেইট না। খুবই ছোট আমার দুই হাত প্রশস্ত করতে যতটুকু জায়গার প্রয়োজন ততটুকু এবং উচ্চতা আমার বুক সমান। উপর থেকে টুক করে লোহা সরালেই গেইট খুলে যায়। গেইটের ঠিক দশ হাত দূরে দালান। এতটুকু জায়গা কিপ্টা পেট মোটা আনারস আঙ্কেল পাকা করে ভংচং মানে ফুলের টব রেখে দিয়েছে। মেয়েদের নাকি ফুল ভীষণ প্রিয় কিন্তু আমি তাদের থেকে আলাদা। আমার প্রিয় দুনিয়ার সব ফল। যাইহোক সেসব গল্প অন্য একদিন শুনাবো। বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলাম পেট মোটা আনারস আঙ্কেল খবরের কাগজ পড়ছেন। আমাকে এক পলক দেখেই উনার প্রেশার বেড়ে গেল যেন। পত্রিকা ভাজ করেই নিজেকে বাতাস করতে লাগলেন। উনার কাণ্ডে মুচকি হাসলাম অতঃপর বললাম,
” ও পেট মোটা আনারস আঙ্কেল, তেতুলের পানি নিয়ে আসবো নাকি?”

উনি হয়তো ভয় পেলেন। পত্র পত্রিকা ফেলে “আমি চললাম” বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন।

পেট মোটা আনারস আঙ্কেলকে চলে যেতে দেখে হাসছি। সোফার উপর ব্যাগ রেখে সাদা কইতরের মাকে ডাক দিলাম।

” ও সুন্দরী! কই লুকাইলা? তোমার আনারস তো ভয় পেলো!”

সাদা কইতরের মা হয়তো কাপড় ধুচ্ছিল। আমার স্ফর শুনে দেখলাম বাথরুম থেকে বের হলো।
” তুবা রাণী! কতদিন পর আসলি। তা কলেজের পোশাকে কেন? তুই কি আজও কলেজে যাসনি?”

” ঐসব কথা ছাড়ো। তোমার কইতরের ছাও টা কই গো? তার জন্য একটা স্পেশাল খাওন আনছি।”

ব্যাগ থেকে আমড়ার ভর্তার বক্স বের করতে করতে হামির কথা জিজ্ঞেস করছিলাম। হামি অর্থাৎ নেংটি কইতর সাদা কইতরের ছোট ভাই। বয়স ছয় বছর। একদম পাকা টসটসে পেঁপে। কথা শুনলে ইচ্ছে করে কুমড়োর সাথে তাকেও ভাজি করি। আমার দূরবর্তী শ’ত্রু। সাদা কইতরের কাছাকাছি থাকলে তার সাহস বাড়ে, আর অনুপস্থিতিতে ভয়ে ম’রে।

” ইউ আইয়াম। আবার আসছো আমাকে ক্ষ্যাপাতে?”

হাতে অঙ্কন খাতা। হয়তো নতুন কিছু এঁকে নিয়ে এসেছে মাকে দেখাবে বলে। আমাকে দেখেই উলটো রাস্তায় চলে যেতে নেয়।

” এই নেংটি কইতর!”
” ডোন্ট কল মি নেংটি। ইউ পঁচা আইয়াম! আম্মুউউউউউউউ,,,,”

দুই ভাইয়ের কান্না আমার হাসির কারণ।

” এই চুপ চুপ নেংটি কইতর বাবু! তোমার জন্য তাজা তাজা ভর্তা নিয়ে এসেছি। আসো খাবে।”

এক হাত দূরে বসে নেংটি কইতর উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। আমি বক্স থেকে আমড়া বের করে তার হাতে দিতেই কোথায় থেকে যেন সাদা কইতর চলে আসে। আমার হাত থেকে আমড়ার ভর্তা ফেলে দিয়ে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে।

” এই মেয়ে! এটাতে কি মিশিয়েছ?”

দূর থেকে আমি সাহসী মেয়ে কিন্তু কাছ থেকে মেচু বিলাই। তবে সেটা প্রকাশ করলাম না। সাদা কইতরের থেকে বেশি চিৎকার করে প্রত্যুত্তরে বললাম,

“সরিষার তেলের সাথে কইতরের ঘু!”

” ওয়াক ওয়াক ওয়াক।”

সাদা কইতর মনে হয় এবার আমাকে আস্তো রাখবে না। একদিকে নেংটি কইতর ওয়াক ওয়াক করছে অন্যদিকে সাদা কইতর আমার দিকে এগিয়ে আসছে। হাত থেকে ভর্তা সহ বক্স এক দৌঁড়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সাদা কইতর এগিয়ে আসছে তার পাশেই নেংটি কইতর কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দুই নদের মাঝে ছোট তুবা। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে জোরে বললাম,

” তুমি বন্ধু সাদা কইতর,
আমি দুষ্টু রাণী!
আজকের মতো মাফ চাইছি,
করব না আর দুষ্টুমি!

চলবে…………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে