পূর্ব-রোদ পর্ব-৩৫

0
2412

@পূর্ব-রোদ?
#পর্ব_৩৫
#লেখিকা_আমিশা_নূর

রাফিয়া তাড়াতাড়ি রোদের মুখ চেপে ধরলো।রাফিয়ার ইচ্ছে করছে নিজের কাপলে নিজের থাপ্পড় লাগাতে।তার আগেই বুঝা উচিত ছিলো রোদ একটা বদের হাড্ডি।একরাশ বিরক্তি নিয়ে নাবিলা সব তেঁতুল তিন ভাগ করলো।তারপর সবাই মিলে ঠিক করলো ছাদে গিয়ে তেঁতুল খাওয়া হবে।তিনজন চুপিচুপি ছাঁদে গেলো।


“রোদ,তোর বেবি’র নাম কী দিবি?”
“তোকে বলবো ক্যান?”
“না মানে তোর যদি মনে কর ছেলে হলো আর আমার মেয়ে তখন তোর ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিবো।”
“কক্ষণো না।আমার আর পূর্বের দশা দেখোস নাই?বোন আগে থেকে বিয়ে ঠিক করে রাখা অফ কর।বড় হয়ে ওরা নিজেরা ঠিক করবে।”

রোদের অসহায় কন্ঠ শুনে নাবিলা হুহু করে হেসে উঠলো।রাফিয়া গাল ফুলিয়ে তেঁতুল খেতে লাগলো।তখন তাদের কেনে ভেসে আসলো চাঁদনি মোহাম্মদের কন্ঠস্বর।তিনজন ভয় পেয়ে পেছন ফিরে তাকালো।তার হাতে থাকা তেতুল পেছন করে রাখলো।চাঁদনি মোহাম্মদ তখন বললেন,

“তোরা এই সময় ছাঁদে কী করছিস?রোদ তোকে না বলছি যখন তখন ছাঁদে আসবি না।”
“আম্মি আমি আসিনি।রাফিয়া জোর করে এনেছে।”

রোদের কথা শুনে রাফিয়া হা হয়ে গেলো।কিন্তু চাঁদনি মোহাম্মদ তার কথা বিশ্বাস করলেন না।তখন তিনি বললেন,”তোদের হাত পেছনে কেনো?কী আছে হাতে?”

এই কথা শুনে বাকি তিনজোড়া চোখ রসগোল্লার সাইজ হয়ে গেলো।তিনজন এক সাথে মাথা নাড়ালো।তিনি তাদের কথা না শুনে হাত দেখে প্রচন্ড রেগে বললেন,”এই জন্য তো বলি তেঁতুল কম হলো কেনো?তোদের’কে আমি….”

তিন মূর্তিকে পিটানোর জন্য তিনি লাঠির খোজ করছেন।এই ফাঁকে তারা ছাদ থেকে সুরসুর করে নেমে গেলো।চাঁদনি মোহাম্মদ সাবধানের স্বরে রোদকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”রোদ সাবধানে যাস!”


নাবিলা চতুর্থ বারের মতো মেঘের নাম্বারে ডায়াল করলো।কিন্তু ওপাশ থেকে বার বার জানান দিচ্ছে মেঘের ফোন বন্ধ।নাবিলা রেগে মোবাইল ফোন বিছানায় ছুঁড়ে মারলো।গত তিন ধরে মেঘের নাম্বার থেকে এই একটা কথায় আসছে।কিন্তু নাবিলা বুঝছে না মেঘের নাম্বার বন্ধ কেনো?নাবিল মোবাইল বিছানা থেকে তুলে তার মায়ের নাম্বারে ডায়াল করলো।দু’বার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হলো।নাবিলা মোবাইল ফোন কানে লাগিয়ে কর্কশ কন্ঠে বললো,

“ভাই কোথায়?তিন ধরে কল করছি ফোন বন্ধ কেনো?”
“মেঘ কাল ইন্ডিয়া থেকে এসেছে আর এসেই রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়।এখনো দরজা খুলেনি।”
“কী?দরজা খুলেনি মানে কী?বাড়িতে কখন এসেছে?”
“ইন্ডিয়া থেকে রাতে আসলো।চোখ খুব লাল ছিলো।হয়তো এখনো ঘুমাচ্ছে।”
“মেঘ ইন্ডিয়া গেছিলো?”
“হুম।বুঝছি না আমি ছেলেটার কী হলো?”
“আঙ্কেল কোথায়?”
“উনি তো এখন অফিসে।”
“ওহ।আমি আজ সিলেট আসছি মা।”
“রোদের কী অবস্থা?কেমন আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো।রাফিয়া এসেছে।রোদ কিছুদিন ওর বাড়িতে যাবে।এই ফাঁকে আমি সিলেট আসছি।”
“আচ্ছা আয়।”

নিনা হাসানের সাথে কথা শেষ করে নাবিলা চিন্তায় পড়ে গেলো।একদিকে সেদিনের পর থেকে নিলয়ের কোনো খোঁজ নেই অন্যদিকে মেঘের এই অবস্থা।কিন্তু নিলয়ের বাড়ি তো ইন্ডিয়া।তাহলে কী মেঘ নিলয়ের কাছে গেছিলো?

এসব ভাবতে ভাবতে নাবিলা জামা-কাপড় গুছিয়ে নিলো।এতোদিন সে নিলয়ের নাম্বারে চাইলে ডায়াল করতে পারতো।কিন্তু কেনো যেনো শত কষ্ট হলেও নাবিলা’র মন চাইনি দ্বিতীয় বার নিলয়ের সাথে কথা বলুক।তবুও মনে পড়তো নিলয়কে।বিশেষ সে রাতটা!যে রাতে তাদের শেষ দেখাটা হয়।নাবিলা কাঁদে!খুব কাঁদে!তবে সেটা একলা।কাউকে বুঝতে দেয়না সে ভালো নেই!তার আশেপাশের সবাই জানে নাবিলা হ্যাপি আছে।কিন্তু নাবিলা জানে সে কেমন আছে?


“দেখেছিস কান্ডখানা?রোদের আজকেই যেতে হচ্ছে তোরও আজকে?”
“ও মাই কিউটি আন্টি প্লিজ রাগ করে না।মা’কে মনে পড়ছিলো খু-ব।”
“আচ্ছা যা।সাবধানে যাবি।”
“ওক্কে।রোদ কী বেরিয়েছে?”
“না।এখনো রুমে আছে।”
“আচ্ছা।তুমি নিজের খেয়াল রাখবে,ঠিক মতো ঔষুধ খাবে আর আঙ্কেলের সাথে রোমান্স কম করো।”
“তবে রে ফাজিল…”

চাঁদনি মোহাম্মদের হাতের নাগাল থেকে বেরিয়ে নাবিলা রোদের রুমে ঢুকলো।রুমের দরজা খুলা ছিলো তাই নাবিলা রুমে ঢুকে দেখে রোদ রেডি হচ্ছে আর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছে।বিড়বিড়’টা হলে অনেকটা এরকম,”ইশ রে রাফিয়া!দিন দিন মোটু হয়ে যাচ্ছি।এই জামাটা আগে ঠিক মতো হতো না এখন দেখ।”

নাবিলা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো রাফিয়া’কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।তাহলে রোদ কথা বলছে কাকে?ভূত-টুত দেখলো নাকি? নাবিলা এহেম এহেম করে রুমে ঢুকলো।

কারো আওয়াজ পেয়ে রোদ চারপাশে তাকিয়ে নাবিলা’কে উদ্দেশ্য করে বললো,”আরে রাফিয়া কোথায়?এখানে তো ছিলো।”
“তিহানের সাথে ফোনে প্রেমআলাপ করছে হয়তো।”
“হায়রে..বয়ফ্রেন্ড হলে সবাই বেস্টফ্রেন্ড’কে ভূলে যায়।”

কথাটা বলে রোদ নিজের জিহ্বা কাটলো।কারণ রাফিয়া’র বয়ফ্রেন্ড থাকলে রোদের স্বামী আছে।হাবলার মতে হেসে নাবিলা’র দিকে তাকিয়ে বললো,”জাস্ট কথার কথা বললাম আর কি!”

তখনি রাগান্বিত চেহেরা নিয়ে রাফিয়া রুমে প্রবেশ করলো।রাফিয়ার মুখ দেখে মনে হচ্ছে কারে সাথে ঝগড়ায় পরাজিত হয়ে এসেছে তাই রেগে আছে।রোদ-নাবিলা কিছু জিজ্ঞেস করার আগে রাফিয়া বললো,

“বয়ফ্রেন্ড না কচু,ঐটা হ্যান ঐটা ত্যান।বিরক্তিকর একটা বিষয়।সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া দিবে।এক্কেবারে ব্রেকআপ করে ফেলছি।ঠিক করছি না নাবিলাপু?”
“হ্যা হ্যা একদম ঠিক।”
“ঠিকই তো।আমি ঠিকই করি।তবে এবার ফাইলান ব্রেকআপ করলাম।দেখি এবার তিহানের বাচ্চা কী করে?আমাকে…”

রাফিয়া আরো কিছু বিড়বিড় করছে।রাগের কারণে কোনো কিছু স্পষ্ট হচ্ছে না।রাফিয়া’র মুখ থেকে ব্রেকআপ শব্দ শুনে নাবিলা-রোদ মোটও অবাক হলো না।কারণ রাফিয়া-তিহানের নিত্যদিনের ব্যাপার ব্রেকআপটা।প্রতিবারই বলে ফাইলান ব্রেকআপ।কিন্তু এই ঝগড়া দিলো তো এই আবার ভালো হয়ে গেলো।রাফিয়া দিকে গুরুত্ব না দিয়ে নাবিলা রোদের উদ্দেশ্য বললো,”আমি সিলেট যাচ্ছি।তুমি নিজের খেয়াল রাখবে।বুঝেছো?”
“আচ্ছা।”
“আর একদম ভ্যাঁ ভ্যাঁ কাঁদবে না।এতে বাবু’র ক্ষতি হতে পারে রোদ।”
“আমি একদম কাদি না নাবলাপু।”

রোদের কথা শুনে নাবিলা মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরলো।এই ক’মাসে নাবিলা’র প্রিয় মানুষদের মধ্যে একজন হয়ে উঠেছে নাবিলা।একদম বোনের সম্পর্ক তাদের!


“নাস্তা করেছো রোদ?”
“হুম।মামুনির কাছে আসছি।সকালে রাফিয়া আনতে গেছিলো।”
“হু,মা বলেছে।”
“নাবিলাপু সিলেট গেছে। জানো?”
“হু।ওর সাথে একটু কথা বলা দরকার ছিলো।”
“এখন বাসে থাকবে হয়তো।রাতে ফ্রী থাকলে করিও।”
“নাইট ক্লাস আছে আজ।”
“ওহ।তারমানে রাতে কথা বলতে পারবে না কারো সাথে?”

ওপাশ থেকে পূর্ব ভালোভাবে বুঝলো “কারো সাথে” মানে রোদ তার সাথে বুঝাচ্ছে।খুব কষ্ট হয় পূর্ব এমন অভিমানি কথা শুনলে।কিন্তু মানিয়ে নিতে হয়।নাহলে সামলানো কষ্টকর!


“মা মেঘ কোথায়?”
“রুমে আছে।সকালে বের হয়ে নাস্তা করেছে কিন্তু কোনো কথা বলেনি।”
“কী যে হয়েছে তোমার ছেলেটার?দাঁড়াও আমি দেখে আসি…”
“খেয়ে যা।”
“আগে মেঘের সাথে কথা বলে আসি।”
“মেঘ কী?তোকে না বলেছিলাম ‘ভাই’ ডাকতে?”
“মা..ডাকি তো ‘ভাই’।আমার মাঝেমধ্যে মনে হয় তোমার ছেলে বয়সে আমার ছোট তাই মেঘ চলে আসে।”
“হু,”

নাবিলা নিনা হাসানের সাথে কথা না বারিয়ে মেঘের রুমের উদ্দেশ্য হাঁটতে লাগলো।এখন নাবিলা মেঘের বাবার বাড়িতে।নিনা হাসানের জেদের জন্য এবাড়িতে আসতে হয়।যদিও নাবিলা মেঘের বাবা’কে “বাবা” ডাকে না কিন্তু উনি বাবা’র চেয়ে কোনোকিছু’তে কম না।দশটার সময় নাবিলা নিজের বাড়িতে পৌঁছে।আর এখন মেঘের রুমের সামনে এসে দেখলো দরজা খোলা আছে।

নাবিলা নক না করে রুমে ঢুকে দেখে মেঘ রুমে নেই।নাবিলা ভ্রু-কুচকে বেলকোনি চেক করলো।দূর্ভাগ্যবশত মেঘকে বেলকোনিতে পাওয়া গেলো না।নাবিলা মেঘের রুমের বেডে বসে কিছুক্ষণ ভাবলো রুমের কোথায় থাকতে পারে।তখন বা’পাশে তাকিয়ে দেখলো ওয়াশরুম।ওয়াশরুম থেকে এখন পানির আওয়াজও আসছে।নাবিলা ভাবলো হয়তো ওয়াশরুমে আছে।সে কিছুক্ষণ কান খাড়া করলো।তখনি ভেসে কারো গোঙানির শব্দ।নাবিলা সে শব্দ অনুসরণ করে ওয়াশরুমের পাশে গেলো।

নাবিলা’কে অবাক করে দিয়ে তার কানে ভেসে আসলো ওপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ।নাবিলা অবাকের চেয়েও বেশি অবাক হলো।মেঘ কাঁদছে?কাঁদছে মেঘ!কেনো?

নাবিলা শুকনো হাত দিয়ে নিজের মুখ মুছে নিলো।কপালে তার ভি-ষ-ণ রকমের চিন্তার ভাব।তার মাথায় ঢুকছে না মেঘ এভাবে কাদছে কেনো?কী হয়েছে মেঘের?

হঠাৎ ওয়াশরুমের পানির কল বন্ধ হয়ে গেলো।নাবিলা ভাবলো এবার হয়তো মেঘ বের হবে।নাবিলা নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছে।তার মনে হলো এখন মেঘের সামনে না পড়া উচিত।তাই সে রুম থেকে বের হতে যাবে তখন পেছন থেকে মেঘ ডাকলো।মেঘের কন্ঠস্বর শুনে নাবিলা থেমে গেলো।থমথমে মুখ নিয়ে নাবিলা মেঘের দিকে তাকালো।

মেঘের চোখ দুটো ফোলে লাল হয়ে আছে।শরীর আগের থেকে অনেকটা শুকিয়ে গেছে।নাবিলা অনেকটা তাড়াহুড়ো করে মেঘের সামনে দাঁড়ালো।নাবিলা কিছু জিজ্ঞেস করার আগে মেঘ বললো,

“তুই কখন এলি?”
“সকালে।তুই ইন্ডিয়া গেলি আমাকে না জানিয়ে?”
“জরুরি কাজ পড়ে গেছিলো।”
“ওহ।”

নাবিলা আড় চোখে মেঘের দিকে তাকালো।মেঘ তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছচে।মেঘকে সরাসরি কান্না করার কথা জিজ্ঞেস করতে নাবিলা’র অসস্তি হচ্ছে।কারণ মেঘ তো লুকিয়ে কাঁদছিলো!সবার আড়ালে!একলা!!

নাবিলা শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,”তুই ঠিক আছিস?”

নাবিলা’র কথা শুনে মেঘ তোয়ালে চেয়ারে রেখে তার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,”কিছু হয়নি।”

নাবিলা অতিরিক্ত মায়া মাখা কন্ঠস্বরে বললো”ভাই বল না!”

নাবিলা’র ইমোশন কথা শুনে মেঘ আরো নরম হয়ে গেলো।মেঘ এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ালো।যার অর্থ “না”!

নাবিলা এবার কান্না কান্না কন্ঠস্বরে বললো,”বল না তোর কি হয়েছে?ঠিক আছিস তুই?”
“হু।”

এবারেও মেঘের নেতিবাচক উত্তর শুনে নাবিলা হতাশ হলো।আবারো একরাশ অসস্তি নিয়ে বললো,”নিলয়ের সাথে কথা হয় তোর?”

এই একটা কথা শুনে মেঘ স্থীর হয়ে গেলো।নিলয়?নিলয়ের খোঁজ করছে নাবিলা?কী উত্তর দিবে মেঘ?মেঘের কাছে নিলয় অধ্যায়ের সব প্রশ্ন-উত্তর তো ধোঁয়াশা!

[চলবে]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে